সময়: বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ভোটকেন্দ্র স্থাপনায় ডিসি-এসপি নয়, ক্ষমতা ফিরল নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের হাতে

ডিজিটাল ডেস্ক
  • Update Time : ০৭:০২:৩২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫
  • / ৫৯ Time View

470dcc2b26c3964c844dae331c85e20e 677582f1d5345

 

470dcc2b26c3964c844dae331c85e20e 677582f1d5345

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র স্থাপন ও ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সংশোধিত নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, ভোটকেন্দ্র স্থাপনে আর জেলা প্রশাসক (ডিসি) বা পুলিশ সুপার (এসপি) কোনো কর্তৃত্ব রাখবেন না। পরিবর্তে এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এখন থেকে পালন করবেন ইসির নিজস্ব মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

সোমবার (৩০ জুন) ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০২৫’ গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন, যেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে এই পরিবর্তনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের জন্য কক্ষ নির্ধারণের বিষয়টিও নতুন নীতিমালা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

অতীতের বিতর্কিত কাঠামো পরিবর্তন

২০২৩ সালের ভোটকেন্দ্র স্থাপন নীতিমালায় তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন জেলা প্রশাসন ও পুলিশের অংশগ্রহণে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের জন্য একটি যৌথ কমিটি গঠন করেছিল। সেই সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের উপজেলা কমিটি এবং ডিসির নেতৃত্বে সাত সদস্যের জেলা কমিটি গঠনের বিধান রাখা হয়।

এই কমিটিগুলোই সরেজমিনে গিয়ে ভোটকেন্দ্রের সম্ভাব্য স্থান চিহ্নিত করে মতামত পাঠাতো ইসিতে। তবে এটি নিয়েই তখন থেকেই নানা বিতর্ক, অসন্তোষ এবং নির্বাচন কমিশনের ভেতরেই দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। অনেকেই এই কাঠামোকে কমিশনের সাংবিধানিক কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ন করার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেছিলেন।

বর্তমান কমিশনের দৃঢ় পদক্ষেপ

বর্তমান কমিশনের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে গত ২১ মে অনুষ্ঠিত পঞ্চম কমিশন সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ডিসি-এসপি নেতৃত্বাধীন কমিটি বিলুপ্ত করে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। সভা শেষে কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের জানান, “ভোটকেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত আগের কমিটি এবার বাতিল করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টিও বাদ দেওয়া হয়েছে।”

নতুন নীতিমালার মূল বৈশিষ্ট্য

  • ভোটকেন্দ্র স্থাপন ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব শুধু নির্বাচন কমিশনের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ওপর বর্তাবে।
  • উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ডিসি-ইউএনও নেতৃত্বাধীন কমিটি বিলুপ্ত।
  • ইভিএম কক্ষ নির্ধারণের বিধান বাতিল।
  • পূর্বের মতো প্রতি ৩,০০০ ভোটারের জন্য একটি কেন্দ্র এবং ৫০০ পুরুষ ও ৪০০ নারীর জন্য একটি করে ভোটকক্ষ নির্ধারিত থাকবে।

ভোটার সংখ্যা বাড়লে বাড়তে পারে কেন্দ্রও

২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশে মোট ভোটকেন্দ্র ছিল প্রায় ৪২ হাজার। এবার ভোটার সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটিতে পৌঁছতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সে অনুযায়ী, নতুন নীতিমালার আওতায় ভোটকেন্দ্রের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে পারে।

নির্বাচন কমিশনের বার্তা: নিরপেক্ষতা স্বচ্ছতা

এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন অনেক নির্বাচন বিশ্লেষক ও ইসির অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তারা। তাদের মতে, এ উদ্যোগ নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার একটি সাহসী পদক্ষেপ। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ নিয়ে যে প্রশ্ন ছিল, তা দূর করার একটি কার্যকর উদ্যোগ হিসেবে এটি বিবেচিত হচ্ছে।

একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা বলেন, “ভোটকেন্দ্রের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হলে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা নির্বাচন কমিশনের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থাকা জরুরি। প্রশাসনের হাতে এ দায়িত্ব থাকলে প্রভাব বিস্তারের শঙ্কা থেকেই যায়।”

সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজই হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা। আর সেই লক্ষ্যেই নতুন নীতিমালা বাস্তবায়ন করে কমিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি এখন এই নতুন কাঠামোর আলোকে এগোবে—যেখানে ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ হবে স্বাধীনভাবে, প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই। এটি শুধু নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা বাড়াবে না, বরং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে এক সাহসী অগ্রগতি বলেও বিবেচিত হবে।

 

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

ভোটকেন্দ্র স্থাপনায় ডিসি-এসপি নয়, ক্ষমতা ফিরল নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের হাতে

Update Time : ০৭:০২:৩২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫

 

470dcc2b26c3964c844dae331c85e20e 677582f1d5345

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র স্থাপন ও ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সংশোধিত নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, ভোটকেন্দ্র স্থাপনে আর জেলা প্রশাসক (ডিসি) বা পুলিশ সুপার (এসপি) কোনো কর্তৃত্ব রাখবেন না। পরিবর্তে এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এখন থেকে পালন করবেন ইসির নিজস্ব মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

সোমবার (৩০ জুন) ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০২৫’ গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন, যেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে এই পরিবর্তনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের জন্য কক্ষ নির্ধারণের বিষয়টিও নতুন নীতিমালা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

অতীতের বিতর্কিত কাঠামো পরিবর্তন

২০২৩ সালের ভোটকেন্দ্র স্থাপন নীতিমালায় তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন জেলা প্রশাসন ও পুলিশের অংশগ্রহণে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের জন্য একটি যৌথ কমিটি গঠন করেছিল। সেই সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের উপজেলা কমিটি এবং ডিসির নেতৃত্বে সাত সদস্যের জেলা কমিটি গঠনের বিধান রাখা হয়।

এই কমিটিগুলোই সরেজমিনে গিয়ে ভোটকেন্দ্রের সম্ভাব্য স্থান চিহ্নিত করে মতামত পাঠাতো ইসিতে। তবে এটি নিয়েই তখন থেকেই নানা বিতর্ক, অসন্তোষ এবং নির্বাচন কমিশনের ভেতরেই দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। অনেকেই এই কাঠামোকে কমিশনের সাংবিধানিক কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ন করার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেছিলেন।

বর্তমান কমিশনের দৃঢ় পদক্ষেপ

বর্তমান কমিশনের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে গত ২১ মে অনুষ্ঠিত পঞ্চম কমিশন সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ডিসি-এসপি নেতৃত্বাধীন কমিটি বিলুপ্ত করে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। সভা শেষে কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের জানান, “ভোটকেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত আগের কমিটি এবার বাতিল করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টিও বাদ দেওয়া হয়েছে।”

নতুন নীতিমালার মূল বৈশিষ্ট্য

  • ভোটকেন্দ্র স্থাপন ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব শুধু নির্বাচন কমিশনের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ওপর বর্তাবে।
  • উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ডিসি-ইউএনও নেতৃত্বাধীন কমিটি বিলুপ্ত।
  • ইভিএম কক্ষ নির্ধারণের বিধান বাতিল।
  • পূর্বের মতো প্রতি ৩,০০০ ভোটারের জন্য একটি কেন্দ্র এবং ৫০০ পুরুষ ও ৪০০ নারীর জন্য একটি করে ভোটকক্ষ নির্ধারিত থাকবে।

ভোটার সংখ্যা বাড়লে বাড়তে পারে কেন্দ্রও

২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশে মোট ভোটকেন্দ্র ছিল প্রায় ৪২ হাজার। এবার ভোটার সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটিতে পৌঁছতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সে অনুযায়ী, নতুন নীতিমালার আওতায় ভোটকেন্দ্রের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে পারে।

নির্বাচন কমিশনের বার্তা: নিরপেক্ষতা স্বচ্ছতা

এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন অনেক নির্বাচন বিশ্লেষক ও ইসির অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তারা। তাদের মতে, এ উদ্যোগ নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার একটি সাহসী পদক্ষেপ। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ নিয়ে যে প্রশ্ন ছিল, তা দূর করার একটি কার্যকর উদ্যোগ হিসেবে এটি বিবেচিত হচ্ছে।

একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা বলেন, “ভোটকেন্দ্রের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হলে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা নির্বাচন কমিশনের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থাকা জরুরি। প্রশাসনের হাতে এ দায়িত্ব থাকলে প্রভাব বিস্তারের শঙ্কা থেকেই যায়।”

সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজই হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা। আর সেই লক্ষ্যেই নতুন নীতিমালা বাস্তবায়ন করে কমিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি এখন এই নতুন কাঠামোর আলোকে এগোবে—যেখানে ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ হবে স্বাধীনভাবে, প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই। এটি শুধু নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা বাড়াবে না, বরং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে এক সাহসী অগ্রগতি বলেও বিবেচিত হবে।