মুম্বাইয়ে ১,৫০০ মসজিদ থেকে লাউডস্পিকার সরালো পুলিশ: মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম উদ্বেগ ও ক্ষোভ

- Update Time : ১১:৪২:২২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই ২০২৫
- / ৩২ Time View
ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের রাজধানী মুম্বাইয়ের প্রায় ১,৫০০ মসজিদ ও অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয় থেকে লাউডস্পিকার সরিয়ে নিয়েছে পুলিশ প্রশাসন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে অনেকে একে উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক চাপে পুলিশি পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
কাশ্মীর মিডিয়া সার্ভিসের প্রতিবেদন
কাশ্মীর মিডিয়া সার্ভিসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বুধবার (২ জুলাই) মুম্বাই পুলিশ এই পদক্ষেপ কার্যকর করে। বলা হয়, মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকারের নির্দেশে এবং ধর্মীয় স্থানে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে শহরের বিভিন্ন এলাকার মসজিদ ও অন্যান্য উপাসনালয় থেকে পর্যায়ক্রমে লাউডস্পিকার অপসারণ করা হয়।
পুলিশ প্রশাসনের অবস্থান
মুম্বাই পুলিশ কমিশনার দেবিন ভারতী বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন,
“শুধু মুসলিমদের নয়, শহরের সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে স্থাপিত লাউডস্পিকারের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এটা কোনো একক ধর্মকে লক্ষ্য করে নয়।”
তিনি আরও জানান, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা করেই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পুলিশের দাবি, এই পদক্ষেপ শব্দদূষণ (Noise Pollution) আইন অনুযায়ী, এবং এটি ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে নেওয়া হয়েছে।
শব্দদূষণ (Noise Pollution): পক্ষপাতদুষ্ট পদক্ষেপ
তবে স্থানীয় মুসলিমদের দাবি ভিন্ন। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এই পদক্ষেপ মূলত মুসলিমদের উপাসনালয়কে লক্ষ্য করেই বাস্তবায়িত হচ্ছে। মুসলিম নেতাদের অনেকে অভিযোগ করেন,
“শহরের অনেক মন্দির বা অন্যান্য ধর্মীয় স্থানে আজও লাউডস্পিকার ব্যবহৃত হচ্ছে, অথচ একচেটিয়াভাবে মসজিদগুলোকে এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে।”
তারা মনে করছেন, এই পদক্ষেপ উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর চাপে পুলিশ প্রশাসনের একতরফা সিদ্ধান্ত, যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংবিধানের ধর্মীয় স্বাধীনতার চেতনার বিরুদ্ধে যায়।
আইনি দৃষ্টিকোণ ও সীমাবদ্ধতা
পুলিশ কমিশনার স্পষ্ট করেছেন,
“যেখানে যেখানে লাউডস্পিকার সরানো হয়েছে, সেখানে পুনরায় স্থাপন করা যাবে না। শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসবের সময়, সেটিও নির্দিষ্ট সময় ও অনুমতির ভিত্তিতে অস্থায়ীভাবে ব্যবহার করা যাবে।”
এই সিদ্ধান্ত ভারতের শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০০ অনুসারে নেওয়া হয়েছে বলে প্রশাসনের ভাষ্য। আইনে বলা আছে, রাত ১০টার পর থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কোনো ধরণের উচ্চ শব্দযন্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ, এবং ধর্মীয় স্থানের ক্ষেত্রেও এ নিয়ম প্রযোজ্য।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ প্রতিক্রিয়া
এই পদক্ষেপ এমন এক সময় নেওয়া হলো, যখন মহারাষ্ট্রে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান ও মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা সংকুচিত করার অভিযোগ বারবার উঠছে। এর আগে উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলোতেও আজানের সময় লাউডস্পিকার ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনাগুলো এক ধরনের বৈষম্যমূলক প্রশাসনিক প্রবণতাকে তুলে ধরছে, যেখানে সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে উপেক্ষা করে সংখ্যাগরিষ্ঠদের অনুভূতির উপরই জোর দেওয়া হচ্ছে।
মুম্বাইয়ে মসজিদের লাউডস্পিকার অপসারণ নিঃসন্দেহে একটি সংবেদনশীল ও বিতর্কিত ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন যেখানে এটি আইনানুগ শব্দ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বলছে, সেখানে মুসলিম সম্প্রদায় একে ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ ও বৈষম্যমূলক আচরণ হিসেবে দেখছে।
বর্তমানে সংবিধান, ধর্মীয় অধিকার ও প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা—এই তিনটি প্রশ্ন আবার সামনে এসেছে। এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে আসন্ন সময়ে আইনি চ্যালেঞ্জ, প্রতিবাদ ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও দেখা যেতে পারে। এখন দেখার বিষয়, ভারতের প্রশাসন ও আদালত এই বিষয়ে কী ধরনের অবস্থান গ্রহণ করে।
Please Share This Post in Your Social Media

মুম্বাইয়ে ১,৫০০ মসজিদ থেকে লাউডস্পিকার সরালো পুলিশ: মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম উদ্বেগ ও ক্ষোভ

ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের রাজধানী মুম্বাইয়ের প্রায় ১,৫০০ মসজিদ ও অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয় থেকে লাউডস্পিকার সরিয়ে নিয়েছে পুলিশ প্রশাসন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে অনেকে একে উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক চাপে পুলিশি পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
কাশ্মীর মিডিয়া সার্ভিসের প্রতিবেদন
কাশ্মীর মিডিয়া সার্ভিসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বুধবার (২ জুলাই) মুম্বাই পুলিশ এই পদক্ষেপ কার্যকর করে। বলা হয়, মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকারের নির্দেশে এবং ধর্মীয় স্থানে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে শহরের বিভিন্ন এলাকার মসজিদ ও অন্যান্য উপাসনালয় থেকে পর্যায়ক্রমে লাউডস্পিকার অপসারণ করা হয়।
পুলিশ প্রশাসনের অবস্থান
মুম্বাই পুলিশ কমিশনার দেবিন ভারতী বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন,
“শুধু মুসলিমদের নয়, শহরের সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে স্থাপিত লাউডস্পিকারের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এটা কোনো একক ধর্মকে লক্ষ্য করে নয়।”
তিনি আরও জানান, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা করেই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পুলিশের দাবি, এই পদক্ষেপ শব্দদূষণ (Noise Pollution) আইন অনুযায়ী, এবং এটি ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে নেওয়া হয়েছে।
শব্দদূষণ (Noise Pollution): পক্ষপাতদুষ্ট পদক্ষেপ
তবে স্থানীয় মুসলিমদের দাবি ভিন্ন। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এই পদক্ষেপ মূলত মুসলিমদের উপাসনালয়কে লক্ষ্য করেই বাস্তবায়িত হচ্ছে। মুসলিম নেতাদের অনেকে অভিযোগ করেন,
“শহরের অনেক মন্দির বা অন্যান্য ধর্মীয় স্থানে আজও লাউডস্পিকার ব্যবহৃত হচ্ছে, অথচ একচেটিয়াভাবে মসজিদগুলোকে এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে।”
তারা মনে করছেন, এই পদক্ষেপ উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর চাপে পুলিশ প্রশাসনের একতরফা সিদ্ধান্ত, যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংবিধানের ধর্মীয় স্বাধীনতার চেতনার বিরুদ্ধে যায়।
আইনি দৃষ্টিকোণ ও সীমাবদ্ধতা
পুলিশ কমিশনার স্পষ্ট করেছেন,
“যেখানে যেখানে লাউডস্পিকার সরানো হয়েছে, সেখানে পুনরায় স্থাপন করা যাবে না। শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসবের সময়, সেটিও নির্দিষ্ট সময় ও অনুমতির ভিত্তিতে অস্থায়ীভাবে ব্যবহার করা যাবে।”
এই সিদ্ধান্ত ভারতের শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০০ অনুসারে নেওয়া হয়েছে বলে প্রশাসনের ভাষ্য। আইনে বলা আছে, রাত ১০টার পর থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কোনো ধরণের উচ্চ শব্দযন্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ, এবং ধর্মীয় স্থানের ক্ষেত্রেও এ নিয়ম প্রযোজ্য।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ প্রতিক্রিয়া
এই পদক্ষেপ এমন এক সময় নেওয়া হলো, যখন মহারাষ্ট্রে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান ও মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা সংকুচিত করার অভিযোগ বারবার উঠছে। এর আগে উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলোতেও আজানের সময় লাউডস্পিকার ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনাগুলো এক ধরনের বৈষম্যমূলক প্রশাসনিক প্রবণতাকে তুলে ধরছে, যেখানে সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে উপেক্ষা করে সংখ্যাগরিষ্ঠদের অনুভূতির উপরই জোর দেওয়া হচ্ছে।
মুম্বাইয়ে মসজিদের লাউডস্পিকার অপসারণ নিঃসন্দেহে একটি সংবেদনশীল ও বিতর্কিত ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন যেখানে এটি আইনানুগ শব্দ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বলছে, সেখানে মুসলিম সম্প্রদায় একে ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ ও বৈষম্যমূলক আচরণ হিসেবে দেখছে।
বর্তমানে সংবিধান, ধর্মীয় অধিকার ও প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা—এই তিনটি প্রশ্ন আবার সামনে এসেছে। এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে আসন্ন সময়ে আইনি চ্যালেঞ্জ, প্রতিবাদ ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও দেখা যেতে পারে। এখন দেখার বিষয়, ভারতের প্রশাসন ও আদালত এই বিষয়ে কী ধরনের অবস্থান গ্রহণ করে।