মহররমের রোজা কয় তারিখে রাখা উত্তম? কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিশদ আলোচনা

- Update Time : ০৬:১৪:৩১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫
- / ৯৭ Time View
ইসলামের দৃষ্টিতে মহররম মাস একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ মাস। এটি হিজরি বর্ষের প্রথম মাস, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু ঐতিহাসিক ঘটনা, আত্মত্যাগ, শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহর অনুসরণ। বর্তমান সময় ১৪৪৭ হিজরি সনের ৩ মহররম। এ প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে—মহররমের রোজা কবে রাখা উত্তম?
এই বিষয়ে কুরআন ও সহিহ হাদীসের আলোকে বিস্তারিত আলোচনা করা হলে আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা ও শিক্ষার সন্ধান পাই।
মহররম: একটি সম্মানিত মাস
আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমে বলেন:
إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِندَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ
“নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধানে মাস বারোটি, যখন থেকে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে চারটি সম্মানিত মাস।”
(সূরা তাওবা: ৩৬)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হাদীসে নবী করিম (সা.) বলেন:
“আসমান–জমিন সৃষ্টিলগ্ন থেকেই সময় তার মতো চলছে। বছরে ১২ মাস, তার মধ্যে চারটি সম্মানিত: ধারাবাহিকভাবে তিনটি জিলকদ, জিলহজ ও মহররম; চতুর্থটি হলো রজব।“
(সহিহ বুখারি: ৩১৯৭)
আশুরার রোজার ইতিহাস ও তাৎপর্য
রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরতের পর মদিনায় গিয়ে দেখতে পান, সেখানকার ইহুদিরা মহররমের ১০ তারিখে (আশুরা) রোজা পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এর কারণ কী?
তারা জবাব দিলো:
“এই দিনটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই দিনে মহান আল্লাহ মুসা (আ.) ও তার কওমকে ফিরাউনের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন এবং ফিরাউন ও তার বাহিনীকে ডুবিয়ে মেরেছেন। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ মুসা (আ.) এই দিনে রোজা রাখতেন, তাই আমরাও রাখি।”
এ জবাব শুনে রাসূল (সা.) বললেন:
“মুসা (আ.)-এর কৃতজ্ঞতার অনুসরণে আমরা তাদের চেয়ে
অতঃপর তিনি নিজেও আশুরার রোজা রাখেন এবং মুসলমানদেরও তা রাখতে নির্দেশ দেন।
(সহিহ বুখারি: ৩৩৯৭)
ইহুদিদের সঙ্গে সাদৃশ্য এড়াতে অতিরিক্ত রোজা
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে:
নবীজি (সা.) যখন আশুরার রোজা পালন করলেন এবং সাহাবিদের তা রাখতে বললেন, তখন সাহাবিরা বললেন, “ইহুদিরাও তো এই দিন রোজা রাখে।”
নবীজি (সা.) বললেন,
“পরবর্তী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা শুধু ১০ নয়, বরং ৯ এবং ১০ তারিখ মিলিয়ে দুই দিন রোজা রাখব।”
(সহিহ মুসলিম: ১১৩৪)
অন্য হাদীসে এসেছে:
“তোমরা আশুরার রোজা রাখো, তবে ইহুদিদের সঙ্গে মিল না রাখার জন্য ১০ তারিখের আগে অথবা পরে আরও একদিন রোজা রেখো।”
(মুসনাদে আহমদ: ২১৫৪)
মহররমে রোজা রাখার ফজিলত
মহররম মাসের রোজা রাখা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। হাদীসে এসেছে:
“রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হলো আল্লাহর সম্মানিত মাস (মহররম)-এর রোজা।“
(সহিহ মুসলিম: ১১৬৩)
এ হাদীস দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায়, রমজানের পর রোজার জন্য সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সময় হলো মহররম মাস।
কয় তারিখে রোজা রাখা উত্তম?
উপরোক্ত হাদীসসমূহ বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়, আশুরার রোজা (মহররমের ১০ তারিখ) শুধু একটি দিনে সীমাবদ্ধ নয়। বরং, ইহুদিদের সঙ্গে মিল না রাখার জন্য রাসূল (সা.) আমাদের ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ তারিখ দুই দিন রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
তাই রোজার সুনিয়ম হলো:
- ৯ ও ১০ মহররম
- অথবা ১০ ও ১১ মহররম
- কেউ চাইলে ৯, ১০ ও ১১—এই তিন দিনই রোজা রাখতে পারেন
এভাবে রোজা রাখলে রাসূল (সা.)–এর সুন্নাহর অনুসরণ হবে এবং ইহুদি ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মিল থেকে বিরত থাকা সম্ভব হবে।
মহররম মাসের রোজা শুধুমাত্র অতীত ইতিহাসের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ নয়, বরং তা আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। এ রোজা মুসা (আ.)–এর অনুসরণ, ফারাওনের মতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে আল্লাহর সাহায্যের স্বীকৃতি এবং রাসূল (সা.)–এর সুন্নাহ পালনের প্রতীক।
আমরা যদি ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ মহররম রোজা রাখি, তাহলে আমরা কেবল ইবাদতই করব না, বরং ইসলামের ঐতিহ্য ও রাসূলুল্লাহ (সা.)–এর আদর্শের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করব।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে মহররমের বরকতময় সময় সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে নেক আমলের মাধ্যমে তার সন্তুষ্টি অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমিন।
Please Share This Post in Your Social Media

মহররমের রোজা কয় তারিখে রাখা উত্তম? কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিশদ আলোচনা

ইসলামের দৃষ্টিতে মহররম মাস একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ মাস। এটি হিজরি বর্ষের প্রথম মাস, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু ঐতিহাসিক ঘটনা, আত্মত্যাগ, শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহর অনুসরণ। বর্তমান সময় ১৪৪৭ হিজরি সনের ৩ মহররম। এ প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে—মহররমের রোজা কবে রাখা উত্তম?
এই বিষয়ে কুরআন ও সহিহ হাদীসের আলোকে বিস্তারিত আলোচনা করা হলে আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা ও শিক্ষার সন্ধান পাই।
মহররম: একটি সম্মানিত মাস
আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমে বলেন:
إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِندَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ
“নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধানে মাস বারোটি, যখন থেকে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে চারটি সম্মানিত মাস।”
(সূরা তাওবা: ৩৬)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হাদীসে নবী করিম (সা.) বলেন:
“আসমান–জমিন সৃষ্টিলগ্ন থেকেই সময় তার মতো চলছে। বছরে ১২ মাস, তার মধ্যে চারটি সম্মানিত: ধারাবাহিকভাবে তিনটি জিলকদ, জিলহজ ও মহররম; চতুর্থটি হলো রজব।“
(সহিহ বুখারি: ৩১৯৭)
আশুরার রোজার ইতিহাস ও তাৎপর্য
রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরতের পর মদিনায় গিয়ে দেখতে পান, সেখানকার ইহুদিরা মহররমের ১০ তারিখে (আশুরা) রোজা পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এর কারণ কী?
তারা জবাব দিলো:
“এই দিনটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই দিনে মহান আল্লাহ মুসা (আ.) ও তার কওমকে ফিরাউনের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন এবং ফিরাউন ও তার বাহিনীকে ডুবিয়ে মেরেছেন। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ মুসা (আ.) এই দিনে রোজা রাখতেন, তাই আমরাও রাখি।”
এ জবাব শুনে রাসূল (সা.) বললেন:
“মুসা (আ.)-এর কৃতজ্ঞতার অনুসরণে আমরা তাদের
অতঃপর তিনি নিজেও আশুরার রোজা রাখেন এবং মুসলমানদেরও তা রাখতে নির্দেশ দেন।
(সহিহ বুখারি: ৩৩৯৭)
ইহুদিদের সঙ্গে সাদৃশ্য এড়াতে অতিরিক্ত রোজা
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে:
নবীজি (সা.) যখন আশুরার রোজা পালন করলেন এবং সাহাবিদের তা রাখতে বললেন, তখন সাহাবিরা বললেন, “ইহুদিরাও তো এই দিন রোজা রাখে।”
নবীজি (সা.) বললেন,
“পরবর্তী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা শুধু ১০ নয়, বরং ৯ এবং ১০ তারিখ মিলিয়ে দুই দিন রোজা রাখব।”
(সহিহ মুসলিম: ১১৩৪)
অন্য হাদীসে এসেছে:
“তোমরা আশুরার রোজা রাখো, তবে ইহুদিদের সঙ্গে মিল না রাখার জন্য ১০ তারিখের আগে অথবা পরে আরও একদিন রোজা রেখো।”
(মুসনাদে আহমদ: ২১৫৪)
মহররমে রোজা রাখার ফজিলত
মহররম মাসের রোজা রাখা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। হাদীসে এসেছে:
“রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হলো আল্লাহর সম্মানিত মাস (মহররম)-এর রোজা।“
(সহিহ মুসলিম: ১১৬৩)
এ হাদীস দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায়, রমজানের পর রোজার জন্য সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সময় হলো মহররম মাস।
কয় তারিখে রোজা রাখা উত্তম?
উপরোক্ত হাদীসসমূহ বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়, আশুরার রোজা (মহররমের ১০ তারিখ) শুধু একটি দিনে সীমাবদ্ধ নয়। বরং, ইহুদিদের সঙ্গে মিল না রাখার জন্য রাসূল (সা.) আমাদের ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ তারিখ দুই দিন রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
তাই রোজার সুনিয়ম হলো:
- ৯ ও ১০ মহররম
- অথবা ১০ ও ১১ মহররম
- কেউ চাইলে ৯, ১০ ও ১১—এই তিন দিনই রোজা রাখতে পারেন
এভাবে রোজা রাখলে রাসূল (সা.)–এর সুন্নাহর অনুসরণ হবে এবং ইহুদি ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মিল থেকে বিরত থাকা সম্ভব হবে।
মহররম মাসের রোজা শুধুমাত্র অতীত ইতিহাসের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ নয়, বরং তা আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। এ রোজা মুসা (আ.)–এর অনুসরণ, ফারাওনের মতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে আল্লাহর সাহায্যের স্বীকৃতি এবং রাসূল (সা.)–এর সুন্নাহ পালনের প্রতীক।
আমরা যদি ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ মহররম রোজা রাখি, তাহলে আমরা কেবল ইবাদতই করব না, বরং ইসলামের ঐতিহ্য ও রাসূলুল্লাহ (সা.)–এর আদর্শের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করব।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে মহররমের বরকতময় সময় সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে নেক আমলের মাধ্যমে তার সন্তুষ্টি অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমিন।