প্রযুক্তির মঞ্চে ইরানি নারীদের দুর্দান্ত উত্থান: বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে ইরানের কন্যারা

- Update Time : ০৬:৪৩:৩২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৪ জুলাই ২০২৫
- / ৫১ Time View
আজকের বিশ্বে প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন মানেই কেবল পুরুষের ক্ষেত্র নয়—এই বাস্তবতাকে জোরালোভাবে প্রমাণ করে চলেছেন ইরানি নারীরা। মধ্যপ্রাচ্যের একটি ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ইরান, কিন্তু সেই দেশেই প্রযুক্তি, উদ্ভাবন এবং জ্ঞান-ভিত্তিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে নারীদের যে শক্তিশালী অগ্রযাত্রা, তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিস্ময় সৃষ্টি করছে।
বিশেষত গত কয়েক বছরে, ইরানি নারীদের উচ্চ প্রযুক্তির খাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সাফল্য কেবল দেশীয় ক্ষেত্রেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাগুলোতেও ইরানের নারীদের নেতৃত্বকে তুলে ধরেছে নতুন মাত্রায়।
নারী উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তির নেতৃত্বে সাফল্যের গল্প
২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত ব্রিকস নারী স্টার্টআপ প্রতিযোগিতা—একটি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম যেখানে ৩০টি দেশের হাজারো স্টার্টআপ অংশ নেয়—সে প্রতিযোগিতার মঞ্চে ইতিহাস গড়েছেন চারজন ইরানি নারী: আজম কারামি, মাহভাশ আবিয়ারি, মারজি ইব্রাহিমি, এবং ফাতেমে হোসেইনি।
তাঁদের উদ্ভাবনী প্রকল্পগুলো কেবল বিচারকদের মন জয় করেনি, বরং প্রতিযোগিতার জয়ীদের তালিকায় ইরানকে রাশিয়ার পরই দ্বিতীয় অবস্থানে নিয়ে আসে।
- আজম কারামি, যিনি টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেমে পিএইচডি করেছেন, পরিচালনা করছেন একটি জ্ঞানভিত্তিক কোম্পানি। তাঁর কোম্পানিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), রোবোটিক্স, ড্রোন প্রযুক্তি, রিমোট সেন্সিং, স্মার্ট পর্যবেক্ষণ ও IoT-এর মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে।
- ফাতেমে হোসেইনি এমন একটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় আছেন, যেটি স্নায়বিক রোগীদের জন্য উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর পণ্য তৈরি করে। বিশেষ করে তাদের তৈরি করা “Intelligent Spoon for Tremor Alleviation (ISTA)” মস্তিষ্কজনিত কাঁপুনির সমস্যায় ভোগা রোগীদের জন্য যুগান্তকারী উদ্ভাবন। এটি এমন একটি সেন্সরভিত্তিক চামচ, যা কাঁপুনির মাত্রা কমিয়ে খাওয়াকে সহজতর করে তোলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরে ইরানই এই প্রযুক্তি বাস্তবায়নকারী তৃতীয় দেশ।
- মারজিহ ইব্রাহিমি প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি স্টার্টআপ, যার কাজ ক্যান্সার ও অটোইমিউন রোগ প্রতিরোধে ইমিউন সেল ব্যাংক তৈরি করা। এই প্রকল্পটি স্বাস্থ্য খাতে ইরানের নবীন গবেষণা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার দৃষ্টান্ত।
- মাহভাশ আবিয়ারি উদ্ভাবন করেছেন একটি AI-চালিত ‘গ্লুকোজ মনিটরিং সিস্টেম’, যা রোগীর আচরণ বিশ্লেষণ করে নির্ভুল প্রেসক্রিপশন তৈরিতে চিকিৎসকদের সহায়তা করে।
এছাড়াও, নাফিসে হাতামি নামের একজন নারী উদ্যোক্তা একটি শক্তিশালী ডিজিটাল প্রমাণীকরণ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছেন, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং সর্বাধুনিক অ্যালগরিদম ব্যবহার করে ইরানে ডিজিটাল স্বাক্ষর এবং ডিজিটাল অর্থনীতির রূপান্তর ঘটাতে সফল হয়েছে।
জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে নারীদের উত্থান
ইরানে জ্ঞান–ভিত্তিক অর্থনীতি (Knowledge-based Economy)-তে নারীদের অংশগ্রহণ দ্রুত বাড়ছে। ইরানি ক্যালেন্ডারের বছর ১৪০০ (২০২১-২২) থেকে নারীদের ব্যবস্থাপনায় যুক্ত থাকার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। চলতি বছরে (ইরানি বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী) প্রথম ৯ মাসে এ সংখ্যা ১,০৯২ থেকে বেড়ে ২,২৫০-এ পৌঁছেছে।
যদিও এই অগ্রগতি প্রশংসনীয়, তবুও প্রযুক্তি খাতে নারীদের অংশগ্রহণ এখনো পুরুষদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। ইরানের জ্ঞান-ভিত্তিক কোম্পানিগুলোর পরিচালনা পর্ষদে মোট ২৭,২৩৭ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র ৫,১৫৪ জন নারী, যা মাত্র ১৯ শতাংশ। আর নতুন প্রতিষ্ঠিত প্রযুক্তি-ভিত্তিক কোম্পানির মধ্যে নারীদের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির হার মাত্র ১২ শতাংশ।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার দ্বৈরথ
ইরানের নারীরা প্রযুক্তি খাতে অগ্রসর হলেও এখনো বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও কাঠামোগত বাধা—যেমন লিঙ্গ বৈষম্য, বিনিয়োগে সীমাবদ্ধতা, উচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সুযোগের অভাব—এই সবই তাদের অগ্রযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে। তবে তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যেও যেভাবে ইরানি নারীরা নিজেদের উদ্ভাবনী শক্তি, দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বিশ্ব মঞ্চে স্থান করে নিচ্ছেন, তা নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণাদায়ী।
বিশ্বকে বার্তা
ইরানি নারীদের এই সাফল্য আন্তর্জাতিক মহলে একটি শক্তিশালী বার্তা পৌঁছে দিয়েছে—প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ কেবল সম্ভাবনাময়ই নয়, বরং তা বাস্তবিকভাবেই কার্যকর ও ফলপ্রসূ। অন্যান্য দেশগুলোর জন্য এটি একটি উদাহরণ, যেখানে এখনো নারীরা প্রযুক্তি খাতে পিছিয়ে রয়েছে।
ইরানের নারীরা আজ কেবল একজন ব্যবহারকারী হিসেবে প্রযুক্তির অংশ নন, বরং তারা প্রযুক্তির নির্মাতা, উদ্ভাবক এবং নীতিনির্ধারক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন। এই অগ্রযাত্রা শুধু ইরান নয়—সারা বিশ্বের নারীসমাজের জন্য একটি সাহসী ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তথ্য-প্রযুক্তি ও জ্ঞান-ভিত্তিক অর্থনীতিতে তাঁদের এই উত্থান আগামী দিনের সমাজকে আরও বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও উদ্ভাবনী করে তুলবে, এমনটাই প্রত্যাশা।
সূত্র: তেহরান টাইমস, BRICS Forum, ইরানি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ।
Please Share This Post in Your Social Media

প্রযুক্তির মঞ্চে ইরানি নারীদের দুর্দান্ত উত্থান: বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে ইরানের কন্যারা

আজকের বিশ্বে প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন মানেই কেবল পুরুষের ক্ষেত্র নয়—এই বাস্তবতাকে জোরালোভাবে প্রমাণ করে চলেছেন ইরানি নারীরা। মধ্যপ্রাচ্যের একটি ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ইরান, কিন্তু সেই দেশেই প্রযুক্তি, উদ্ভাবন এবং জ্ঞান-ভিত্তিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে নারীদের যে শক্তিশালী অগ্রযাত্রা, তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিস্ময় সৃষ্টি করছে।
বিশেষত গত কয়েক বছরে, ইরানি নারীদের উচ্চ প্রযুক্তির খাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সাফল্য কেবল দেশীয় ক্ষেত্রেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাগুলোতেও ইরানের নারীদের নেতৃত্বকে তুলে ধরেছে নতুন মাত্রায়।
নারী উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তির নেতৃত্বে সাফল্যের গল্প
২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত ব্রিকস নারী স্টার্টআপ প্রতিযোগিতা—একটি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম যেখানে ৩০টি দেশের হাজারো স্টার্টআপ অংশ নেয়—সে প্রতিযোগিতার মঞ্চে ইতিহাস গড়েছেন চারজন ইরানি নারী: আজম কারামি, মাহভাশ আবিয়ারি, মারজি ইব্রাহিমি, এবং ফাতেমে হোসেইনি।
তাঁদের উদ্ভাবনী প্রকল্পগুলো কেবল বিচারকদের মন জয় করেনি, বরং প্রতিযোগিতার জয়ীদের তালিকায় ইরানকে রাশিয়ার পরই দ্বিতীয় অবস্থানে নিয়ে আসে।
- আজম কারামি, যিনি টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেমে পিএইচডি করেছেন, পরিচালনা করছেন একটি জ্ঞানভিত্তিক কোম্পানি। তাঁর কোম্পানিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), রোবোটিক্স, ড্রোন প্রযুক্তি, রিমোট সেন্সিং, স্মার্ট পর্যবেক্ষণ ও IoT-এর মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে।
- ফাতেমে হোসেইনি এমন একটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় আছেন, যেটি স্নায়বিক রোগীদের জন্য উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর পণ্য তৈরি করে। বিশেষ করে তাদের তৈরি করা “Intelligent Spoon for Tremor Alleviation (ISTA)” মস্তিষ্কজনিত কাঁপুনির সমস্যায় ভোগা রোগীদের জন্য যুগান্তকারী উদ্ভাবন। এটি এমন একটি সেন্সরভিত্তিক চামচ, যা কাঁপুনির মাত্রা কমিয়ে খাওয়াকে সহজতর করে তোলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরে ইরানই এই প্রযুক্তি বাস্তবায়নকারী তৃতীয় দেশ।
- মারজিহ ইব্রাহিমি প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি স্টার্টআপ, যার কাজ ক্যান্সার ও অটোইমিউন রোগ প্রতিরোধে ইমিউন সেল ব্যাংক তৈরি করা। এই প্রকল্পটি স্বাস্থ্য খাতে ইরানের নবীন গবেষণা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার দৃষ্টান্ত।
- মাহভাশ আবিয়ারি উদ্ভাবন করেছেন একটি AI-চালিত ‘গ্লুকোজ মনিটরিং সিস্টেম’, যা রোগীর আচরণ বিশ্লেষণ করে নির্ভুল প্রেসক্রিপশন তৈরিতে চিকিৎসকদের সহায়তা করে।
এছাড়াও, নাফিসে হাতামি নামের একজন নারী উদ্যোক্তা একটি শক্তিশালী ডিজিটাল প্রমাণীকরণ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছেন, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং সর্বাধুনিক অ্যালগরিদম ব্যবহার করে ইরানে ডিজিটাল স্বাক্ষর এবং ডিজিটাল অর্থনীতির রূপান্তর ঘটাতে সফল হয়েছে।
জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে নারীদের উত্থান
ইরানে জ্ঞান–ভিত্তিক অর্থনীতি (Knowledge-based Economy)-তে নারীদের অংশগ্রহণ দ্রুত বাড়ছে। ইরানি ক্যালেন্ডারের বছর ১৪০০ (২০২১-২২) থেকে নারীদের ব্যবস্থাপনায় যুক্ত থাকার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। চলতি বছরে (ইরানি বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী) প্রথম ৯ মাসে এ সংখ্যা ১,০৯২ থেকে বেড়ে ২,২৫০-এ পৌঁছেছে।
যদিও এই অগ্রগতি প্রশংসনীয়, তবুও প্রযুক্তি খাতে নারীদের অংশগ্রহণ এখনো পুরুষদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। ইরানের জ্ঞান-ভিত্তিক কোম্পানিগুলোর পরিচালনা পর্ষদে মোট ২৭,২৩৭ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র ৫,১৫৪ জন নারী, যা মাত্র ১৯ শতাংশ। আর নতুন প্রতিষ্ঠিত প্রযুক্তি-ভিত্তিক কোম্পানির মধ্যে নারীদের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির হার মাত্র ১২ শতাংশ।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার দ্বৈরথ
ইরানের নারীরা প্রযুক্তি খাতে অগ্রসর হলেও এখনো বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও কাঠামোগত বাধা—যেমন লিঙ্গ বৈষম্য, বিনিয়োগে সীমাবদ্ধতা, উচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সুযোগের অভাব—এই সবই তাদের অগ্রযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে। তবে তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যেও যেভাবে ইরানি নারীরা নিজেদের উদ্ভাবনী শক্তি, দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বিশ্ব মঞ্চে স্থান করে নিচ্ছেন, তা নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণাদায়ী।
বিশ্বকে বার্তা
ইরানি নারীদের এই সাফল্য আন্তর্জাতিক মহলে একটি শক্তিশালী বার্তা পৌঁছে দিয়েছে—প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ কেবল সম্ভাবনাময়ই নয়, বরং তা বাস্তবিকভাবেই কার্যকর ও ফলপ্রসূ। অন্যান্য দেশগুলোর জন্য এটি একটি উদাহরণ, যেখানে এখনো নারীরা প্রযুক্তি খাতে পিছিয়ে রয়েছে।
ইরানের নারীরা আজ কেবল একজন ব্যবহারকারী হিসেবে প্রযুক্তির অংশ নন, বরং তারা প্রযুক্তির নির্মাতা, উদ্ভাবক এবং নীতিনির্ধারক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন। এই অগ্রযাত্রা শুধু ইরান নয়—সারা বিশ্বের নারীসমাজের জন্য একটি সাহসী ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তথ্য-প্রযুক্তি ও জ্ঞান-ভিত্তিক অর্থনীতিতে তাঁদের এই উত্থান আগামী দিনের সমাজকে আরও বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও উদ্ভাবনী করে তুলবে, এমনটাই প্রত্যাশা।
সূত্র: তেহরান টাইমস, BRICS Forum, ইরানি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ।