ইলন মাস্কের ‘আমেরিকা পার্টি: যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা

- Update Time : ১১:১৯:০৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৬ জুলাই ২০২৫
- / ৩২ Time View
বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তি খাতের স্নায়ুকেন্দ্র ইলন মাস্ক এবার প্রবেশ করলেন সরাসরি রাজনীতির ময়দানে। টেসলা ও স্পেসএক্সের প্রধান নির্বাহী শনিবার (৫ জুলাই) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার)-এ ঘোষণা দেন, তিনি একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন, যার নাম ‘আমেরিকা পার্টি’। মাস্ক এই দলকে ঘোষণা করেন “আপনার স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার” হিসেবে।
এই ঘোষণাটি ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। যদিও হোয়াইট হাউস বা ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি, তবে রাজনীতিক ও বিশ্লেষকদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে।
জরিপ থেকে যাত্রা
নতুন দল গঠনের আগে মাস্ক এক্স-এ একটি জনমত জরিপ চালান, যেখানে প্রায় ১২ লাখ ব্যবহারকারী অংশ নেন। তিনি দাবি করেন, অংশগ্রহণকারীদের দুই-তৃতীয়াংশই মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যমান দুই-দলীয় রাজনৈতিক কাঠামোর বাইরে একটি নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম দরকার। এই জনমতের ভিত্তিতেই মাস্ক ‘আমেরিকা পার্টি’ গঠনের ঘোষণা দেন।
ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন
একসময় ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন ইলন মাস্ক। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তিনি সরকারি দক্ষতা বিভাগের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং প্রচারাভিযানে আর্থিক সহায়তাও দেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ ক্রমশ তীব্র হয়েছে।
মূলত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নতুন অর্থনৈতিক নীতি—বিশেষ করে ‘বিগ বিউটিফুল বিল’ নামক করছাড় ও সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির আইন নিয়ে মাস্কের অসন্তোষ প্রকাশ পায়। তিনি একে “যুক্তরাষ্ট্রকে দেউলিয়াত্বের পথে নিয়ে যাবে” বলেও মন্তব্য করেন।
পাল্টা হুমকি ও অর্থনৈতিক অভিঘাত
মাস্ক যখন ‘আমেরিকা পার্টি’ গঠনের ঘোষণা দেন এবং বিদ্যমান আইনপ্রণেতাদের নির্বাচনে হারানোর জন্য অর্থ ব্যয়ের প্রতিশ্রুতি দেন, তখন ট্রাম্প শিবির থেকেও পাল্টা হুমকি আসে। ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মহল থেকে বলা হয়, ফেডারেল ভর্তুকি ও কর সুবিধা বাতিল করে দেওয়া হতে পারে মাস্কের বিভিন্ন কোম্পানির জন্য।
এই দ্বন্দ্বের সরাসরি প্রতিফলন দেখা গেছে বাজারে। ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর টেসলার শেয়ারের দাম যেখানে ছিল ৪৮৮ ডলার, তা দ্রুত কমে গত সপ্তাহে ৩১৫ ডলারে নেমে আসে।
রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক দল গঠন ও সেটিকে মূলধারায় আনা সবসময়ই একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট—এই দুই দলের আধিপত্য চলে আসছে ১৬০ বছরের বেশি সময় ধরে। এদের বাইরে গঠিত বহু দলই টিকে থাকতে পারেনি। তবে মাস্কের বিশাল সম্পদ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রভাব এবং উদ্যোক্তা-খ্যাতির কারণে অনেকেই মনে করছেন, ‘আমেরিকা পার্টি’ অপ্রত্যাশিত সাড়া ফেলতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই নতুন দল যদি ২০২৬ সালের কংগ্রেস নির্বাচন কিংবা ২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, তাহলে তা রিপাবলিকানদের জন্য বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে—বিশেষত দক্ষিণপন্থি ভোট বিভাজনের আশঙ্কা থেকে।
মাস্কের রাজনৈতিক দর্শন
ইলন মাস্ক এর আগে বিভিন্ন সময় উদারনৈতিক ও রক্ষণশীল উভয় মতের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, সরকার হস্তক্ষেপের বিরোধিতা ও প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যৎ নির্মাণে বিশ্বাসী বলে বারবার জানিয়ে আসছেন।
‘আমেরিকা পার্টি’ নিয়ে তার ঘোষণাতেও এ বিষয়গুলো স্পষ্ট—যেখানে তিনি বলেন, “এই দল মানুষের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেবে এবং সরকারকে ছোট করবে, যেন ব্যক্তি ও উদ্যোক্তারা নতুন করে বিকশিত হতে পারেন।”
ভবিষ্যতের পথে
ইলন মাস্কের রাজনৈতিক পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করতে চলেছে। যদিও এটি কতটা কার্যকর হবে তা এখনো অনিশ্চিত, তবে এর মধ্য দিয়ে মার্কিন রাজনীতিতে একটি নতুন মেরুকরণ ও মতবিরোধের সূচনা হচ্ছে—বিশেষ করে প্রযুক্তি ও পুঁজির সংস্পর্শে গঠিত ‘উদ্যোক্তা রাজনীতি’র একটি রূপরেখা ফুটে উঠছে।
এই ‘আমেরিকা পার্টি’ কেবল মাস্কের রাজনৈতিক উচ্চাশার প্রতিফলন নয়, বরং এটি বর্তমান মার্কিন রাজনৈতিক কাঠামোর প্রতি জনগণের গভীর অসন্তোষ ও নতুন বিকল্পের সন্ধানেরও প্রতীক হয়ে উঠতে পারে। সময়ই বলে দেবে, মাস্কের এই পদক্ষেপ শুধুই আলোড়ন, নাকি একটি নতুন রাজনৈতিক যুগের সূচনা।
Please Share This Post in Your Social Media

ইলন মাস্কের ‘আমেরিকা পার্টি: যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা

বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তি খাতের স্নায়ুকেন্দ্র ইলন মাস্ক এবার প্রবেশ করলেন সরাসরি রাজনীতির ময়দানে। টেসলা ও স্পেসএক্সের প্রধান নির্বাহী শনিবার (৫ জুলাই) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার)-এ ঘোষণা দেন, তিনি একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন, যার নাম ‘আমেরিকা পার্টি’। মাস্ক এই দলকে ঘোষণা করেন “আপনার স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার” হিসেবে।
এই ঘোষণাটি ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। যদিও হোয়াইট হাউস বা ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি, তবে রাজনীতিক ও বিশ্লেষকদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে।
জরিপ থেকে যাত্রা
নতুন দল গঠনের আগে মাস্ক এক্স-এ একটি জনমত জরিপ চালান, যেখানে প্রায় ১২ লাখ ব্যবহারকারী অংশ নেন। তিনি দাবি করেন, অংশগ্রহণকারীদের দুই-তৃতীয়াংশই মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যমান দুই-দলীয় রাজনৈতিক কাঠামোর বাইরে একটি নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম দরকার। এই জনমতের ভিত্তিতেই মাস্ক ‘আমেরিকা পার্টি’ গঠনের ঘোষণা দেন।
ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন
একসময় ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন ইলন মাস্ক। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তিনি সরকারি দক্ষতা বিভাগের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং প্রচারাভিযানে আর্থিক সহায়তাও দেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ ক্রমশ তীব্র হয়েছে।
মূলত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নতুন অর্থনৈতিক নীতি—বিশেষ করে ‘বিগ বিউটিফুল বিল’ নামক করছাড় ও সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির আইন নিয়ে মাস্কের অসন্তোষ প্রকাশ পায়। তিনি একে “যুক্তরাষ্ট্রকে দেউলিয়াত্বের পথে নিয়ে যাবে” বলেও মন্তব্য করেন।
পাল্টা হুমকি ও অর্থনৈতিক অভিঘাত
মাস্ক যখন ‘আমেরিকা পার্টি’ গঠনের ঘোষণা দেন এবং বিদ্যমান আইনপ্রণেতাদের নির্বাচনে হারানোর জন্য অর্থ ব্যয়ের প্রতিশ্রুতি দেন, তখন ট্রাম্প শিবির থেকেও পাল্টা হুমকি আসে। ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মহল থেকে বলা হয়, ফেডারেল ভর্তুকি ও কর সুবিধা বাতিল করে দেওয়া হতে পারে মাস্কের বিভিন্ন কোম্পানির জন্য।
এই দ্বন্দ্বের সরাসরি প্রতিফলন দেখা গেছে বাজারে। ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর টেসলার শেয়ারের দাম যেখানে ছিল ৪৮৮ ডলার, তা দ্রুত কমে গত সপ্তাহে ৩১৫ ডলারে নেমে আসে।
রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক দল গঠন ও সেটিকে মূলধারায় আনা সবসময়ই একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট—এই দুই দলের আধিপত্য চলে আসছে ১৬০ বছরের বেশি সময় ধরে। এদের বাইরে গঠিত বহু দলই টিকে থাকতে পারেনি। তবে মাস্কের বিশাল সম্পদ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রভাব এবং উদ্যোক্তা-খ্যাতির কারণে অনেকেই মনে করছেন, ‘আমেরিকা পার্টি’ অপ্রত্যাশিত সাড়া ফেলতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই নতুন দল যদি ২০২৬ সালের কংগ্রেস নির্বাচন কিংবা ২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, তাহলে তা রিপাবলিকানদের জন্য বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে—বিশেষত দক্ষিণপন্থি ভোট বিভাজনের আশঙ্কা থেকে।
মাস্কের রাজনৈতিক দর্শন
ইলন মাস্ক এর আগে বিভিন্ন সময় উদারনৈতিক ও রক্ষণশীল উভয় মতের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, সরকার হস্তক্ষেপের বিরোধিতা ও প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যৎ নির্মাণে বিশ্বাসী বলে বারবার জানিয়ে আসছেন।
‘আমেরিকা পার্টি’ নিয়ে তার ঘোষণাতেও এ বিষয়গুলো স্পষ্ট—যেখানে তিনি বলেন, “এই দল মানুষের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেবে এবং সরকারকে ছোট করবে, যেন ব্যক্তি ও উদ্যোক্তারা নতুন করে বিকশিত হতে পারেন।”
ভবিষ্যতের পথে
ইলন মাস্কের রাজনৈতিক পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করতে চলেছে। যদিও এটি কতটা কার্যকর হবে তা এখনো অনিশ্চিত, তবে এর মধ্য দিয়ে মার্কিন রাজনীতিতে একটি নতুন মেরুকরণ ও মতবিরোধের সূচনা হচ্ছে—বিশেষ করে প্রযুক্তি ও পুঁজির সংস্পর্শে গঠিত ‘উদ্যোক্তা রাজনীতি’র একটি রূপরেখা ফুটে উঠছে।
এই ‘আমেরিকা পার্টি’ কেবল মাস্কের রাজনৈতিক উচ্চাশার প্রতিফলন নয়, বরং এটি বর্তমান মার্কিন রাজনৈতিক কাঠামোর প্রতি জনগণের গভীর অসন্তোষ ও নতুন বিকল্পের সন্ধানেরও প্রতীক হয়ে উঠতে পারে। সময়ই বলে দেবে, মাস্কের এই পদক্ষেপ শুধুই আলোড়ন, নাকি একটি নতুন রাজনৈতিক যুগের সূচনা।