সময়: মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

যুদ্ধবিরতির ফাঁকেই চীন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হাতে পেল ইরান, আকাশ প্রতিরক্ষায় নতুন মাত্রা

ডিজিটাল ডেস্ক
  • Update Time : ০৯:২০:০০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ জুলাই ২০২৫
  • / ১০ Time View

BeFunky collage 2025 07 08T205222683 2507081453

শেয়ার করুনঃ
Pin Share

BeFunky collage 2025 07 08T205222683 2507081453

ইসরায়েলের সঙ্গে টানা ১২ দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শেষে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা এলেও ইরানের প্রতিরক্ষা জোরদারের তৎপরতা থেমে নেই। যুদ্ধবিরতির কয়েক দিনের মধ্যেই তেহরান চীনের কাছ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেপণাস্ত্র চালান গ্রহণ করেছে। সূত্র বলছে, এই চালানে রয়েছে ভূমি-থেকে-আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র, যা ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

চীনইরান অস্ত্র বাণিজ্যে তেলের বিনিময় নীতি

‘মিডল ইস্ট আই’-কে দেওয়া এক আরব গোয়েন্দা কর্মকর্তার সাক্ষাৎকারে জানা যায়, ২৪ জুন যুদ্ধবিরতির অব্যবহিত পরেই চীনের তৈরি এই SAM (Surface-to-Air Missile) সিস্টেম ইরানে পৌঁছায়। চালানের সুনির্দিষ্ট পরিমাণ, মডেল কিংবা প্রযুক্তিগত বিবরণ এখনো প্রকাশ পায়নি, তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, HQ-২২ বা তার উন্নত সংস্করণ ইরানকে সরবরাহ করা হয়েছে। এই কর্মকর্তার মতে, ইরান চীন থেকে এই অস্ত্র তেলের বিনিময়ে সংগ্রহ করেছে—একটি চুক্তি যেটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই কার্যকর হয়েছে।

উল্লেখ্য, চীন বর্তমানে ইরানি জ্বালানির সবচেয়ে বড় ক্রেতা। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে চীন বিগত কয়েক বছর ধরে রেকর্ড পরিমাণে ইরানি অপরিশোধিত তেল আমদানি করে আসছে। ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্য অনুসারে, ইরানের প্রায় ৯০ শতাংশ তেল রপ্তানি হয় চীনে। নিষেধাজ্ঞা এড়াতে চীন মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।

আঞ্চলিক নিরাপত্তা জটিলতায় নতুন মাত্রা

এই নতুন ক্ষেপণাস্ত্র চালান শুধু ইরানের প্রতিরক্ষা নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে নিরাপত্তা পরিস্থিতিকেও জটিল করে তুলেছে। আরব ও পশ্চিমা গোয়েন্দা বিশ্লেষকদের মতে, এই অস্ত্রচালান ইরান-চীন সম্পর্কের কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা এবং পারস্পরিক নির্ভরতার নতুন অধ্যায় নির্দেশ করছে। এতদিন ধারণা করা হচ্ছিল যে সাম্প্রতিক ইসরায়েল-ইরান সংঘর্ষকালে চীন ও রাশিয়া ইরানের কাছ থেকে কৌশলগত দূরত্ব বজায় রেখেছিল। তবে এই অস্ত্র সরবরাহ সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই চালান ভবিষ্যতের যেকোনও যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইরানকে আকাশপথে অধিক প্রতিরোধ গড়ার সক্ষমতা দেবে। বিশেষত মার্কিন ও ইসরায়েলি F-35 স্টেলথ যুদ্ধবিমান মোকাবেলায় এখন পর্যন্ত ইরানের হাতে কার্যকর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল সীমিত। অতীতে ইরান নিজেদের তৈরি খোরদাদ-৩ ও বাভার-৩৭৩ এবং রাশিয়ার এস-৩০০ সিস্টেমের উপর নির্ভর করলেও তা পুরোপুরি আধুনিক যুদ্ধবিমানের মোকাবেলায় যথেষ্ট ছিল না।

ইসরায়েলি হামলা ইরানের প্রতিক্রিয়া

সাম্প্রতিক সংঘাতে ইসরায়েল সফলভাবে ইরানের বিভিন্ন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্র ধ্বংস করে এবং ড্রোন ও বিমান হামলায় শীর্ষ ইরানি সামরিক কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের টার্গেট করে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইরানও ইসরায়েলের তেল আবিব ও হাইফার গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থাপনায় হামলা চালায়। এই পাল্টাপাল্টি হামলায় উভয় পক্ষেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, তবে এতে ইরানের দুর্বল আকাশ প্রতিরক্ষা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এই পটভূমিতেই চীনা SAM সিস্টেম যুক্ত হওয়া ইরানের প্রতিরক্ষা কৌশলের একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে ধরা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, HQ-২২ বা HQ-৯ এর মতো আধুনিক চীনা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যুক্ত হওয়ায় ইরান এখন আরও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত ও ধ্বংস করতে পারবে।

আঞ্চলিক সমীকরণে চীনের অবস্থান স্পষ্ট হচ্ছে

এদিকে, চীনের এই অস্ত্র সরবরাহকে শুধু একটি বাণিজ্যিক চুক্তি না বলে কৌশলগত হিসাবও মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। চীন পূর্বে পাকিস্তান, মিসর ও আলজেরিয়ার মতো দেশগুলোকেও HQ-৯ ও HQ-১৬ ক্ষেপণাস্ত্র সিস্টেম সরবরাহ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারে আমেরিকান আধিপত্যের বিপরীতে বেইজিং এখন আরও সরাসরি ভূমিকা রাখতে চাইছে বলে মনে করা হচ্ছে।

চীন এখন শুধু তেলের ক্রেতা নয়, বরং ইরানের অস্ত্রভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে আগ্রহী দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত অংশীদার—এই বার্তাই দিচ্ছে নতুন SAM চালান। একইসঙ্গে এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে যুদ্ধবিরতি থাকা সত্ত্বেও ইরান ও তার মিত্ররা পরবর্তী সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে

যদিও চীন ও ইরান উভয়পক্ষ এই অস্ত্রচালান সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি, তবে এই খবরের মাধ্যমে স্পষ্ট যে মধ্যপ্রাচ্য এখন আরেকটি নতুন ঠান্ডা যুদ্ধের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের প্রতিপক্ষ হিসেবে চীন ও ইরান এখন আরও সুসংহতভাবে আবির্ভূত হচ্ছে। আর এই প্রেক্ষাপটে, এই ক্ষেপণাস্ত্র চালান শুধু একটি অস্ত্র সংগ্রহ নয়—বরং এক নতুন ভূরাজনৈতিক সমীকরণের আগমনী বার্তা।

সূত্র: মিডল ইস্ট আই

 

শেয়ার করুনঃ
Pin Share

Please Share This Post in Your Social Media

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Newest
Oldest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

যুদ্ধবিরতির ফাঁকেই চীন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হাতে পেল ইরান, আকাশ প্রতিরক্ষায় নতুন মাত্রা

Update Time : ০৯:২০:০০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ জুলাই ২০২৫
শেয়ার করুনঃ
Pin Share

BeFunky collage 2025 07 08T205222683 2507081453

ইসরায়েলের সঙ্গে টানা ১২ দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শেষে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা এলেও ইরানের প্রতিরক্ষা জোরদারের তৎপরতা থেমে নেই। যুদ্ধবিরতির কয়েক দিনের মধ্যেই তেহরান চীনের কাছ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেপণাস্ত্র চালান গ্রহণ করেছে। সূত্র বলছে, এই চালানে রয়েছে ভূমি-থেকে-আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র, যা ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

চীনইরান অস্ত্র বাণিজ্যে তেলের বিনিময় নীতি

‘মিডল ইস্ট আই’-কে দেওয়া এক আরব গোয়েন্দা কর্মকর্তার সাক্ষাৎকারে জানা যায়, ২৪ জুন যুদ্ধবিরতির অব্যবহিত পরেই চীনের তৈরি এই SAM (Surface-to-Air Missile) সিস্টেম ইরানে পৌঁছায়। চালানের সুনির্দিষ্ট পরিমাণ, মডেল কিংবা প্রযুক্তিগত বিবরণ এখনো প্রকাশ পায়নি, তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, HQ-২২ বা তার উন্নত সংস্করণ ইরানকে সরবরাহ করা হয়েছে। এই কর্মকর্তার মতে, ইরান চীন থেকে এই অস্ত্র তেলের বিনিময়ে সংগ্রহ করেছে—একটি চুক্তি যেটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই কার্যকর হয়েছে।

উল্লেখ্য, চীন বর্তমানে ইরানি জ্বালানির সবচেয়ে বড় ক্রেতা। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে চীন বিগত কয়েক বছর ধরে রেকর্ড পরিমাণে ইরানি অপরিশোধিত তেল আমদানি করে আসছে। ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্য অনুসারে, ইরানের প্রায় ৯০ শতাংশ তেল রপ্তানি হয় চীনে। নিষেধাজ্ঞা এড়াতে চীন মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।

আঞ্চলিক নিরাপত্তা জটিলতায় নতুন মাত্রা

এই নতুন ক্ষেপণাস্ত্র চালান শুধু ইরানের প্রতিরক্ষা নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে নিরাপত্তা পরিস্থিতিকেও জটিল করে তুলেছে। আরব ও পশ্চিমা গোয়েন্দা বিশ্লেষকদের মতে, এই অস্ত্রচালান ইরান-চীন সম্পর্কের কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা এবং পারস্পরিক নির্ভরতার নতুন অধ্যায় নির্দেশ করছে। এতদিন ধারণা করা হচ্ছিল যে সাম্প্রতিক ইসরায়েল-ইরান সংঘর্ষকালে চীন ও রাশিয়া ইরানের কাছ থেকে কৌশলগত দূরত্ব বজায় রেখেছিল। তবে এই অস্ত্র সরবরাহ সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই চালান ভবিষ্যতের যেকোনও যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইরানকে আকাশপথে অধিক প্রতিরোধ গড়ার সক্ষমতা দেবে। বিশেষত মার্কিন ও ইসরায়েলি F-35 স্টেলথ যুদ্ধবিমান মোকাবেলায় এখন পর্যন্ত ইরানের হাতে কার্যকর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল সীমিত। অতীতে ইরান নিজেদের তৈরি খোরদাদ-৩ ও বাভার-৩৭৩ এবং রাশিয়ার এস-৩০০ সিস্টেমের উপর নির্ভর করলেও তা পুরোপুরি আধুনিক যুদ্ধবিমানের মোকাবেলায় যথেষ্ট ছিল না।

ইসরায়েলি হামলা ইরানের প্রতিক্রিয়া

সাম্প্রতিক সংঘাতে ইসরায়েল সফলভাবে ইরানের বিভিন্ন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্র ধ্বংস করে এবং ড্রোন ও বিমান হামলায় শীর্ষ ইরানি সামরিক কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের টার্গেট করে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইরানও ইসরায়েলের তেল আবিব ও হাইফার গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থাপনায় হামলা চালায়। এই পাল্টাপাল্টি হামলায় উভয় পক্ষেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, তবে এতে ইরানের দুর্বল আকাশ প্রতিরক্ষা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এই পটভূমিতেই চীনা SAM সিস্টেম যুক্ত হওয়া ইরানের প্রতিরক্ষা কৌশলের একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে ধরা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, HQ-২২ বা HQ-৯ এর মতো আধুনিক চীনা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যুক্ত হওয়ায় ইরান এখন আরও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত ও ধ্বংস করতে পারবে।

আঞ্চলিক সমীকরণে চীনের অবস্থান স্পষ্ট হচ্ছে

এদিকে, চীনের এই অস্ত্র সরবরাহকে শুধু একটি বাণিজ্যিক চুক্তি না বলে কৌশলগত হিসাবও মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। চীন পূর্বে পাকিস্তান, মিসর ও আলজেরিয়ার মতো দেশগুলোকেও HQ-৯ ও HQ-১৬ ক্ষেপণাস্ত্র সিস্টেম সরবরাহ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারে আমেরিকান আধিপত্যের বিপরীতে বেইজিং এখন আরও সরাসরি ভূমিকা রাখতে চাইছে বলে মনে করা হচ্ছে।

চীন এখন শুধু তেলের ক্রেতা নয়, বরং ইরানের অস্ত্রভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে আগ্রহী দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত অংশীদার—এই বার্তাই দিচ্ছে নতুন SAM চালান। একইসঙ্গে এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে যুদ্ধবিরতি থাকা সত্ত্বেও ইরান ও তার মিত্ররা পরবর্তী সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে

যদিও চীন ও ইরান উভয়পক্ষ এই অস্ত্রচালান সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি, তবে এই খবরের মাধ্যমে স্পষ্ট যে মধ্যপ্রাচ্য এখন আরেকটি নতুন ঠান্ডা যুদ্ধের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের প্রতিপক্ষ হিসেবে চীন ও ইরান এখন আরও সুসংহতভাবে আবির্ভূত হচ্ছে। আর এই প্রেক্ষাপটে, এই ক্ষেপণাস্ত্র চালান শুধু একটি অস্ত্র সংগ্রহ নয়—বরং এক নতুন ভূরাজনৈতিক সমীকরণের আগমনী বার্তা।

সূত্র: মিডল ইস্ট আই

 

শেয়ার করুনঃ
Pin Share