ইতালিতে আবারও বাংলাদেশি যুবক ছুরিকাঘাতে নিহত — রোমে প্রবাসীদের মধ্যে শোক, আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা

- Update Time : ০৬:১৩:০০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫
- / ৩৮ Time View

ইতালির রাজধানী রোমে আবারও ঘটে গেল মর্মান্তিক একটি হত্যাকাণ্ড। ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন মামুন খান (২২) নামের এক বাংলাদেশি তরুণ। স্থানীয় সময় শনিবার দিবাগত রাত ১২টা ১৫ মিনিটে রোমের ক্রিস্টোফোরো কলম্বো সড়কে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, এটি নিছক ছিনতাই নয়, বরং পূর্বপরিকল্পিত হত্যার শিকার হয়েছেন মামুন। এখনো পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ, তবে তদন্ত চলছে জোরেশোরে।
নিহত মামুন খানের বাড়ি বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলায়। জীবিকার তাগিদে প্রায় তিন বছর আগে রোমানিয়া হয়ে ইতালিতে আসেন তিনি। রোমে একটি স্থানীয় রেস্তোরাঁয় কাজ করতেন এবং খুব দ্রুত নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে নিয়োজিত ছিলেন।
ঘটনাস্থলে কী ঘটেছিল?
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, ঘটনার দিন রাতে কাজ শেষে মামুন কয়েকজন স্বদেশি যুবকের সঙ্গে পার্কে বসেছিলেন। এ সময় পার্কের কিছুটা দূরে এক যুবককে ছিনতাইয়ের চেষ্টা করা হয়। আতঙ্কিত সেই যুবক দৌড়ে এসে মামুনদের কাছে সাহায্য চান। সবাই মিলে ছিনতাইকারীকে ধাওয়া দিলে সে পালিয়ে যায়। কিছু সময় পর ওই ব্যক্তি পিছন থেকে মামুনের দিকে কিছু একটা নিক্ষেপ করে এবং মামুন যখন তাকে ধাওয়া করেন, তখনই ছিনতাইকারী হঠাৎ সামনে এসে ধারালো ছুরি দিয়ে মামুনকে আঘাত করে দ্রুত পালিয়ে যায়।
সাথে সাথে মামুনের সহকর্মীরা জরুরি সেবা নম্বর (ARES 118)-এ ফোন করলে মেডিকেল টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। তবে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার সময় তার মোবাইল, মানিব্যাগসহ ব্যক্তিগত সামগ্রী অক্ষত ছিল, যা নিশ্চিত করে যে এটি ছিনতাই নয়, বরং পূর্বপরিকল্পিত আক্রমণ।
তদন্তে অগ্রগতি
স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাটি প্রথমে ছিনতাই হিসেবে মনে হলেও তদন্তে এটি ‘পারসোনাল কনফ্লিক্ট’ বা ব্যক্তিগত বিরোধের জেরে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তদন্তকারীরা মামুন খানের সঙ্গে কারও ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল কিনা, তা খতিয়ে দেখছেন। পার্কের আশপাশে থাকা সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। পুলিশের আশা, শিগগিরই অভিযুক্তদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।
প্রবাসীদের মধ্যে শোক ও ক্ষোভ
এই ঘটনায় রোমে বাংলাদেশি প্রবাসীদের মধ্যে চরম শোক এবং নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে। স্থানীয় বাংলাদেশ কমিউনিটির নেতারা দ্রুত দোষীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
বেলাবো উপজেলা সমিতির সভাপতি আমান উল্লাহ আমান বলেন, “রোমের মতো একটি শহরের রাস্তায় একজন বাংলাদেশি তরুণকে এভাবে খুন হতে হবে—এটা মেনে নেওয়া যায় না। আমরা দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছি।”
আরেকজন প্রবাসী জলিল হোসেন বলেন, “আমরা এখানে দিনরাত খেটে খাওয়া মানুষ। আমরা সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে চাই। কিন্তু প্রতিনিয়ত আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।”
বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রতিক্রিয়া
রোমে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম ও কল্যাণ) আসিফ আনাম সিদ্দীকি বলেন, “আমরা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছি এবং ইতালীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। মামুন খানের পরিচয় নিশ্চিত করতে আমরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পেয়েছি।”
তিনি আরও জানান, ইতালিতে নিযুক্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত ইতোমধ্যে রোমের প্রিফেক্টসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন, যাতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। মামুন খানের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর আবারও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
প্রতিবাদ কর্মসূচি ও পরিবারের আহাজারি
মামুন হত্যার প্রতিবাদে আগামী ৬ জুলাই রোমের মন্তালিওয়ালা গির্জার সামনে একটি প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধনের ডাক দিয়েছে স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটি। তাদের দাবি—দ্রুত বিচার, প্রবাসীদের নিরাপত্তা এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ।
বাংলাদেশে মামুনের পরিবার ইতোমধ্যে তার মরদেহ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার অনুরোধ জানিয়েছে। মামুন ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার মৃত্যুতে মা-বাবা, ভাই-বোন ও আত্মীয়স্বজনরা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। এক আত্মীয় জানান, “মামুনের স্বপ্ন ছিল নিজের একটি ছোট ব্যবসা দাঁড় করানো। সেই স্বপ্ন এখন রক্তে ভেসে গেছে।”
বিশ্লেষকদের মত
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরও সক্রিয় ভূমিকা জরুরি। শুধুমাত্র দূতাবাসে যোগাযোগ রাখলেই চলবে না, বরং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত সমন্বয় এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
মামুন খানের মৃত্যু শুধু একটি মর্মান্তিক ঘটনা নয়—এটি গোটা প্রবাসী বাংলাদেশি সমাজের নিরাপত্তাহীনতার চিত্রও তুলে ধরেছে। সময় এসেছে, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো মামুন এভাবে প্রাণ না হারায়।
Please Share This Post in Your Social Media

ইতালিতে আবারও বাংলাদেশি যুবক ছুরিকাঘাতে নিহত — রোমে প্রবাসীদের মধ্যে শোক, আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা


ইতালির রাজধানী রোমে আবারও ঘটে গেল মর্মান্তিক একটি হত্যাকাণ্ড। ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন মামুন খান (২২) নামের এক বাংলাদেশি তরুণ। স্থানীয় সময় শনিবার দিবাগত রাত ১২টা ১৫ মিনিটে রোমের ক্রিস্টোফোরো কলম্বো সড়কে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, এটি নিছক ছিনতাই নয়, বরং পূর্বপরিকল্পিত হত্যার শিকার হয়েছেন মামুন। এখনো পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ, তবে তদন্ত চলছে জোরেশোরে।
নিহত মামুন খানের বাড়ি বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলায়। জীবিকার তাগিদে প্রায় তিন বছর আগে রোমানিয়া হয়ে ইতালিতে আসেন তিনি। রোমে একটি স্থানীয় রেস্তোরাঁয় কাজ করতেন এবং খুব দ্রুত নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে নিয়োজিত ছিলেন।
ঘটনাস্থলে কী ঘটেছিল?
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, ঘটনার দিন রাতে কাজ শেষে মামুন কয়েকজন স্বদেশি যুবকের সঙ্গে পার্কে বসেছিলেন। এ সময় পার্কের কিছুটা দূরে এক যুবককে ছিনতাইয়ের চেষ্টা করা হয়। আতঙ্কিত সেই যুবক দৌড়ে এসে মামুনদের কাছে সাহায্য চান। সবাই মিলে ছিনতাইকারীকে ধাওয়া দিলে সে পালিয়ে যায়। কিছু সময় পর ওই ব্যক্তি পিছন থেকে মামুনের দিকে কিছু একটা নিক্ষেপ করে এবং মামুন যখন তাকে ধাওয়া করেন, তখনই ছিনতাইকারী হঠাৎ সামনে এসে ধারালো ছুরি দিয়ে মামুনকে আঘাত করে দ্রুত পালিয়ে যায়।
সাথে সাথে মামুনের সহকর্মীরা জরুরি সেবা নম্বর (ARES 118)-এ ফোন করলে মেডিকেল টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। তবে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার সময় তার মোবাইল, মানিব্যাগসহ ব্যক্তিগত সামগ্রী অক্ষত ছিল, যা নিশ্চিত করে যে এটি ছিনতাই নয়, বরং পূর্বপরিকল্পিত আক্রমণ।
তদন্তে অগ্রগতি
স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাটি প্রথমে ছিনতাই হিসেবে মনে হলেও তদন্তে এটি ‘পারসোনাল কনফ্লিক্ট’ বা ব্যক্তিগত বিরোধের জেরে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তদন্তকারীরা মামুন খানের সঙ্গে কারও ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল কিনা, তা খতিয়ে দেখছেন। পার্কের আশপাশে থাকা সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। পুলিশের আশা, শিগগিরই অভিযুক্তদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।
প্রবাসীদের মধ্যে শোক ও ক্ষোভ
এই ঘটনায় রোমে বাংলাদেশি প্রবাসীদের মধ্যে চরম শোক এবং নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে। স্থানীয় বাংলাদেশ কমিউনিটির নেতারা দ্রুত দোষীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
বেলাবো উপজেলা সমিতির সভাপতি আমান উল্লাহ আমান বলেন, “রোমের মতো একটি শহরের রাস্তায় একজন বাংলাদেশি তরুণকে এভাবে খুন হতে হবে—এটা মেনে নেওয়া যায় না। আমরা দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছি।”
আরেকজন প্রবাসী জলিল হোসেন বলেন, “আমরা এখানে দিনরাত খেটে খাওয়া মানুষ। আমরা সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে চাই। কিন্তু প্রতিনিয়ত আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।”
বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রতিক্রিয়া
রোমে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম ও কল্যাণ) আসিফ আনাম সিদ্দীকি বলেন, “আমরা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছি এবং ইতালীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। মামুন খানের পরিচয় নিশ্চিত করতে আমরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পেয়েছি।”
তিনি আরও জানান, ইতালিতে নিযুক্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত ইতোমধ্যে রোমের প্রিফেক্টসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন, যাতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। মামুন খানের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর আবারও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
প্রতিবাদ কর্মসূচি ও পরিবারের আহাজারি
মামুন হত্যার প্রতিবাদে আগামী ৬ জুলাই রোমের মন্তালিওয়ালা গির্জার সামনে একটি প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধনের ডাক দিয়েছে স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটি। তাদের দাবি—দ্রুত বিচার, প্রবাসীদের নিরাপত্তা এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ।
বাংলাদেশে মামুনের পরিবার ইতোমধ্যে তার মরদেহ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার অনুরোধ জানিয়েছে। মামুন ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার মৃত্যুতে মা-বাবা, ভাই-বোন ও আত্মীয়স্বজনরা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। এক আত্মীয় জানান, “মামুনের স্বপ্ন ছিল নিজের একটি ছোট ব্যবসা দাঁড় করানো। সেই স্বপ্ন এখন রক্তে ভেসে গেছে।”
বিশ্লেষকদের মত
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরও সক্রিয় ভূমিকা জরুরি। শুধুমাত্র দূতাবাসে যোগাযোগ রাখলেই চলবে না, বরং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত সমন্বয় এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
মামুন খানের মৃত্যু শুধু একটি মর্মান্তিক ঘটনা নয়—এটি গোটা প্রবাসী বাংলাদেশি সমাজের নিরাপত্তাহীনতার চিত্রও তুলে ধরেছে। সময় এসেছে, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো মামুন এভাবে প্রাণ না হারায়।