ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত ৭২: হাসপাতালগুলোতে চলছে চরম সংকট আল জাজিরার প্রতিবেদন

- Update Time : ১১:২৩:০৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫
- / ৪৮ Time View

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার ওপর চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসন আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। গতকাল রোববার (২৯ জুন) এক দিনের মধ্যেই ইসরায়েলি বিমান ও স্থল হামলায় অন্তত ৭২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এই তথ্য জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্যসেবা–সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে।
সূত্র জানায়, নিহতদের মধ্যে গাজা সিটি ও উত্তরাঞ্চলেই মারা গেছেন অন্তত ৪৭ জন। বাকি হতাহতরা গাজার অন্যান্য এলাকায় নিহত হন। অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক—নারী, শিশু এবং বয়স্ক। গাজা সিটিতে মোতায়েন থাকা আল-জাজিরার সাংবাদিক মোয়াথ আল-কাহলৌত সরেজমিনে জানান, শহরের প্রধান হাসপাতালগুলোর মধ্যে অন্যতম আল-আহলি হাসপাতালের পরিস্থিতি বর্তমানে ‘সম্পূর্ণ বিপর্যয়কর’।
মোয়াথ আল-কাহলৌত বলেন, ‘‘গাজার জেইতুন ও সাবরা এলাকার পাশাপাশি বাণিজ্যিক কেন্দ্র আল-জাওয়িয়া বাজারে ইসরায়েলি বিমান হামলায় অসংখ্য বেসামরিক মানুষ আহত হন। এদের অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন আল-আহলি হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালটির সক্ষমতা মারাত্মকভাবে সীমিত। প্রয়োজনীয় শয্যা, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে বহু মানুষ মেঝেতে পড়ে থেকে কাতরাচ্ছেন। শিশুরাও এর বাইরে নয়।’’
গাজার দক্ষিণাঞ্চলের রাফা শহরের উত্তরে আরও একটি মর্মান্তিক হামলার ঘটনা ঘটে। ‘গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ) পরিচালিত একটি সহায়তা কেন্দ্রের সামনে ত্রাণ সংগ্রহে জড়ো হওয়া ক্ষুধার্ত মানুষের ওপর চালানো হয় ইসরায়েলি হামলা। এতে অন্তত পাঁচজন নিহত হন বলে জানান চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এই হামলায় নিহতরা সবাই ত্রাণ সংগ্রহ করতে এসেছিলেন, যারা দিনের পর দিন খাদ্যাভাবে ভুগছিলেন।
দীর্ঘমেয়াদি গণহত্যার চিত্র
হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি অভিযান ও অবরোধে এ পর্যন্ত ৫৬ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু, যা যুদ্ধবিধিসম্মত মানবিক সুরক্ষার সম্পূর্ণ লঙ্ঘন বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো মনে করছে।
তবে ইসরায়েলের একটি প্রভাবশালী পত্রিকা হারেৎজ গত শুক্রবার (২৭ জুন) এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানিয়েছে, বাস্তবে নিহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। গবেষণায় দাবি করা হয়, ইসরায়েলি আগ্রাসনে গাজায় এ পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যা গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪ শতাংশ। এই তথ্য যদি সত্য হয়, তবে এটি হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যার উদাহরণ।
মানবিক বিপর্যয় চরমে
চলমান সংঘাতে গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে। বোমা হামলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হাসপাতাল, ওষুধ ও বিদ্যুৎ সংকট এবং নিরাপত্তার অভাবে চিকিৎসাসেবা কার্যত অচল। আন্তর্জাতিক রেডক্রস, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO), এবং জাতিসংঘ একাধিকবার ইসরায়েলকে মানবিক করিডোর খুলে দেওয়ার আহ্বান জানালেও, বহু স্থানে তা কার্যকর হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘ অবরোধ এবং সামরিক আগ্রাসনের ফলে গাজা এখন বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। পানি, খাদ্য, বিদ্যুৎ, ও চিকিৎসা সুবিধার ঘাটতির পাশাপাশি মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিও দিন দিন বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলে আবারও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস মানবিক বিপর্যয় রোধে দ্রুত যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়া তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, ও আর্জেন্টিনাসহ বিভিন্ন দেশের সরকার ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (ICC) মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
গাজায় প্রতিদিনের ইসরায়েলি আগ্রাসন যেন এক নিষ্ঠুর গণহত্যার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছে। প্রতিটি বোমা বিস্ফোরণ, প্রতিটি কান্না, আর প্রতিটি শিশুর মৃত্যু বিশ্ব বিবেককে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে—আর কতদিন? শান্তির স্বার্থে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তা প্রবেশাধিকার, এবং যুদ্ধাপরাধের নিরপেক্ষ বিচার এখন সময়ের দাবি।
Please Share This Post in Your Social Media

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত ৭২: হাসপাতালগুলোতে চলছে চরম সংকট আল জাজিরার প্রতিবেদন


ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার ওপর চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসন আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। গতকাল রোববার (২৯ জুন) এক দিনের মধ্যেই ইসরায়েলি বিমান ও স্থল হামলায় অন্তত ৭২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এই তথ্য জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্যসেবা–সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে।
সূত্র জানায়, নিহতদের মধ্যে গাজা সিটি ও উত্তরাঞ্চলেই মারা গেছেন অন্তত ৪৭ জন। বাকি হতাহতরা গাজার অন্যান্য এলাকায় নিহত হন। অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক—নারী, শিশু এবং বয়স্ক। গাজা সিটিতে মোতায়েন থাকা আল-জাজিরার সাংবাদিক মোয়াথ আল-কাহলৌত সরেজমিনে জানান, শহরের প্রধান হাসপাতালগুলোর মধ্যে অন্যতম আল-আহলি হাসপাতালের পরিস্থিতি বর্তমানে ‘সম্পূর্ণ বিপর্যয়কর’।
মোয়াথ আল-কাহলৌত বলেন, ‘‘গাজার জেইতুন ও সাবরা এলাকার পাশাপাশি বাণিজ্যিক কেন্দ্র আল-জাওয়িয়া বাজারে ইসরায়েলি বিমান হামলায় অসংখ্য বেসামরিক মানুষ আহত হন। এদের অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন আল-আহলি হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালটির সক্ষমতা মারাত্মকভাবে সীমিত। প্রয়োজনীয় শয্যা, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে বহু মানুষ মেঝেতে পড়ে থেকে কাতরাচ্ছেন। শিশুরাও এর বাইরে নয়।’’
গাজার দক্ষিণাঞ্চলের রাফা শহরের উত্তরে আরও একটি মর্মান্তিক হামলার ঘটনা ঘটে। ‘গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ) পরিচালিত একটি সহায়তা কেন্দ্রের সামনে ত্রাণ সংগ্রহে জড়ো হওয়া ক্ষুধার্ত মানুষের ওপর চালানো হয় ইসরায়েলি হামলা। এতে অন্তত পাঁচজন নিহত হন বলে জানান চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এই হামলায় নিহতরা সবাই ত্রাণ সংগ্রহ করতে এসেছিলেন, যারা দিনের পর দিন খাদ্যাভাবে ভুগছিলেন।
দীর্ঘমেয়াদি গণহত্যার চিত্র
হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি অভিযান ও অবরোধে এ পর্যন্ত ৫৬ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু, যা যুদ্ধবিধিসম্মত মানবিক সুরক্ষার সম্পূর্ণ লঙ্ঘন বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো মনে করছে।
তবে ইসরায়েলের একটি প্রভাবশালী পত্রিকা হারেৎজ গত শুক্রবার (২৭ জুন) এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানিয়েছে, বাস্তবে নিহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। গবেষণায় দাবি করা হয়, ইসরায়েলি আগ্রাসনে গাজায় এ পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যা গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪ শতাংশ। এই তথ্য যদি সত্য হয়, তবে এটি হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যার উদাহরণ।
মানবিক বিপর্যয় চরমে
চলমান সংঘাতে গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে। বোমা হামলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হাসপাতাল, ওষুধ ও বিদ্যুৎ সংকট এবং নিরাপত্তার অভাবে চিকিৎসাসেবা কার্যত অচল। আন্তর্জাতিক রেডক্রস, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO), এবং জাতিসংঘ একাধিকবার ইসরায়েলকে মানবিক করিডোর খুলে দেওয়ার আহ্বান জানালেও, বহু স্থানে তা কার্যকর হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘ অবরোধ এবং সামরিক আগ্রাসনের ফলে গাজা এখন বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। পানি, খাদ্য, বিদ্যুৎ, ও চিকিৎসা সুবিধার ঘাটতির পাশাপাশি মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিও দিন দিন বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলে আবারও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস মানবিক বিপর্যয় রোধে দ্রুত যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়া তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, ও আর্জেন্টিনাসহ বিভিন্ন দেশের সরকার ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (ICC) মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
গাজায় প্রতিদিনের ইসরায়েলি আগ্রাসন যেন এক নিষ্ঠুর গণহত্যার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছে। প্রতিটি বোমা বিস্ফোরণ, প্রতিটি কান্না, আর প্রতিটি শিশুর মৃত্যু বিশ্ব বিবেককে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে—আর কতদিন? শান্তির স্বার্থে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তা প্রবেশাধিকার, এবং যুদ্ধাপরাধের নিরপেক্ষ বিচার এখন সময়ের দাবি।