স্বামী বা সঙ্গীর শরীর থেকে দুর্গন্ধ: কারণ, সম্পর্কের উপর প্রভাব এবং করণীয় বিশ্লেষণ

- Update Time : ১১:০০:০৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৯ জুলাই ২০২৫
- / ২৭ Time View
দাম্পত্য বা প্রেমের সম্পর্কের সৌন্দর্য মূলত তৈরি হয় বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমে। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের কিছু বাস্তব সমস্যা, যেমন একজন সঙ্গীর শরীর থেকে আসা অস্বাভাবিক ও বিরক্তিকর দুর্গন্ধ, কখনো কখনো এই ঘনিষ্ঠতাকে ব্যাহত করতে পারে। অনেকেই এই বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে দ্বিধাবোধ করেন—ভয় থাকে, সম্পর্কটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যজন কষ্ট পাবে, কিংবা বিষয়টি “অশোভন” হিসেবে দেখা হবে। অথচ এই সমস্যার পেছনে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য ও মানসিক উপাদান, যা জানলে এবং বুঝলে সমাধান অনেক সহজ হয়ে দাঁড়ায়।
শরীর থেকে দুর্গন্ধের সম্ভাব্য কারণসমূহ
১. ব্যক্তিগত পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার অভাব
শরীরের দুর্গন্ধের সবচেয়ে সাধারণ এবং প্রতিরোধযোগ্য কারণ হলো অপরিষ্কার থাকা। দিনের পর দিন গোসল না করা, পরিষ্কার কাপড় না পরা, বগল বা কুঁচকির মতো অংশে জমে থাকা ঘাম, মৃত কোষ ও ব্যাকটেরিয়া থেকে এক ধরনের তীব্র গন্ধ তৈরি হয়। বিশেষ করে যারা নিয়মিত বাইরে কাজ করেন বা শারীরিক পরিশ্রম করেন, তাদের শরীর থেকে ঘামের গন্ধ অনেক বেশি আসতে পারে। এই দুর্গন্ধ অনেক সময় এত তীব্র হয় যে, ঘরোয়া পরিবেশেও তা অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। অথচ একটু যত্ন ও নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করলেই এই সমস্যা দূর হতে পারে।
২. মুখগহ্বরে সমস্যা
অনেক পুরুষের মুখ থেকে তীব্র দুর্গন্ধ বের হয়, যা শুধু শারীরিক ঘনিষ্ঠতার সময় নয়, বরং সাধারণ কথাবার্তার সময়ও বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। এই গন্ধ সাধারণত দাঁতের ফাঁকে খাবার জমে থাকা, ক্যাভিটি, দাঁতের গোঁড়ায় ইনফেকশন বা মাড়ির রোগের কারণে হয়। মুখে শুকনোভাব বা মুখে লালা উৎপাদন কমে গেলেও ব্যাকটেরিয়ার কার্যক্রম বেড়ে যায়, যা দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে। নিয়মিত ব্রাশ না করা, মাউথওয়াশ ব্যবহার না করা এবং দাঁতের সমস্যা অবহেলা করলে এই সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায়।
৩. ত্বকের সংক্রমণ ও ছত্রাক (ফাংগাল) ইনফেকশন
বগল, কুঁচকি, পায়ের আঙুলের ফাঁক—এই জায়গাগুলোয় ঘাম ও আর্দ্রতা জমে ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়, যা তীব্র গন্ধের কারণ হতে পারে। অনেক সময় এই গন্ধ পচা বা টক জাতীয় হয়ে থাকে। যারা রোজ গোসল করেন না বা একজোড়া মোজা বা অন্তর্বাস বহুদিন ব্যবহার করেন, তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। এর পাশাপাশি কাঁচা চুল শুকিয়ে না রেখে টুপি বা হেলমেট পরে থাকলেও স্ক্যাল্পে ইনফেকশন হতে পারে।
৪. দীর্ঘমেয়াদি রোগ: ডায়াবেটিস, কিডনি বা লিভার সমস্যা
ডায়াবেটিস, কিডনি জটিলতা বা লিভারজনিত রোগের রোগীদের শরীরে এক ধরনের “ফ্রুটি” বা অ্যাসেটোন জাতীয় গন্ধ পাওয়া যায়। অনেক সময় এই গন্ধ সাধারণ ঘামের গন্ধের মতো নয়—বরং এটি শরীরের ভেতরের রসায়নের পরিবর্তনের কারণে হয়। এই ধরনের গন্ধ অনেক সময় রোগের পূর্বাভাস হতে পারে। তাই এই ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
৫. খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন
শরীর থেকে বাজে গন্ধ আসার পেছনে খাদ্যাভ্যাস বড় একটি ভূমিকা রাখে। অতিরিক্ত পেঁয়াজ, রসুন, ঝাল-মশলাযুক্ত খাবার, লাল মাংস এবং চর্বিযুক্ত খাবার হজমে সমস্যা করে, ফলে তা ঘামের মাধ্যমে গন্ধযুক্ত রাসায়নিক বের করে। আবার, যেসব ব্যক্তি নিয়মিত ধূমপান বা মদ্যপান করেন, তাদের শরীর থেকে একটি ধাতব, পচা ধরনের গন্ধ আসতে পারে। এই গন্ধ শুধু শরীর থেকে নয়, মুখ থেকে, চুল থেকেও ছড়ায়।
৬. হরমোনের পরিবর্তন বা পুরুষত্বজনিত পরিবর্তন
কিছু পুরুষের শরীরে অ্যান্ড্রোজেন হরমোনের মাত্রা বেশি থাকায় তারা তুলনামূলকভাবে বেশি ঘামেন। এই অতিরিক্ত ঘামের ফলে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি হয় এবং দুর্গন্ধ ছড়ায়। আবার, বয়ঃসন্ধিকাল, দুশ্চিন্তা বা অতিরিক্ত মানসিক চাপেও হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়ে গন্ধ বাড়তে পারে।
গন্ধজনিত সমস্যায় দাম্পত্য জীবনে প্রভাব
এই ধরনের গন্ধ শুধু একটি শারীরিক সমস্যা নয়, এটি সম্পর্কের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে। প্রাথমিকভাবে বিষয়টি অস্বস্তিকর মনে হলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি সঙ্গীর প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দেয়। অনেকে শারীরিক ঘনিষ্ঠতা এড়িয়ে চলতে শুরু করেন, কেউ কেউ দূরত্ব সৃষ্টি করেন, আবার অনেকেই মানসিকভাবে বিরক্ত বা হতাশ হয়ে পড়েন।
দাম্পত্য জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পারস্পরিক আকর্ষণ ও বোঝাপড়া। যদি এই সমস্যা সময়মতো সমাধান না করা হয়, তবে তা সম্পর্কের শিকড় কাঁপিয়ে দিতে পারে। অনেক স্ত্রী সরাসরি অভিযোগ না করে চুপচাপ সহ্য করতে থাকেন—যা পরে মানসিক অস্থিরতা ও একাকীত্বের রূপ নেয়।
করণীয়
১. সহানুভূতিশীলভাবে আলোচনা করুন
এই ধরনের বিষয় সরাসরি, কটাক্ষ বা বিরক্তি দিয়ে বললে অপর ব্যক্তি অপমানিত বোধ করতে পারেন। ফলে তিনি রাগান্বিত বা আত্মগোপনে চলে যেতে পারেন। বরং স্নেহ ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে বিষয়টি তোলাই শ্রেয়। উদাহরণস্বরূপ:
“আমাদের সম্পর্ক যেমন গভীর, তেমনই আমাদের স্বাস্থ্যও গুরুত্বপূর্ণ। আমি লক্ষ্য করছি, তোমার শরীর থেকে সামান্য গন্ধ আসছে, যা হয়তো স্বাস্থ্যগত কোনো কারণে হতে পারে। আমরা একসাথে খেয়াল করলে ভালো হয়, তুমি আমার সবচেয়ে আপন।”
এই ধরনের বক্তব্যে সমস্যা না শুধুই উপস্থাপন হয়, বরং একসঙ্গে সমাধানেরও ইঙ্গিত থাকে।
২. পরিচ্ছন্নতা চর্চা উদ্বুদ্ধ করুন
সঙ্গীকে নিয়মিত গোসল, অন্তর্বাস পরিবর্তন, পরিষ্কার তোয়ালে ব্যবহার, ঘুমানোর আগে মুখ ধোয়া, মুখে ব্রাশ ও মাউথওয়াশ ব্যবহারে উৎসাহিত করা দরকার। বাজারে নানা ধরনের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল সাবান, বডি ওয়াশ, ডিওডোরেন্ট, ফ্রেশনার ও স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট রয়েছে, যা ব্যবহার করলে শরীরের দুর্গন্ধ অনেকটাই কমে।
৩. স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান
দীর্ঘস্থায়ী বা অস্বাভাবিক গন্ধ অনেক সময় কোনো অভ্যন্তরীণ রোগের লক্ষণ হতে পারে। যেমন কিডনি বিকল হলে প্রস্রাবের গন্ধের মতো গন্ধ শরীর থেকে আসতে পারে। আবার ডায়াবেটিস রোগীদের মুখ বা শরীর থেকে অ্যাসেটোন জাতীয় গন্ধ আসতে পারে। তাই সঙ্গীকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া, স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো এবং প্রয়োজনে ওষুধ ও চিকিৎসা গ্রহণ করানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৪. মুখ ও দাঁতের যত্ন
প্রতিদিন দুইবার দাঁত ব্রাশ করা, অন্তত একবার ডেন্টাল ফ্লস ব্যবহার, মাউথওয়াশ ব্যবহার ও মুখ শুকনো না রাখার জন্য নিয়মিত পানি পান করা জরুরি। বছরে অন্তত একবার দাঁতের চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।
৫. সুষম খাবার ও পর্যাপ্ত পানি পান
প্রতিদিন প্রচুর পানি পান করলে শরীর থেকে টক্সিন ও দুর্গন্ধ তৈরি হওয়া উপাদান দূর হয়। পাশাপাশি বেশি ফাইবারযুক্ত খাবার, সবুজ শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়া গন্ধ কমাতে সাহায্য করে। অ্যালকোহল, ধূমপান, ক্যাফেইন ইত্যাদি যত কম খাওয়া যায়, ততই ভালো।
৬. ভালোবাসা ও ধৈর্য বজায় রাখা
এই ধরনের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে সহানুভূতির সঙ্গে সঙ্গীর পাশে থাকা দরকার। তাঁকে ছোট বা অপমান না করে ধীরে ধীরে সচেতনতা তৈরি করা যায়। অনেক সময় একান্তে একসঙ্গে স্নান, একসঙ্গে স্কিন কেয়ার বা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করার চেষ্টা সম্পর্ককেও মজবুত করে।
শরীর থেকে বাজে গন্ধ আসা একটি ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সমস্যা হলেও, তা দাম্পত্য জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এই সমস্যাকে উপেক্ষা না করে বুঝে, শুনে, সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে প্রতিরোধ করাই শ্রেয়। মনে রাখতে হবে—প্রেম, শ্রদ্ধা ও স্বাস্থ্যকর জীবনচর্চা মিলেই গড়ে ওঠে একটি সুখী দাম্পত্য জীবন।
আপনার ভালোবাসা ও সচেতনতা হয়তো আপনার সঙ্গীর জীবনে এক নতুন আলোর দ্বার খুলে দিতে পারে।
Please Share This Post in Your Social Media

স্বামী বা সঙ্গীর শরীর থেকে দুর্গন্ধ: কারণ, সম্পর্কের উপর প্রভাব এবং করণীয় বিশ্লেষণ

দাম্পত্য বা প্রেমের সম্পর্কের সৌন্দর্য মূলত তৈরি হয় বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমে। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের কিছু বাস্তব সমস্যা, যেমন একজন সঙ্গীর শরীর থেকে আসা অস্বাভাবিক ও বিরক্তিকর দুর্গন্ধ, কখনো কখনো এই ঘনিষ্ঠতাকে ব্যাহত করতে পারে। অনেকেই এই বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে দ্বিধাবোধ করেন—ভয় থাকে, সম্পর্কটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যজন কষ্ট পাবে, কিংবা বিষয়টি “অশোভন” হিসেবে দেখা হবে। অথচ এই সমস্যার পেছনে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য ও মানসিক উপাদান, যা জানলে এবং বুঝলে সমাধান অনেক সহজ হয়ে দাঁড়ায়।
শরীর থেকে দুর্গন্ধের সম্ভাব্য কারণসমূহ
১. ব্যক্তিগত পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার অভাব
শরীরের দুর্গন্ধের সবচেয়ে সাধারণ এবং প্রতিরোধযোগ্য কারণ হলো অপরিষ্কার থাকা। দিনের পর দিন গোসল না করা, পরিষ্কার কাপড় না পরা, বগল বা কুঁচকির মতো অংশে জমে থাকা ঘাম, মৃত কোষ ও ব্যাকটেরিয়া থেকে এক ধরনের তীব্র গন্ধ তৈরি হয়। বিশেষ করে যারা নিয়মিত বাইরে কাজ করেন বা শারীরিক পরিশ্রম করেন, তাদের শরীর থেকে ঘামের গন্ধ অনেক বেশি আসতে পারে। এই দুর্গন্ধ অনেক সময় এত তীব্র হয় যে, ঘরোয়া পরিবেশেও তা অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। অথচ একটু যত্ন ও নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করলেই এই সমস্যা দূর হতে পারে।
২. মুখগহ্বরে সমস্যা
অনেক পুরুষের মুখ থেকে তীব্র দুর্গন্ধ বের হয়, যা শুধু শারীরিক ঘনিষ্ঠতার সময় নয়, বরং সাধারণ কথাবার্তার সময়ও বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। এই গন্ধ সাধারণত দাঁতের ফাঁকে খাবার জমে থাকা, ক্যাভিটি, দাঁতের গোঁড়ায় ইনফেকশন বা মাড়ির রোগের কারণে হয়। মুখে শুকনোভাব বা মুখে লালা উৎপাদন কমে গেলেও ব্যাকটেরিয়ার কার্যক্রম বেড়ে যায়, যা দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে। নিয়মিত ব্রাশ না করা, মাউথওয়াশ ব্যবহার না করা এবং দাঁতের সমস্যা অবহেলা করলে এই সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায়।
৩. ত্বকের সংক্রমণ ও ছত্রাক (ফাংগাল) ইনফেকশন
বগল, কুঁচকি, পায়ের আঙুলের ফাঁক—এই জায়গাগুলোয় ঘাম ও আর্দ্রতা জমে ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়, যা তীব্র গন্ধের কারণ হতে পারে। অনেক সময় এই গন্ধ পচা বা টক জাতীয় হয়ে থাকে। যারা রোজ গোসল করেন না বা একজোড়া মোজা বা অন্তর্বাস বহুদিন ব্যবহার করেন, তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। এর পাশাপাশি কাঁচা চুল শুকিয়ে না রেখে টুপি বা হেলমেট পরে থাকলেও স্ক্যাল্পে ইনফেকশন হতে পারে।
৪. দীর্ঘমেয়াদি রোগ: ডায়াবেটিস, কিডনি বা লিভার সমস্যা
ডায়াবেটিস, কিডনি জটিলতা বা লিভারজনিত রোগের রোগীদের শরীরে এক ধরনের “ফ্রুটি” বা অ্যাসেটোন জাতীয় গন্ধ পাওয়া যায়। অনেক সময় এই গন্ধ সাধারণ ঘামের গন্ধের মতো নয়—বরং এটি শরীরের ভেতরের রসায়নের পরিবর্তনের কারণে হয়। এই ধরনের গন্ধ অনেক সময় রোগের পূর্বাভাস হতে পারে। তাই এই ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
৫. খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন
শরীর থেকে বাজে গন্ধ আসার পেছনে খাদ্যাভ্যাস বড় একটি ভূমিকা রাখে। অতিরিক্ত পেঁয়াজ, রসুন, ঝাল-মশলাযুক্ত খাবার, লাল মাংস এবং চর্বিযুক্ত খাবার হজমে সমস্যা করে, ফলে তা ঘামের মাধ্যমে গন্ধযুক্ত রাসায়নিক বের করে। আবার, যেসব ব্যক্তি নিয়মিত ধূমপান বা মদ্যপান করেন, তাদের শরীর থেকে একটি ধাতব, পচা ধরনের গন্ধ আসতে পারে। এই গন্ধ শুধু শরীর থেকে নয়, মুখ থেকে, চুল থেকেও ছড়ায়।
৬. হরমোনের পরিবর্তন বা পুরুষত্বজনিত পরিবর্তন
কিছু পুরুষের শরীরে অ্যান্ড্রোজেন হরমোনের মাত্রা বেশি থাকায় তারা তুলনামূলকভাবে বেশি ঘামেন। এই অতিরিক্ত ঘামের ফলে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি হয় এবং দুর্গন্ধ ছড়ায়। আবার, বয়ঃসন্ধিকাল, দুশ্চিন্তা বা অতিরিক্ত মানসিক চাপেও হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়ে গন্ধ বাড়তে পারে।
গন্ধজনিত সমস্যায় দাম্পত্য জীবনে প্রভাব
এই ধরনের গন্ধ শুধু একটি শারীরিক সমস্যা নয়, এটি সম্পর্কের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে। প্রাথমিকভাবে বিষয়টি অস্বস্তিকর মনে হলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি সঙ্গীর প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দেয়। অনেকে শারীরিক ঘনিষ্ঠতা এড়িয়ে চলতে শুরু করেন, কেউ কেউ দূরত্ব সৃষ্টি করেন, আবার অনেকেই মানসিকভাবে বিরক্ত বা হতাশ হয়ে পড়েন।
দাম্পত্য জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পারস্পরিক আকর্ষণ ও বোঝাপড়া। যদি এই সমস্যা সময়মতো সমাধান না করা হয়, তবে তা সম্পর্কের শিকড় কাঁপিয়ে দিতে পারে। অনেক স্ত্রী সরাসরি অভিযোগ না করে চুপচাপ সহ্য করতে থাকেন—যা পরে মানসিক অস্থিরতা ও একাকীত্বের রূপ নেয়।
করণীয়
১. সহানুভূতিশীলভাবে আলোচনা করুন
এই ধরনের বিষয় সরাসরি, কটাক্ষ বা বিরক্তি দিয়ে বললে অপর ব্যক্তি অপমানিত বোধ করতে পারেন। ফলে তিনি রাগান্বিত বা আত্মগোপনে চলে যেতে পারেন। বরং স্নেহ ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে বিষয়টি তোলাই শ্রেয়। উদাহরণস্বরূপ:
“আমাদের সম্পর্ক যেমন গভীর, তেমনই আমাদের স্বাস্থ্যও গুরুত্বপূর্ণ। আমি লক্ষ্য করছি, তোমার শরীর থেকে সামান্য গন্ধ আসছে, যা হয়তো স্বাস্থ্যগত কোনো কারণে হতে পারে। আমরা একসাথে খেয়াল করলে ভালো হয়, তুমি আমার সবচেয়ে আপন।”
এই ধরনের বক্তব্যে সমস্যা না শুধুই উপস্থাপন হয়, বরং একসঙ্গে সমাধানেরও ইঙ্গিত থাকে।
২. পরিচ্ছন্নতা চর্চা উদ্বুদ্ধ করুন
সঙ্গীকে নিয়মিত গোসল, অন্তর্বাস পরিবর্তন, পরিষ্কার তোয়ালে ব্যবহার, ঘুমানোর আগে মুখ ধোয়া, মুখে ব্রাশ ও মাউথওয়াশ ব্যবহারে উৎসাহিত করা দরকার। বাজারে নানা ধরনের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল সাবান, বডি ওয়াশ, ডিওডোরেন্ট, ফ্রেশনার ও স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট রয়েছে, যা ব্যবহার করলে শরীরের দুর্গন্ধ অনেকটাই কমে।
৩. স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান
দীর্ঘস্থায়ী বা অস্বাভাবিক গন্ধ অনেক সময় কোনো অভ্যন্তরীণ রোগের লক্ষণ হতে পারে। যেমন কিডনি বিকল হলে প্রস্রাবের গন্ধের মতো গন্ধ শরীর থেকে আসতে পারে। আবার ডায়াবেটিস রোগীদের মুখ বা শরীর থেকে অ্যাসেটোন জাতীয় গন্ধ আসতে পারে। তাই সঙ্গীকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া, স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো এবং প্রয়োজনে ওষুধ ও চিকিৎসা গ্রহণ করানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৪. মুখ ও দাঁতের যত্ন
প্রতিদিন দুইবার দাঁত ব্রাশ করা, অন্তত একবার ডেন্টাল ফ্লস ব্যবহার, মাউথওয়াশ ব্যবহার ও মুখ শুকনো না রাখার জন্য নিয়মিত পানি পান করা জরুরি। বছরে অন্তত একবার দাঁতের চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।
৫. সুষম খাবার ও পর্যাপ্ত পানি পান
প্রতিদিন প্রচুর পানি পান করলে শরীর থেকে টক্সিন ও দুর্গন্ধ তৈরি হওয়া উপাদান দূর হয়। পাশাপাশি বেশি ফাইবারযুক্ত খাবার, সবুজ শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়া গন্ধ কমাতে সাহায্য করে। অ্যালকোহল, ধূমপান, ক্যাফেইন ইত্যাদি যত কম খাওয়া যায়, ততই ভালো।
৬. ভালোবাসা ও ধৈর্য বজায় রাখা
এই ধরনের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে সহানুভূতির সঙ্গে সঙ্গীর পাশে থাকা দরকার। তাঁকে ছোট বা অপমান না করে ধীরে ধীরে সচেতনতা তৈরি করা যায়। অনেক সময় একান্তে একসঙ্গে স্নান, একসঙ্গে স্কিন কেয়ার বা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করার চেষ্টা সম্পর্ককেও মজবুত করে।
শরীর থেকে বাজে গন্ধ আসা একটি ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সমস্যা হলেও, তা দাম্পত্য জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এই সমস্যাকে উপেক্ষা না করে বুঝে, শুনে, সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে প্রতিরোধ করাই শ্রেয়। মনে রাখতে হবে—প্রেম, শ্রদ্ধা ও স্বাস্থ্যকর জীবনচর্চা মিলেই গড়ে ওঠে একটি সুখী দাম্পত্য জীবন।
আপনার ভালোবাসা ও সচেতনতা হয়তো আপনার সঙ্গীর জীবনে এক নতুন আলোর দ্বার খুলে দিতে পারে।