সময়: রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

মার্কিন-ইসরায়েলি ত্রাণকেন্দ্রে খাবার নিতে এসে প্রাণ গেছে ৭৪৩ ফিলিস্তিনির: মানবিকতার নামে নির্মমতা?

ডিজিটাল ডেস্ক
  • Update Time : ০৫:৫২:৩৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ জুলাই ২০২৫
  • / ১৭ Time View

prothomalo bangla 2025 07 06 y1loosra Gaza Humanitarian Foundation

 

prothomalo bangla 2025 07 06 y1loosra Gaza Humanitarian Foundation

গাজায় চলমান ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে যখন সাধারণ মানুষ ক্ষুধা-তৃষ্ণায় অস্থির, তখন আশার আলো হয়ে এসেছিল একটি ত্রাণ সংস্থা—গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এবং ইসরায়েল-সমর্থিত এই সংস্থা ‘মানবিক সহায়তা’ দেওয়ার নামে যে কাজ শুরু করেছিল, তা এখন এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডির নাম হয়ে উঠেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের আশপাশে ত্রাণ নিতে এসে মারাত্মক সহিংসতার শিকার হয়ে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৭৪৩ জন ফিলিস্তিনি, আহত হয়েছেন ৪ হাজার ৮৯১ জন।

ত্রাণ বিতরণের আড়ালে মৃত্যুপুরী

জিএইচএফ মে মাসের শেষ দিকে গাজায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করে। তবে কিছুদিনের মধ্যেই অভিযোগ উঠতে শুরু করে যে, সংস্থাটির ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম ঘিরে প্রাণঘাতী সহিংসতা ঘটছে। ক্ষুধার্ত ও দুর্বল ফিলিস্তিনিরা ত্রাণের আশায় ভিড় করলে, সেখানে উপস্থিত ইসরায়েলি বাহিনী এবং জিএইচএফএর নিরাপত্তাকর্মীরা নির্বিচারে গুলি চালায়, কখনো ছোড়ে স্ট্যান গ্রেনেডও।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) এক প্রতিবেদনে জানায়, জিএইচএফে নিযুক্ত মার্কিন ভাড়াটে নিরাপত্তাকর্মীরা প্রায়ই ত্রাণ নিতে আসা নিরীহ মানুষদের প্রতি অতিরিক্ত রূঢ় এবং সহিংস আচরণ করেন। একজন মার্কিন কর্মীর বর্ণনায়, “ওইসব কেন্দ্র যেন অস্ত্রধারীদের খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। তারা যা খুশি তাই করছে।”

ক্ষুধা যখন মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হয়

গাজার পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে আল-জাজিরার সাংবাদিক হানি মাহমুদ বলেন, “এই মানুষগুলো কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যায়নি। তারা গিয়েছিল শুধু একটু খাবারের আশায়। মায়েরা সন্তানের ক্ষুধা মেটাতে গিয়ে নিজের প্রাণ হারাচ্ছেন।” তিনি আরও বলেন, “মানুষ এতটাই অনাহারে আছে যে, প্রতিদিনের খাবার হিসাব করে খেতে হচ্ছে। অনেক মা নিজে না খেয়ে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন।”

একজন আহত ফিলিস্তিনি, মজিদ আবু লাবান, বলেন, “আমার সন্তানেরা টানা তিন দিন না খেয়ে ছিল। তাই বাধ্য হয়ে জিএইচএফের ত্রাণকেন্দ্রে যাই। কিন্তু সেখানে আমাদের গুলি করা হয়।” মজিদের মতো অসংখ্য বাবা-মা আজ দিশেহারা।

সমালোচনার মুখে জিএইচএফ, পাশে মার্কিন প্রশাসন

বিশ্বজুড়ে তীব্র সমালোচনার মুখেও জিএইচএফ তাদের কর্মকাণ্ডকে ন্যায্য বলে দাবি করছে। এপি’র রিপোর্টকে ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ বলে উড়িয়ে দিয়ে সংস্থাটি জানিয়েছে, তারা নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই কাজ করছে। তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বিষয়টি আরও জটিল হয়ে পড়ে যখন জানা যায়, ট্রাম্প প্রশাসন সম্প্রতি এই বিতর্কিত সংস্থাকে ৩০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রশ্ন—এই অর্থ মানবিক সহায়তার জন্য, নাকি ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে?

যুদ্ধবিরতির আলোচনা, কিন্তু হামলা অব্যাহত

অন্যদিকে কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও মিসরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা চললেও গাজায় ইসরায়েলি হামলা একটুও থেমে নেই। রোববার ভোরে ইসরায়েলের বিমান ও ড্রোন হামলায় আরও ২৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর আগের দিন শনিবার ২৪ ঘণ্টায় ৭৮ জন নিহত হন।

গাজা সিটির উত্তরের শেখ রাদওয়ানে একটি বাড়িতে ইসরায়েলের হামলায় নিহত হন ১২ জন, যাদের অধিকাংশই বাস্তুহারা হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানে। তুফা নামক এলাকায় এক হামলায় নিহত হয়েছেন তিনজন, আর দক্ষিণের খান ইউনিসে এক তাঁবুতে ড্রোন হামলায় দুজন নিহত হন।

মানবিকসহায়তার নামে রাজনৈতিক প্রকল্প?

বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, জিএইচএফ আদতে একটি রাজনৈতিক প্রকল্প, যার মাধ্যমে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চায় গাজার মানুষের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে তথাকথিত সহায়তা দেখিয়ে বিশ্বসম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করতে। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় মানবিক ত্রাণ দেওয়া জরুরি হলেও, সেই ত্রাণ যদি পরিণত হয় মৃত্যু ও ভয়াবহতার উৎসে, তবে তা আর সহায়তা নয়—বরং একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা।

মানবতা কোথায়?

গাজায় দুই বছরের কাছাকাছি সময় ধরে চলা এই যুদ্ধ শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, গোটা মানবতার উপরই আঘাত হানছে। শিশুদের খাদ্যের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়া, মায়েদের নিজ সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিয়ে নিজে না খেয়ে মারা যাওয়া—এইসব দৃশ্য আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম চিত্র। আর এসবের পেছনে যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে কোনো আন্তর্জাতিক জবাবদিহিতা না থাকায় প্রশ্ন উঠছে: জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা, এবং বিশ্ব বিবেক কি আজ নীরব দর্শক হয়ে গেছে?

ত্রাণ নয়, এখন ফিলিস্তিনের দরকার শান্তি, স্বাধীনতা এবং মর্যাদাপূর্ণ বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। মানবিকতা যদি গুলির আওয়াজে হারিয়ে যায়, তবে আমাদের সভ্যতাও প্রশ্নের মুখে।

 

Please Share This Post in Your Social Media

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Newest
Oldest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

মার্কিন-ইসরায়েলি ত্রাণকেন্দ্রে খাবার নিতে এসে প্রাণ গেছে ৭৪৩ ফিলিস্তিনির: মানবিকতার নামে নির্মমতা?

Update Time : ০৫:৫২:৩৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ জুলাই ২০২৫

 

prothomalo bangla 2025 07 06 y1loosra Gaza Humanitarian Foundation

গাজায় চলমান ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে যখন সাধারণ মানুষ ক্ষুধা-তৃষ্ণায় অস্থির, তখন আশার আলো হয়ে এসেছিল একটি ত্রাণ সংস্থা—গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এবং ইসরায়েল-সমর্থিত এই সংস্থা ‘মানবিক সহায়তা’ দেওয়ার নামে যে কাজ শুরু করেছিল, তা এখন এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডির নাম হয়ে উঠেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের আশপাশে ত্রাণ নিতে এসে মারাত্মক সহিংসতার শিকার হয়ে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৭৪৩ জন ফিলিস্তিনি, আহত হয়েছেন ৪ হাজার ৮৯১ জন।

ত্রাণ বিতরণের আড়ালে মৃত্যুপুরী

জিএইচএফ মে মাসের শেষ দিকে গাজায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করে। তবে কিছুদিনের মধ্যেই অভিযোগ উঠতে শুরু করে যে, সংস্থাটির ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম ঘিরে প্রাণঘাতী সহিংসতা ঘটছে। ক্ষুধার্ত ও দুর্বল ফিলিস্তিনিরা ত্রাণের আশায় ভিড় করলে, সেখানে উপস্থিত ইসরায়েলি বাহিনী এবং জিএইচএফএর নিরাপত্তাকর্মীরা নির্বিচারে গুলি চালায়, কখনো ছোড়ে স্ট্যান গ্রেনেডও।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) এক প্রতিবেদনে জানায়, জিএইচএফে নিযুক্ত মার্কিন ভাড়াটে নিরাপত্তাকর্মীরা প্রায়ই ত্রাণ নিতে আসা নিরীহ মানুষদের প্রতি অতিরিক্ত রূঢ় এবং সহিংস আচরণ করেন। একজন মার্কিন কর্মীর বর্ণনায়, “ওইসব কেন্দ্র যেন অস্ত্রধারীদের খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। তারা যা খুশি তাই করছে।”

ক্ষুধা যখন মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হয়

গাজার পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে আল-জাজিরার সাংবাদিক হানি মাহমুদ বলেন, “এই মানুষগুলো কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যায়নি। তারা গিয়েছিল শুধু একটু খাবারের আশায়। মায়েরা সন্তানের ক্ষুধা মেটাতে গিয়ে নিজের প্রাণ হারাচ্ছেন।” তিনি আরও বলেন, “মানুষ এতটাই অনাহারে আছে যে, প্রতিদিনের খাবার হিসাব করে খেতে হচ্ছে। অনেক মা নিজে না খেয়ে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন।”

একজন আহত ফিলিস্তিনি, মজিদ আবু লাবান, বলেন, “আমার সন্তানেরা টানা তিন দিন না খেয়ে ছিল। তাই বাধ্য হয়ে জিএইচএফের ত্রাণকেন্দ্রে যাই। কিন্তু সেখানে আমাদের গুলি করা হয়।” মজিদের মতো অসংখ্য বাবা-মা আজ দিশেহারা।

সমালোচনার মুখে জিএইচএফ, পাশে মার্কিন প্রশাসন

বিশ্বজুড়ে তীব্র সমালোচনার মুখেও জিএইচএফ তাদের কর্মকাণ্ডকে ন্যায্য বলে দাবি করছে। এপি’র রিপোর্টকে ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ বলে উড়িয়ে দিয়ে সংস্থাটি জানিয়েছে, তারা নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই কাজ করছে। তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বিষয়টি আরও জটিল হয়ে পড়ে যখন জানা যায়, ট্রাম্প প্রশাসন সম্প্রতি এই বিতর্কিত সংস্থাকে ৩০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রশ্ন—এই অর্থ মানবিক সহায়তার জন্য, নাকি ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে?

যুদ্ধবিরতির আলোচনা, কিন্তু হামলা অব্যাহত

অন্যদিকে কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও মিসরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা চললেও গাজায় ইসরায়েলি হামলা একটুও থেমে নেই। রোববার ভোরে ইসরায়েলের বিমান ও ড্রোন হামলায় আরও ২৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর আগের দিন শনিবার ২৪ ঘণ্টায় ৭৮ জন নিহত হন।

গাজা সিটির উত্তরের শেখ রাদওয়ানে একটি বাড়িতে ইসরায়েলের হামলায় নিহত হন ১২ জন, যাদের অধিকাংশই বাস্তুহারা হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানে। তুফা নামক এলাকায় এক হামলায় নিহত হয়েছেন তিনজন, আর দক্ষিণের খান ইউনিসে এক তাঁবুতে ড্রোন হামলায় দুজন নিহত হন।

মানবিকসহায়তার নামে রাজনৈতিক প্রকল্প?

বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, জিএইচএফ আদতে একটি রাজনৈতিক প্রকল্প, যার মাধ্যমে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চায় গাজার মানুষের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে তথাকথিত সহায়তা দেখিয়ে বিশ্বসম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করতে। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় মানবিক ত্রাণ দেওয়া জরুরি হলেও, সেই ত্রাণ যদি পরিণত হয় মৃত্যু ও ভয়াবহতার উৎসে, তবে তা আর সহায়তা নয়—বরং একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা।

মানবতা কোথায়?

গাজায় দুই বছরের কাছাকাছি সময় ধরে চলা এই যুদ্ধ শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, গোটা মানবতার উপরই আঘাত হানছে। শিশুদের খাদ্যের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়া, মায়েদের নিজ সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিয়ে নিজে না খেয়ে মারা যাওয়া—এইসব দৃশ্য আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম চিত্র। আর এসবের পেছনে যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে কোনো আন্তর্জাতিক জবাবদিহিতা না থাকায় প্রশ্ন উঠছে: জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা, এবং বিশ্ব বিবেক কি আজ নীরব দর্শক হয়ে গেছে?

ত্রাণ নয়, এখন ফিলিস্তিনের দরকার শান্তি, স্বাধীনতা এবং মর্যাদাপূর্ণ বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। মানবিকতা যদি গুলির আওয়াজে হারিয়ে যায়, তবে আমাদের সভ্যতাও প্রশ্নের মুখে।