তিন সপ্তাহ ধরে ভারতে বৃটিশ যুদ্ধবিমান: প্রযুক্তি নাকি রাজনীতি—রহস্যের গন্ধে উত্তাল কূটনৈতিক মহল

- Update Time : ১০:৫৯:৩৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৪ জুলাই ২০২৫
- / ৫৯ Time View
ভারতের কেরালার তিরুবনন্তপুরম বিমানবন্দরে গত ১৪ জুন থেকে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা বৃটিশ স্টিলথ যুদ্ধবিমান এফ–৩৫বি বিশ্বজুড়ে কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। এতটা উচ্চপ্রযুক্তির, কড়া নিরাপত্তার জেট দীর্ঘ তিন সপ্তাহ ধরে বিদেশের মাটিতে পড়ে রয়েছে—এটা কেবল প্রযুক্তিগত সমস্যার ফল, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে গভীর কোনো কূটনৈতিক বার্তা বা গোপন অপারেশন? এই প্রশ্ন এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
ঘটনার শুরু: এক জরুরি অবতরণ
প্রথমে জানা যায়, বৃটিশ রণতরী এইচএমএস প্রিন্স অব ওয়েলস থেকে প্রশিক্ষণ অভিযানে থাকা অবস্থায় ভারত মহাসাগরের ওপর বৈরি আবহাওয়ার কবলে পড়ে বিমানটি। নিরাপত্তার স্বার্থে এটি জরুরি অবতরণ করে কেরালার তিরুবনন্তপুরম বিমানবন্দরে। যদিও জেটটি নিরাপদে অবতরণ করতে সক্ষম হয়, এরপরই শুরু হয় যান্ত্রিক জটিলতা।
বিমানটি এতটাই উচ্চ প্রযুক্তি নির্ভর যে, সাধারণ কোনো বিমানবন্দরের পক্ষে সেটি মেরামত করা প্রায় অসম্ভব। ফলে রয়্যাল নেভির প্রকৌশলীরা দিনরাত মেরামতের চেষ্টা চালিয়ে গেলেও কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।
তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও সমাধান নেই: সন্দেহ আরও ঘনীভূত
বৃটেনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এফ-৩৫বির মেরামতের জন্য বিশেষজ্ঞ দল ও সরঞ্জাম পাঠানো হচ্ছে, যা পৌঁছালে এটিকে MRO (Maintenance, Repair, and Overhaul) সেকশনে স্থানান্তর করা হবে। যদিও ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এ নিয়ে কিছু বলেনি, তবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দুই দেশের পক্ষ থেকেই কঠোর তদারকি চলছে।
এই দীর্ঘ অবস্থান ও ধীর পদক্ষেপ অনেকের কাছে রহস্যজনক বলে মনে হয়েছে। অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. সামীর পাতিল মন্তব্য করেন, “এটা বৃটেনের জন্য কৌশলগত ও মর্যাদার দিক থেকে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতি। শত্রু দেশের মাটিতে এমনটা হলে হয়তো এত সময় নেওয়া যেত না।”
নিরাপত্তা প্রশ্নে রাজনৈতিক উত্তাপ বৃটেনে
এই ঘটনাটি বৃটেনের পার্লামেন্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। বিরোধীদলীয় এমপি বেন ওবিজে–জে বিষয়টি উত্থাপন করে প্রশ্ন করেন, যুদ্ধবিমানটি কবে ফিরবে, এবং সংবেদনশীল তথ্য ও প্রযুক্তি নিরাপদ আছে কি না। জবাবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লুক
তবে কূটনীতিকদের অনেকে মনে করেন, এই ধরনের যুদ্ধবিমান কোনো দেশে এভাবে পড়ে থাকলে সেখানে ‘গোপন চুক্তি’ বা ‘প্রযুক্তি বিনিময়ের’ গন্ধ থাকাটাই স্বাভাবিক।
প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা না রাজনীতির কৌশল?
বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, এটি নিছক একটি প্রযুক্তিগত দুর্ঘটনা নয়। বরং এর মাধ্যমে বৃটেন ও ভারতের মধ্যে কোনো গোপন সামরিক সমঝোতা বা যৌথ প্রযুক্তি পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয় থাকতে পারে। মনে রাখা প্রয়োজন, ভারত সম্প্রতি তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে এবং মার্কিন প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহও বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বৃটিশ প্রযুক্তি এবং ভারতের প্রতিরক্ষা নীতির মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে এই ঘটনার মাধ্যমে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘মিম ঝড়’ ও সমালোচনার মুখে রয়্যাল নেভি
এফ-৩৫বি জেটের করুণ দশা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো মিম যুদ্ধ শুরু হয়েছে। কেউ বলছে, “বিমানটি মাত্র ৪ মিলিয়নে বিক্রি হবে,” কেউ বলছে, “এতে অটোমেটিক পার্কিং থেকে শুরু করে ট্রাফিক আইন ভাঙলে গুলি করার সিস্টেমও আছে!” কেরালা পর্যটন বিভাগও হাস্যরসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তারা একটি কৃত্রিম ছবি প্রকাশ করে লিখেছে, “কেরালা এমন গন্তব্য যেখানে আপনি চাইলেও ফিরতে পারবেন না।”
এই মজার পেছনে রয়েছে সিরিয়াস বার্তাও—এই ধরনের ঘটনাগুলো একটি রাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতা ও পরিকল্পনার ওপর প্রশ্ন তোলে।
এফ–৩৫বি: একটি উচ্চ প্রযুক্তির বিস্ময়
এই যুদ্ধবিমানটি নির্মাণ করেছে লকহিড মার্টিন। এফ-৩৫বি হলো এমন একটি মডেল, যা স্বল্প দূরত্বে উড্ডয়ন এবং খাড়াভাবে অবতরণ করতে পারে—এটি স্টিলথ প্রযুক্তি সমৃদ্ধ, যার অস্তিত্ব শত্রুর রাডারে ধরা পড়ে না। এত উচ্চক্ষমতার বিমান বিদেশে পড়ে থাকা নিরাপত্তার দিক থেকে বিরাট উদ্বেগের বিষয়।
রহস্য কীভাবে গড়ায় আরও গভীরে?
এফ-৩৫বি কাণ্ড কেবল একটি যান্ত্রিক গোলযোগের চেয়েও অনেক বেশি কিছু। এটি প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা কৌশল, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং সাইবার নিরাপত্তার এক জটিল গাঁটছড়া। যদিও বৃটেন বলছে বিমানটি তাদের নিয়ন্ত্রণেই আছে, বিশ্লেষকদের অনেকেই সন্দেহ করছেন, এই দীর্ঘ উপস্থিতি ভারতের মাটিতে এমন কিছু রেখে যাবে যা সামরিক, প্রযুক্তি ও কূটনীতির ভবিষ্যৎ গতিপথ বদলে দিতে পারে।
যা এখনো পরিষ্কার নয়, তা হলো—এই ‘ভবঘুরে জেট‘-এর উদ্দেশ্য ছিল কেবল প্রশিক্ষণ, নাকি এর ছায়ায় ঘটছে আরও বড় কিছু।
Please Share This Post in Your Social Media

তিন সপ্তাহ ধরে ভারতে বৃটিশ যুদ্ধবিমান: প্রযুক্তি নাকি রাজনীতি—রহস্যের গন্ধে উত্তাল কূটনৈতিক মহল

ভারতের কেরালার তিরুবনন্তপুরম বিমানবন্দরে গত ১৪ জুন থেকে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা বৃটিশ স্টিলথ যুদ্ধবিমান এফ–৩৫বি বিশ্বজুড়ে কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। এতটা উচ্চপ্রযুক্তির, কড়া নিরাপত্তার জেট দীর্ঘ তিন সপ্তাহ ধরে বিদেশের মাটিতে পড়ে রয়েছে—এটা কেবল প্রযুক্তিগত সমস্যার ফল, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে গভীর কোনো কূটনৈতিক বার্তা বা গোপন অপারেশন? এই প্রশ্ন এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
ঘটনার শুরু: এক জরুরি অবতরণ
প্রথমে জানা যায়, বৃটিশ রণতরী এইচএমএস প্রিন্স অব ওয়েলস থেকে প্রশিক্ষণ অভিযানে থাকা অবস্থায় ভারত মহাসাগরের ওপর বৈরি আবহাওয়ার কবলে পড়ে বিমানটি। নিরাপত্তার স্বার্থে এটি জরুরি অবতরণ করে কেরালার তিরুবনন্তপুরম বিমানবন্দরে। যদিও জেটটি নিরাপদে অবতরণ করতে সক্ষম হয়, এরপরই শুরু হয় যান্ত্রিক জটিলতা।
বিমানটি এতটাই উচ্চ প্রযুক্তি নির্ভর যে, সাধারণ কোনো বিমানবন্দরের পক্ষে সেটি মেরামত করা প্রায় অসম্ভব। ফলে রয়্যাল নেভির প্রকৌশলীরা দিনরাত মেরামতের চেষ্টা চালিয়ে গেলেও কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।
তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও সমাধান নেই: সন্দেহ আরও ঘনীভূত
বৃটেনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এফ-৩৫বির মেরামতের জন্য বিশেষজ্ঞ দল ও সরঞ্জাম পাঠানো হচ্ছে, যা পৌঁছালে এটিকে MRO (Maintenance, Repair, and Overhaul) সেকশনে স্থানান্তর করা হবে। যদিও ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এ নিয়ে কিছু বলেনি, তবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দুই দেশের পক্ষ থেকেই কঠোর তদারকি চলছে।
এই দীর্ঘ অবস্থান ও ধীর পদক্ষেপ অনেকের কাছে রহস্যজনক বলে মনে হয়েছে। অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. সামীর পাতিল মন্তব্য করেন, “এটা বৃটেনের জন্য কৌশলগত ও মর্যাদার দিক থেকে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতি। শত্রু দেশের মাটিতে এমনটা হলে হয়তো এত সময় নেওয়া যেত না।”
নিরাপত্তা প্রশ্নে রাজনৈতিক উত্তাপ বৃটেনে
এই ঘটনাটি বৃটেনের পার্লামেন্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। বিরোধীদলীয় এমপি বেন ওবিজে–জে বিষয়টি উত্থাপন করে প্রশ্ন করেন, যুদ্ধবিমানটি কবে ফিরবে, এবং সংবেদনশীল তথ্য ও প্রযুক্তি নিরাপদ আছে কি না। জবাবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লুক
তবে কূটনীতিকদের অনেকে মনে করেন, এই ধরনের যুদ্ধবিমান কোনো দেশে এভাবে পড়ে থাকলে সেখানে ‘গোপন চুক্তি’ বা ‘প্রযুক্তি বিনিময়ের’ গন্ধ থাকাটাই স্বাভাবিক।
প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা না রাজনীতির কৌশল?
বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, এটি নিছক একটি প্রযুক্তিগত দুর্ঘটনা নয়। বরং এর মাধ্যমে বৃটেন ও ভারতের মধ্যে কোনো গোপন সামরিক সমঝোতা বা যৌথ প্রযুক্তি পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয় থাকতে পারে। মনে রাখা প্রয়োজন, ভারত সম্প্রতি তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে এবং মার্কিন প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহও বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বৃটিশ প্রযুক্তি এবং ভারতের প্রতিরক্ষা নীতির মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে এই ঘটনার মাধ্যমে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘মিম ঝড়’ ও সমালোচনার মুখে রয়্যাল নেভি
এফ-৩৫বি জেটের করুণ দশা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো মিম যুদ্ধ শুরু হয়েছে। কেউ বলছে, “বিমানটি মাত্র ৪ মিলিয়নে বিক্রি হবে,” কেউ বলছে, “এতে অটোমেটিক পার্কিং থেকে শুরু করে ট্রাফিক আইন ভাঙলে গুলি করার সিস্টেমও আছে!” কেরালা পর্যটন বিভাগও হাস্যরসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তারা একটি কৃত্রিম ছবি প্রকাশ করে লিখেছে, “কেরালা এমন গন্তব্য যেখানে আপনি চাইলেও ফিরতে পারবেন না।”
এই মজার পেছনে রয়েছে সিরিয়াস বার্তাও—এই ধরনের ঘটনাগুলো একটি রাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতা ও পরিকল্পনার ওপর প্রশ্ন তোলে।
এফ–৩৫বি: একটি উচ্চ প্রযুক্তির বিস্ময়
এই যুদ্ধবিমানটি নির্মাণ করেছে লকহিড মার্টিন। এফ-৩৫বি হলো এমন একটি মডেল, যা স্বল্প দূরত্বে উড্ডয়ন এবং খাড়াভাবে অবতরণ করতে পারে—এটি স্টিলথ প্রযুক্তি সমৃদ্ধ, যার অস্তিত্ব শত্রুর রাডারে ধরা পড়ে না। এত উচ্চক্ষমতার বিমান বিদেশে পড়ে থাকা নিরাপত্তার দিক থেকে বিরাট উদ্বেগের বিষয়।
রহস্য কীভাবে গড়ায় আরও গভীরে?
এফ-৩৫বি কাণ্ড কেবল একটি যান্ত্রিক গোলযোগের চেয়েও অনেক বেশি কিছু। এটি প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা কৌশল, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং সাইবার নিরাপত্তার এক জটিল গাঁটছড়া। যদিও বৃটেন বলছে বিমানটি তাদের নিয়ন্ত্রণেই আছে, বিশ্লেষকদের অনেকেই সন্দেহ করছেন, এই দীর্ঘ উপস্থিতি ভারতের মাটিতে এমন কিছু রেখে যাবে যা সামরিক, প্রযুক্তি ও কূটনীতির ভবিষ্যৎ গতিপথ বদলে দিতে পারে।
যা এখনো পরিষ্কার নয়, তা হলো—এই ‘ভবঘুরে জেট‘-এর উদ্দেশ্য ছিল কেবল প্রশিক্ষণ, নাকি এর ছায়ায় ঘটছে আরও বড় কিছু।