সময়: বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন: অর্থ পাচারকারীদের সঙ্গে ‘সমঝোতার’ কথা ভাবছে বাংলাদেশ সরকার

ডিজিটাল ডেস্ক
  • Update Time : ০৬:২৯:৪১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ জুন ২০২৫
  • / ৮৩ Time View

ahmonsur.original

 

ahmonsur.original

 

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বিদেশে অর্থ পাচারে অভিযুক্ত ধনকুবেরদের সঙ্গে ‘আর্থিক সমঝোতায়’ পৌঁছানোর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও সরকারের অর্থ পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক ড. আহসান এইচ মনসুর পত্রিকাটিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, অপেক্ষাকৃত কম গুরুতর অর্থপাচার মামলাগুলোর ক্ষেত্রে আর্থিক সমঝোতা একটি ‘বাস্তব বিকল্প’ হতে পারে।

অর্থ পুনরুদ্ধারে নতুন কৌশলের ইঙ্গিত

বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার গত আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। তাদের অন্যতম অগ্রাধিকার এখন দুর্নীতির মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধার। ড. মনসুর জানিয়েছেন, আর্থিক সমঝোতার মাধ্যমে তহবিল পুনরুদ্ধার একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, বিশেষ করে যেখানে আইন লঙ্ঘনের মাত্রা তুলনামূলকভাবে হালকা।

তিনি বলেন, “যদি আইন লঙ্ঘনের প্রকৃতি তুলনামূলকভাবে হালকা হয়, তবে আমরা দেওয়ানি মামলা করব এবং সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আর্থিক সমঝোতার কথা বিবেচনা করা হবে।” তিনি আরও জানান, তিনি ভবিষ্যৎ আন্তর্জাতিক মামলা পরিচালনার জন্য অভিযুক্তদের কাছ থেকে ১০ কোটি ডলার পর্যন্ত অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়েছেন।

শেখ হাসিনা যুগের অর্থপাচার তদন্ত

সরকারের প্রকাশিত এক অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র অনুযায়ী, শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে দেশ থেকে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই বিশাল অঙ্কের অর্থ পাচারের পেছনে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ড. মনসুর এবং সরকারের অন্য কর্মকর্তারা জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মিত্ররা দেশের ব্যাংক ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে ভুয়া ঋণের মাধ্যমে এবং সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে এই অর্থ বিদেশে পাচার করেন।

এদিকে, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই অর্থপাচার বিরোধী অভিযানকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যসহ প্রভাবশালী ১১টি পরিবারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। পাশাপাশি কিছু অভ্যন্তরীণ ব্যাংক অ্যাকাউন্টও ইতিমধ্যে জব্দ করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সহায়তা চায় বাংলাদেশ

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, “এটা চুরি হওয়া অর্থ। আমি বলব আইনগত ও নৈতিকভাবে যুক্তরাজ্য সরকারের উচিত এই অর্থ শনাক্ত করতে সহায়তা করা।” তিনি চলতি সপ্তাহে লন্ডন সফর করছেন এবং যুক্তরাজ্য সরকারের কাছ থেকে আরও সহযোগিতা চাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন।

বাংলাদেশ সরকার আশা করছে, যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশসমূহ তাদের দেশে পাচার হওয়া অর্থ শনাক্ত ও ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করবে। এরই মধ্যে কিছু বিদেশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়েছে।

অর্থনৈতিক শ্বেতপত্রে গুরুতর অভিযোগ

অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশে প্রণীত এবং গত ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত অর্থনৈতিক শ্বেতপত্রে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে ক্ষমতার অপব্যবহার, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং অবকাঠামো প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে।

আইএমএফ-এর সাবেক কর্মকর্তা ড. মনসুর বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য কাউকে প্রতিহিংসা করা নয়, বরং জনগণের অর্থ যারা লুট করেছে, সেই অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফিরিয়ে আনা।”

সমঝোতা নাকি দায়মুক্তি?

তবে অর্থপাচারকারীদের সঙ্গে সমঝোতার এ ধারণা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। অনেকে এটিকে কার্যত ‘দায়মুক্তি’ দেওয়ার একটি পথ হিসেবে দেখছেন। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, সমঝোতার বিষয়টি কেবলমাত্র নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে, বিশেষ বিবেচনায় ও আর্থিক স্বার্থে বিবেচনা করা হবে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই প্রক্রিয়ার সফলতা নির্ভর করবে স্বচ্ছতা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ওপর। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও আর্থিক ব্যবস্থার স্বচ্ছতা রক্ষাও এখন সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেও, আর্থিক সমঝোতার মতো বিষয়গুলো নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এখন দেখার বিষয়, এই সমঝোতা আদৌ রাষ্ট্রীয় স্বার্থে উপকারী হয়ে ওঠে, নাকি দুর্নীতিবাজদের জন্য একটি নতুন রাস্তা খুলে দেয়।

এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, আইনানুগ ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার সমন্বয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে অন্তর্বর্তী প্রশাসনকে।

 

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন: অর্থ পাচারকারীদের সঙ্গে ‘সমঝোতার’ কথা ভাবছে বাংলাদেশ সরকার

Update Time : ০৬:২৯:৪১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ জুন ২০২৫

 

ahmonsur.original

 

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বিদেশে অর্থ পাচারে অভিযুক্ত ধনকুবেরদের সঙ্গে ‘আর্থিক সমঝোতায়’ পৌঁছানোর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও সরকারের অর্থ পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক ড. আহসান এইচ মনসুর পত্রিকাটিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, অপেক্ষাকৃত কম গুরুতর অর্থপাচার মামলাগুলোর ক্ষেত্রে আর্থিক সমঝোতা একটি ‘বাস্তব বিকল্প’ হতে পারে।

অর্থ পুনরুদ্ধারে নতুন কৌশলের ইঙ্গিত

বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার গত আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। তাদের অন্যতম অগ্রাধিকার এখন দুর্নীতির মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধার। ড. মনসুর জানিয়েছেন, আর্থিক সমঝোতার মাধ্যমে তহবিল পুনরুদ্ধার একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, বিশেষ করে যেখানে আইন লঙ্ঘনের মাত্রা তুলনামূলকভাবে হালকা।

তিনি বলেন, “যদি আইন লঙ্ঘনের প্রকৃতি তুলনামূলকভাবে হালকা হয়, তবে আমরা দেওয়ানি মামলা করব এবং সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আর্থিক সমঝোতার কথা বিবেচনা করা হবে।” তিনি আরও জানান, তিনি ভবিষ্যৎ আন্তর্জাতিক মামলা পরিচালনার জন্য অভিযুক্তদের কাছ থেকে ১০ কোটি ডলার পর্যন্ত অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়েছেন।

শেখ হাসিনা যুগের অর্থপাচার তদন্ত

সরকারের প্রকাশিত এক অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র অনুযায়ী, শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে দেশ থেকে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই বিশাল অঙ্কের অর্থ পাচারের পেছনে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ড. মনসুর এবং সরকারের অন্য কর্মকর্তারা জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মিত্ররা দেশের ব্যাংক ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে ভুয়া ঋণের মাধ্যমে এবং সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে এই অর্থ বিদেশে পাচার করেন।

এদিকে, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই অর্থপাচার বিরোধী অভিযানকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যসহ প্রভাবশালী ১১টি পরিবারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। পাশাপাশি কিছু অভ্যন্তরীণ ব্যাংক অ্যাকাউন্টও ইতিমধ্যে জব্দ করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সহায়তা চায় বাংলাদেশ

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, “এটা চুরি হওয়া অর্থ। আমি বলব আইনগত ও নৈতিকভাবে যুক্তরাজ্য সরকারের উচিত এই অর্থ শনাক্ত করতে সহায়তা করা।” তিনি চলতি সপ্তাহে লন্ডন সফর করছেন এবং যুক্তরাজ্য সরকারের কাছ থেকে আরও সহযোগিতা চাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন।

বাংলাদেশ সরকার আশা করছে, যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশসমূহ তাদের দেশে পাচার হওয়া অর্থ শনাক্ত ও ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করবে। এরই মধ্যে কিছু বিদেশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়েছে।

অর্থনৈতিক শ্বেতপত্রে গুরুতর অভিযোগ

অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশে প্রণীত এবং গত ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত অর্থনৈতিক শ্বেতপত্রে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে ক্ষমতার অপব্যবহার, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং অবকাঠামো প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে।

আইএমএফ-এর সাবেক কর্মকর্তা ড. মনসুর বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য কাউকে প্রতিহিংসা করা নয়, বরং জনগণের অর্থ যারা লুট করেছে, সেই অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফিরিয়ে আনা।”

সমঝোতা নাকি দায়মুক্তি?

তবে অর্থপাচারকারীদের সঙ্গে সমঝোতার এ ধারণা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। অনেকে এটিকে কার্যত ‘দায়মুক্তি’ দেওয়ার একটি পথ হিসেবে দেখছেন। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, সমঝোতার বিষয়টি কেবলমাত্র নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে, বিশেষ বিবেচনায় ও আর্থিক স্বার্থে বিবেচনা করা হবে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই প্রক্রিয়ার সফলতা নির্ভর করবে স্বচ্ছতা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ওপর। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও আর্থিক ব্যবস্থার স্বচ্ছতা রক্ষাও এখন সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেও, আর্থিক সমঝোতার মতো বিষয়গুলো নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এখন দেখার বিষয়, এই সমঝোতা আদৌ রাষ্ট্রীয় স্বার্থে উপকারী হয়ে ওঠে, নাকি দুর্নীতিবাজদের জন্য একটি নতুন রাস্তা খুলে দেয়।

এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, আইনানুগ ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার সমন্বয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে অন্তর্বর্তী প্রশাসনকে।