এনসিপি কি ‘মব’ দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে? উঠছে প্রশ্ন

- Update Time : ০৩:২৭:২৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৪ জুলাই ২০২৫
- / ৮৭ Time View
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি প্রশ্ন ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠছে—জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও তার অঙ্গ সংগঠন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ কি মব বা সংঘবদ্ধ জনতার মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে? একের পর এক বিতর্কিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে জনমনে তৈরি হচ্ছে সংশয়। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি ঘটেছে গত মঙ্গলবার, যখন চট্টগ্রামের পটিয়া থানায় ছাত্রলীগের এক নেতাকে পুলিশে দেওয়ার পর মামলা না থাকায় পুলিশ গ্রেপ্তার করতে অস্বীকৃতি জানায়। এ নিয়ে শুরু হয় বাগ্বিতণ্ডা এবং তা পরিণত হয় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে।
“পটিয়া থানা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে!”
এই উত্তপ্ত ঘটনার ঠিক পরপরই এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আরিফ সোহেল তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে লেখেন, “পটিয়া থানা মাটির সাথে মিশায়া দিতে হবে!”—যা সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয় এবং রাজনৈতিক মহলে উদ্বেগ তৈরি করে।
পরদিন, ২ জুলাই সকালে, এনসিপি ও ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে থানার ওসির অপসারণসহ দায়ীদের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ হয়। রাতেই ওসি আবু জাহেদ মো. নাজমুন নূরকে প্রত্যাহারের খবর ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন—এটা কি সংগঠিত জনচাপ ছিল, না কি সুপরিকল্পিত ‘মব প্রেসার’?
অতীতেও ছিল মব–সদৃশ কার্যক্রম
এই একক ঘটনা নয়। এর আগে গত ২৯ মে রংপুরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের বাড়িতে হামলার ঘটনায়ও ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ও এনসিপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। যদিও তারা পাল্টা অভিযোগ করে বলেছে, আগে তাদের ওপর হামলা হয়েছিল।
তারও আগে, ১৯ মে ঢাকার ধানমন্ডিতে হাক্কানী পাবলিশার্সের সামনে স্লোগান ও বিশৃঙ্খলার সময় পুলিশ তিনজনকে আটক করে। পরে এনসিপির জ্যেষ্ঠ নেতা আবদুল হান্নান মাসউদ মুচলেকার মাধ্যমে তাদের মুক্ত করেন। এরপর তাকে দল থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়, যা পরে প্রত্যাহার করা হয়।
মব নিয়ে দ্বিধান্বিত অবস্থান
এনসিপির নেতাদের বক্তব্যে মব বিষয়ক অবস্থান স্পষ্ট নয়। একদিকে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম মবকে ‘বিক্ষুব্ধ জনতা’ আখ্যা দিয়ে বলেন, “সঠিক নেতৃত্বের অভাবে তাদের কেউ কেউ অন্যদের হাতিয়ার হয়েছে, এটাই আমাদের দুর্বলতা।”
অন্যদিকে দলটির যুগ্ম সদস্য সচিব মুশফিক উস সালেহীন মবে দলের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ সরাসরি নাকচ করে বলেন, “আমরা সবকিছুই নিজেদের নামেই করি। মব বা ছদ্ম পরিচয়ে কিছু করার প্রয়োজন হয় না।”
রাষ্ট্রীয় অবস্থানও বিভ্রান্তিকর
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এনসিপির মতো ভাষা ব্যবহার করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমও। তিনি বলেন, “এগুলো মব নয়, প্রেসার। যারা ১৫ বছর ধরে নিপীড়িত, তারা ক্ষোভ প্রকাশ করছে।” ফলে অনেকের মতে, এই বক্তব্য সরকারি অবস্থানের পক্ষেই কিছুটা সহানুভূতিশীলতা প্রকাশ করছে।
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “সবাই আইনের শাসনের কথা বললেও, আমরা নিজেরাই কখনো কখনো আইন হাতে নিচ্ছি।” তিনি এটিকে রাজনৈতিক নেতাদের দ্বৈত নীতির বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বিশ্লেষক সাব্বির আহমেদ আরও একধাপ এগিয়ে বলেন, “এই মবের পেছনে সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে। মব ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে দমন সহজ হয় এবং এই ভয় প্রদর্শনের রাজনীতি সরকারের পছন্দের হতে পারে।”
কৌশল, না বাস্তবতা?
নতুন উদীয়মান দল হিসেবে এনসিপি নিজেকে ‘দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী শক্তি’ হিসেবে তুলে ধরছে। কিন্তু সম্প্রতি তাদের নেতাকর্মীদের যেসব কর্মকাণ্ড সামনে এসেছে, তাতে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে—এই দল কি শুধুই ন্যায়ের পক্ষে কথা বলছে, না কি নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জনক্ষোভকে ‘মব’ রূপে ব্যবহার করছে?
যদি তারা সত্যিই সহিংসতা ও অনিয়মের বিরুদ্ধে থাকে, তবে দল হিসেবে স্পষ্ট, সংগঠিত এবং আইনের ভিতরে থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করা তাদের দায়িত্ব। নাহলে তারা জনতার ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে মব-রাজনীতির অপবাদে জড়িয়ে যেতে পারে—যা দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক আস্থার বড় সংকটে পরিণত হতে পারে।
সামনের দিনগুলোতে এনসিপি ও তার অঙ্গ সংগঠন কীভাবে এই প্রশ্নগুলোর জবাব দেয়, সেটিই হবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
Please Share This Post in Your Social Media

এনসিপি কি ‘মব’ দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে? উঠছে প্রশ্ন

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি প্রশ্ন ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠছে—জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও তার অঙ্গ সংগঠন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ কি মব বা সংঘবদ্ধ জনতার মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে? একের পর এক বিতর্কিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে জনমনে তৈরি হচ্ছে সংশয়। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি ঘটেছে গত মঙ্গলবার, যখন চট্টগ্রামের পটিয়া থানায় ছাত্রলীগের এক নেতাকে পুলিশে দেওয়ার পর মামলা না থাকায় পুলিশ গ্রেপ্তার করতে অস্বীকৃতি জানায়। এ নিয়ে শুরু হয় বাগ্বিতণ্ডা এবং তা পরিণত হয় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে।
“পটিয়া থানা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে!”
এই উত্তপ্ত ঘটনার ঠিক পরপরই এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আরিফ সোহেল তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে লেখেন, “পটিয়া থানা মাটির সাথে মিশায়া দিতে হবে!”—যা সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয় এবং রাজনৈতিক মহলে উদ্বেগ তৈরি করে।
পরদিন, ২ জুলাই সকালে, এনসিপি ও ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে থানার ওসির অপসারণসহ দায়ীদের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ হয়। রাতেই ওসি আবু জাহেদ মো. নাজমুন নূরকে প্রত্যাহারের খবর ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন—এটা কি সংগঠিত জনচাপ ছিল, না কি সুপরিকল্পিত ‘মব প্রেসার’?
অতীতেও ছিল মব–সদৃশ কার্যক্রম
এই একক ঘটনা নয়। এর আগে গত ২৯ মে রংপুরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের বাড়িতে হামলার ঘটনায়ও ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ও এনসিপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। যদিও তারা পাল্টা অভিযোগ করে বলেছে, আগে তাদের ওপর হামলা হয়েছিল।
তারও আগে, ১৯ মে ঢাকার ধানমন্ডিতে হাক্কানী পাবলিশার্সের সামনে স্লোগান ও বিশৃঙ্খলার সময় পুলিশ তিনজনকে আটক করে। পরে এনসিপির জ্যেষ্ঠ নেতা আবদুল হান্নান মাসউদ মুচলেকার মাধ্যমে তাদের মুক্ত করেন। এরপর তাকে দল থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়, যা পরে প্রত্যাহার করা হয়।
মব নিয়ে দ্বিধান্বিত অবস্থান
এনসিপির নেতাদের বক্তব্যে মব বিষয়ক অবস্থান স্পষ্ট নয়। একদিকে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম মবকে ‘বিক্ষুব্ধ জনতা’ আখ্যা দিয়ে বলেন, “সঠিক নেতৃত্বের অভাবে তাদের কেউ কেউ অন্যদের হাতিয়ার হয়েছে, এটাই আমাদের দুর্বলতা।”
অন্যদিকে দলটির যুগ্ম সদস্য সচিব মুশফিক উস সালেহীন মবে দলের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ সরাসরি নাকচ করে বলেন, “আমরা সবকিছুই নিজেদের নামেই করি। মব বা ছদ্ম পরিচয়ে কিছু করার প্রয়োজন হয় না।”
রাষ্ট্রীয় অবস্থানও বিভ্রান্তিকর
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এনসিপির মতো ভাষা ব্যবহার করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমও। তিনি বলেন, “এগুলো মব নয়, প্রেসার। যারা ১৫ বছর ধরে নিপীড়িত, তারা ক্ষোভ প্রকাশ করছে।” ফলে অনেকের মতে, এই বক্তব্য সরকারি অবস্থানের পক্ষেই কিছুটা সহানুভূতিশীলতা প্রকাশ করছে।
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “সবাই আইনের শাসনের কথা বললেও, আমরা নিজেরাই কখনো কখনো আইন হাতে নিচ্ছি।” তিনি এটিকে রাজনৈতিক নেতাদের দ্বৈত নীতির বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বিশ্লেষক সাব্বির আহমেদ আরও একধাপ এগিয়ে বলেন, “এই মবের পেছনে সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে। মব ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে দমন সহজ হয় এবং এই ভয় প্রদর্শনের রাজনীতি সরকারের পছন্দের হতে পারে।”
কৌশল, না বাস্তবতা?
নতুন উদীয়মান দল হিসেবে এনসিপি নিজেকে ‘দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী শক্তি’ হিসেবে তুলে ধরছে। কিন্তু সম্প্রতি তাদের নেতাকর্মীদের যেসব কর্মকাণ্ড সামনে এসেছে, তাতে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে—এই দল কি শুধুই ন্যায়ের পক্ষে কথা বলছে, না কি নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জনক্ষোভকে ‘মব’ রূপে ব্যবহার করছে?
যদি তারা সত্যিই সহিংসতা ও অনিয়মের বিরুদ্ধে থাকে, তবে দল হিসেবে স্পষ্ট, সংগঠিত এবং আইনের ভিতরে থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করা তাদের দায়িত্ব। নাহলে তারা জনতার ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে মব-রাজনীতির অপবাদে জড়িয়ে যেতে পারে—যা দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক আস্থার বড় সংকটে পরিণত হতে পারে।
সামনের দিনগুলোতে এনসিপি ও তার অঙ্গ সংগঠন কীভাবে এই প্রশ্নগুলোর জবাব দেয়, সেটিই হবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।