গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর আত্মহত্যা করেছেন ৪৩ ইসরায়েলি সেনা, মানসিক রোগাক্রান্তদেরও পাঠানো হচ্ছে যুদ্ধে

- Update Time : ০৬:১৫:২৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ জুলাই ২০২৫
- / ১৬ Time View
গাজায় চলমান যুদ্ধে অংশগ্রহণের মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অন্তত ৪৩ জন ইসরায়েলি সেনা আত্মহত্যা করেছেন বলে স্বীকার করেছে দেশটির সামরিক বাহিনীর একটি সূত্র। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা এ তথ্য জানিয়ে উল্লেখ করেছে, আত্মহত্যার মূল কারণ পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) এবং যুদ্ধের ভয়াবহ মানসিক চাপ। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ‘আল-আকসা স্টর্ম’ নামের অভিযানের মাধ্যমে গাজায় হামলা শুরুর পর থেকেই এই আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়তে থাকে।
সর্বশেষ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ২৪ বছর বয়সী সেনা সদস্য ড্যানিয়েল এডরির ক্ষেত্রে, যিনি লেবানন ও গাজা সীমান্ত থেকে নিহত সেনাদের মৃতদেহ পরিবহনের দায়িত্বে ছিলেন। ময়নাতদন্ত ও ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায়, যুদ্ধক্ষেত্রে মৃতদেহ পরিবহনের মানসিক আঘাত সহ্য করতে না পেরে তিনি নিজের জীবন শেষ করে দেন।
যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হচ্ছে মানসিক রোগাক্রান্ত সেনাদের
জনবল সংকটে ভুগতে থাকা ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বর্তমানে মানসিক রোগে আক্রান্ত রিজার্ভ সেনাদেরও যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাচ্ছে বলে জানিয়েছে প্রভাবশালী ইসরায়েলি দৈনিক হারেটজ। সেনাবাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কমান্ডার বলেন, “আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই। এমনকি যারা মানসিক চিকিৎসার আওতায় রয়েছে, তাদেরও গাজায় নামাতে হচ্ছে।” তিনি জানান, বর্তমানে গাজার যুদ্ধে অংশ নেওয়া হাজার হাজার সেনা চরম মানসিক অবসাদ, আতঙ্ক ও বিকারগ্রস্ততায় আক্রান্ত।
৯ হাজার সেনা মানসিক প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত
ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৭ অক্টোবরের পর থেকে ৯ হাজার ইসরায়েলি সেনা মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছেন। এদের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। যদিও ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করেনি, তবে স্থানীয় গণমাধ্যম জানায়—অনেক সেনার মৃতদেহ গোপনে এবং সামরিক সম্মান ছাড়াই দাফন করা হচ্ছে।
একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেনা সদস্য বলেন, “আমাদের সামনে এখন দুটো পথ— আত্মহত্যা অথবা পালিয়ে যাওয়া। অনেকেই দ্বিতীয় পথ বেছে নিচ্ছে।”
সংকট সামাল দিতে ৮০০ মনোরোগ চিকিৎসক নিয়োগ
মানসিক সংকট ও আত্মহত্যার হার বেড়ে যাওয়ায় ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) এখন পর্যন্ত ৮০০ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়েছে। পাশাপাশি মনোসামাজিক কাউন্সেলিং সেন্টার চালু করা হয়েছে সেনাদের মানসিক সমর্থন দেওয়ার জন্য। এসব পদক্ষেপের মধ্যেও পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনায় বিরোধী দল
এ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও তাঁর সরকারকে দায়ী করেছেন বিরোধী রাজনীতিবিদরা। সংসদ সদস্য এবং বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার লাপিদ বলেছেন, “নেতানিয়াহু আমাদের সেনাদের খান ইউনিস ও জেনিনের মতো বিপজ্জনক অঞ্চলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন, অথচ হারেদি (অর্থোডক্স) ইহুদিদের সেনাবাহিনীতে যোগদানে বাধা দিচ্ছেন।”
ইসরায়েল বেইতেনু পার্টির প্রধান অভিগদোর লিবারম্যান আরও বলেন, “গত কয়েক মাসে নিহত সেনারা আসলে ক্ষমতাসীন ডানপন্থি জোটের রাজনৈতিক অজুহাত রক্ষার বলি। সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে বন্দিবিনিময় চুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করছে, যার ফলে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে।”
এই পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে ইসরায়েলি জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে এবং সরকার ও সামরিক নেতৃত্বের উপর চাপ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ ইসরায়েলি নাগরিক যুদ্ধ বন্ধ করে বন্দিবিনিময় ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পক্ষে। তবে সরকার এখনো আগ্রাসী নীতি অব্যাহত রেখেছে, যার ফলে সেনাদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।
সূত্র: আল–জাজিরা, হারেটজ, ইরনা নিউজ, সামা নিউজ, ক্যান ১১ (ইসরায়েলি রাষ্ট্রীয় টিভি)।
Please Share This Post in Your Social Media

গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর আত্মহত্যা করেছেন ৪৩ ইসরায়েলি সেনা, মানসিক রোগাক্রান্তদেরও পাঠানো হচ্ছে যুদ্ধে

গাজায় চলমান যুদ্ধে অংশগ্রহণের মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অন্তত ৪৩ জন ইসরায়েলি সেনা আত্মহত্যা করেছেন বলে স্বীকার করেছে দেশটির সামরিক বাহিনীর একটি সূত্র। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা এ তথ্য জানিয়ে উল্লেখ করেছে, আত্মহত্যার মূল কারণ পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) এবং যুদ্ধের ভয়াবহ মানসিক চাপ। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ‘আল-আকসা স্টর্ম’ নামের অভিযানের মাধ্যমে গাজায় হামলা শুরুর পর থেকেই এই আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়তে থাকে।
সর্বশেষ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ২৪ বছর বয়সী সেনা সদস্য ড্যানিয়েল এডরির ক্ষেত্রে, যিনি লেবানন ও গাজা সীমান্ত থেকে নিহত সেনাদের মৃতদেহ পরিবহনের দায়িত্বে ছিলেন। ময়নাতদন্ত ও ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায়, যুদ্ধক্ষেত্রে মৃতদেহ পরিবহনের মানসিক আঘাত সহ্য করতে না পেরে তিনি নিজের জীবন শেষ করে দেন।
যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হচ্ছে মানসিক রোগাক্রান্ত সেনাদের
জনবল সংকটে ভুগতে থাকা ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বর্তমানে মানসিক রোগে আক্রান্ত রিজার্ভ সেনাদেরও যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাচ্ছে বলে জানিয়েছে প্রভাবশালী ইসরায়েলি দৈনিক হারেটজ। সেনাবাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কমান্ডার বলেন, “আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই। এমনকি যারা মানসিক চিকিৎসার আওতায় রয়েছে, তাদেরও গাজায় নামাতে হচ্ছে।” তিনি জানান, বর্তমানে গাজার যুদ্ধে অংশ নেওয়া হাজার হাজার সেনা চরম মানসিক অবসাদ, আতঙ্ক ও বিকারগ্রস্ততায় আক্রান্ত।
৯ হাজার সেনা মানসিক প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত
ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৭ অক্টোবরের পর থেকে ৯ হাজার ইসরায়েলি সেনা মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছেন। এদের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। যদিও ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করেনি, তবে স্থানীয় গণমাধ্যম জানায়—অনেক সেনার মৃতদেহ গোপনে এবং সামরিক সম্মান ছাড়াই দাফন করা হচ্ছে।
একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেনা সদস্য বলেন, “আমাদের সামনে এখন দুটো পথ— আত্মহত্যা অথবা পালিয়ে যাওয়া। অনেকেই দ্বিতীয় পথ বেছে নিচ্ছে।”
সংকট সামাল দিতে ৮০০ মনোরোগ চিকিৎসক নিয়োগ
মানসিক সংকট ও আত্মহত্যার হার বেড়ে যাওয়ায় ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) এখন পর্যন্ত ৮০০ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়েছে। পাশাপাশি মনোসামাজিক কাউন্সেলিং সেন্টার চালু করা হয়েছে সেনাদের মানসিক সমর্থন দেওয়ার জন্য। এসব পদক্ষেপের মধ্যেও পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনায় বিরোধী দল
এ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও তাঁর সরকারকে দায়ী করেছেন বিরোধী রাজনীতিবিদরা। সংসদ সদস্য এবং বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার লাপিদ বলেছেন, “নেতানিয়াহু আমাদের সেনাদের খান ইউনিস ও জেনিনের মতো বিপজ্জনক অঞ্চলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন, অথচ হারেদি (অর্থোডক্স) ইহুদিদের সেনাবাহিনীতে যোগদানে বাধা দিচ্ছেন।”
ইসরায়েল বেইতেনু পার্টির প্রধান অভিগদোর লিবারম্যান আরও বলেন, “গত কয়েক মাসে নিহত সেনারা আসলে ক্ষমতাসীন ডানপন্থি জোটের রাজনৈতিক অজুহাত রক্ষার বলি। সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে বন্দিবিনিময় চুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করছে, যার ফলে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে।”
এই পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে ইসরায়েলি জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে এবং সরকার ও সামরিক নেতৃত্বের উপর চাপ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ ইসরায়েলি নাগরিক যুদ্ধ বন্ধ করে বন্দিবিনিময় ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পক্ষে। তবে সরকার এখনো আগ্রাসী নীতি অব্যাহত রেখেছে, যার ফলে সেনাদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।
সূত্র: আল–জাজিরা, হারেটজ, ইরনা নিউজ, সামা নিউজ, ক্যান ১১ (ইসরায়েলি রাষ্ট্রীয় টিভি)।