গাজায় ইসরায়েলি হামলা হিরোশিমার চেয়েও ভয়াবহ: জাতিসংঘ দূতের বিস্ফোরক প্রতিবেদন

- Update Time : ১১:০৭:২৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৪ জুলাই ২০২৫
- / ৫৫ Time View
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলার ভয়াবহতা নিয়ে বিশ্বজুড়ে আবারও নতুন করে ক্ষোভ ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে উপস্থাপিত এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রান্সেসকা আলবানিজ এই হামলাকে আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয় হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
তিনি দাবি করেন, গাজায় ইসরায়েল যে পরিমাণ বিস্ফোরক ব্যবহার করেছে তার ওজন প্রায় ৮৫ হাজার টন—যা ১৯৪৫ সালের হিরোশিমায় ফেলা পারমাণবিক বোমার চেয়েও ছয়গুণ বেশি শক্তিশালী। তার ভাষায়, “এটি কেবল একটি যুদ্ধ নয়, এটি একটি পরিকল্পিত গণহত্যা—যার পেছনে আছে বাণিজ্যিক স্বার্থ, অস্ত্র পরীক্ষার কৌশল এবং নির্মমতা।”
‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’—একটি মৃত্যুফাঁদ
আলবানিজ আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত তথাকথিত ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ বাস্তবে মানবিক সহায়তা নয়, বরং একটি মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। যেখানে মানুষ খাবারের আশায় দাঁড়ালেও সেখানেই ঘটে যাচ্ছে প্রাণঘাতী হামলা। তার মতে, গাজায় ইসরায়েলের সামরিক আক্রমণ কোনো বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাস দমন অভিযান নয়, বরং এটি হলো এক বাণিজ্যিক যুদ্ধপ্রক্রিয়া, যার কেন্দ্রে রয়েছে করপোরেট অর্থনীতি।
প্রাণহানির ভয়াবহ পরিসংখ্যান
আলবানিজের প্রতিবেদনে প্রকাশ, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি অভিযান গাজায় প্রাণ কেড়ে নিয়েছে অন্তত ৫৭,১৩০ জনের। আহত হয়েছেন আরও ১,৩৪,৫৯২ জন। কেবল গত ২৪ ঘণ্টায়ই নিহত হয়েছেন ১১৮ জন, আহত হয়েছেন ৫৮১ জন। এই হামলাগুলোর শিকার হয়েছেন এমনকি ত্রাণ নিতে আসা নিরীহ মানুষও—যার মধ্যে গত মে মাস থেকে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৬৫২ ত্রাণপ্রার্থীর।
‘দখলদার অর্থনীতি’ ও করপোরেট লাভের অন্ধ উৎসব
এই গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে রয়েছে এক ভয়ংকর অর্থনৈতিক কাঠামো—যাকে আলবানিজ ‘দখলদার অর্থনীতি’ নামে আখ্যায়িত করেন। তার মতে, অন্তত ৪৮টি আন্তর্জাতিক করপোরেট প্রতিষ্ঠান সরাসরি ইসরায়েলের এই আক্রমণ-প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে রয়েছে অস্ত্র নির্মাতা, প্রযুক্তি কোম্পানি, জ্বালানি উৎপাদক, ব্যাংক, এমনকি বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জে যুদ্ধের সময় ২১৩ শতাংশ মুনাফা বেড়েছে—যেখানে মানুষ মরছে, সেখানে করপোরেট দানবরা সম্পদে ফুলেফেঁপে উঠছে।
গাজাকে সামরিক পরীক্ষাগার হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ
ফ্রান্সেসকা আলবানিজ বলেন, “গাজা এখন একটি জীবন্ত সামরিক পরীক্ষাগারে পরিণত হয়েছে, যেখানে ইসরায়েল নতুন ড্রোন, রাডার, নজরদারি প্রযুক্তি ও অস্ত্র পরীক্ষার কাজ করছে ফিলিস্তিনিদের দেহের ওপর।”
জাতিসংঘের কাছে কঠোর পদক্ষেপের আহ্বান
এই বাস্তবতায় তিনি জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে আহ্বান জানান—
- ইসরায়েলের ওপর পূর্ণ অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করতে,
- সকল বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে,
- এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহির আওতায় আনতে।
তার ভাষায়, “যেসব কোম্পানি যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যায় ভূমিকা রাখছে, তাদের আইনের আওতায় আনা জরুরি। বিশ্বকে আজ একটি নৈতিক অবস্থান নিতে হবে।”
বয়কট ও গণজাগরণই পরিবর্তনের চাবিকাঠি
প্রতিবেদনের শেষে আলবানিজ বিশ্বজুড়ে নাগরিক সমাজ, আইনজীবী, সাংবাদিক, ট্রেড ইউনিয়ন এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “এই নিষ্ঠুরতার বিপরীতে নীরব থাকা মানেই তার অংশীদার হওয়া। বয়কট, নিষেধাজ্ঞা ও জবাবদিহির দাবিতেই নিহিত রয়েছে গাজার মানুষের মুক্তির পথ।”
তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, “গাজায় কী ঘটবে, তা নির্ভর করছে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নৈতিক সাহস ও ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তের ওপর।”
তথ্যসূত্র: আল–জাজিরা
Please Share This Post in Your Social Media

গাজায় ইসরায়েলি হামলা হিরোশিমার চেয়েও ভয়াবহ: জাতিসংঘ দূতের বিস্ফোরক প্রতিবেদন

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলার ভয়াবহতা নিয়ে বিশ্বজুড়ে আবারও নতুন করে ক্ষোভ ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে উপস্থাপিত এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রান্সেসকা আলবানিজ এই হামলাকে আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয় হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
তিনি দাবি করেন, গাজায় ইসরায়েল যে পরিমাণ বিস্ফোরক ব্যবহার করেছে তার ওজন প্রায় ৮৫ হাজার টন—যা ১৯৪৫ সালের হিরোশিমায় ফেলা পারমাণবিক বোমার চেয়েও ছয়গুণ বেশি শক্তিশালী। তার ভাষায়, “এটি কেবল একটি যুদ্ধ নয়, এটি একটি পরিকল্পিত গণহত্যা—যার পেছনে আছে বাণিজ্যিক স্বার্থ, অস্ত্র পরীক্ষার কৌশল এবং নির্মমতা।”
‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’—একটি মৃত্যুফাঁদ
আলবানিজ আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত তথাকথিত ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ বাস্তবে মানবিক সহায়তা নয়, বরং একটি মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। যেখানে মানুষ খাবারের আশায় দাঁড়ালেও সেখানেই ঘটে যাচ্ছে প্রাণঘাতী হামলা। তার মতে, গাজায় ইসরায়েলের সামরিক আক্রমণ কোনো বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাস দমন অভিযান নয়, বরং এটি হলো এক বাণিজ্যিক যুদ্ধপ্রক্রিয়া, যার কেন্দ্রে রয়েছে করপোরেট অর্থনীতি।
প্রাণহানির ভয়াবহ পরিসংখ্যান
আলবানিজের প্রতিবেদনে প্রকাশ, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি অভিযান গাজায় প্রাণ কেড়ে নিয়েছে অন্তত ৫৭,১৩০ জনের। আহত হয়েছেন আরও ১,৩৪,৫৯২ জন। কেবল গত ২৪ ঘণ্টায়ই নিহত হয়েছেন ১১৮ জন, আহত হয়েছেন ৫৮১ জন। এই হামলাগুলোর শিকার হয়েছেন এমনকি ত্রাণ নিতে আসা নিরীহ মানুষও—যার মধ্যে গত মে মাস থেকে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৬৫২ ত্রাণপ্রার্থীর।
‘দখলদার অর্থনীতি’ ও করপোরেট লাভের অন্ধ উৎসব
এই গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে রয়েছে এক ভয়ংকর অর্থনৈতিক কাঠামো—যাকে আলবানিজ ‘দখলদার অর্থনীতি’ নামে আখ্যায়িত করেন। তার মতে, অন্তত ৪৮টি আন্তর্জাতিক করপোরেট প্রতিষ্ঠান সরাসরি ইসরায়েলের এই আক্রমণ-প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে রয়েছে অস্ত্র নির্মাতা, প্রযুক্তি কোম্পানি, জ্বালানি উৎপাদক, ব্যাংক, এমনকি বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জে যুদ্ধের সময় ২১৩ শতাংশ মুনাফা বেড়েছে—যেখানে মানুষ মরছে, সেখানে করপোরেট দানবরা সম্পদে ফুলেফেঁপে উঠছে।
গাজাকে সামরিক পরীক্ষাগার হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ
ফ্রান্সেসকা আলবানিজ বলেন, “গাজা এখন একটি জীবন্ত সামরিক পরীক্ষাগারে পরিণত হয়েছে, যেখানে ইসরায়েল নতুন ড্রোন, রাডার, নজরদারি প্রযুক্তি ও অস্ত্র পরীক্ষার কাজ করছে ফিলিস্তিনিদের দেহের ওপর।”
জাতিসংঘের কাছে কঠোর পদক্ষেপের আহ্বান
এই বাস্তবতায় তিনি জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে আহ্বান জানান—
- ইসরায়েলের ওপর পূর্ণ অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করতে,
- সকল বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে,
- এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহির আওতায় আনতে।
তার ভাষায়, “যেসব কোম্পানি যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যায় ভূমিকা রাখছে, তাদের আইনের আওতায় আনা জরুরি। বিশ্বকে আজ একটি নৈতিক অবস্থান নিতে হবে।”
বয়কট ও গণজাগরণই পরিবর্তনের চাবিকাঠি
প্রতিবেদনের শেষে আলবানিজ বিশ্বজুড়ে নাগরিক সমাজ, আইনজীবী, সাংবাদিক, ট্রেড ইউনিয়ন এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “এই নিষ্ঠুরতার বিপরীতে নীরব থাকা মানেই তার অংশীদার হওয়া। বয়কট, নিষেধাজ্ঞা ও জবাবদিহির দাবিতেই নিহিত রয়েছে গাজার মানুষের মুক্তির পথ।”
তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, “গাজায় কী ঘটবে, তা নির্ভর করছে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নৈতিক সাহস ও ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তের ওপর।”
তথ্যসূত্র: আল–জাজিরা