ইসলাম কোনো ধর্ম নয় বলে কটাক্ষ: যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ইসলামবিদ্বেষের নতুন ঢেউ

- Update Time : ১১:৩২:০৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫
- / ৪৫ Time View
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ইসলামবিদ্বেষের ঘটনা নতুন করে উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে, নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারিতে মুসলিম প্রার্থী জোহরান মামদানির প্রার্থীতা নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে এ বিদ্বেষ আরও বেশি প্রকাশ্য ও উগ্র রূপ নিচ্ছে। একাধিক মার্কিন রাজনীতিক, সামাজিক মাধ্যমে প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং রক্ষণশীল গোষ্ঠী তাকে ঘিরে মুসলিমবিরোধী প্রচারণা জোরদার করেছেন।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কেবল অনলাইন বেনামি ব্যবহারকারী নয়, বরং প্রভাবশালী রাজনীতিবিদরাও মামদানিকে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে আক্রমণ করছেন। রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান র্যান্ডি ফাইন, কোনোরকম প্রমাণ ছাড়াই, দাবি করেছেন—মামদানি জিতলে নিউ ইয়র্ক সিটিতে ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠিত হবে।
কংগ্রেসওম্যান মার্জোরি টেলর গ্রিন আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) বোরকা পরা স্ট্যাচু অফ লিবার্টির একটি কার্টুন পোস্ট করেছেন, যা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
এছাড়া সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিন প্রকাশ্যে বলেছেন, “ইসলাম কোনো ধর্ম নয়, এটি একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ।” তার এই বক্তব্য ইসলামবিদ্বেষকে শুধু উসকেই দেয়নি, বরং ইসলামকে নিয়ে মার্কিন সমাজে একটি বিভ্রান্তিকর বার্তাও ছড়িয়ে দিয়েছে।
রক্ষণশীল কর্মী চার্লি কার্ক ৯/১১ হামলার প্রসঙ্গ টেনে এনে মামদানিকে ‘মুসলিম মাওবাদী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। ডানপন্থী ভাষ্যকার অ্যাঞ্জি ওং বলেন, নিউ ইয়র্কবাসীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন কারণ তারা একজন মুসলিম মেয়রের সঙ্গে বসবাস করছেন। এই বক্তব্যগুলো সরাসরি ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক এবং মার্কিন সমাজে মুসলিম নাগরিকদের হুমকির মুখে ফেলছে।
ডানপন্থী কর্মী ও ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ লরা লুমার লিখেছেন, মামদানি মেয়র হলে নিউ ইয়র্কে আবার ৯/১১-এর মতো হামলা ঘটবে। তিনি তাকে ‘জিহাদি মুসলিম’ বলেও উল্লেখ করেছেন। এমন বক্তব্য শুধু ইসলামবিদ্বেষ নয়, বরং মার্কিন মুসলিম সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগজনক সংকেত বহন করে।
নিউ ইয়র্ক সিটির কাউন্সিল সদস্য ভিকি পালাদিনো এক রেডিও সাক্ষাৎকারে মামদানিকে ‘পরিচিত জিহাদি সন্ত্রাসী’ এবং ‘কমিউনিস্ট’ আখ্যা দেন। তার মার্কিন নাগরিকত্ব থাকা সত্ত্বেও তাকে দেশ থেকে বের করে দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

রিপাবলিকান প্রতিনিধি অ্যান্ডি ওগলেস যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগে একটি চিঠি পাঠিয়ে মামদানির নাগরিকত্ব বাতিল এবং তাকে নির্বাসনের দাবি জানান। এইসব বক্তব্য ব্যক্তি অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও নাগরিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই বিদ্বেষপূর্ণ আবহে কংগ্রেসম্যান ব্র্যান্ডন গিল মামদানির বিরিয়ানি খাওয়ার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করে কটাক্ষ করেন, “যুক্তরাষ্ট্রের সভ্য মানুষরা এভাবে খায় না।” এমন মন্তব্য শুধু একজন প্রার্থীর খাদ্যাভ্যাসকে নয়, বরং তৃতীয় বিশ্বের প্রতি একটি ঔপনিবেশিক ও বর্ণবাদী মানসিকতাকে তুলে ধরে।
এদিকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও মামদানিকে নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। তিনি মামদানিকে ‘শতভাগ কমিউনিস্ট উন্মাদ’ বলে অভিহিত করেন এবং তার চেহারা ও কণ্ঠস্বর নিয়েও বিদ্রূপ করেন। যদিও তিনি সরাসরি ধর্ম বা জাতিগত পরিচয় উল্লেখ করেননি, তবে তার ইঙ্গিত যথেষ্ট স্পষ্ট ছিল।
মার্কিন মুসলিম নাগরিক অধিকার সংগঠন CAIR-এর (Council on American-Islamic Relations) গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি পরিচালক কোরি সাইলর The Guardian-কে বলেন, “বর্তমানে যেসব প্রতিক্রিয়া আমরা দেখছি, তা শুধু ইসলামবিদ্বেষেরই বহিঃপ্রকাশ।” তিনি সতর্ক করে দেন, “২০১০ সালে গ্রাউন্ড জিরোর কাছে ইসলামিক কালচারাল সেন্টার নির্মাণ নিয়ে যে জাতীয় বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, এখনকার পরিস্থিতি তারই পুনরাবৃত্তি হতে পারে।”
এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, আমেরিকার ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুসংস্কৃতির সমাজে ইসলামবিদ্বেষ এখন আর প্রান্তিক চিন্তাভাবনা নয়, বরং রাজনৈতিক মূলধারায় ঢুকে পড়েছে। একদিকে, এই অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানসম্মত ধর্মীয় স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, অন্যদিকে এর ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর বাড়তি সামাজিক চাপ ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হচ্ছে।
যেখানে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে ‘অবস্নুটি হ্যাভেন’ বা ধর্মীয় স্বাধীনতার আশ্রয়স্থল হিসেবে উপস্থাপন করে, সেখানে একজন মুসলিম প্রার্থী শুধুমাত্র তার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে এমন তীব্র ও প্রকাশ্য বিদ্বেষের মুখে পড়লে তা দেশটির গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সহনশীল সমাজব্যবস্থার জন্য এক বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ হিসেবেই বিবেচিত হবে।
সর্বশেষ পরিস্থিতি ইঙ্গিত দিচ্ছে, ২০২৪ সালের নির্বাচনী রাজনীতিতে মুসলিমদের ভূমিকা, ধর্মীয় পরিচয় এবং আমেরিকান পরিচয়ের সংজ্ঞা নিয়েই আরও তীব্র বিতর্ক, উত্তেজনা ও সংঘর্ষ দেখা যেতে পারে। এই বিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও জনসচেতনতা জরুরি হয়ে উঠছে এখনই।
Please Share This Post in Your Social Media

ইসলাম কোনো ধর্ম নয় বলে কটাক্ষ: যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ইসলামবিদ্বেষের নতুন ঢেউ

সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ইসলামবিদ্বেষের ঘটনা নতুন করে উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে, নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারিতে মুসলিম প্রার্থী জোহরান মামদানির প্রার্থীতা নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে এ বিদ্বেষ আরও বেশি প্রকাশ্য ও উগ্র রূপ নিচ্ছে। একাধিক মার্কিন রাজনীতিক, সামাজিক মাধ্যমে প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং রক্ষণশীল গোষ্ঠী তাকে ঘিরে মুসলিমবিরোধী প্রচারণা জোরদার করেছেন।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কেবল অনলাইন বেনামি ব্যবহারকারী নয়, বরং প্রভাবশালী রাজনীতিবিদরাও মামদানিকে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে আক্রমণ করছেন। রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান র্যান্ডি ফাইন, কোনোরকম প্রমাণ ছাড়াই, দাবি করেছেন—মামদানি জিতলে নিউ ইয়র্ক সিটিতে ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠিত হবে।
কংগ্রেসওম্যান মার্জোরি টেলর গ্রিন আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) বোরকা পরা স্ট্যাচু অফ লিবার্টির একটি কার্টুন পোস্ট করেছেন, যা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
এছাড়া সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিন প্রকাশ্যে বলেছেন, “ইসলাম কোনো ধর্ম নয়, এটি একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ।” তার এই বক্তব্য ইসলামবিদ্বেষকে শুধু উসকেই দেয়নি, বরং ইসলামকে নিয়ে মার্কিন সমাজে একটি বিভ্রান্তিকর বার্তাও ছড়িয়ে দিয়েছে।
রক্ষণশীল কর্মী চার্লি কার্ক ৯/১১ হামলার প্রসঙ্গ টেনে এনে মামদানিকে ‘মুসলিম মাওবাদী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। ডানপন্থী ভাষ্যকার অ্যাঞ্জি ওং বলেন, নিউ ইয়র্কবাসীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন কারণ তারা একজন মুসলিম মেয়রের সঙ্গে বসবাস করছেন। এই বক্তব্যগুলো সরাসরি ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক এবং মার্কিন সমাজে মুসলিম নাগরিকদের হুমকির মুখে ফেলছে।
ডানপন্থী কর্মী ও ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ লরা লুমার লিখেছেন, মামদানি মেয়র হলে নিউ ইয়র্কে আবার ৯/১১-এর মতো হামলা ঘটবে। তিনি তাকে ‘জিহাদি মুসলিম’ বলেও উল্লেখ করেছেন। এমন বক্তব্য শুধু ইসলামবিদ্বেষ নয়, বরং মার্কিন মুসলিম সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগজনক সংকেত বহন করে।
নিউ ইয়র্ক সিটির কাউন্সিল সদস্য ভিকি পালাদিনো এক রেডিও সাক্ষাৎকারে মামদানিকে ‘পরিচিত জিহাদি সন্ত্রাসী’ এবং ‘কমিউনিস্ট’ আখ্যা দেন। তার মার্কিন নাগরিকত্ব থাকা সত্ত্বেও তাকে দেশ থেকে বের করে দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

রিপাবলিকান প্রতিনিধি অ্যান্ডি ওগলেস যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগে একটি চিঠি পাঠিয়ে মামদানির নাগরিকত্ব বাতিল এবং তাকে নির্বাসনের দাবি জানান। এইসব বক্তব্য ব্যক্তি অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও নাগরিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই বিদ্বেষপূর্ণ আবহে কংগ্রেসম্যান ব্র্যান্ডন গিল মামদানির বিরিয়ানি খাওয়ার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করে কটাক্ষ করেন, “যুক্তরাষ্ট্রের সভ্য মানুষরা এভাবে খায় না।” এমন মন্তব্য শুধু একজন প্রার্থীর খাদ্যাভ্যাসকে নয়, বরং তৃতীয় বিশ্বের প্রতি একটি ঔপনিবেশিক ও বর্ণবাদী মানসিকতাকে তুলে ধরে।
এদিকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও মামদানিকে নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। তিনি মামদানিকে ‘শতভাগ কমিউনিস্ট উন্মাদ’ বলে অভিহিত করেন এবং তার চেহারা ও কণ্ঠস্বর নিয়েও বিদ্রূপ করেন। যদিও তিনি সরাসরি ধর্ম বা জাতিগত পরিচয় উল্লেখ করেননি, তবে তার ইঙ্গিত যথেষ্ট স্পষ্ট ছিল।
মার্কিন মুসলিম নাগরিক অধিকার সংগঠন CAIR-এর (Council on American-Islamic Relations) গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি পরিচালক কোরি সাইলর The Guardian-কে বলেন, “বর্তমানে যেসব প্রতিক্রিয়া আমরা দেখছি, তা শুধু ইসলামবিদ্বেষেরই বহিঃপ্রকাশ।” তিনি সতর্ক করে দেন, “২০১০ সালে গ্রাউন্ড জিরোর কাছে ইসলামিক কালচারাল সেন্টার নির্মাণ নিয়ে যে জাতীয় বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, এখনকার পরিস্থিতি তারই পুনরাবৃত্তি হতে পারে।”
এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, আমেরিকার ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুসংস্কৃতির সমাজে ইসলামবিদ্বেষ এখন আর প্রান্তিক চিন্তাভাবনা নয়, বরং রাজনৈতিক মূলধারায় ঢুকে পড়েছে। একদিকে, এই অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানসম্মত ধর্মীয় স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, অন্যদিকে এর ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর বাড়তি সামাজিক চাপ ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হচ্ছে।
যেখানে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে ‘অবস্নুটি হ্যাভেন’ বা ধর্মীয় স্বাধীনতার আশ্রয়স্থল হিসেবে উপস্থাপন করে, সেখানে একজন মুসলিম প্রার্থী শুধুমাত্র তার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে এমন তীব্র ও প্রকাশ্য বিদ্বেষের মুখে পড়লে তা দেশটির গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সহনশীল সমাজব্যবস্থার জন্য এক বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ হিসেবেই বিবেচিত হবে।
সর্বশেষ পরিস্থিতি ইঙ্গিত দিচ্ছে, ২০২৪ সালের নির্বাচনী রাজনীতিতে মুসলিমদের ভূমিকা, ধর্মীয় পরিচয় এবং আমেরিকান পরিচয়ের সংজ্ঞা নিয়েই আরও তীব্র বিতর্ক, উত্তেজনা ও সংঘর্ষ দেখা যেতে পারে। এই বিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও জনসচেতনতা জরুরি হয়ে উঠছে এখনই।