ইবি শিক্ষক ড. আজিজুল ইসলামের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ, ১২ ছাত্রী লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন

- Update Time : ০২:০০:১১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২ জুলাই ২০২৫
- / ৫৮ Time View
কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) আবারও শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির গুরুতর অভিযোগ উঠে এসেছে। বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আজিজুল ইসলামের বিরুদ্ধে অন্তত ১২ জন ছাত্রী লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রীদের প্রতি কুরুচিপূর্ণ, অশালীন ও ভয়ভীতিমূলক আচরণ করে আসছেন।
গত ২২ জুন বিভাগের সভাপতি বরাবর অভিযোগপত্র জমা দেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা। ১ জুলাই বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা তৈরি করে।
ভিডিও কল করে শারীরিক গঠন দেখতে চাওয়া
অভিযোগপত্রে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের এক ছাত্রী বলেন, “স্যার আমাকে ইমোতে ভিডিও কল দেন। আমি রিসিভ না করায় পরে অডিও কল করেন। তখন বলেন, ‘অনেকদিন তোমাদের দেখি না, মোটা হয়েছো না চিকন হয়েছো দেখতে ভিডিও কল দিচ্ছি।’ এরপর বলেন, ‘তোমার কি কথা বলার কেউ আছে?’ আমি বলি, ‘না’। তখন তিনি মন্তব্য করেন, ‘এখন বলছো কেউ নেই, কিছুদিন পর দেখি ক্যাম্পাসে কোনো ছেলের হাত ধরে ঘুরছো।’”
ওই ছাত্রী আরও বলেন, “স্যার ক্লাসে বিভিন্ন সময় ইঙ্গিতপূর্ণ ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন। আমার উচ্চতা নিয়ে অশ্লীল রসিকতা করেন। বিবাহিত হওয়ায় স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও অপমানজনক মন্তব্য করেন। এমনকি মেন্সট্রুয়েশন সাইকেল নিয়েও আমাকে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে ব্যঙ্গ করেন। এভাবে ক্লাসে বারবার হেনস্তার পাশাপাশি হুমকি দেন যে, তার কোর্সে ভালো রেজাল্ট পাবো না।”
অভিযোগের বিবরণ: ভয়, হুমকি ও বডি শেমিং
শুধু একজন নয়, একাধিক ছাত্রী অভিযোগ করেছেন, আজিজুল ইসলাম নিয়মিতই হোয়াটসঅ্যাপে কুরুচিপূর্ণ বার্তা পাঠাতেন। ইচ্ছাকৃতভাবে পরীক্ষা ও অ্যাসাইনমেন্টে নম্বর কমিয়ে দিতেন। নিজের অফিস কক্ষে ডেকে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে অপ্রাসঙ্গিক ও আপত্তিকর প্রশ্ন করতেন। অনেক সময় রাতে ভিডিও কল দিতেন, কল না ধরলে পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট দেওয়ার হুমকি দিতেন। বিবাহিত ছাত্রীদের বৈবাহিক জীবন নিয়েও অবমাননাকর মন্তব্য করতেন।
তাদের অভিযোগ, এই শিক্ষক নিজের পছন্দের ছাত্রীদের প্রজেক্টে কাজ করতে জোর করতেন এবং নানা উপায়ে বডি শেমিং করতেন। এতদিন এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। তবে একসঙ্গে একাধিক ছাত্রী অভিযোগ করায় বিষয়টি গুরুতর রূপ নিয়েছে।
অভিযুক্ত শিক্ষকের বক্তব্য: “ষড়যন্ত্রের শিকার”
অভিযোগের বিষয়ে ড. আজিজুল ইসলাম বলেন, “আমি কাউকে হেনস্তা করিনি। কেউ আমার কথাবার্তাকে ভুলভাবে নিয়েছে। এটা পরিকল্পিতভাবে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। আমি হয়তো কখন কী বলেছি, তা মনে করতে পারছি না। বিভাগের কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছি, শিক্ষার্থীদের সুন্দর পোশাক পরে আসার কথা বলেছি, তবে বুঝিনি কেউ তা অন্যভাবে নেবে।”
তবে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ও বিশদ বর্ণনার বিপরীতে তার এমন প্রতিক্রিয়া অনেকের কাছে অসংবেদনশীল ও দায়িত্বহীন বলে মনে হয়েছে।
বিভাগীয় পদক্ষেপ: কার্যক্রম থেকে বিরতি
বিভাগীয় সভাপতি অধ্যাপক ড. একেএম নাজমুল হুদা গণমাধ্যমকে বলেন, “আমরা অভিযোগ পাওয়ার পর একাডেমিক কমিটির সভা বসিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রাথমিকভাবে অভিযোগের যথেষ্ট সত্যতা পেয়েছি। তাই অভিযুক্ত শিক্ষককে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিভাগের সকল কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
তিনি আরও জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক নীতিমালার আলোকে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
এই ঘটনাটি আবারও প্রমাণ করে, দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কতটা অসুরক্ষিত পরিবেশ বিরাজ করছে। শিক্ষার্থীদের সাহসী পদক্ষেপ ও প্রশাসনের দ্রুত প্রতিক্রিয়া প্রশংসনীয় হলেও, এ ধরনের ঘটনার যেন আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে হবে কঠোর শাস্তি ও নজরদারির মাধ্যমে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে শক্তিশালী কোড অফ কন্ডাক্ট কার্যকর করতে হবে, যাতে কারো বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ ওঠার আগেই তার অপকর্ম থামানো যায়।
Please Share This Post in Your Social Media

ইবি শিক্ষক ড. আজিজুল ইসলামের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ, ১২ ছাত্রী লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন

কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) আবারও শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির গুরুতর অভিযোগ উঠে এসেছে। বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আজিজুল ইসলামের বিরুদ্ধে অন্তত ১২ জন ছাত্রী লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রীদের প্রতি কুরুচিপূর্ণ, অশালীন ও ভয়ভীতিমূলক আচরণ করে আসছেন।
গত ২২ জুন বিভাগের সভাপতি বরাবর অভিযোগপত্র জমা দেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা। ১ জুলাই বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা তৈরি করে।
ভিডিও কল করে শারীরিক গঠন দেখতে চাওয়া
অভিযোগপত্রে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের এক ছাত্রী বলেন, “স্যার আমাকে ইমোতে ভিডিও কল দেন। আমি রিসিভ না করায় পরে অডিও কল করেন। তখন বলেন, ‘অনেকদিন তোমাদের দেখি না, মোটা হয়েছো না চিকন হয়েছো দেখতে ভিডিও কল দিচ্ছি।’ এরপর বলেন, ‘তোমার কি কথা বলার কেউ আছে?’ আমি বলি, ‘না’। তখন তিনি মন্তব্য করেন, ‘এখন বলছো কেউ নেই, কিছুদিন পর দেখি ক্যাম্পাসে কোনো ছেলের হাত ধরে ঘুরছো।’”
ওই ছাত্রী আরও বলেন, “স্যার ক্লাসে বিভিন্ন সময় ইঙ্গিতপূর্ণ ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন। আমার উচ্চতা নিয়ে অশ্লীল রসিকতা করেন। বিবাহিত হওয়ায় স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও অপমানজনক মন্তব্য করেন। এমনকি মেন্সট্রুয়েশন সাইকেল নিয়েও আমাকে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে ব্যঙ্গ করেন। এভাবে ক্লাসে বারবার হেনস্তার পাশাপাশি হুমকি দেন যে, তার কোর্সে ভালো রেজাল্ট পাবো না।”
অভিযোগের বিবরণ: ভয়, হুমকি ও বডি শেমিং
শুধু একজন নয়, একাধিক ছাত্রী অভিযোগ করেছেন, আজিজুল ইসলাম নিয়মিতই হোয়াটসঅ্যাপে কুরুচিপূর্ণ বার্তা পাঠাতেন। ইচ্ছাকৃতভাবে পরীক্ষা ও অ্যাসাইনমেন্টে নম্বর কমিয়ে দিতেন। নিজের অফিস কক্ষে ডেকে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে অপ্রাসঙ্গিক ও আপত্তিকর প্রশ্ন করতেন। অনেক সময় রাতে ভিডিও কল দিতেন, কল না ধরলে পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট দেওয়ার হুমকি দিতেন। বিবাহিত ছাত্রীদের বৈবাহিক জীবন নিয়েও অবমাননাকর মন্তব্য করতেন।
তাদের অভিযোগ, এই শিক্ষক নিজের পছন্দের ছাত্রীদের প্রজেক্টে কাজ করতে জোর করতেন এবং নানা উপায়ে বডি শেমিং করতেন। এতদিন এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। তবে একসঙ্গে একাধিক ছাত্রী অভিযোগ করায় বিষয়টি গুরুতর রূপ নিয়েছে।
অভিযুক্ত শিক্ষকের বক্তব্য: “ষড়যন্ত্রের শিকার”
অভিযোগের বিষয়ে ড. আজিজুল ইসলাম বলেন, “আমি কাউকে হেনস্তা করিনি। কেউ আমার কথাবার্তাকে ভুলভাবে নিয়েছে। এটা পরিকল্পিতভাবে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। আমি হয়তো কখন কী বলেছি, তা মনে করতে পারছি না। বিভাগের কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছি, শিক্ষার্থীদের সুন্দর পোশাক পরে আসার কথা বলেছি, তবে বুঝিনি কেউ তা অন্যভাবে নেবে।”
তবে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ও বিশদ বর্ণনার বিপরীতে তার এমন প্রতিক্রিয়া অনেকের কাছে অসংবেদনশীল ও দায়িত্বহীন বলে মনে হয়েছে।
বিভাগীয় পদক্ষেপ: কার্যক্রম থেকে বিরতি
বিভাগীয় সভাপতি অধ্যাপক ড. একেএম নাজমুল হুদা গণমাধ্যমকে বলেন, “আমরা অভিযোগ পাওয়ার পর একাডেমিক কমিটির সভা বসিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রাথমিকভাবে অভিযোগের যথেষ্ট সত্যতা পেয়েছি। তাই অভিযুক্ত শিক্ষককে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিভাগের সকল কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
তিনি আরও জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক নীতিমালার আলোকে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
এই ঘটনাটি আবারও প্রমাণ করে, দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কতটা অসুরক্ষিত পরিবেশ বিরাজ করছে। শিক্ষার্থীদের সাহসী পদক্ষেপ ও প্রশাসনের দ্রুত প্রতিক্রিয়া প্রশংসনীয় হলেও, এ ধরনের ঘটনার যেন আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে হবে কঠোর শাস্তি ও নজরদারির মাধ্যমে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে শক্তিশালী কোড অফ কন্ডাক্ট কার্যকর করতে হবে, যাতে কারো বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ ওঠার আগেই তার অপকর্ম থামানো যায়।