প্রশাসনে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতিফলন নেই, আওয়ামী-ফ্যাসিবাদী আমলাদের তালিকা এখনো প্রকাশ হয়নি

- Update Time : ০৭:২৫:৫৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই ২০২৫
- / ১০৮ Time View
জুলাই ছিল দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এক অবিস্মরণীয় ডাক, যেখানে জনতার জাগরণ নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি বহন করেছিল। তবে সেই আন্দোলনের চেতনার প্রতিফলন প্রশাসনে আজও দেখা যায় না; বরং মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে এখনো গণহত্যা ও ফ্যাসিবাদ কায়েমের সহযোগী কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন। গত দশ মাসে বর্তমান সরকার ফ্যাসিবাদী আমলাদের কোনো তালিকা প্রকাশ করেনি, বরং তাঁদেরই জেলা-উপজেলা প্রশাসন, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব, উপসচিব, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা বিদেশি দূতাবাসে নিয়োগ ও বদলির সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে জুলাই মঞ্চ প্রশাসনে গণহত্যা ও ফ্যাসিবাদ কায়েমে সহযোগী ৪৪ জন আমলার অপসারণের দাবি জানিয়ে আবেদন করেছে। এ ছাড়া ২৯তম বিসিএসের নিয়োগ সম্পন্ন হওয়ার ১৩ মাস পর ‘ভুয়া ক্যাডারদের’ নিয়োগের সুপারিশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যে গেজেট প্রকাশ করে, সেটি তৎকালীন সিনিয়র সচিব আবদুস সোবহান সিকদার কর্তৃক স্বাক্ষরিত ছিল।
এরই মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রশাসনে অনিয়ম ও ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িত ২১ জন কর্মকর্তাকে শনাক্ত করলেও ফ্যাসিস্ট আমলাদের নিয়োগ থেমে নেই। এ অবস্থায় প্রশাসনে গণহত্যা ও ফ্যাসিবাদ কায়েমে সহায়তাকারী সুবিধাভোগী সচিবদের দ্রুত অপসারণ এবং সব ধরনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের দাবিতে উপদেষ্টা বরাবর চিঠি দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম। গত ২০ মে এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত উপদেষ্টা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। এদিকে আজ বৃহস্পতিবার অথবা আগামী সপ্তাহে সচিব পদে নতুন নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, যেখানে আবারও ফ্যাসিবাদী সরকারের ঘনিষ্ঠ আমলাদের পদোন্নতির জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের’ বর্ষপূর্তিতে মাসব্যাপী কর্মসূচির উদ্বোধনকালে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, গত বছরের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থান আমাদের মুক্তির স্বাদ দিয়েছিল এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এক অমোঘ ডাক ছিল। সেই আন্দোলনের মূল কথা ছিল—ফ্যাসিবাদ বিলোপ করে জনগণের হাতে রাষ্ট্র ফিরিয়ে দেওয়া। তিনি বলেন, ২৪-এর জুলাই আমাদের ইতিহাসের এক অম্লান স্মৃতি, যা একই সঙ্গে বেদনা ও প্রতিজ্ঞার প্রতীক। স্বাধীন দেশে নির্দিষ্ট সময়কালে এত তরুণের আত্মহুতির পরও সংস্কার ও বিচার না হওয়া আরও গভীর কষ্টের সৃষ্টি করে। তবে সরকার ইতোমধ্যে প্রশাসন থেকে ফ্যাসিবাদী আমলাদের অপসারণে জুলাই মাস থেকেই পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বলে জনপ্রশাসন ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র নিশ্চিত করেছে। সচিব পদে পদায়নের জন্য একটি ফিটলিস্ট তৈরি করা হয়েছে, এবং আজ বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সভায় তা চূড়ান্ত করার কথা রয়েছে।
এছাড়া প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করায় লালমনিরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সাবেক সহকারী কমিশনার তাপসী তাবাসসুম উর্মিকে গতকাল বুধবার সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে; এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনও জারি হয়েছে। এ বিষয়ে ইনকিলাবকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান বলেন, “আসলে সব কিছু একবারে করা যায় না। সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের কাজ চলমান রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে প্রশাসনের দৈনন্দিন কাজ এবং পদোন্নতির প্রক্রিয়াও এগিয়ে চলছে। শিগগিরই শূন্য থাকা সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে চারটি সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং আরও হবে। আমরা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় যোগ্য ও বঞ্চিতদের মধ্য থেকে কর্মকর্তাদের নির্বাচন করছি এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিফলন বাস্তবায়নের জন্য ধারাবাহিকভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।”
এদিকে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের ১০ মাস পার হলেও এখনো পর্যন্ত জুলাই বিপ্লবের কোনো পূর্ণ স্বীকৃতি বাস্তবায়ন হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলার বিচার করার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে সেই উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। প্রশাসনে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত কিছু কর্মকর্তাকে অবসর দেওয়া ও কিছুজনকে ওএসডি করলেও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ এখনো ফ্যাসিবাদী আমলাদের হাতেই। পতিত স্বৈরাচার সরকারের আমলে গত ১৫ বছর বঞ্চিত থাকা কর্মকর্তারা এখনো পদোন্নতির স্বপ্ন নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, অন্যদিকে সুবিধাভোগী আমলারা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও পদ দখল করে রয়েছেন। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারসহ ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে—পদমর্যাদা, সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তারা পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন। স্বৈরাচার সরকারের সময়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, বঞ্চিতদের কম গুরুত্ব দেওয়া, কর্মকর্তাদের সন্দেহের চোখে দেখা, দায়িত্বের চেয়ার হারানোর আতঙ্ক—এসবই প্রশাসনে এক অস্থিরতা তৈরি করেছে। সর্বশেষ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগ থেকে বিএনপি-জামায়াত ঘরানার কয়েকজন কর্মকর্তাকে সরিয়ে ফ্যাসিবাদপন্থী কর্মকর্তাদের পদায়নের অভিযোগ উঠেছে, যার পেছনে সরাসরি সংশ্লিষ্ট রয়েছেন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব।
জানা গেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে বর্তমানে ৯টি সচিব পদ শূন্য রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে এসব পদ পূরণে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় নিয়োগ বিলম্বিত হচ্ছে, যার ফলে ওইসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে অতিরিক্ত সচিবদের দিয়ে রুটিন দায়িত্বে পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু পূর্ণ সচিবের অভাবে দপ্তরগুলোর কার্যক্রমে দক্ষতার ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, ফলে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ধীরগতির হয়ে পড়েছে। এতে করে মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি বঞ্চিত হচ্ছেন এবং কেউ কেউ হতাশ হয়ে অবসরে চলে যাচ্ছেন। উল্লেখ্য, গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী সরকার পতনের আগেও অনেক কর্মকর্তা রাজনৈতিক কারণে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। তারা আশা করেছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি পাবেন। কিন্তু অজানা কারণে সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। যদিও সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) সচিব পদে পদোন্নতির জন্য এক ডজন অতিরিক্ত সচিবের নাম অন্তর্ভুক্ত করে একটি ‘ফিটলিস্ট’ তৈরি করেছে, তবে এখনো পর্যন্ত সেই তালিকার অনুমোদন না মেলায় পদোন্নতির প্রক্রিয়া থমকে আছে।
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিব পদ শূন্য থাকায় প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে, যা সরকারের সামগ্রিক সক্ষমতা ও ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সচিব পদে যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতির সুযোগ না পেয়ে অবসরে চলে যাচ্ছেন, এতে করে প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ দক্ষতা হ্রাস পাচ্ছে এবং নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে শূন্য পদে দ্রুত সচিব নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে সম্প্রতি জনপ্রশাসন বিষয়ক কমিটির সভাপতি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে একটি ডিও লেটার পাঠিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, গত ৮ জানুয়ারি গঠিত জনপ্রশাসন বিষয়ক কমিটির অন্যতম দায়িত্ব ছিল সচিব পদায়নের সুপারিশ প্রণয়ন, এবং সেই অনুযায়ী একটি ‘ফিটলিস্ট’ও তৈরি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড, ভূমি আপিল বোর্ড, জাতীয় উন্নয়ন প্রশাসন একাডেমি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, জাতীয় সংসদ সচিবালয়সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও সংস্থায় সচিব পদ শূন্য রয়েছে, যেগুলোতে শিগগিরই নিয়োগ দেওয়া হতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে।
সুত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব
Please Share This Post in Your Social Media

প্রশাসনে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতিফলন নেই, আওয়ামী-ফ্যাসিবাদী আমলাদের তালিকা এখনো প্রকাশ হয়নি

জুলাই ছিল দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এক অবিস্মরণীয় ডাক, যেখানে জনতার জাগরণ নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি বহন করেছিল। তবে সেই আন্দোলনের চেতনার প্রতিফলন প্রশাসনে আজও দেখা যায় না; বরং মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে এখনো গণহত্যা ও ফ্যাসিবাদ কায়েমের সহযোগী কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন। গত দশ মাসে বর্তমান সরকার ফ্যাসিবাদী আমলাদের কোনো তালিকা প্রকাশ করেনি, বরং তাঁদেরই জেলা-উপজেলা প্রশাসন, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব, উপসচিব, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা বিদেশি দূতাবাসে নিয়োগ ও বদলির সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে জুলাই মঞ্চ প্রশাসনে গণহত্যা ও ফ্যাসিবাদ কায়েমে সহযোগী ৪৪ জন আমলার অপসারণের দাবি জানিয়ে আবেদন করেছে। এ ছাড়া ২৯তম বিসিএসের নিয়োগ সম্পন্ন হওয়ার ১৩ মাস পর ‘ভুয়া ক্যাডারদের’ নিয়োগের সুপারিশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যে গেজেট প্রকাশ করে, সেটি তৎকালীন সিনিয়র সচিব আবদুস সোবহান সিকদার কর্তৃক স্বাক্ষরিত ছিল।
এরই মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রশাসনে অনিয়ম ও ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িত ২১ জন কর্মকর্তাকে শনাক্ত করলেও ফ্যাসিস্ট আমলাদের নিয়োগ থেমে নেই। এ অবস্থায় প্রশাসনে গণহত্যা ও ফ্যাসিবাদ কায়েমে সহায়তাকারী সুবিধাভোগী সচিবদের দ্রুত অপসারণ এবং সব ধরনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের দাবিতে উপদেষ্টা বরাবর চিঠি দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম। গত ২০ মে এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত উপদেষ্টা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। এদিকে আজ বৃহস্পতিবার অথবা আগামী সপ্তাহে সচিব পদে নতুন নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, যেখানে আবারও ফ্যাসিবাদী সরকারের ঘনিষ্ঠ আমলাদের পদোন্নতির জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের’ বর্ষপূর্তিতে মাসব্যাপী কর্মসূচির উদ্বোধনকালে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, গত বছরের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থান আমাদের মুক্তির স্বাদ দিয়েছিল এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এক অমোঘ ডাক ছিল। সেই আন্দোলনের মূল কথা ছিল—ফ্যাসিবাদ বিলোপ করে জনগণের হাতে রাষ্ট্র ফিরিয়ে দেওয়া। তিনি বলেন, ২৪-এর জুলাই আমাদের ইতিহাসের এক অম্লান স্মৃতি, যা একই সঙ্গে বেদনা ও প্রতিজ্ঞার প্রতীক। স্বাধীন দেশে নির্দিষ্ট সময়কালে এত তরুণের আত্মহুতির পরও সংস্কার ও বিচার না হওয়া আরও গভীর কষ্টের সৃষ্টি করে। তবে সরকার ইতোমধ্যে প্রশাসন থেকে ফ্যাসিবাদী আমলাদের অপসারণে জুলাই মাস থেকেই পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বলে জনপ্রশাসন ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র নিশ্চিত করেছে। সচিব পদে পদায়নের জন্য একটি ফিটলিস্ট তৈরি করা হয়েছে, এবং আজ বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সভায় তা চূড়ান্ত করার কথা রয়েছে।
এছাড়া প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করায় লালমনিরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সাবেক সহকারী কমিশনার তাপসী তাবাসসুম উর্মিকে গতকাল বুধবার সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে; এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনও জারি হয়েছে। এ বিষয়ে ইনকিলাবকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান বলেন, “আসলে সব কিছু একবারে করা যায় না। সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের কাজ চলমান রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে প্রশাসনের দৈনন্দিন কাজ এবং পদোন্নতির প্রক্রিয়াও এগিয়ে চলছে। শিগগিরই শূন্য থাকা সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে চারটি সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং আরও হবে। আমরা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় যোগ্য ও বঞ্চিতদের মধ্য থেকে কর্মকর্তাদের নির্বাচন করছি এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিফলন বাস্তবায়নের জন্য ধারাবাহিকভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।”
এদিকে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের ১০ মাস পার হলেও এখনো পর্যন্ত জুলাই বিপ্লবের কোনো পূর্ণ স্বীকৃতি বাস্তবায়ন হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলার বিচার করার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে সেই উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। প্রশাসনে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত কিছু কর্মকর্তাকে অবসর দেওয়া ও কিছুজনকে ওএসডি করলেও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ এখনো ফ্যাসিবাদী আমলাদের হাতেই। পতিত স্বৈরাচার সরকারের আমলে গত ১৫ বছর বঞ্চিত থাকা কর্মকর্তারা এখনো পদোন্নতির স্বপ্ন নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, অন্যদিকে সুবিধাভোগী আমলারা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও পদ দখল করে রয়েছেন। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারসহ ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে—পদমর্যাদা, সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তারা পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন। স্বৈরাচার সরকারের সময়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, বঞ্চিতদের কম গুরুত্ব দেওয়া, কর্মকর্তাদের সন্দেহের চোখে দেখা, দায়িত্বের চেয়ার হারানোর আতঙ্ক—এসবই প্রশাসনে এক অস্থিরতা তৈরি করেছে। সর্বশেষ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগ থেকে বিএনপি-জামায়াত ঘরানার কয়েকজন কর্মকর্তাকে সরিয়ে ফ্যাসিবাদপন্থী কর্মকর্তাদের পদায়নের অভিযোগ উঠেছে, যার পেছনে সরাসরি সংশ্লিষ্ট রয়েছেন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব।
জানা গেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে বর্তমানে ৯টি সচিব পদ শূন্য রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে এসব পদ পূরণে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় নিয়োগ বিলম্বিত হচ্ছে, যার ফলে ওইসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে অতিরিক্ত সচিবদের দিয়ে রুটিন দায়িত্বে পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু পূর্ণ সচিবের অভাবে দপ্তরগুলোর কার্যক্রমে দক্ষতার ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, ফলে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ধীরগতির হয়ে পড়েছে। এতে করে মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি বঞ্চিত হচ্ছেন এবং কেউ কেউ হতাশ হয়ে অবসরে চলে যাচ্ছেন। উল্লেখ্য, গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী সরকার পতনের আগেও অনেক কর্মকর্তা রাজনৈতিক কারণে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। তারা আশা করেছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি পাবেন। কিন্তু অজানা কারণে সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। যদিও সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) সচিব পদে পদোন্নতির জন্য এক ডজন অতিরিক্ত সচিবের নাম অন্তর্ভুক্ত করে একটি ‘ফিটলিস্ট’ তৈরি করেছে, তবে এখনো পর্যন্ত সেই তালিকার অনুমোদন না মেলায় পদোন্নতির প্রক্রিয়া থমকে আছে।
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিব পদ শূন্য থাকায় প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে, যা সরকারের সামগ্রিক সক্ষমতা ও ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সচিব পদে যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতির সুযোগ না পেয়ে অবসরে চলে যাচ্ছেন, এতে করে প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ দক্ষতা হ্রাস পাচ্ছে এবং নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে শূন্য পদে দ্রুত সচিব নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে সম্প্রতি জনপ্রশাসন বিষয়ক কমিটির সভাপতি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে একটি ডিও লেটার পাঠিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, গত ৮ জানুয়ারি গঠিত জনপ্রশাসন বিষয়ক কমিটির অন্যতম দায়িত্ব ছিল সচিব পদায়নের সুপারিশ প্রণয়ন, এবং সেই অনুযায়ী একটি ‘ফিটলিস্ট’ও তৈরি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড, ভূমি আপিল বোর্ড, জাতীয় উন্নয়ন প্রশাসন একাডেমি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, জাতীয় সংসদ সচিবালয়সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও সংস্থায় সচিব পদ শূন্য রয়েছে, যেগুলোতে শিগগিরই নিয়োগ দেওয়া হতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে।
সুত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব