সাবেক তিন সিইসি ও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ যুক্ত

- Update Time : ১১:২০:১১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
- / ৭৯ Time View
ঢাকা, ২৬ জুন:
সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) সহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ, প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের গুরুতর অভিযোগ যুক্ত করা হয়েছে। গতকাল বুধবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মিনহাজুর রহমানের আদালত এসব অভিযোগ সংযুক্ত করার আবেদন গ্রহণ করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেরেবাংলা নগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শামসুজ্জোহা সরকার এ সংক্রান্ত আবেদন দাখিল করেন।
আজ বৃহস্পতিবার বিষয়টি গণমাধ্যমে নিশ্চিত করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) প্রসিকিউশন বিভাগের উপপরিদর্শক রফিকুল ইসলাম।
অভিযোগের পেছনের পটভূমি
এই মামলার সূত্রপাত হয়েছিল ২২ জুন, যখন বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় যে, বিগত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন সংবিধান অনুযায়ী দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। উল্টো, ভয়-ভীতি, গায়েবি মামলা, গুম, খুন ও নির্যাতনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে একতরফা নির্বাচন পরিচালনা করেছে তারা।
মামলার মূল অভিযোগে বলা হয়, এই নির্বাচনগুলোতে সাধারণ মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। নির্বাচনের সময় দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন এবং গঠনমূলক নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট করা হয়। এতে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সংবিধান ও আইন লঙ্ঘন করেছেন।
অভিযুক্তদের তালিকা
এই মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন—
- ২০১৪ সালের তৎকালীন সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ
- ২০১৮ সালের সিইসি এ কে এম নূরুল হুদা
- ২০২৪ সালের সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল
এছাড়া সাবেক পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করা কয়েকজন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাও আসামির তালিকায় রয়েছেন:
- হাসান মাহমুদ খন্দকার
- এ কে এম শহীদুল হক
- জাবেদ পাটোয়ারী
- বেনজির আহমেদ
- চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা নির্বাচন পরিচালনার নামে সংবিধান লঙ্ঘন করে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন এবং জনগণের ভোটাধিকার হরণে সহায়তা করেছেন।
নতুন অভিযোগের যুক্তি
শেরেবাংলা নগর থানার তদন্ত কর্মকর্তা মামলায় নতুন করে দণ্ডবিধির ১২০(ক) (রাষ্ট্রদ্রোহের ষড়যন্ত্র), ৪২০ (প্রতারণা) ও ৪০৬ (আত্মসাৎ) ধারাগুলো যুক্ত করার আবেদন করেন। আদালত তা গ্রহণ করে অভিযোগপত্রে এই ধারা সংযুক্ত করেন।
এতে বলা হয়েছে, অভিযুক্তরা পরিকল্পিতভাবে ভুয়া নির্বাচন সম্পন্ন করেছেন, যেখানে জনগণকে ভয় দেখিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে রাখা হয়। প্রার্থীরা ভোট না পেয়েও বিজয়ী ঘোষণা পান, যা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চক্রান্ত এবং জনগণের সাথে প্রতারণার শামিল।
সাক্ষ্য–প্রমাণের সম্ভাব্য উৎস
মামলায় বলা হয়েছে, ওই তিন নির্বাচনের সময়কালে ভোটাররা, যারা ভোট দিতে পারেননি, তারা প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী। এছাড়া অনেক প্রিজাইডিং অফিসার, পুলিশ কর্মকর্তা, কেন্দ্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং স্থানীয়রা এসব ঘটনার স্বাক্ষী হতে পারেন। ব্যালট পেপারে যাদের সিল ও স্বাক্ষর রয়েছে, তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করে সত্য উদঘাটন করা যেতে পারে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষণ
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মামলাটি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্ককে নতুন মাত্রা দিচ্ছে। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রাজনৈতিক ও আইনি প্রেক্ষাপটে বিস্তর আলোচনার জন্ম দেবে।
বিএনপির দাবি, তারা নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে আসছে বহু বছর ধরে। এই মামলায় অভিযোগ গঠনের পর তা নতুন গতিপথে প্রবেশ করেছে।
নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও দুর্নীতির অভিযোগ বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য এক জটিল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মামলার বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও সঠিক পথে পরিচালিত হলে তা দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে।
Please Share This Post in Your Social Media

সাবেক তিন সিইসি ও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ যুক্ত

ঢাকা, ২৬ জুন:
সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) সহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ, প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের গুরুতর অভিযোগ যুক্ত করা হয়েছে। গতকাল বুধবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মিনহাজুর রহমানের আদালত এসব অভিযোগ সংযুক্ত করার আবেদন গ্রহণ করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেরেবাংলা নগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শামসুজ্জোহা সরকার এ সংক্রান্ত আবেদন দাখিল করেন।
আজ বৃহস্পতিবার বিষয়টি গণমাধ্যমে নিশ্চিত করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) প্রসিকিউশন বিভাগের উপপরিদর্শক রফিকুল ইসলাম।
অভিযোগের পেছনের পটভূমি
এই মামলার সূত্রপাত হয়েছিল ২২ জুন, যখন বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় যে, বিগত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন সংবিধান অনুযায়ী দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। উল্টো, ভয়-ভীতি, গায়েবি মামলা, গুম, খুন ও নির্যাতনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে একতরফা নির্বাচন পরিচালনা করেছে তারা।
মামলার মূল অভিযোগে বলা হয়, এই নির্বাচনগুলোতে সাধারণ মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। নির্বাচনের সময় দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন এবং গঠনমূলক নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট করা হয়। এতে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সংবিধান ও আইন লঙ্ঘন করেছেন।
অভিযুক্তদের তালিকা
এই মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন—
- ২০১৪ সালের তৎকালীন সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ
- ২০১৮ সালের সিইসি এ কে এম নূরুল হুদা
- ২০২৪ সালের সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল
এছাড়া সাবেক পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করা কয়েকজন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাও আসামির তালিকায় রয়েছেন:
- হাসান মাহমুদ খন্দকার
- এ কে এম শহীদুল হক
- জাবেদ পাটোয়ারী
- বেনজির আহমেদ
- চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা নির্বাচন পরিচালনার নামে সংবিধান লঙ্ঘন করে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন এবং জনগণের ভোটাধিকার হরণে সহায়তা করেছেন।
নতুন অভিযোগের যুক্তি
শেরেবাংলা নগর থানার তদন্ত কর্মকর্তা মামলায় নতুন করে দণ্ডবিধির ১২০(ক) (রাষ্ট্রদ্রোহের ষড়যন্ত্র), ৪২০ (প্রতারণা) ও ৪০৬ (আত্মসাৎ) ধারাগুলো যুক্ত করার আবেদন করেন। আদালত তা গ্রহণ করে অভিযোগপত্রে এই ধারা সংযুক্ত করেন।
এতে বলা হয়েছে, অভিযুক্তরা পরিকল্পিতভাবে ভুয়া নির্বাচন সম্পন্ন করেছেন, যেখানে জনগণকে ভয় দেখিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে রাখা হয়। প্রার্থীরা ভোট না পেয়েও বিজয়ী ঘোষণা পান, যা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চক্রান্ত এবং জনগণের সাথে প্রতারণার শামিল।
সাক্ষ্য–প্রমাণের সম্ভাব্য উৎস
মামলায় বলা হয়েছে, ওই তিন নির্বাচনের সময়কালে ভোটাররা, যারা ভোট দিতে পারেননি, তারা প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী। এছাড়া অনেক প্রিজাইডিং অফিসার, পুলিশ কর্মকর্তা, কেন্দ্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং স্থানীয়রা এসব ঘটনার স্বাক্ষী হতে পারেন। ব্যালট পেপারে যাদের সিল ও স্বাক্ষর রয়েছে, তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করে সত্য উদঘাটন করা যেতে পারে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষণ
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মামলাটি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্ককে নতুন মাত্রা দিচ্ছে। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রাজনৈতিক ও আইনি প্রেক্ষাপটে বিস্তর আলোচনার জন্ম দেবে।
বিএনপির দাবি, তারা নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে আসছে বহু বছর ধরে। এই মামলায় অভিযোগ গঠনের পর তা নতুন গতিপথে প্রবেশ করেছে।
নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও দুর্নীতির অভিযোগ বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য এক জটিল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মামলার বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও সঠিক পথে পরিচালিত হলে তা দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে।