পবিত্র কাবাঘর ১২০ কেজি স্বর্ণের নতুন গিলাফে আবৃত—হিজরি নববর্ষে মহিমান্বিত এক ঐতিহ্যবাহী আয়োজন

- Update Time : ১১:১২:৫৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
- / ৬৯ Time View
পবিত্র কাবাঘর, মুসলমানদের কিবলা ও ইসলামী ঐতিহ্যের প্রতীক, নতুন গিলাফে আবৃত হয়েছে হিজরি ১৪৪৭ সালের সূচনায়। মঙ্গলবার দিবাগত রাত, অর্থাৎ বুধবার (২৫ জুন) এশার নামাজের পর পবিত্র মসজিদুল হারামে কাবাঘরের পুরনো গিলাফ সরিয়ে নতুন গিলাফ স্থাপন করা হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ আচার সম্পন্ন হয় অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ও ধর্মীয় মর্যাদায় ভরপুর পরিবেশে, যেখানে উপস্থিত ছিলেন সৌদি রাজপরিবারের সদস্য, মসজিদুল হারামের শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ।
রাজকীয় হস্তান্তর ও ধর্মীয় সম্মাননা
গিলাফ হস্তান্তরের দায়িত্ব পালন করেন মক্কা অঞ্চলের উপ-আমির এবং হজ ও ওমরাহবিষয়ক স্থায়ী কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান প্রিন্স সাউদ বিন মিশাল। তিনি সৌদি বাদশাহ ও খাদিমুল হারামাইন আল-শরীফাইন সালমান বিন আবদুল আজিজের পক্ষ থেকে এই গিলাফ হস্তান্তর করেন। গিলাফ গ্রহণ করেন মসজিদুল হারামের সিনিয়র কিপার (খাদিম) আবদুল মালিক বিন তাহা আল-শাইবি। এই আচার শুধু গিলাফ পরিবর্তনের অনুষ্ঠানই নয়, বরং এটি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, আনুগত্য ও ধর্মীয় ইতিহাসের প্রতীক।
গিলাফের নির্মাণ ও কারুকাজ
‘কিসওয়া’ নামে পরিচিত পবিত্র কাবার এই গিলাফ তৈরি করা হয় মক্কায় অবস্থিত কিং আবদুল আজিজ কমপ্লেক্স ফর হলি কাবা কিসওয়াতে, যা বিশ্বের অন্যতম উন্নত ও ব্যয়বহুল ধর্মীয় শিল্পকেন্দ্র। নতুন গিলাফে ব্যবহার করা হয়েছে:
- ১২০ কেজি খাঁটি স্বর্ণ
- ১০০ কেজি রুপা (সিলভার)
- ১,০০০ কেজি প্রাকৃতিক কালো রঙের সিল্ক (রেশম)
গিলাফটির উচ্চতা ১৪ মিটার। উপরিভাগে রয়েছে ৯৫ সেন্টিমিটার প্রশস্ত ও ৪৭ মিটার দীর্ঘ বেল্ট, যেখানে সুরা ও কোরআনের আয়াত সোনালী সুতা দিয়ে সূক্ষ্ম নকশায় লেখা। গিলাফে যুক্ত থাকে ১৬টি কারুকার্যখচিত অংশ, যা ইসলামী ঐতিহ্য, কলা ও ক্যালিগ্রাফির নিখুঁত রূপায়ণ।
গিলাফ তৈরি হয় পাঁচটি বৃহৎ টুকরো কাপড় জোড়া দিয়ে। এতে কোরআন থেকে নির্বাচিত আয়াত, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ”, “ইয়া রহমানু ইরহামনা”, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় বার্তা ও দোয়া সংযোজিত থাকে।
পরিবর্তনের সময়সূচির ইতিহাস
ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে প্রায় ১,৪০০ বছর ধরে পবিত্র কাবাঘরের গিলাফ পরিবর্তন করা হতো জিলহজ মাসের ৯ তারিখ, হজের ‘আরাফাত দিবসে’। কিন্তু ২০২২ সাল অর্থাৎ ১৪৪৪ হিজরি থেকে সৌদি সরকার এই সময়সূচি পরিবর্তন করে। সিদ্ধান্ত হয়, হিজরি নববর্ষ অর্থাৎ মহররম মাসের প্রথম রাতেই গিলাফ পরিবর্তন করা হবে, যাতে নতুন বছরের সূচনাকে একটি পবিত্র ও স্মরণীয় প্রতীকে পরিণত করা যায়।
এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সৌদি সরকার একটি ঐতিহাসিক রীতি নতুন মাত্রায় নিয়ে যায়, যা হিজরি বর্ষপঞ্জিকে কেন্দ্র করে মুসলিমদের মধ্যে কাবাঘর ও নববর্ষকে ঘিরে আধ্যাত্মিক গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে তোলে।
নির্মাণ প্রক্রিয়া ও মানব সম্পদ
গিলাফ তৈরিতে নিযুক্ত থাকে ২০০-রও বেশি দক্ষ কর্মী, যাদের মধ্যে ক্যালিগ্রাফার, বয়নশিল্পী, স্বর্ণ-রুপার সূতা প্রস্তুতকারী, ডিজাইনার এবং কারিগরি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। তাদের সকলেই উচ্চতর ধর্মীয় সচেতনতা ও পেশাগত নিষ্ঠার সঙ্গে এই পবিত্র কাজে অংশ নেন।
গিলাফ তৈরির মোট ব্যয় প্রায় ২০–২৫ মিলিয়ন সৌদি রিয়াল, যা বিশ্বের যেকোনো ধর্মীয় কাপড় তৈরির প্রক্রিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও অভিজাত।
في لحظات مليئة بالوقار، كسوة الكعبة المشرفة الجديدة تصل إلى صحن الطواف. #كسوة_الكعبة_المشرفة pic.twitter.com/yiV80rUi9P
— قناة القرآن الكريم (@qurantvsa) June 25, 2025
কাবা শরিফ ও মুসলিম উম্মাহর সম্পর্ক
পবিত্র কাবাঘর মুসলমানদের কেবল নামাজের কিবলা নয়, এটি এক অবিচ্ছেদ্য আত্মিক ও ঐতিহাসিক বন্ধনের নাম। কাবার গিলাফ পরিবর্তনের এই আয়োজন মুসলিম বিশ্বের জন্য সম্মান, পবিত্রতা, ঐতিহ্য ও বিশ্বাসের প্রতীক। প্রতি বছর কোটি কোটি মুসলমান সারা বিশ্ব থেকে হজ ও ওমরাহ পালনে আসেন এবং নতুন গিলাফে আবৃত কাবাঘর দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
পবিত্র কাবাঘরের গিলাফ পরিবর্তন কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়; এটি একটি বিশাল সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং আধ্যাত্মিক আয়োজন, যা বিশ্ব মুসলিমদের হৃদয়ে গভীরভাবে দাগ কেটে যায়। ১২০ কেজি স্বর্ণ, ১০০ কেজি রুপা ও এক হাজার কেজি সিল্ক দিয়ে নির্মিত এই গিলাফ একদিকে যেমন শিল্পকলার নিদর্শন, অন্যদিকে তেমনি এটি আল্লাহর ঘরের মর্যাদা, মুসলিম ঐক্য এবং ইসলামের চিরন্তন মহিমার প্রতীক।
তথ্যসূত্র:
- আরব নিউজ
- সৌদি প্রেস এজেন্সি (SPA)
- কিং আবদুল আজিজ কমপ্লেক্স ফর কিসওয়া
- মক্কা মিউনিসিপ্যালিটি অফিসিয়াল রিলিজ
Please Share This Post in Your Social Media

পবিত্র কাবাঘর ১২০ কেজি স্বর্ণের নতুন গিলাফে আবৃত—হিজরি নববর্ষে মহিমান্বিত এক ঐতিহ্যবাহী আয়োজন

পবিত্র কাবাঘর, মুসলমানদের কিবলা ও ইসলামী ঐতিহ্যের প্রতীক, নতুন গিলাফে আবৃত হয়েছে হিজরি ১৪৪৭ সালের সূচনায়। মঙ্গলবার দিবাগত রাত, অর্থাৎ বুধবার (২৫ জুন) এশার নামাজের পর পবিত্র মসজিদুল হারামে কাবাঘরের পুরনো গিলাফ সরিয়ে নতুন গিলাফ স্থাপন করা হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ আচার সম্পন্ন হয় অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ও ধর্মীয় মর্যাদায় ভরপুর পরিবেশে, যেখানে উপস্থিত ছিলেন সৌদি রাজপরিবারের সদস্য, মসজিদুল হারামের শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ।
রাজকীয় হস্তান্তর ও ধর্মীয় সম্মাননা
গিলাফ হস্তান্তরের দায়িত্ব পালন করেন মক্কা অঞ্চলের উপ-আমির এবং হজ ও ওমরাহবিষয়ক স্থায়ী কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান প্রিন্স সাউদ বিন মিশাল। তিনি সৌদি বাদশাহ ও খাদিমুল হারামাইন আল-শরীফাইন সালমান বিন আবদুল আজিজের পক্ষ থেকে এই গিলাফ হস্তান্তর করেন। গিলাফ গ্রহণ করেন মসজিদুল হারামের সিনিয়র কিপার (খাদিম) আবদুল মালিক বিন তাহা আল-শাইবি। এই আচার শুধু গিলাফ পরিবর্তনের অনুষ্ঠানই নয়, বরং এটি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, আনুগত্য ও ধর্মীয় ইতিহাসের প্রতীক।
গিলাফের নির্মাণ ও কারুকাজ
‘কিসওয়া’ নামে পরিচিত পবিত্র কাবার এই গিলাফ তৈরি করা হয় মক্কায় অবস্থিত কিং আবদুল আজিজ কমপ্লেক্স ফর হলি কাবা কিসওয়াতে, যা বিশ্বের অন্যতম উন্নত ও ব্যয়বহুল ধর্মীয় শিল্পকেন্দ্র। নতুন গিলাফে ব্যবহার করা হয়েছে:
- ১২০ কেজি খাঁটি স্বর্ণ
- ১০০ কেজি রুপা (সিলভার)
- ১,০০০ কেজি প্রাকৃতিক কালো রঙের সিল্ক (রেশম)
গিলাফটির উচ্চতা ১৪ মিটার। উপরিভাগে রয়েছে ৯৫ সেন্টিমিটার প্রশস্ত ও ৪৭ মিটার দীর্ঘ বেল্ট, যেখানে সুরা ও কোরআনের আয়াত সোনালী সুতা দিয়ে সূক্ষ্ম নকশায় লেখা। গিলাফে যুক্ত থাকে ১৬টি কারুকার্যখচিত অংশ, যা ইসলামী ঐতিহ্য, কলা ও ক্যালিগ্রাফির নিখুঁত রূপায়ণ।
গিলাফ তৈরি হয় পাঁচটি বৃহৎ টুকরো কাপড় জোড়া দিয়ে। এতে কোরআন থেকে নির্বাচিত আয়াত, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ”, “ইয়া রহমানু ইরহামনা”, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় বার্তা ও দোয়া সংযোজিত থাকে।
পরিবর্তনের সময়সূচির ইতিহাস
ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে প্রায় ১,৪০০ বছর ধরে পবিত্র কাবাঘরের গিলাফ পরিবর্তন করা হতো জিলহজ মাসের ৯ তারিখ, হজের ‘আরাফাত দিবসে’। কিন্তু ২০২২ সাল অর্থাৎ ১৪৪৪ হিজরি থেকে সৌদি সরকার এই সময়সূচি পরিবর্তন করে। সিদ্ধান্ত হয়, হিজরি নববর্ষ অর্থাৎ মহররম মাসের প্রথম রাতেই গিলাফ পরিবর্তন করা হবে, যাতে নতুন বছরের সূচনাকে একটি পবিত্র ও স্মরণীয় প্রতীকে পরিণত করা যায়।
এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সৌদি সরকার একটি ঐতিহাসিক রীতি নতুন মাত্রায় নিয়ে যায়, যা হিজরি বর্ষপঞ্জিকে কেন্দ্র করে মুসলিমদের মধ্যে কাবাঘর ও নববর্ষকে ঘিরে আধ্যাত্মিক গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে তোলে।
নির্মাণ প্রক্রিয়া ও মানব সম্পদ
গিলাফ তৈরিতে নিযুক্ত থাকে ২০০-রও বেশি দক্ষ কর্মী, যাদের মধ্যে ক্যালিগ্রাফার, বয়নশিল্পী, স্বর্ণ-রুপার সূতা প্রস্তুতকারী, ডিজাইনার এবং কারিগরি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। তাদের সকলেই উচ্চতর ধর্মীয় সচেতনতা ও পেশাগত নিষ্ঠার সঙ্গে এই পবিত্র কাজে অংশ নেন।
গিলাফ তৈরির মোট ব্যয় প্রায় ২০–২৫ মিলিয়ন সৌদি রিয়াল, যা বিশ্বের যেকোনো ধর্মীয় কাপড় তৈরির প্রক্রিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও অভিজাত।
في لحظات مليئة بالوقار، كسوة الكعبة المشرفة الجديدة تصل إلى صحن الطواف. #كسوة_الكعبة_المشرفة pic.twitter.com/yiV80rUi9P
— قناة القرآن الكريم (@qurantvsa) June 25, 2025
কাবা শরিফ ও মুসলিম উম্মাহর সম্পর্ক
পবিত্র কাবাঘর মুসলমানদের কেবল নামাজের কিবলা নয়, এটি এক অবিচ্ছেদ্য আত্মিক ও ঐতিহাসিক বন্ধনের নাম। কাবার গিলাফ পরিবর্তনের এই আয়োজন মুসলিম বিশ্বের জন্য সম্মান, পবিত্রতা, ঐতিহ্য ও বিশ্বাসের প্রতীক। প্রতি বছর কোটি কোটি মুসলমান সারা বিশ্ব থেকে হজ ও ওমরাহ পালনে আসেন এবং নতুন গিলাফে আবৃত কাবাঘর দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
পবিত্র কাবাঘরের গিলাফ পরিবর্তন কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়; এটি একটি বিশাল সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং আধ্যাত্মিক আয়োজন, যা বিশ্ব মুসলিমদের হৃদয়ে গভীরভাবে দাগ কেটে যায়। ১২০ কেজি স্বর্ণ, ১০০ কেজি রুপা ও এক হাজার কেজি সিল্ক দিয়ে নির্মিত এই গিলাফ একদিকে যেমন শিল্পকলার নিদর্শন, অন্যদিকে তেমনি এটি আল্লাহর ঘরের মর্যাদা, মুসলিম ঐক্য এবং ইসলামের চিরন্তন মহিমার প্রতীক।
তথ্যসূত্র:
- আরব নিউজ
- সৌদি প্রেস এজেন্সি (SPA)
- কিং আবদুল আজিজ কমপ্লেক্স ফর কিসওয়া
- মক্কা মিউনিসিপ্যালিটি অফিসিয়াল রিলিজ