জাপানে মাঝ আকাশে বোয়িং ৭৩৭-এ ভয়াবহ যান্ত্রিক ত্রুটি

- Update Time : ০৬:১৯:৩৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই ২০২৫
- / ৬৯ Time View
জাপানে মাঝ আকাশে বোয়িং ৭৩৭–এ ভয়াবহ যান্ত্রিক ত্রুটি: প্রাণ বাঁচানোর আকুতি ও শেষ বার্তা লিখলেন আতঙ্কিত যাত্রীরা
জাপানে মাঝ আকাশে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজের যাত্রীরা। টোকিওগামী একটি ফ্লাইট হঠাৎ করে যান্ত্রিক ত্রুটির শিকার হয়ে মাত্র ১০ মিনিটের ব্যবধানে প্রায় ২৬ হাজার ফুট নিচে নেমে আসে। অকস্মাৎ ঘটে যাওয়া এ ঘটনায় বিমানের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক, চোখের সামনে মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করে অনেক যাত্রী তাদের পরিবারের উদ্দেশ্যে শেষবারের মতো চিঠি বা বার্তা লিখে রাখেন—যেন এটি ছিল জীবনের শেষ মুহূর্ত।
ঘটনাটি ঘটেছে সোমবার (৩০ জুন) সন্ধ্যায়। স্প্রিং জাপান নামক প্রতিষ্ঠানটি জাপান এয়ারলাইন্সের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। তাদের পরিচালিত ফ্লাইট জেএল৮৬৯৬/আইজে০০৪ চীনের সাংহাই পুডং বিমানবন্দর থেকে জাপানের টোকিওর নারিতা বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল। ফ্লাইটটিতে ১৯১ জন যাত্রী ও ক্রু সদস্য ছিলেন।
কীভাবে ঘটল ঘটনাটি?
জাপানের স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর বরাতে জানা যায়, স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৫৩ মিনিটে উড়োজাহাজটি যখন ৩৬ হাজার ফুট উচ্চতায় ছিল, তখন হঠাৎ প্রেসারাইজেশন সিস্টেমে মারাত্মক ত্রুটি দেখা দেয়। অর্থাৎ, বিমানের অভ্যন্তরে প্রয়োজনীয় চাপ বজায় রাখতে না পারায় অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। এর ফলে বিমানের স্বয়ংক্রিয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে যায় এবং যাত্রীদের জন্য অক্সিজেন মাস্ক খুলে পড়ে।
মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে বিমানটি ৩৬ হাজার ফুট থেকে নেমে আসে ১০ হাজার ৫০০ ফুটে। এটি ছিল এক ভয়ঙ্কর পতনের অভিজ্ঞতা। যাত্রীরা কেউ কেউ ঘুমিয়ে ছিলেন, কেউ তখন খাবার খাচ্ছিলেন, হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় বিমানের ভেতরে চিৎকার ও কান্নার শব্দে ভরে ওঠে পুরো কেবিন।
যাত্রীদের অভিজ্ঞতা
একজন যাত্রী মার্কিন সংবাদমাধ্যম Associated Press (AP)-কে বলেন,
“একটা বিকট শব্দ হলো, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমার সামনের মাস্কটি খুলে পড়ল। তখনই বিমানের এক এয়ার হোস্টেস আতঙ্কিত গলায় চিৎকার করে বলছিলেন, ‘মাস্ক পরুন, সমস্যা হয়েছে।’ বুঝতেই পারিনি, কী ঘটছে।”
আরেক যাত্রী বলেন,
“আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি, আশেপাশে সবাই মাস্ক পরে বসে আছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।”
সবচেয়ে হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতা জানান আরেক আতঙ্কগ্রস্ত যাত্রী। তিনি বলেন,
“আমি তখন ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করি। নিশ্চিত ছিলাম—আমরা হয়তো আর বাঁচব না। আমি আমার পরিবারকে বিদায় জানিয়ে মোবাইলে একটা শেষ মেসেজ লিখি, ইনস্যুরেন্স পলিসির নম্বর, ব্যাংক কার্ডের পিন নম্বরসহ সব লিখে রাখি যেন মৃত্যুর পর পরিবার কষ্ট না পায়।”
জরুরি অবতরণ ও পরবর্তী ব্যবস্থা
এই ভয়াবহ পরিস্থিতি সামাল দিতে পাইলট দ্রুত বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ফ্লাইটটি ওসাকার কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণের সিদ্ধান্ত নেন। রাত ৮টা ৫০ মিনিটে বিমানটি নিরাপদে অবতরণ করে। সৌভাগ্যবশত, কোনো যাত্রী বা ক্রু আহত হননি।
ঘটনার পরপরই বিমানটি যান্ত্রিক পরীক্ষার আওতায় আনা হয়। জাপানের পরিবহন মন্ত্রণালয় ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে এবং বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের উড়োজাহাজটির প্রেসারাইজেশন সিস্টেমে কী ধরনের ত্রুটি দেখা দিয়েছিল তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ক্ষতিপূরণ ও যাত্রীসেবা
এই ভীতিকর অভিজ্ঞতার জন্য প্রতিটি যাত্রীকে ১৫ হাজার ইয়েন (প্রায় ৯৩ মার্কিন ডলার) ক্ষতিপূরণ প্রদান করেছে কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে যাত্রীদের জন্য এক রাতের হোটেল ব্যবস্থা ও পরবর্তী ফ্লাইটে গন্তব্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে।
যদিও এখন পর্যন্ত জাপান এয়ারলাইন্স বা পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিস্তারিত কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি, তবে এমন একটি ঘটনা দেশটির বিমান চলাচল নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তুলেছে।
পূর্ব অভিজ্ঞতা ও নিরাপত্তা প্রশ্ন
উল্লেখ্য, বোয়িং ৭৩৭ মডেলটি নিয়ে আগেও বিভিন্ন দেশে যান্ত্রিক ত্রুটি বা দুর্ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। বিশেষ করে ৭৩৭ ম্যাক্স সিরিজের একাধিক দুর্ঘটনার কারণে বোয়িং-এর এই সিরিজ নিয়ে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল। যদিও এই ফ্লাইটটি ৭৩৭-৮০০ সিরিজের, তবুও মাঝ আকাশে অক্সিজেনের ঘাটতির মত ঘটনা যেকোনো সময় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
এখন বিশ্বজুড়ে এ ঘটনাটি নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অনেকে মনে করছেন, এ ঘটনা শুধু প্রযুক্তিগত নয়, মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও যাত্রীদের ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ফের প্রমাণিত হলো—বিমানের যেকোনো যান্ত্রিক ত্রুটি মুহূর্তেই এক প্রাণঘাতী পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা বাড়লেও, জীবন কখন যে বিপদের মুখে পড়বে তা কেউ জানে না। যাত্রীরা বেঁচে ফিরেছেন ঠিকই, কিন্তু তাদের জীবনের সেই কয়েকটি মুহূর্ত—যেখানে তারা ভাবছিলেন ‘এটাই শেষ’—তা চিরকাল তাদের মনের গভীরে দাগ কেটে থাকবে।
Please Share This Post in Your Social Media

জাপানে মাঝ আকাশে বোয়িং ৭৩৭-এ ভয়াবহ যান্ত্রিক ত্রুটি

জাপানে মাঝ আকাশে বোয়িং ৭৩৭–এ ভয়াবহ যান্ত্রিক ত্রুটি: প্রাণ বাঁচানোর আকুতি ও শেষ বার্তা লিখলেন আতঙ্কিত যাত্রীরা
জাপানে মাঝ আকাশে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজের যাত্রীরা। টোকিওগামী একটি ফ্লাইট হঠাৎ করে যান্ত্রিক ত্রুটির শিকার হয়ে মাত্র ১০ মিনিটের ব্যবধানে প্রায় ২৬ হাজার ফুট নিচে নেমে আসে। অকস্মাৎ ঘটে যাওয়া এ ঘটনায় বিমানের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক, চোখের সামনে মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করে অনেক যাত্রী তাদের পরিবারের উদ্দেশ্যে শেষবারের মতো চিঠি বা বার্তা লিখে রাখেন—যেন এটি ছিল জীবনের শেষ মুহূর্ত।
ঘটনাটি ঘটেছে সোমবার (৩০ জুন) সন্ধ্যায়। স্প্রিং জাপান নামক প্রতিষ্ঠানটি জাপান এয়ারলাইন্সের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। তাদের পরিচালিত ফ্লাইট জেএল৮৬৯৬/আইজে০০৪ চীনের সাংহাই পুডং বিমানবন্দর থেকে জাপানের টোকিওর নারিতা বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল। ফ্লাইটটিতে ১৯১ জন যাত্রী ও ক্রু সদস্য ছিলেন।
কীভাবে ঘটল ঘটনাটি?
জাপানের স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর বরাতে জানা যায়, স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৫৩ মিনিটে উড়োজাহাজটি যখন ৩৬ হাজার ফুট উচ্চতায় ছিল, তখন হঠাৎ প্রেসারাইজেশন সিস্টেমে মারাত্মক ত্রুটি দেখা দেয়। অর্থাৎ, বিমানের অভ্যন্তরে প্রয়োজনীয় চাপ বজায় রাখতে না পারায় অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। এর ফলে বিমানের স্বয়ংক্রিয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে যায় এবং যাত্রীদের জন্য অক্সিজেন মাস্ক খুলে পড়ে।
মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে বিমানটি ৩৬ হাজার ফুট থেকে নেমে আসে ১০ হাজার ৫০০ ফুটে। এটি ছিল এক ভয়ঙ্কর পতনের অভিজ্ঞতা। যাত্রীরা কেউ কেউ ঘুমিয়ে ছিলেন, কেউ তখন খাবার খাচ্ছিলেন, হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় বিমানের ভেতরে চিৎকার ও কান্নার শব্দে ভরে ওঠে পুরো কেবিন।
যাত্রীদের অভিজ্ঞতা
একজন যাত্রী মার্কিন সংবাদমাধ্যম Associated Press (AP)-কে বলেন,
“একটা বিকট শব্দ হলো, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমার সামনের মাস্কটি খুলে পড়ল। তখনই বিমানের এক এয়ার হোস্টেস আতঙ্কিত গলায় চিৎকার করে বলছিলেন, ‘মাস্ক পরুন, সমস্যা হয়েছে।’ বুঝতেই পারিনি, কী ঘটছে।”
আরেক যাত্রী বলেন,
“আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি, আশেপাশে সবাই মাস্ক পরে বসে আছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।”
সবচেয়ে হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতা জানান আরেক আতঙ্কগ্রস্ত যাত্রী। তিনি বলেন,
“আমি তখন ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করি। নিশ্চিত ছিলাম—আমরা হয়তো আর বাঁচব না। আমি আমার পরিবারকে বিদায় জানিয়ে মোবাইলে একটা শেষ মেসেজ লিখি, ইনস্যুরেন্স পলিসির নম্বর, ব্যাংক কার্ডের পিন নম্বরসহ সব লিখে রাখি যেন মৃত্যুর পর পরিবার কষ্ট না পায়।”
জরুরি অবতরণ ও পরবর্তী ব্যবস্থা
এই ভয়াবহ পরিস্থিতি সামাল দিতে পাইলট দ্রুত বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ফ্লাইটটি ওসাকার কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণের সিদ্ধান্ত নেন। রাত ৮টা ৫০ মিনিটে বিমানটি নিরাপদে অবতরণ করে। সৌভাগ্যবশত, কোনো যাত্রী বা ক্রু আহত হননি।
ঘটনার পরপরই বিমানটি যান্ত্রিক পরীক্ষার আওতায় আনা হয়। জাপানের পরিবহন মন্ত্রণালয় ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে এবং বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের উড়োজাহাজটির প্রেসারাইজেশন সিস্টেমে কী ধরনের ত্রুটি দেখা দিয়েছিল তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ক্ষতিপূরণ ও যাত্রীসেবা
এই ভীতিকর অভিজ্ঞতার জন্য প্রতিটি যাত্রীকে ১৫ হাজার ইয়েন (প্রায় ৯৩ মার্কিন ডলার) ক্ষতিপূরণ প্রদান করেছে কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে যাত্রীদের জন্য এক রাতের হোটেল ব্যবস্থা ও পরবর্তী ফ্লাইটে গন্তব্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে।
যদিও এখন পর্যন্ত জাপান এয়ারলাইন্স বা পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিস্তারিত কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি, তবে এমন একটি ঘটনা দেশটির বিমান চলাচল নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তুলেছে।
পূর্ব অভিজ্ঞতা ও নিরাপত্তা প্রশ্ন
উল্লেখ্য, বোয়িং ৭৩৭ মডেলটি নিয়ে আগেও বিভিন্ন দেশে যান্ত্রিক ত্রুটি বা দুর্ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। বিশেষ করে ৭৩৭ ম্যাক্স সিরিজের একাধিক দুর্ঘটনার কারণে বোয়িং-এর এই সিরিজ নিয়ে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল। যদিও এই ফ্লাইটটি ৭৩৭-৮০০ সিরিজের, তবুও মাঝ আকাশে অক্সিজেনের ঘাটতির মত ঘটনা যেকোনো সময় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
এখন বিশ্বজুড়ে এ ঘটনাটি নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অনেকে মনে করছেন, এ ঘটনা শুধু প্রযুক্তিগত নয়, মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও যাত্রীদের ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ফের প্রমাণিত হলো—বিমানের যেকোনো যান্ত্রিক ত্রুটি মুহূর্তেই এক প্রাণঘাতী পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা বাড়লেও, জীবন কখন যে বিপদের মুখে পড়বে তা কেউ জানে না। যাত্রীরা বেঁচে ফিরেছেন ঠিকই, কিন্তু তাদের জীবনের সেই কয়েকটি মুহূর্ত—যেখানে তারা ভাবছিলেন ‘এটাই শেষ’—তা চিরকাল তাদের মনের গভীরে দাগ কেটে থাকবে।