সময়: বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইরানে অন্তর্বাস পরে প্রতিবাদ জানানো তরুণীর শাস্তি ছাড়াই মুক্তি

ডিজিটাল ডেস্ক
  • Update Time : ০৬:৫৪:২৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
  • / ৯৪ Time View

1732173628 6fd33470dea458ab90e18c964caa6eb9

ইরানে হিজাবের বিরুদ্ধে অর্ধনগ্ন অবস্থায় প্রতিবাদ জানিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সেই তরুণী শাস্তি ছাড়াই মুক্তি পেয়েছেন। দেশটির বিচার বিভাগ ঘোষণা করেছে যে, তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হবে না। ইরানের মতো কঠোর ইসলামিক বিধিনিষেধযুক্ত দেশে এ ধরনের ঘটনা বিরল।

ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ

নভেম্বরের শুরুতে তেহরানের ইসলামিক আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে। হিজাববিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেওয়া এক তরুণী শুধুমাত্র অন্তর্বাস পরে ক্যাম্পাস চত্বরে হাঁটাহাঁটি করেন। এটি ছিল তার প্রতিবাদের একটি আকস্মিক এবং সাহসী অভিব্যক্তি।

তিনি অভিযোগ করেন যে, সঠিকভাবে হিজাব না পরার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে হেনস্তা করেছেন। সেই হেনস্তার প্রতিবাদে তিনি প্রকাশ্যে পোশাক খুলে ফেলেন এবং এমনভাবে প্রতিরোধ জানান যা ইরানে আগে কখনো দেখা যায়নি।

ঘটনার ভিডিওটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং তা ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। ভিডিওটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করে। কিন্তু এর পরপরই তাকে আটক করে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী।

মানসিক স্বাস্থ্য এবং মুক্তির প্রেক্ষাপট

ইরানের বিচার বিভাগের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, তাকে গ্রেপ্তারের পরপরই একটি মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে তার মানসিক অসুস্থতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই কারণ দেখিয়ে তাকে শাস্তি না দিয়ে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

যদিও সরকার তরুণীর মানসিক অসুস্থতার বিষয়টি উল্লেখ করেছে, অনেকেই মনে করেন, এটি আসলে তরুণীর প্রতিবাদকে খাটো করার একটি পন্থা। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন তরুণীর ওপর কোনো ধরনের নির্যাতন চালানো হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

এই ঘটনার পরপরই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠন তরুণীর গ্রেপ্তারের তীব্র নিন্দা জানায়। তারা মনে করে, ইরানে নারীদের হিজাব আইন নিয়ে প্রতিবাদ করার অধিকার সীমিত এবং সরকার তা দমন করার চেষ্টা করছে।

বিভিন্ন সংগঠন তরুণীর সাহসিকতার প্রশংসা করেছে এবং একে ইরানে নারীদের চলমান অধিকার আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে অভিহিত করেছে।

ইরানের কঠোর হিজাব আইন

ইরানে নারীদের জন্য হিজাব পরিধান বাধ্যতামূলক। ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে নারীদের পোশাকের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এই আইন ভঙ্গ করলে নারীদের কারাদণ্ড, জরিমানা, এমনকি নীতি পুলিশের হেফাজতে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।

২০২২ সালে কুর্দি তরুণী মাশা আমিনির মৃত্যু ইরানে হিজাব আইনবিরোধী আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দেয়। তাকে নীতি পুলিশ আটক করার পর তার মৃত্যু হয়, যা দেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ইরানের বিভিন্ন শহরে হাজারো নারী রাস্তায় নেমে হিজাববিরোধী বিক্ষোভ করেন।

তরুণ প্রজন্মের প্রতিবাদ এবং সম্ভাব্য পরিবর্তন

ইরানের তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে নারীরা, গত কয়েক বছরে কঠোর বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে সাহসী পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তাদের এই প্রতিবাদ কেবল হিজাব আইনকে কেন্দ্র করে নয়, বরং সামাজিক এবং রাজনৈতিক অধিকারের দাবির প্রতিফলন।

বর্তমান ঘটনায় সংশ্লিষ্ট তরুণী শাস্তি ছাড়া মুক্তি পেয়েছেন, যা বিরল। তবে এর মাধ্যমে সরকার হিজাববিরোধী আন্দোলন থামাতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।

ইরানের ভবিষ্যৎ নারীর অধিকারের দৃষ্টিকোণ

বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরানের এই প্রজন্মের আন্দোলন দেশটির সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। হিজাববিরোধী আন্দোলন এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরানের নারী অধিকারের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

এই তরুণীর সাহসিকতা ইরানে নারীদের অধিকারের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এ ঘটনা স্পষ্টতই প্রমাণ করে যে, নারীরা তাদের স্বাধীনতা ও মর্যাদার জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে প্রস্তুত।

 

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

ইরানে অন্তর্বাস পরে প্রতিবাদ জানানো তরুণীর শাস্তি ছাড়াই মুক্তি

Update Time : ০৬:৫৪:২৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

ইরানে হিজাবের বিরুদ্ধে অর্ধনগ্ন অবস্থায় প্রতিবাদ জানিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সেই তরুণী শাস্তি ছাড়াই মুক্তি পেয়েছেন। দেশটির বিচার বিভাগ ঘোষণা করেছে যে, তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হবে না। ইরানের মতো কঠোর ইসলামিক বিধিনিষেধযুক্ত দেশে এ ধরনের ঘটনা বিরল।

ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ

নভেম্বরের শুরুতে তেহরানের ইসলামিক আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে। হিজাববিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেওয়া এক তরুণী শুধুমাত্র অন্তর্বাস পরে ক্যাম্পাস চত্বরে হাঁটাহাঁটি করেন। এটি ছিল তার প্রতিবাদের একটি আকস্মিক এবং সাহসী অভিব্যক্তি।

তিনি অভিযোগ করেন যে, সঠিকভাবে হিজাব না পরার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে হেনস্তা করেছেন। সেই হেনস্তার প্রতিবাদে তিনি প্রকাশ্যে পোশাক খুলে ফেলেন এবং এমনভাবে প্রতিরোধ জানান যা ইরানে আগে কখনো দেখা যায়নি।

ঘটনার ভিডিওটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং তা ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। ভিডিওটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করে। কিন্তু এর পরপরই তাকে আটক করে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী।

মানসিক স্বাস্থ্য এবং মুক্তির প্রেক্ষাপট

ইরানের বিচার বিভাগের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, তাকে গ্রেপ্তারের পরপরই একটি মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে তার মানসিক অসুস্থতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই কারণ দেখিয়ে তাকে শাস্তি না দিয়ে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

যদিও সরকার তরুণীর মানসিক অসুস্থতার বিষয়টি উল্লেখ করেছে, অনেকেই মনে করেন, এটি আসলে তরুণীর প্রতিবাদকে খাটো করার একটি পন্থা। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন তরুণীর ওপর কোনো ধরনের নির্যাতন চালানো হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

এই ঘটনার পরপরই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠন তরুণীর গ্রেপ্তারের তীব্র নিন্দা জানায়। তারা মনে করে, ইরানে নারীদের হিজাব আইন নিয়ে প্রতিবাদ করার অধিকার সীমিত এবং সরকার তা দমন করার চেষ্টা করছে।

বিভিন্ন সংগঠন তরুণীর সাহসিকতার প্রশংসা করেছে এবং একে ইরানে নারীদের চলমান অধিকার আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে অভিহিত করেছে।

ইরানের কঠোর হিজাব আইন

ইরানে নারীদের জন্য হিজাব পরিধান বাধ্যতামূলক। ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে নারীদের পোশাকের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এই আইন ভঙ্গ করলে নারীদের কারাদণ্ড, জরিমানা, এমনকি নীতি পুলিশের হেফাজতে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।

২০২২ সালে কুর্দি তরুণী মাশা আমিনির মৃত্যু ইরানে হিজাব আইনবিরোধী আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দেয়। তাকে নীতি পুলিশ আটক করার পর তার মৃত্যু হয়, যা দেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ইরানের বিভিন্ন শহরে হাজারো নারী রাস্তায় নেমে হিজাববিরোধী বিক্ষোভ করেন।

তরুণ প্রজন্মের প্রতিবাদ এবং সম্ভাব্য পরিবর্তন

ইরানের তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে নারীরা, গত কয়েক বছরে কঠোর বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে সাহসী পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তাদের এই প্রতিবাদ কেবল হিজাব আইনকে কেন্দ্র করে নয়, বরং সামাজিক এবং রাজনৈতিক অধিকারের দাবির প্রতিফলন।

বর্তমান ঘটনায় সংশ্লিষ্ট তরুণী শাস্তি ছাড়া মুক্তি পেয়েছেন, যা বিরল। তবে এর মাধ্যমে সরকার হিজাববিরোধী আন্দোলন থামাতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।

ইরানের ভবিষ্যৎ নারীর অধিকারের দৃষ্টিকোণ

বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরানের এই প্রজন্মের আন্দোলন দেশটির সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। হিজাববিরোধী আন্দোলন এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরানের নারী অধিকারের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

এই তরুণীর সাহসিকতা ইরানে নারীদের অধিকারের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এ ঘটনা স্পষ্টতই প্রমাণ করে যে, নারীরা তাদের স্বাধীনতা ও মর্যাদার জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে প্রস্তুত।