বিমানবন্দরে প্রবাসীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার: প্রশ্নবিদ্ধ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা

- Update Time : ১২:৫৭:২৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ৫ জুলাই ২০২৫
- / ১১৯ Time View
বিদেশে পরিশ্রম করে দেশের অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার করা প্রবাসীরা দেশে ফিরে পাচ্ছেন না সম্মানজনক অভ্যর্থনা। বরং বিমানবন্দরে পা রেখেই তাদের অনেককে হতে হচ্ছে অসম্মান, হয়রানি ও অবজ্ঞার শিকার—যা দীর্ঘদিনের অভিযোগ হলেও সম্প্রতি তা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে।
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রবেশপথে ইমিগ্রেশন, কাস্টমস ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে প্রবাসীরা নিয়মিতভাবেই ভোগান্তির মুখোমুখি হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
“ভাবটা এমন, যেন আমরা অপরাধী“
সৌদি আরব ফেরত প্রবাসী মো. শামীম (৩৮) দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন,
“১৪ ঘণ্টার ফ্লাইট শেষে ঢাকায় নেমেছি, লাগেজ পেতে লেগেছে প্রায় এক ঘণ্টা। এরপর কাস্টমসে আমাকে ঘণ্টাখানেক দাঁড় করিয়ে রেখে এমনভাবে ব্যাগ চেক করা হলো, যেন আমি কোনো অপরাধী। তারা আমাদের দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকায়, যেন আমরা দেশের বোঝা।”
এই অভিজ্ঞতা নতুন নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রবাসীদের এমন অভিযোগ উঠে আসছে। কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার, কারও লাগেজে অপ্রয়োজনীয় তল্লাশি, আবার কারও কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ দাবির অভিযোগও রয়েছে।
অভিযোগের সংখ্যা হাজারের ঘরে
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের হটলাইন ও পোর্টালের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ২০ হাজারের বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ অভিযোগ কাস্টমস, ইমিগ্রেশন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণ সংক্রান্ত।
চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই গত তিন বছরে অন্তত ২০ জন প্রবাসী হয়রানির অভিযোগ করেছেন, যাদের কেউ কেউ জানিয়েছেন লাগেজ ছাড় করতে গিয়ে ‘নির্ধারিত ফি’র বাইরে ঘুষ দিতে হয়েছে।
“এটা শুধু ব্যক্তি অপমান নয়, রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা“
আইন ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন,
“বিমানবন্দর হলো দেশের মুখ। একজন প্রবাসী সেখানে
সমাধানের পথ কী?
বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের মতে, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি—
- কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের আচরণগত প্রশিক্ষণ
- বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত ও কার্যকর সিসিটিভি নজরদারি
- প্রবাসীদের জন্য পৃথক অভিযোগ নিষ্পত্তি ইউনিট গঠন
- ই-গেট ও অটোমেটেড চেকিং সিস্টেম চালু ও বিস্তার
- হটলাইন অভিযোগগুলো নিরপেক্ষ তদন্ত ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
এছাড়া জাতীয়ভাবে প্রবাসী সম্মান সপ্তাহ পালন করে এই জনশক্তিকে ইতিবাচক বার্তা দেওয়ার কথাও ভাবা যেতে পারে।
রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের প্রতি রাষ্ট্রের কৃতজ্ঞতা কোথায়?
প্রবাসীরা প্রতিবছর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন। এই অর্থ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অথচ তাদের অবদান স্বীকৃত না হয়ে বিমানবন্দরে হয়রানি ও অপমানের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
এক প্রবাসীর কথায়,
“বিমানবন্দরে কেউ যদি একটু ভালো ব্যবহার করে, তাহলে মনটা আনন্দে ভরে যায়। কিন্তু বেশিরভাগ সময় মনে হয়, দেশে ফিরে যেন জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে। এটা দুঃখজনক, লজ্জাজনক।”
দেশপ্রেমের টানে, পরিবার ও জাতির ভবিষ্যতের জন্য বিদেশে শ্রম দিয়ে যাওয়া প্রবাসীরা যেন দেশে ফিরে সম্মানহানি না হন, সেটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এই অপমানজনক আচরণ শুধু ব্যক্তিগত নয়—এটি জাতীয় ভাবমূর্তির প্রশ্ন। যদি দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তবে ক্ষোভ জমতে জমতে একদিন বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে—যার দায় নেবে কে?
সুত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব
Please Share This Post in Your Social Media

বিমানবন্দরে প্রবাসীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার: প্রশ্নবিদ্ধ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা

বিদেশে পরিশ্রম করে দেশের অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার করা প্রবাসীরা দেশে ফিরে পাচ্ছেন না সম্মানজনক অভ্যর্থনা। বরং বিমানবন্দরে পা রেখেই তাদের অনেককে হতে হচ্ছে অসম্মান, হয়রানি ও অবজ্ঞার শিকার—যা দীর্ঘদিনের অভিযোগ হলেও সম্প্রতি তা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে।
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রবেশপথে ইমিগ্রেশন, কাস্টমস ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে প্রবাসীরা নিয়মিতভাবেই ভোগান্তির মুখোমুখি হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
“ভাবটা এমন, যেন আমরা অপরাধী“
সৌদি আরব ফেরত প্রবাসী মো. শামীম (৩৮) দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন,
“১৪ ঘণ্টার ফ্লাইট শেষে ঢাকায় নেমেছি, লাগেজ পেতে লেগেছে প্রায় এক ঘণ্টা। এরপর কাস্টমসে আমাকে ঘণ্টাখানেক দাঁড় করিয়ে রেখে এমনভাবে ব্যাগ চেক করা হলো, যেন আমি কোনো অপরাধী। তারা আমাদের দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকায়, যেন আমরা দেশের বোঝা।”
এই অভিজ্ঞতা নতুন নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রবাসীদের এমন অভিযোগ উঠে আসছে। কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার, কারও লাগেজে অপ্রয়োজনীয় তল্লাশি, আবার কারও কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ দাবির অভিযোগও রয়েছে।
অভিযোগের সংখ্যা হাজারের ঘরে
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের হটলাইন ও পোর্টালের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ২০ হাজারের বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ অভিযোগ কাস্টমস, ইমিগ্রেশন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণ সংক্রান্ত।
চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই গত তিন বছরে অন্তত ২০ জন প্রবাসী হয়রানির অভিযোগ করেছেন, যাদের কেউ কেউ জানিয়েছেন লাগেজ ছাড় করতে গিয়ে ‘নির্ধারিত ফি’র বাইরে ঘুষ দিতে হয়েছে।
“এটা শুধু ব্যক্তি অপমান নয়, রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা“
আইন ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন,
“বিমানবন্দর হলো দেশের মুখ। একজন প্রবাসী
সমাধানের পথ কী?
বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের মতে, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি—
- কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের আচরণগত প্রশিক্ষণ
- বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত ও কার্যকর সিসিটিভি নজরদারি
- প্রবাসীদের জন্য পৃথক অভিযোগ নিষ্পত্তি ইউনিট গঠন
- ই-গেট ও অটোমেটেড চেকিং সিস্টেম চালু ও বিস্তার
- হটলাইন অভিযোগগুলো নিরপেক্ষ তদন্ত ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
এছাড়া জাতীয়ভাবে প্রবাসী সম্মান সপ্তাহ পালন করে এই জনশক্তিকে ইতিবাচক বার্তা দেওয়ার কথাও ভাবা যেতে পারে।
রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের প্রতি রাষ্ট্রের কৃতজ্ঞতা কোথায়?
প্রবাসীরা প্রতিবছর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন। এই অর্থ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অথচ তাদের অবদান স্বীকৃত না হয়ে বিমানবন্দরে হয়রানি ও অপমানের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
এক প্রবাসীর কথায়,
“বিমানবন্দরে কেউ যদি একটু ভালো ব্যবহার করে, তাহলে মনটা আনন্দে ভরে যায়। কিন্তু বেশিরভাগ সময় মনে হয়, দেশে ফিরে যেন জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে। এটা দুঃখজনক, লজ্জাজনক।”
দেশপ্রেমের টানে, পরিবার ও জাতির ভবিষ্যতের জন্য বিদেশে শ্রম দিয়ে যাওয়া প্রবাসীরা যেন দেশে ফিরে সম্মানহানি না হন, সেটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এই অপমানজনক আচরণ শুধু ব্যক্তিগত নয়—এটি জাতীয় ভাবমূর্তির প্রশ্ন। যদি দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তবে ক্ষোভ জমতে জমতে একদিন বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে—যার দায় নেবে কে?
সুত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব