যুক্তরাষ্ট্রের ১৫ শহরে ছড়িয়ে পড়েছে বিক্ষোভ

- Update Time : ১২:২৭:৪৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ জুন ২০২৫
- / ৭৫ Time View
যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে শুরু হওয়া শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ এখন রূপ নিয়েছে একটি জাতীয় গণআন্দোলনে। ট্রাম্প প্রশাসনের কড়া অভিবাসন নীতির প্রতিবাদে দেশজুড়ে অন্তত ১৫টি শহরে ছড়িয়ে পড়েছে এই আন্দোলন, যা বর্তমানে একটি সাংবিধানিক ও মানবাধিকার সংকটের রূপ নিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে শুরু, সারা দেশে বিস্তার
গত শুক্রবার লস অ্যাঞ্জেলেসের ডাউনটাউনের একটি আইস (U.S. Immigration and Customs Enforcement) কেন্দ্রে কয়েকজন অভিবাসীকে আটক করার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরই প্রতিবাদের সূচনা ঘটে। প্রথমে স্থানীয় পরিবার, শিক্ষার্থী ও অধিকারকর্মীরা জড়ো হয়ে তাদের মুক্তির দাবি জানাতে থাকেন। ধীরে ধীরে এই আন্দোলনের আওয়াজ পৌঁছে যায় ক্যালিফোর্নিয়ার সীমানা ছাড়িয়ে দেশব্যাপী।
নিউ ইয়র্ক সিটি, শিকাগো, সান ফ্রান্সিসকো, ডেনভার, সান্তা আনা, লাস ভেগাস, আটলান্টা, ফিলাডেলফিয়া, মিলওয়াকি, সিয়াটেল, বোস্টন, ওয়াশিংটন ডিসি, ডালাস, অস্টিন এবং স্যান আন্তোনিও শহরগুলোতে একই দাবিতে অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবাদ সভা।
নিউ ইয়র্কে ধাওয়া–পাল্টা ধাওয়া
ম্যানহাটনের আইস অফিসের সামনে শত শত মানুষ স্লোগান তুলে রাস্তা অবরোধ করে বসে পড়েন। দিনব্যাপী শান্তিপূর্ণ হলেও রাতের বেলায় পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। গ্রেফতার করা হয় বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারীকে। এনওয়াইপিডি-র বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ এনেছে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো।
টেক্সাসে উত্তেজনা: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ
অস্টিন, ডালাস ও স্যান আন্তোনিও শহরগুলোতে সবচেয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অস্টিনে শত শত মানুষ জে. জে. পিকল ফেডারেল বিল্ডিং অভিমুখে মিছিল করে যায়। তাদের হাতে ধরা ছিল “No human is illegal”, “Abolish ICE” ও “Families belong together” লেখা প্ল্যাকার্ড। পুলিশ প্রতিবাদকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস ছুড়ে এবং অন্তত ১৩ জনকে গ্রেফতার করে।
ডালাসেও একই রকম উত্তেজনা দেখা দেয়। স্যান আন্তোনিওতে যদিও আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকে, তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আশঙ্কা করছে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট দ্রুত জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষীদের মোতায়েনের ঘোষণা দেন এবং দাবি করেন “বাইরের উসকানিদাতারা” আন্দোলনকে সহিংসতায় রূপ দিতে চাইছে — যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে আন্দোলনকারী পক্ষ।
লস অ্যাঞ্জেলেসে কারফিউ জারি
আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু লস অ্যাঞ্জেলেসে ব্যাপক গ্রেফতার ও সংঘর্ষের জেরে মেয়র ক্যারেন ব্যাস সন্ধ্যা ৮টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করেছেন। এলএপিডি-এর তথ্যমতে, আন্দোলনের প্রথম চার দিনে প্রায় ৪০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
তবে কারফিউ সত্ত্বেও শহরের নানা জায়গায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংগঠিত হয়ে ছোট ছোট প্রতিবাদ মিছিল অব্যাহত রয়েছে। “এটা শুধু একটি শহরের জন্য নয় — এটা একটি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, যা মানুষকে অপরাধী বানায় শুধুমাত্র ভালো জীবন চাওয়ার জন্য,” বলেন লস অ্যাঞ্জেলেসের আন্দোলনকারী মারিসোল ভেগা।
ট্রাম্পের অবস্থান: “বিদেশি শত্রুদের হাত থেকে শহর মুক্ত করব”
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সমর্থকদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অভিবাসীদের “বিদেশি শত্রু” বলে আখ্যায়িত করে ঘোষণা দেন, তিনি লস অ্যাঞ্জেলেসের মতো শহরগুলোকে “মুক্ত করবেন”। তার এই মন্তব্য আরও তীব্র করে তুলেছে জাতীয় বিতর্ক।
ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউসোম প্রেসিডেন্টের বক্তব্যকে “আমেরিকান গণতন্ত্রের ওপর হামলা” বলে উল্লেখ করে বলেন, “এই মানুষগুলো কোনো বিদেশি শত্রু নয় — এরা বাবা, মা, শ্রমিক, শিক্ষার্থী — অনেকেই এই দেশে যুগের পর যুগ ধরে বসবাস করছে।”
সাংবিধানিক সংকট?
বিশ্লেষক ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, জাতীয় রক্ষীদের অভ্যন্তরীণ আন্দোলনে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত Posse Comitatus Act-এর লঙ্ঘন হতে পারে। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (ACLU) ইতোমধ্যেই একাধিক মামলা দায়ের করেছে এবং বলেছে, “আমরা যা দেখছি, তা হলো ফেডারেল শক্তির অস্ত্রায়ন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর দমনমূলক ব্যবহার।”
আন্দোলন থামছে না
গ্রেফতার, কারফিউ বা সামরিক মোতায়েন — কিছুই যেন এই আন্দোলন থামাতে পারছে না। শিক্ষার্থী সংগঠন, শ্রমিক ইউনিয়ন, ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন প্রতিনিয়ত নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে।
“এটা শুধু আইস-এর বিরুদ্ধে নয়,” ফিলাডেলফিয়ার এক সংগঠক জামাল রিভার্স বলেন, “এটা মর্যাদা, সাম্য এবং সরকারের জবাবদিহিতার প্রশ্ন।”
২০২৬ সালের নির্বাচন সামনে রেখে আমেরিকা এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। অভিবাসন ইস্যুকে কেন্দ্র করে যেভাবে বিক্ষোভ বিস্তার লাভ করছে, তাতে আগামী দিনের জাতীয় নীতিমালা ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের ওপর এর গভীর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
Please Share This Post in Your Social Media

যুক্তরাষ্ট্রের ১৫ শহরে ছড়িয়ে পড়েছে বিক্ষোভ

যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে শুরু হওয়া শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ এখন রূপ নিয়েছে একটি জাতীয় গণআন্দোলনে। ট্রাম্প প্রশাসনের কড়া অভিবাসন নীতির প্রতিবাদে দেশজুড়ে অন্তত ১৫টি শহরে ছড়িয়ে পড়েছে এই আন্দোলন, যা বর্তমানে একটি সাংবিধানিক ও মানবাধিকার সংকটের রূপ নিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে শুরু, সারা দেশে বিস্তার
গত শুক্রবার লস অ্যাঞ্জেলেসের ডাউনটাউনের একটি আইস (U.S. Immigration and Customs Enforcement) কেন্দ্রে কয়েকজন অভিবাসীকে আটক করার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরই প্রতিবাদের সূচনা ঘটে। প্রথমে স্থানীয় পরিবার, শিক্ষার্থী ও অধিকারকর্মীরা জড়ো হয়ে তাদের মুক্তির দাবি জানাতে থাকেন। ধীরে ধীরে এই আন্দোলনের আওয়াজ পৌঁছে যায় ক্যালিফোর্নিয়ার সীমানা ছাড়িয়ে দেশব্যাপী।
নিউ ইয়র্ক সিটি, শিকাগো, সান ফ্রান্সিসকো, ডেনভার, সান্তা আনা, লাস ভেগাস, আটলান্টা, ফিলাডেলফিয়া, মিলওয়াকি, সিয়াটেল, বোস্টন, ওয়াশিংটন ডিসি, ডালাস, অস্টিন এবং স্যান আন্তোনিও শহরগুলোতে একই দাবিতে অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবাদ সভা।
নিউ ইয়র্কে ধাওয়া–পাল্টা ধাওয়া
ম্যানহাটনের আইস অফিসের সামনে শত শত মানুষ স্লোগান তুলে রাস্তা অবরোধ করে বসে পড়েন। দিনব্যাপী শান্তিপূর্ণ হলেও রাতের বেলায় পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। গ্রেফতার করা হয় বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারীকে। এনওয়াইপিডি-র বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ এনেছে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো।
টেক্সাসে উত্তেজনা: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ
অস্টিন, ডালাস ও স্যান আন্তোনিও শহরগুলোতে সবচেয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অস্টিনে শত শত মানুষ জে. জে. পিকল ফেডারেল বিল্ডিং অভিমুখে মিছিল করে যায়। তাদের হাতে ধরা ছিল “No human is illegal”, “Abolish ICE” ও “Families belong together” লেখা প্ল্যাকার্ড। পুলিশ প্রতিবাদকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস ছুড়ে এবং অন্তত ১৩ জনকে গ্রেফতার করে।
ডালাসেও একই রকম উত্তেজনা দেখা দেয়। স্যান আন্তোনিওতে যদিও আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকে, তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আশঙ্কা করছে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট দ্রুত জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষীদের মোতায়েনের ঘোষণা দেন এবং দাবি করেন “বাইরের উসকানিদাতারা” আন্দোলনকে সহিংসতায় রূপ দিতে চাইছে — যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে আন্দোলনকারী পক্ষ।
লস অ্যাঞ্জেলেসে কারফিউ জারি
আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু লস অ্যাঞ্জেলেসে ব্যাপক গ্রেফতার ও সংঘর্ষের জেরে মেয়র ক্যারেন ব্যাস সন্ধ্যা ৮টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করেছেন। এলএপিডি-এর তথ্যমতে, আন্দোলনের প্রথম চার দিনে প্রায় ৪০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
তবে কারফিউ সত্ত্বেও শহরের নানা জায়গায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংগঠিত হয়ে ছোট ছোট প্রতিবাদ মিছিল অব্যাহত রয়েছে। “এটা শুধু একটি শহরের জন্য নয় — এটা একটি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, যা মানুষকে অপরাধী বানায় শুধুমাত্র ভালো জীবন চাওয়ার জন্য,” বলেন লস অ্যাঞ্জেলেসের আন্দোলনকারী মারিসোল ভেগা।
ট্রাম্পের অবস্থান: “বিদেশি শত্রুদের হাত থেকে শহর মুক্ত করব”
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সমর্থকদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অভিবাসীদের “বিদেশি শত্রু” বলে আখ্যায়িত করে ঘোষণা দেন, তিনি লস অ্যাঞ্জেলেসের মতো শহরগুলোকে “মুক্ত করবেন”। তার এই মন্তব্য আরও তীব্র করে তুলেছে জাতীয় বিতর্ক।
ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউসোম প্রেসিডেন্টের বক্তব্যকে “আমেরিকান গণতন্ত্রের ওপর হামলা” বলে উল্লেখ করে বলেন, “এই মানুষগুলো কোনো বিদেশি শত্রু নয় — এরা বাবা, মা, শ্রমিক, শিক্ষার্থী — অনেকেই এই দেশে যুগের পর যুগ ধরে বসবাস করছে।”
সাংবিধানিক সংকট?
বিশ্লেষক ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, জাতীয় রক্ষীদের অভ্যন্তরীণ আন্দোলনে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত Posse Comitatus Act-এর লঙ্ঘন হতে পারে। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (ACLU) ইতোমধ্যেই একাধিক মামলা দায়ের করেছে এবং বলেছে, “আমরা যা দেখছি, তা হলো ফেডারেল শক্তির অস্ত্রায়ন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর দমনমূলক ব্যবহার।”
আন্দোলন থামছে না
গ্রেফতার, কারফিউ বা সামরিক মোতায়েন — কিছুই যেন এই আন্দোলন থামাতে পারছে না। শিক্ষার্থী সংগঠন, শ্রমিক ইউনিয়ন, ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন প্রতিনিয়ত নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে।
“এটা শুধু আইস-এর বিরুদ্ধে নয়,” ফিলাডেলফিয়ার এক সংগঠক জামাল রিভার্স বলেন, “এটা মর্যাদা, সাম্য এবং সরকারের জবাবদিহিতার প্রশ্ন।”
২০২৬ সালের নির্বাচন সামনে রেখে আমেরিকা এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। অভিবাসন ইস্যুকে কেন্দ্র করে যেভাবে বিক্ষোভ বিস্তার লাভ করছে, তাতে আগামী দিনের জাতীয় নীতিমালা ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের ওপর এর গভীর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।