বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাপের মুখে পটিয়া থানার ওসি প্রত্যাহার

- Update Time : ০৬:৫৫:৪১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই ২০২৫
- / ৫৬ Time View
চট্টগ্রামের পটিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জায়েদ মো. নাজমুন নূরকে অবশেষে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বুধবার (২ জুলাই) রাত সাড়ে ১০টার দিকে তাকে চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়। তার স্থলে চন্দনাইশ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) যুযুৎসু চাকমাকে পটিয়ার নতুন ওসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) লাগাতার আন্দোলনের মুখে পুলিশের এই সিদ্ধান্ত আসে। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
৯ ঘণ্টার মহাসড়ক অবরোধে চরম ভোগান্তি
বুধবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে শুরু করে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়ার ইন্দ্রপুল এলাকায় সড়ক অবরোধ করে রাখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। প্রায় ৯ ঘণ্টা ধরে মহাসড়ক অবরোধ থাকায় দুই পাশে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট। এতে অসংখ্য যাত্রী চরম ভোগান্তির শিকার হন, বিশেষ করে অ্যাম্বুলেন্স ও দূরপাল্লার বাসযাত্রীদের দুর্ভোগ সীমাহীন হয়।
এনসিপির শহরের অবরোধ
একই সময়, বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীর জাকির হোসেন সড়কে অবস্থান নেয় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর নেতাকর্মীরা। তারা ওসি নাজমুন নূরের অপসারণ ও শাস্তির দাবিতে ব্যানার-প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ করেন।
ঘটনার পেছনের প্রেক্ষাপট
বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে গত মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে, পটিয়ার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে থেকে দীপঙ্কর দে (২৯) নামের ছাত্রলীগের এক কর্মীকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা আটক করার মধ্য দিয়ে। পরে তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হলেও পুলিশ তার বিরুদ্ধে মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায়, কারণ তার বিরুদ্ধে আগে থেকে কোনো অভিযোগ বা মামলা ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে উত্তেজনা বাড়ে এবং আন্দোলনকারীরা পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব ও দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ তোলেন। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, দীপঙ্করকে থানায় আনার সময় আন্দোলনকারীরা তাকে মারধর করছিলেন এবং থানার ভেতরে একপ্রকার ‘মব’ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। পুলিশ দাবি করে, তারা আইনের ভেতরে থেকেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
পুলিশের লাঠিচার্জ ও আহতরা
অভিযোগ রয়েছে, উত্তেজনার একপর্যায়ে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠিচার্জ করে, যাতে অন্তত কয়েকজন গুরুতর আহত হন। আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয় স্থানীয়ভাবে, তবে কেউ কেউ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন।
প্রশাসনের সিদ্ধান্ত ও পরবর্তী পদক্ষেপ
আন্দোলনকারীদের দাবির মুখে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ দ্রুত পদক্ষেপ নেয় এবং ওসি নাজমুন নূরকে প্রত্যাহার করে ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত করে। তার স্থানে দায়িত্ব দেওয়া হয় যুযুৎসু চাকমাকে, যিনি এর আগে চন্দনাইশ থানায় তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
এই পদায়নকে প্রশাসনের একটি কৌশলী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা পরিস্থিতি শান্ত করতে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজনৈতিক ও নাগরিক প্রতিক্রিয়া
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক নেতা বলেন, “আমরা পুলিশের নিরপেক্ষতা চাই। একটি নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্যকে রক্ষা করতে গিয়ে পুলিশ আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। আমরা তার শাস্তি চেয়েছিলাম, অবশেষে সেটাই হয়েছে।”
জাতীয় নাগরিক পার্টির এক সিনিয়র সদস্য বলেন, “জনগণের আন্দোলনের মুখে প্রশাসন পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। এটা গণতান্ত্রিক চেতনার বিজয়।”
শেষ কথা
এই ঘটনায় স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে, যদি কোনো প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ জনগণের দাবিকে অবজ্ঞা করে, তবে সম্মিলিত আন্দোলনই পারে তা পরিবর্তন করতে। ওসি নাজমুন নূরের প্রত্যাহার যেন প্রশাসনের প্রতি একটি বার্তা—জনগণের স্বার্থই শেষ কথা।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, শুধুই কি ওসি প্রত্যাহারে সমাধান হবে? না কি এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা জরুরি? তা সময়ই বলে দেবে।
Please Share This Post in Your Social Media

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাপের মুখে পটিয়া থানার ওসি প্রত্যাহার

চট্টগ্রামের পটিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জায়েদ মো. নাজমুন নূরকে অবশেষে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বুধবার (২ জুলাই) রাত সাড়ে ১০টার দিকে তাকে চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়। তার স্থলে চন্দনাইশ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) যুযুৎসু চাকমাকে পটিয়ার নতুন ওসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) লাগাতার আন্দোলনের মুখে পুলিশের এই সিদ্ধান্ত আসে। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
৯ ঘণ্টার মহাসড়ক অবরোধে চরম ভোগান্তি
বুধবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে শুরু করে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়ার ইন্দ্রপুল এলাকায় সড়ক অবরোধ করে রাখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। প্রায় ৯ ঘণ্টা ধরে মহাসড়ক অবরোধ থাকায় দুই পাশে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট। এতে অসংখ্য যাত্রী চরম ভোগান্তির শিকার হন, বিশেষ করে অ্যাম্বুলেন্স ও দূরপাল্লার বাসযাত্রীদের দুর্ভোগ সীমাহীন হয়।
এনসিপির শহরের অবরোধ
একই সময়, বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীর জাকির হোসেন সড়কে অবস্থান নেয় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর নেতাকর্মীরা। তারা ওসি নাজমুন নূরের অপসারণ ও শাস্তির দাবিতে ব্যানার-প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ করেন।
ঘটনার পেছনের প্রেক্ষাপট
বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে গত মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে, পটিয়ার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে থেকে দীপঙ্কর দে (২৯) নামের ছাত্রলীগের এক কর্মীকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা আটক করার মধ্য দিয়ে। পরে তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হলেও পুলিশ তার বিরুদ্ধে মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায়, কারণ তার বিরুদ্ধে আগে থেকে কোনো অভিযোগ বা মামলা ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে উত্তেজনা বাড়ে এবং আন্দোলনকারীরা পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব ও দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ তোলেন। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, দীপঙ্করকে থানায় আনার সময় আন্দোলনকারীরা তাকে মারধর করছিলেন এবং থানার ভেতরে একপ্রকার ‘মব’ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। পুলিশ দাবি করে, তারা আইনের ভেতরে থেকেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
পুলিশের লাঠিচার্জ ও আহতরা
অভিযোগ রয়েছে, উত্তেজনার একপর্যায়ে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠিচার্জ করে, যাতে অন্তত কয়েকজন গুরুতর আহত হন। আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয় স্থানীয়ভাবে, তবে কেউ কেউ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন।
প্রশাসনের সিদ্ধান্ত ও পরবর্তী পদক্ষেপ
আন্দোলনকারীদের দাবির মুখে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ দ্রুত পদক্ষেপ নেয় এবং ওসি নাজমুন নূরকে প্রত্যাহার করে ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত করে। তার স্থানে দায়িত্ব দেওয়া হয় যুযুৎসু চাকমাকে, যিনি এর আগে চন্দনাইশ থানায় তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
এই পদায়নকে প্রশাসনের একটি কৌশলী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা পরিস্থিতি শান্ত করতে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজনৈতিক ও নাগরিক প্রতিক্রিয়া
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক নেতা বলেন, “আমরা পুলিশের নিরপেক্ষতা চাই। একটি নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্যকে রক্ষা করতে গিয়ে পুলিশ আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। আমরা তার শাস্তি চেয়েছিলাম, অবশেষে সেটাই হয়েছে।”
জাতীয় নাগরিক পার্টির এক সিনিয়র সদস্য বলেন, “জনগণের আন্দোলনের মুখে প্রশাসন পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। এটা গণতান্ত্রিক চেতনার বিজয়।”
শেষ কথা
এই ঘটনায় স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে, যদি কোনো প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ জনগণের দাবিকে অবজ্ঞা করে, তবে সম্মিলিত আন্দোলনই পারে তা পরিবর্তন করতে। ওসি নাজমুন নূরের প্রত্যাহার যেন প্রশাসনের প্রতি একটি বার্তা—জনগণের স্বার্থই শেষ কথা।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, শুধুই কি ওসি প্রত্যাহারে সমাধান হবে? না কি এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা জরুরি? তা সময়ই বলে দেবে।