এনবিআরের চলমান সংকট নিরসনে অন্তর্বর্তী সরকারের কড়া বার্তা: দেশের জনগণ ও অর্থনীতির সুরক্ষায় সরকার কঠোর হতে বাধ্য হবে

- Update Time : ০৫:৪৯:৪২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫
- / ৮৫ Time View
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)–এর চলমান অচলাবস্থা ও এর কারণে দেশের রাজস্ব আদায়, আমদানি-রফতানি এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিপর্যয় সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার রবিবার (২৯ জুন) এক কড়া বিবৃতি প্রদান করেছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো ওই বিবৃতিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, “অনতিবিলম্বে এনবিআরের সব কর্মকর্তা–কর্মচারী কর্মস্থলে ফিরে যাবেন এবং দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকবেন। অন্যথায় সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।”
বাজেট বাস্তবায়নে দুর্বলতা ও এনবিআরের ভূমিকা
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে একটি কার্যকর ও উন্নয়নমুখী বাজেট বাস্তবায়নের প্রধান অন্তরায় হলো রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থার দীর্ঘদিনের দুর্বলতা ও অদক্ষতা। বাজেটের আয়ভাগে নির্ভরযোগ্যতা না থাকায় প্রতি বছর সরকারকে অভ্যন্তরীণ ঋণ ও বৈদেশিক সাহায্যের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে এনবিআরের দক্ষ, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ভূমিকা থাকা জরুরি হলেও বাস্তবে বহু বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতি, অনিয়ম, অদক্ষতা এবং রাজনৈতিক আশ্রয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট দ্বারা চালিত হয়ে আসছে।
সরকার বলছে, জাতীয় রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ এবং দুর্নীতিমুক্ত করতে এনবিআরের পুনর্গঠন এখন সময়ের দাবি। এ লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, ট্রেড সংগঠন, সুশীল সমাজ ও প্রশাসনিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে এনবিআরের প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কর্মকর্তা–কর্মচারীদের ‘আন্দোলন’ এবং এর প্রভাব
গত দুই মাস ধরে এনবিআরের অধীন বিভিন্ন শুল্ক স্টেশন, কাস্টমস হাউস, বন্ড কমিশনারেট ও অন্যান্য দপ্তরের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী দফায় দফায় কর্মবিরতি, আলসেমি ও প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছেন। তারা দাবির নামে অফিসে অনুপস্থিত থেকে বা সীমিত কার্যক্রম চালিয়ে ব্যবসা–বাণিজ্যে প্রচণ্ড প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন। এর ফলে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকার আমদানি-রফতানি কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে দাবি করেছে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো।
সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি: এই আন্দোলন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত
সরকার মনে করছে, এই তথাকথিত আন্দোলন কোনো নিরীহ বা যুক্তিসঙ্গত দাবির বহিঃপ্রকাশ নয়; বরং এটি পরিকল্পিতভাবে একটি গণবিরোধী সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে পরিচালিত। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আন্দোলনের
সরকার আরো জানায়, এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি সরকার গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করতে প্রস্তুত ছিল এবং একাধিকবার আলোচনায় বসার আহ্বান জানানো হলেও তারা তা উপেক্ষা করেছেন। তারা আলোচনার টেবিলের পরিবর্তে ‘অনমনীয় আন্দোলনের’ পথে হেঁটে জনগণ ও ব্যবসা-ব্যবস্থাকে জিম্মি করে ফেলেছেন।
‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ ঘোষণা
পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনায় সরকার গুরুত্বপূর্ণ এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিবৃতিতে জানানো হয়, “জাতীয় স্বার্থে এনবিআরের আওতাধীন সকল কাস্টমস হাউস, ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি), বন্ড কমিশনারেট ও শুল্ক স্টেশনসমূহের সকল শ্রেণির চাকরিকে ‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।”
এর ফলে এখন থেকে এইসব সেবায় কর্মরত কেউ অঘোষিত কর্মবিরতি, ধর্মঘট বা দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে তার বিরুদ্ধে ‘অত্যাবশ্যকীয় সেবা আইন ১৯৫২’ এর আওতায় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। প্রয়োজনে সাময়িক বরখাস্ত, চাকরিচ্যুতি এমনকি ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি হওয়ার সুযোগও রয়েছে।
ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) এর সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, “রাজস্ব বিভাগের অচলাবস্থায় দেশের আমদানি–রফতানি চেইন ভেঙে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছে। ক্রয়াদেশ বাতিলের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।” এ অবস্থাকে ‘অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি।
অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রশিদুল হাসান বলেন, “এনবিআরের সংস্কার একটি জরুরি কাজ। কিন্তু অভ্যন্তরীণ চাপ, চক্রান্ত ও সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর বাধায় বিষয়টি বারবার আটকে যাচ্ছে।”
শেষ বার্তা
সরকার বিবৃতির শেষাংশে আবারও এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে আহ্বান জানিয়েছে, তারা যেন দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন এবং আইনভঙ্গকারী কর্মসূচি পরিহার করেন। সরকার বলেছে, “আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান চাই। তবে যদি কেউ জাতীয় অর্থনীতি ও জনগণের স্বার্থ বিরোধী অবস্থানে অনড় থাকে, তাহলে সরকার কঠোর হতে বাধ্য হবে।”
এই বিবৃতি স্পষ্টতই ইঙ্গিত দেয়, অন্তর্বর্তী সরকার আর কোন প্রকার অচলাবস্থা বরদাশত করবে না এবং প্রয়োজনে প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে পিছপা হবে না। এখন দেখার বিষয়, এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারের এই কড়া অবস্থানের প্রতি কী প্রতিক্রিয়া দেখান।
Please Share This Post in Your Social Media

এনবিআরের চলমান সংকট নিরসনে অন্তর্বর্তী সরকারের কড়া বার্তা: দেশের জনগণ ও অর্থনীতির সুরক্ষায় সরকার কঠোর হতে বাধ্য হবে

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)–এর চলমান অচলাবস্থা ও এর কারণে দেশের রাজস্ব আদায়, আমদানি-রফতানি এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিপর্যয় সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার রবিবার (২৯ জুন) এক কড়া বিবৃতি প্রদান করেছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো ওই বিবৃতিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, “অনতিবিলম্বে এনবিআরের সব কর্মকর্তা–কর্মচারী কর্মস্থলে ফিরে যাবেন এবং দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকবেন। অন্যথায় সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।”
বাজেট বাস্তবায়নে দুর্বলতা ও এনবিআরের ভূমিকা
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে একটি কার্যকর ও উন্নয়নমুখী বাজেট বাস্তবায়নের প্রধান অন্তরায় হলো রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থার দীর্ঘদিনের দুর্বলতা ও অদক্ষতা। বাজেটের আয়ভাগে নির্ভরযোগ্যতা না থাকায় প্রতি বছর সরকারকে অভ্যন্তরীণ ঋণ ও বৈদেশিক সাহায্যের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে এনবিআরের দক্ষ, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ভূমিকা থাকা জরুরি হলেও বাস্তবে বহু বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতি, অনিয়ম, অদক্ষতা এবং রাজনৈতিক আশ্রয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট দ্বারা চালিত হয়ে আসছে।
সরকার বলছে, জাতীয় রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ এবং দুর্নীতিমুক্ত করতে এনবিআরের পুনর্গঠন এখন সময়ের দাবি। এ লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, ট্রেড সংগঠন, সুশীল সমাজ ও প্রশাসনিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে এনবিআরের প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কর্মকর্তা–কর্মচারীদের ‘আন্দোলন’ এবং এর প্রভাব
গত দুই মাস ধরে এনবিআরের অধীন বিভিন্ন শুল্ক স্টেশন, কাস্টমস হাউস, বন্ড কমিশনারেট ও অন্যান্য দপ্তরের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী দফায় দফায় কর্মবিরতি, আলসেমি ও প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছেন। তারা দাবির নামে অফিসে অনুপস্থিত থেকে বা সীমিত কার্যক্রম চালিয়ে ব্যবসা–বাণিজ্যে প্রচণ্ড প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন। এর ফলে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকার আমদানি-রফতানি কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে দাবি করেছে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো।
সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি: এই আন্দোলন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত
সরকার মনে করছে, এই তথাকথিত আন্দোলন কোনো নিরীহ বা যুক্তিসঙ্গত দাবির বহিঃপ্রকাশ নয়; বরং এটি পরিকল্পিতভাবে একটি গণবিরোধী সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে পরিচালিত। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আন্দোলনের
সরকার আরো জানায়, এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি সরকার গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করতে প্রস্তুত ছিল এবং একাধিকবার আলোচনায় বসার আহ্বান জানানো হলেও তারা তা উপেক্ষা করেছেন। তারা আলোচনার টেবিলের পরিবর্তে ‘অনমনীয় আন্দোলনের’ পথে হেঁটে জনগণ ও ব্যবসা-ব্যবস্থাকে জিম্মি করে ফেলেছেন।
‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ ঘোষণা
পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনায় সরকার গুরুত্বপূর্ণ এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিবৃতিতে জানানো হয়, “জাতীয় স্বার্থে এনবিআরের আওতাধীন সকল কাস্টমস হাউস, ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি), বন্ড কমিশনারেট ও শুল্ক স্টেশনসমূহের সকল শ্রেণির চাকরিকে ‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।”
এর ফলে এখন থেকে এইসব সেবায় কর্মরত কেউ অঘোষিত কর্মবিরতি, ধর্মঘট বা দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে তার বিরুদ্ধে ‘অত্যাবশ্যকীয় সেবা আইন ১৯৫২’ এর আওতায় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। প্রয়োজনে সাময়িক বরখাস্ত, চাকরিচ্যুতি এমনকি ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি হওয়ার সুযোগও রয়েছে।
ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) এর সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, “রাজস্ব বিভাগের অচলাবস্থায় দেশের আমদানি–রফতানি চেইন ভেঙে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছে। ক্রয়াদেশ বাতিলের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।” এ অবস্থাকে ‘অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি।
অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রশিদুল হাসান বলেন, “এনবিআরের সংস্কার একটি জরুরি কাজ। কিন্তু অভ্যন্তরীণ চাপ, চক্রান্ত ও সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর বাধায় বিষয়টি বারবার আটকে যাচ্ছে।”
শেষ বার্তা
সরকার বিবৃতির শেষাংশে আবারও এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে আহ্বান জানিয়েছে, তারা যেন দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন এবং আইনভঙ্গকারী কর্মসূচি পরিহার করেন। সরকার বলেছে, “আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান চাই। তবে যদি কেউ জাতীয় অর্থনীতি ও জনগণের স্বার্থ বিরোধী অবস্থানে অনড় থাকে, তাহলে সরকার কঠোর হতে বাধ্য হবে।”
এই বিবৃতি স্পষ্টতই ইঙ্গিত দেয়, অন্তর্বর্তী সরকার আর কোন প্রকার অচলাবস্থা বরদাশত করবে না এবং প্রয়োজনে প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে পিছপা হবে না। এখন দেখার বিষয়, এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারের এই কড়া অবস্থানের প্রতি কী প্রতিক্রিয়া দেখান।