রাশিয়ার স্বীকৃতির পরপরই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা: তালেবানের দুই শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে আইসিসির বড় পদক্ষেপ

- Update Time : ০৯:৩৭:৪৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ জুলাই ২০২৫
- / ১৫ Time View
বিশ্বমঞ্চে একদিকে যখন তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে রাশিয়া আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দ্বার খুলে দিল, ঠিক তখনই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) আফগানিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তালেবানের দুই শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। নারীদের প্রতি পরিকল্পিত নিপীড়নের অভিযোগে এই পরোয়ানা জারি করা হয়, যা তালেবান শাসনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেল বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
নারীদের টার্গেট করে পরিকল্পিত নিপীড়নের অভিযোগ
মঙ্গলবার (৮ জুলাই) আল জাজিরার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, হেগভিত্তিক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তালেবানের সুপ্রিম লিডার হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা এবং প্রধান বিচারপতি আব্দুল হাকিম হাক্কানির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, তারা নারী ও মেয়েদের লিঙ্গের কারণে পরিকল্পিতভাবে নিপীড়নের শিকার করেছেন এবং তাদের মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন।
আইসিসি জানায়, ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়জুড়ে নারীদের শিক্ষার অধিকার, স্বাধীনভাবে চলাফেরা, কাজ করার সুযোগ, মতপ্রকাশ, বিবেক ও ধর্মীয় স্বাধীনতাসহ নানাবিধ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আদালতের ভাষায়, “তালেবান পুরো জনগণের ওপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, কিন্তু নারীদের তারা নির্দিষ্টভাবে তাদের লিঙ্গের কারণে লক্ষ্যবস্তু করেছে।”
এছাড়াও যৌনতা ও লিঙ্গ পরিচয়ের ভিন্ন রূপের প্রকাশ ঘটানোর কারণে অনেককেই আটক, নির্যাতন বা সামাজিকভাবে হেয় করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ শুধু সাংবিধানিক নয়, বরং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলেও চিহ্নিত করা হয়েছে।
আইসিসির ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা
হেগভিত্তিক আইসিসি মূলত যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধ নিয়ে কাজ করে। তবে সংস্থাটির নিজস্ব কোনো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নেই। ফলে তাদের জারি করা পরোয়ানা বাস্তবায়নের দায়িত্ব সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ওপর বর্তায়। ইতিহাসের বহু উদাহরণে দেখা গেছে, অভিযুক্তরা বছর ধরে গা-ঢাকা দিয়ে থাকে বা রাজনৈতিক আশ্রয়ে রক্ষা পায়। তাই এই পরোয়ানা বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়েছে।
রাশিয়ার স্বীকৃতি এবং এর তাৎপর্য
এই পরোয়ানার ঘোষণার মাত্র কয়েক দিন আগেই বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে রাশিয়া। ৩ জুলাই রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা বিশ্বাস করি, ইসলামিক আমিরাত সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বিভিন্ন খাতে দুই দেশের মধ্যে উৎপাদনশীল সহযোগিতার ভিত্তি তৈরি করবে।”
এই স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনার জন্ম দেয়। কারণ এখন পর্যন্ত তালেবান সরকার নারীর অধিকার, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দিক দিয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড রক্ষা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। রাশিয়ার স্বীকৃতি তালেবান সরকারকে বৈধতা দিতে সাহায্য করলেও আইসিসির পরোয়ানায় তাদের বিরুদ্ধে অপরাধের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
বিশ্লেষকদের মতে, এই পরোয়ানা শুধু তালেবানের জন্য নয়, বরং তাদের মিত্র রাষ্ট্রগুলোর জন্যও এক ধরনের কূটনৈতিক চাপ তৈরি করবে। আফগানিস্তানের সঙ্গে যারা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বাড়াতে চায়, তাদের এখন মানবাধিকারের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে তালেবানের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক সীমিত রেখেছে।
রাশিয়ার স্বীকৃতি, চীন ও ইরানের নীরব সমর্থন এবং একই সময়ে আইসিসির পরোয়ানা—এই তিনটি ঘটনাই প্রমাণ করে, আফগানিস্তানকে ঘিরে একটি নতুন ভূরাজনৈতিক লড়াই শুরু হয়েছে। আর এই প্রেক্ষাপটে নারীর অধিকারের প্রশ্ন এখন শুধুই মানবিক ইস্যু নয়, বরং বৈশ্বিক কূটনীতিরও গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের এই পদক্ষেপ তালেবান নেতৃত্বের ওপর এক বড় ধরনের আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করবে। যদিও বাস্তবায়নের পথে আইনি ও রাজনৈতিক বাধা রয়েছে, তবুও এই পরোয়ানার মাধ্যমে বিশ্ব জানিয়ে দিল—নারীদের প্রতি নিপীড়ন সহ্য করা হবে না। একইসঙ্গে, রাশিয়ার স্বীকৃতির প্রেক্ষাপটে এই পরোয়ানা এক ধরনের নৈতিক প্রতিরোধও গড়ে তুলেছে। এখন দেখার বিষয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই বিচারিক পদক্ষেপকে কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে।
Please Share This Post in Your Social Media

রাশিয়ার স্বীকৃতির পরপরই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা: তালেবানের দুই শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে আইসিসির বড় পদক্ষেপ

বিশ্বমঞ্চে একদিকে যখন তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে রাশিয়া আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দ্বার খুলে দিল, ঠিক তখনই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) আফগানিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তালেবানের দুই শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। নারীদের প্রতি পরিকল্পিত নিপীড়নের অভিযোগে এই পরোয়ানা জারি করা হয়, যা তালেবান শাসনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেল বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
নারীদের টার্গেট করে পরিকল্পিত নিপীড়নের অভিযোগ
মঙ্গলবার (৮ জুলাই) আল জাজিরার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, হেগভিত্তিক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তালেবানের সুপ্রিম লিডার হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা এবং প্রধান বিচারপতি আব্দুল হাকিম হাক্কানির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, তারা নারী ও মেয়েদের লিঙ্গের কারণে পরিকল্পিতভাবে নিপীড়নের শিকার করেছেন এবং তাদের মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন।
আইসিসি জানায়, ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়জুড়ে নারীদের শিক্ষার অধিকার, স্বাধীনভাবে চলাফেরা, কাজ করার সুযোগ, মতপ্রকাশ, বিবেক ও ধর্মীয় স্বাধীনতাসহ নানাবিধ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আদালতের ভাষায়, “তালেবান পুরো জনগণের ওপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, কিন্তু নারীদের তারা নির্দিষ্টভাবে তাদের লিঙ্গের কারণে লক্ষ্যবস্তু করেছে।”
এছাড়াও যৌনতা ও লিঙ্গ পরিচয়ের ভিন্ন রূপের প্রকাশ ঘটানোর কারণে অনেককেই আটক, নির্যাতন বা সামাজিকভাবে হেয় করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ শুধু সাংবিধানিক নয়, বরং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলেও চিহ্নিত করা হয়েছে।
আইসিসির ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা
হেগভিত্তিক আইসিসি মূলত যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধ নিয়ে কাজ করে। তবে সংস্থাটির নিজস্ব কোনো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নেই। ফলে তাদের জারি করা পরোয়ানা বাস্তবায়নের দায়িত্ব সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ওপর বর্তায়। ইতিহাসের বহু উদাহরণে দেখা গেছে, অভিযুক্তরা বছর ধরে গা-ঢাকা দিয়ে থাকে বা রাজনৈতিক আশ্রয়ে রক্ষা পায়। তাই এই পরোয়ানা বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়েছে।
রাশিয়ার স্বীকৃতি এবং এর তাৎপর্য
এই পরোয়ানার ঘোষণার মাত্র কয়েক দিন আগেই বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে রাশিয়া। ৩ জুলাই রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা বিশ্বাস করি, ইসলামিক আমিরাত সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বিভিন্ন খাতে দুই দেশের মধ্যে উৎপাদনশীল সহযোগিতার ভিত্তি তৈরি করবে।”
এই স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনার জন্ম দেয়। কারণ এখন পর্যন্ত তালেবান সরকার নারীর অধিকার, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দিক দিয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড রক্ষা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। রাশিয়ার স্বীকৃতি তালেবান সরকারকে বৈধতা দিতে সাহায্য করলেও আইসিসির পরোয়ানায় তাদের বিরুদ্ধে অপরাধের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
বিশ্লেষকদের মতে, এই পরোয়ানা শুধু তালেবানের জন্য নয়, বরং তাদের মিত্র রাষ্ট্রগুলোর জন্যও এক ধরনের কূটনৈতিক চাপ তৈরি করবে। আফগানিস্তানের সঙ্গে যারা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বাড়াতে চায়, তাদের এখন মানবাধিকারের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে তালেবানের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক সীমিত রেখেছে।
রাশিয়ার স্বীকৃতি, চীন ও ইরানের নীরব সমর্থন এবং একই সময়ে আইসিসির পরোয়ানা—এই তিনটি ঘটনাই প্রমাণ করে, আফগানিস্তানকে ঘিরে একটি নতুন ভূরাজনৈতিক লড়াই শুরু হয়েছে। আর এই প্রেক্ষাপটে নারীর অধিকারের প্রশ্ন এখন শুধুই মানবিক ইস্যু নয়, বরং বৈশ্বিক কূটনীতিরও গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের এই পদক্ষেপ তালেবান নেতৃত্বের ওপর এক বড় ধরনের আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করবে। যদিও বাস্তবায়নের পথে আইনি ও রাজনৈতিক বাধা রয়েছে, তবুও এই পরোয়ানার মাধ্যমে বিশ্ব জানিয়ে দিল—নারীদের প্রতি নিপীড়ন সহ্য করা হবে না। একইসঙ্গে, রাশিয়ার স্বীকৃতির প্রেক্ষাপটে এই পরোয়ানা এক ধরনের নৈতিক প্রতিরোধও গড়ে তুলেছে। এখন দেখার বিষয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই বিচারিক পদক্ষেপকে কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে।