১৪ হাজার কোটি রুপির পিএনবি কেলেঙ্কারি: যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তার মোদি

- Update Time : ১১:০০:৩৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৬ জুলাই ২০২৫
- / ৫৫ Time View
ভারতের ইতিহাসে অন্যতম বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি হিসেবে চিহ্নিত পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক (পিএনবি) জালিয়াতি মামলায় নতুন মোড় এসেছে। প্রায় ১৪ হাজার কোটি রুপি আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আলোচিত হীরা ব্যবসায়ী নীরব মোদির ছোট ভাই নেহাল দীপক মোদিকে যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা (সিবিআই) এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) মামলার তদন্তে নতুন গতি আসার আশা করছে।
ইন্টারপোল রেড কর্নার নোটিশে গ্রেপ্তার
ভারতের অনুরোধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে জারি করা রেড কর্নার নোটিশের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা শুক্রবার (৪ জুলাই) নেহাল মোদিকে গ্রেপ্তার করে। এনডিটিভি’র বরাতে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে তার বিরুদ্ধে আইনি ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চলছিল। নেহাল মোদি বেলজিয়ামের নাগরিক হলেও, তার বিরুদ্ধে ভারতের তদন্ত সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চেয়ে নোটিশ জারি করা হয়।
গুরুতর অভিযোগ: পলায়নে সহায়তা, প্রমাণ নষ্ট ও অর্থপাচার
সিবিআই ও ইডি অভিযোগ করেছে, পিএনবি কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে মূল অভিযুক্ত নীরব মোদিকে পালাতে সহায়তা করেন তার ভাই নেহাল। শুধু পালাতেই নয়, তদন্তে বাধা সৃষ্টি, সাক্ষীদের ভয় দেখানো এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণাদি নষ্ট করার মতো গুরুতর অপরাধেও জড়িত ছিলেন তিনি।
এ ছাড়া, অভিযোগ রয়েছে যে নীরব মোদি এবং তার মামা মেহুল চোকসির আত্মসাত করা হাজার হাজার কোটি রুপি বিদেশে পাচার করতে নেহাল মোদি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ভুয়া কোম্পানি, নকল বিল, ভুয়া লেনদেন এবং অফশোর ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে এই অর্থ পাচারের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে তার সরাসরি ভূমিকা ছিল বলে তদন্তকারীরা দাবি করেছেন।
মার্কিন আদালতে প্রত্যর্পণ শুনানি
যুক্তরাষ্ট্রে নেহাল মোদির প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত মামলার শুনানি আগামী ১৭ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে। ধারণা করা হচ্ছে, তার আইনজীবীরা জামিন আবেদন করবেন, তবে মার্কিন প্রসিকিউশন ইতোমধ্যেই জামিনের বিরোধিতা করার ঘোষণা দিয়েছে। ভারত সরকার ইতোমধ্যে তাকে ভারতে ফেরত আনার জন্য জোর কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে।
পিএনবি কেলেঙ্কারির পটভূমি
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশ্যে আসে ভারতের ইতিহাসে অন্যতম বড় ব্যাংক জালিয়াতির কেলেঙ্কারি। অভিযোগ অনুযায়ী, পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের (পিএনবি) মুম্বাইয়ের ব্র্যাডি হাউস শাখার কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তার সহায়তায় হীরা ব্যবসায়ী নীরব মোদি ও তার মামা মেহুল চোকসি প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ কোটি রুপি অবৈধভাবে তুলে নেন।
তদন্তে জানা যায়, এই জালিয়াতির মধ্যে নীরব মোদির বিরুদ্ধে ৬,৪৯৮ কোটি রুপি এবং মেহুল চোকসির বিরুদ্ধে ৭,০৮০ কোটি রুপি আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন ভুয়া এলওইউ (Letter of Undertaking) ও এলসির (Letter of Credit) মাধ্যমে বিদেশে পাঠানো হয়েছিল, যার মধ্যে অনেক অর্থই হংকং, বেলজিয়াম ও দুবাইয়ের ব্যাংকে স্থানান্তরিত হয়।
কেলেঙ্কারির কথা প্রকাশ্যে আসার আগেই, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতেই নীরব মোদি এবং মেহুল চোকসি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। নীরব মোদি বর্তমানে যুক্তরাজ্যের কারাগারে বন্দী অবস্থায় রয়েছেন এবং ভারত সরকারের প্রত্যর্পণ চেষ্টার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। অপরদিকে, মেহুল চোকসি বর্তমানে ক্যারিবীয় দ্বীপ অ্যান্টিগায় আটক রয়েছেন এবং সেখানেও তার প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া চলছে।
ভারতের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
নেহাল মোদির গ্রেপ্তারের খবরে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নতুন করে আশাবাদী হয়ে উঠেছে। তারা মনে করছে, নেহালের প্রত্যর্পণ হলে কেলেঙ্কারির অনেক অজানা দিক উন্মোচিত হবে এবং এই চক্রে জড়িত আরও উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা সম্ভব হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, শুধু অর্থপাচার নয়, এই ঘটনায় ভারতীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থার নিরাপত্তা এবং দুর্নীতিবিরোধী আইনি কাঠামো নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এই মামলার দীর্ঘস্থায়ী তদন্ত এবং অভিযুক্তদের শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
নেহাল মোদির গ্রেপ্তার ভারতের জন্য একটি কূটনৈতিক ও আইনি সাফল্য হলেও, এই কেলেঙ্কারির পূর্ণ তদন্ত ও বিচার এখনো বহুদূর। আগামী ১৭ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে তার শুনানির দিকে তাকিয়ে রয়েছে গোটা ভারত। যদি তাকে ভারতে প্রত্যর্পণ সম্ভব হয়, তাহলে পিএনবি কেলেঙ্কারির গভীরে লুকিয়ে থাকা অনেক সত্য উন্মোচিত হতে পারে, যা শুধু একজন নয়, বরং গোটা ব্যবস্থার দুর্বলতা ও দুষ্কর্মের চিত্র স্পষ্ট করবে।
Please Share This Post in Your Social Media

১৪ হাজার কোটি রুপির পিএনবি কেলেঙ্কারি: যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তার মোদি

ভারতের ইতিহাসে অন্যতম বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি হিসেবে চিহ্নিত পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক (পিএনবি) জালিয়াতি মামলায় নতুন মোড় এসেছে। প্রায় ১৪ হাজার কোটি রুপি আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আলোচিত হীরা ব্যবসায়ী নীরব মোদির ছোট ভাই নেহাল দীপক মোদিকে যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা (সিবিআই) এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) মামলার তদন্তে নতুন গতি আসার আশা করছে।
ইন্টারপোল রেড কর্নার নোটিশে গ্রেপ্তার
ভারতের অনুরোধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে জারি করা রেড কর্নার নোটিশের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা শুক্রবার (৪ জুলাই) নেহাল মোদিকে গ্রেপ্তার করে। এনডিটিভি’র বরাতে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে তার বিরুদ্ধে আইনি ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চলছিল। নেহাল মোদি বেলজিয়ামের নাগরিক হলেও, তার বিরুদ্ধে ভারতের তদন্ত সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চেয়ে নোটিশ জারি করা হয়।
গুরুতর অভিযোগ: পলায়নে সহায়তা, প্রমাণ নষ্ট ও অর্থপাচার
সিবিআই ও ইডি অভিযোগ করেছে, পিএনবি কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে মূল অভিযুক্ত নীরব মোদিকে পালাতে সহায়তা করেন তার ভাই নেহাল। শুধু পালাতেই নয়, তদন্তে বাধা সৃষ্টি, সাক্ষীদের ভয় দেখানো এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণাদি নষ্ট করার মতো গুরুতর অপরাধেও জড়িত ছিলেন তিনি।
এ ছাড়া, অভিযোগ রয়েছে যে নীরব মোদি এবং তার মামা মেহুল চোকসির আত্মসাত করা হাজার হাজার কোটি রুপি বিদেশে পাচার করতে নেহাল মোদি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ভুয়া কোম্পানি, নকল বিল, ভুয়া লেনদেন এবং অফশোর ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে এই অর্থ পাচারের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে তার সরাসরি ভূমিকা ছিল বলে তদন্তকারীরা দাবি করেছেন।
মার্কিন আদালতে প্রত্যর্পণ শুনানি
যুক্তরাষ্ট্রে নেহাল মোদির প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত মামলার শুনানি আগামী ১৭ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে। ধারণা করা হচ্ছে, তার আইনজীবীরা জামিন আবেদন করবেন, তবে মার্কিন প্রসিকিউশন ইতোমধ্যেই জামিনের বিরোধিতা করার ঘোষণা দিয়েছে। ভারত সরকার ইতোমধ্যে তাকে ভারতে ফেরত আনার জন্য জোর কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে।
পিএনবি কেলেঙ্কারির পটভূমি
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশ্যে আসে ভারতের ইতিহাসে অন্যতম বড় ব্যাংক জালিয়াতির কেলেঙ্কারি। অভিযোগ অনুযায়ী, পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের (পিএনবি) মুম্বাইয়ের ব্র্যাডি হাউস শাখার কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তার সহায়তায় হীরা ব্যবসায়ী নীরব মোদি ও তার মামা মেহুল চোকসি প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ কোটি রুপি অবৈধভাবে তুলে নেন।
তদন্তে জানা যায়, এই জালিয়াতির মধ্যে নীরব মোদির বিরুদ্ধে ৬,৪৯৮ কোটি রুপি এবং মেহুল চোকসির বিরুদ্ধে ৭,০৮০ কোটি রুপি আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন ভুয়া এলওইউ (Letter of Undertaking) ও এলসির (Letter of Credit) মাধ্যমে বিদেশে পাঠানো হয়েছিল, যার মধ্যে অনেক অর্থই হংকং, বেলজিয়াম ও দুবাইয়ের ব্যাংকে স্থানান্তরিত হয়।
কেলেঙ্কারির কথা প্রকাশ্যে আসার আগেই, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতেই নীরব মোদি এবং মেহুল চোকসি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। নীরব মোদি বর্তমানে যুক্তরাজ্যের কারাগারে বন্দী অবস্থায় রয়েছেন এবং ভারত সরকারের প্রত্যর্পণ চেষ্টার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। অপরদিকে, মেহুল চোকসি বর্তমানে ক্যারিবীয় দ্বীপ অ্যান্টিগায় আটক রয়েছেন এবং সেখানেও তার প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া চলছে।
ভারতের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
নেহাল মোদির গ্রেপ্তারের খবরে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নতুন করে আশাবাদী হয়ে উঠেছে। তারা মনে করছে, নেহালের প্রত্যর্পণ হলে কেলেঙ্কারির অনেক অজানা দিক উন্মোচিত হবে এবং এই চক্রে জড়িত আরও উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা সম্ভব হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, শুধু অর্থপাচার নয়, এই ঘটনায় ভারতীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থার নিরাপত্তা এবং দুর্নীতিবিরোধী আইনি কাঠামো নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এই মামলার দীর্ঘস্থায়ী তদন্ত এবং অভিযুক্তদের শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
নেহাল মোদির গ্রেপ্তার ভারতের জন্য একটি কূটনৈতিক ও আইনি সাফল্য হলেও, এই কেলেঙ্কারির পূর্ণ তদন্ত ও বিচার এখনো বহুদূর। আগামী ১৭ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে তার শুনানির দিকে তাকিয়ে রয়েছে গোটা ভারত। যদি তাকে ভারতে প্রত্যর্পণ সম্ভব হয়, তাহলে পিএনবি কেলেঙ্কারির গভীরে লুকিয়ে থাকা অনেক সত্য উন্মোচিত হতে পারে, যা শুধু একজন নয়, বরং গোটা ব্যবস্থার দুর্বলতা ও দুষ্কর্মের চিত্র স্পষ্ট করবে।