সময়: বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

চীনে শনাক্ত নতুন করোনাভাইরাস ‘HKU5-CoV-2’: আরেকটি বৈশ্বিক মহামারির এক ধাপ আগে দাঁড়িয়ে বিশ্ব

ডিজিটাল ডেস্ক
  • Update Time : ০৬:৩২:৩২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১১ জুন ২০২৫
  • / ১১৪ Time View

1749635263 22166c445cedd060e68c4c0dcdb545af

 

1749635263 22166c445cedd060e68c4c0dcdb545af

 

বিশ্ববাসী যখন করোনা মহামারির অভিঘাত কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখন বিজ্ঞানীরা নতুন এক ভাইরাস নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। চীনে সম্প্রতি শনাক্ত হওয়া নতুন করোনাভাইরাস ‘HKU5-CoV-2’-কে বৈশ্বিক মহামারির সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, ভাইরাসটি এখনো মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম হয়নি, তবে মাত্র একটি ক্ষুদ্র জেনেটিক পরিবর্তন ঘটলেই এটি মানুষকে সংক্রমিত করে মহামারির রূপ নিতে পারে।

বিস্তৃত প্রাণীজ সংক্রমণ ক্ষমতা

HKU5-CoV-2 ভাইরাসটি কেবল একটি নতুন প্রজাতিই নয়, বরং এটি কোভিড১৯ সৃষ্টিকারী SARS-CoV-2-এর চেয়েও অধিক সংখ্যক প্রাণীকে সংক্রমণ করতে সক্ষম। এর গঠন এবং আচরণ এমন যে এটি একাধিক প্রজাতির মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে পারে, যা মহামারি ছড়ানোর জন্য একটি ভয়াবহ সূচক।

এই ভাইরাস মূলত বাদুড়ের শরীরে শনাক্ত হয় এবং সেটি এসেছে সেই গবেষণাগার থেকেই, যা ২০১৯ সালে উহানে কোভিডের উৎপত্তিস্থল হিসেবে সন্দেহভাজন ছিল।

মানবশরীরে সংক্রমণের সম্ভাবনা

ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা HKU5-CoV-2 ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিন কীভাবে মানবদেহের এএসি২ (ACE2) কোষের রিসেপ্টরের সঙ্গে যুক্ত হয়, তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তারা দেখতে পান, ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনে মাত্র একটি ছোট জেনেটিক রূপান্তর ঘটলেই তা মানুষের গলা, নাক ও মুখের কোষে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে। আর যদি তা ঘটে, তাহলে এটি মানবদেহের শ্বাসতন্ত্র অন্ত্রের কোষে সংখ্যাবৃদ্ধি করে রোগ ছড়াতে পারবে।

মার্স ভাইরাসের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়

এই ভাইরাসের আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হচ্ছে, এটি মার্স (MERS-CoV) ভাইরাসের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। মার্স ভাইরাসটি ২০১২ সালে প্রথম শনাক্ত হয় এবং এখনও পর্যন্ত কমপক্ষে ২৭টি দেশে এর উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছে, যেখানে ৮৫৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। মার্সে আক্রান্তদের মৃত্যুহার ছিল প্রায় ৩৫ শতাংশ, যা কভিড-১৯-এর তুলনায় অনেক বেশি প্রাণঘাতী।

HKU5-CoV-2-ও মারবেকোভাইরাস (Merbecovirus) নামক একটি কম পরিচিত করোনাভাইরাস গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। এই ভাইরাস পরিবারের বৈশিষ্ট্য হলো, তারা মূলত প্রাণীজ উৎস থেকে সংক্রমিত হয়ে মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে—যাকে বলা হয় জুনোটিক

ট্রান্সমিশন (Zoonotic Transmission)

গবেষকদের উদ্বেগ

ভাইরাসটি নিয়ে পরিচালিত গবেষণার অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী অধ্যাপক মাইকেল লেটকো বলেন,

“আমরা যা পেয়েছি তা হলো, HKU5 ভাইরাসগুলো মানুষের মধ্যে সংক্রমণের জন্য কেবল একটিই ছোট ধাপ দূরে রয়েছে।”

তিনি বলেন, অতীতে এইচকেইউ৫ ভাইরাস নিয়ে গবেষণা খুব কমই হয়েছে, কিন্তু তাদের গবেষণায় দেখা গেছে ভাইরাসটি মানব কোষে প্রবেশের সক্ষমতা অর্জন করতে চলেছে।

ঝুঁকি মূল্যায়ন ভবিষ্যৎ সতর্কতা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা এখনই আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থেকে নজরদারির পরামর্শ দিয়েছেন। যদিও এখন পর্যন্ত HKU5-CoV-2 মানবদেহে সরাসরি সংক্রমিত হয়নি, তবে এর জেনেটিক কাঠামো এবং প্রাণীজ হোস্টের বিস্তৃতি ইঙ্গিত দেয়, এটি ভবিষ্যতে বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যপ্রাণী বাজার এবং খোলাবাজারে প্রাণীজ খাবারের বিক্রি নতুন ভাইরাস ছড়ানোর জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে, ঠিক যেমনটা হয়েছিল ২০১৯ সালে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার সময়।

উপসংহার: আরেকটি বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়ের সম্ভাবনা?

বিশ্ব যখন নতুন করে গতি খুঁজে পাচ্ছে, তখন HKU5-CoV-2 নতুন করে মনে করিয়ে দিল— মহামারি শেষ হলেও ঝুঁকি শেষ হয়নি। এই ভাইরাস হয়তো এখনো মারাত্মক নয়, কিন্তু একটি ছোট জেনেটিক পরিবর্তন ঘটলেই এটি হয়ে উঠতে পারে পরবর্তী বৈশ্বিক বিপর্যয়ের কারণ

বিজ্ঞানীদের মতে, এখন সময় সতর্কতা অবলম্বনের। গবেষণায় বিনিয়োগ, ভাইরাস নজরদারি এবং প্রাণীজ উৎস নিয়ন্ত্রণই পারে ভবিষ্যতের ভয়াবহতাকে প্রতিরোধ করতে।

এইচকেইউ৫ ভাইরাস কেবল চীনের সমস্যা নয়, এটি এখন বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য এক সময়োপযোগী সতর্কবার্তা।

 

 

 

 

 

 

 

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

চীনে শনাক্ত নতুন করোনাভাইরাস ‘HKU5-CoV-2’: আরেকটি বৈশ্বিক মহামারির এক ধাপ আগে দাঁড়িয়ে বিশ্ব

Update Time : ০৬:৩২:৩২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১১ জুন ২০২৫

 

1749635263 22166c445cedd060e68c4c0dcdb545af

 

বিশ্ববাসী যখন করোনা মহামারির অভিঘাত কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখন বিজ্ঞানীরা নতুন এক ভাইরাস নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। চীনে সম্প্রতি শনাক্ত হওয়া নতুন করোনাভাইরাস ‘HKU5-CoV-2’-কে বৈশ্বিক মহামারির সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, ভাইরাসটি এখনো মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম হয়নি, তবে মাত্র একটি ক্ষুদ্র জেনেটিক পরিবর্তন ঘটলেই এটি মানুষকে সংক্রমিত করে মহামারির রূপ নিতে পারে।

বিস্তৃত প্রাণীজ সংক্রমণ ক্ষমতা

HKU5-CoV-2 ভাইরাসটি কেবল একটি নতুন প্রজাতিই নয়, বরং এটি কোভিড১৯ সৃষ্টিকারী SARS-CoV-2-এর চেয়েও অধিক সংখ্যক প্রাণীকে সংক্রমণ করতে সক্ষম। এর গঠন এবং আচরণ এমন যে এটি একাধিক প্রজাতির মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে পারে, যা মহামারি ছড়ানোর জন্য একটি ভয়াবহ সূচক।

এই ভাইরাস মূলত বাদুড়ের শরীরে শনাক্ত হয় এবং সেটি এসেছে সেই গবেষণাগার থেকেই, যা ২০১৯ সালে উহানে কোভিডের উৎপত্তিস্থল হিসেবে সন্দেহভাজন ছিল।

মানবশরীরে সংক্রমণের সম্ভাবনা

ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা HKU5-CoV-2 ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিন কীভাবে মানবদেহের এএসি২ (ACE2) কোষের রিসেপ্টরের সঙ্গে যুক্ত হয়, তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তারা দেখতে পান, ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনে মাত্র একটি ছোট জেনেটিক রূপান্তর ঘটলেই তা মানুষের গলা, নাক ও মুখের কোষে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে। আর যদি তা ঘটে, তাহলে এটি মানবদেহের শ্বাসতন্ত্র অন্ত্রের কোষে সংখ্যাবৃদ্ধি করে রোগ ছড়াতে পারবে।

মার্স ভাইরাসের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়

এই ভাইরাসের আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হচ্ছে, এটি মার্স (MERS-CoV) ভাইরাসের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। মার্স ভাইরাসটি ২০১২ সালে প্রথম শনাক্ত হয় এবং এখনও পর্যন্ত কমপক্ষে ২৭টি দেশে এর উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছে, যেখানে ৮৫৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। মার্সে আক্রান্তদের মৃত্যুহার ছিল প্রায় ৩৫ শতাংশ, যা কভিড-১৯-এর তুলনায় অনেক বেশি প্রাণঘাতী।

HKU5-CoV-2-ও মারবেকোভাইরাস (Merbecovirus) নামক একটি কম পরিচিত করোনাভাইরাস গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। এই ভাইরাস পরিবারের বৈশিষ্ট্য হলো, তারা মূলত প্রাণীজ উৎস থেকে সংক্রমিত হয়ে মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে—যাকে বলা হয় জুনোটিক

ট্রান্সমিশন (Zoonotic Transmission)

গবেষকদের উদ্বেগ

ভাইরাসটি নিয়ে পরিচালিত গবেষণার অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী অধ্যাপক মাইকেল লেটকো বলেন,

“আমরা যা পেয়েছি তা হলো, HKU5 ভাইরাসগুলো মানুষের মধ্যে সংক্রমণের জন্য কেবল একটিই ছোট ধাপ দূরে রয়েছে।”

তিনি বলেন, অতীতে এইচকেইউ৫ ভাইরাস নিয়ে গবেষণা খুব কমই হয়েছে, কিন্তু তাদের গবেষণায় দেখা গেছে ভাইরাসটি মানব কোষে প্রবেশের সক্ষমতা অর্জন করতে চলেছে।

ঝুঁকি মূল্যায়ন ভবিষ্যৎ সতর্কতা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা এখনই আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থেকে নজরদারির পরামর্শ দিয়েছেন। যদিও এখন পর্যন্ত HKU5-CoV-2 মানবদেহে সরাসরি সংক্রমিত হয়নি, তবে এর জেনেটিক কাঠামো এবং প্রাণীজ হোস্টের বিস্তৃতি ইঙ্গিত দেয়, এটি ভবিষ্যতে বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যপ্রাণী বাজার এবং খোলাবাজারে প্রাণীজ খাবারের বিক্রি নতুন ভাইরাস ছড়ানোর জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে, ঠিক যেমনটা হয়েছিল ২০১৯ সালে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার সময়।

উপসংহার: আরেকটি বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়ের সম্ভাবনা?

বিশ্ব যখন নতুন করে গতি খুঁজে পাচ্ছে, তখন HKU5-CoV-2 নতুন করে মনে করিয়ে দিল— মহামারি শেষ হলেও ঝুঁকি শেষ হয়নি। এই ভাইরাস হয়তো এখনো মারাত্মক নয়, কিন্তু একটি ছোট জেনেটিক পরিবর্তন ঘটলেই এটি হয়ে উঠতে পারে পরবর্তী বৈশ্বিক বিপর্যয়ের কারণ

বিজ্ঞানীদের মতে, এখন সময় সতর্কতা অবলম্বনের। গবেষণায় বিনিয়োগ, ভাইরাস নজরদারি এবং প্রাণীজ উৎস নিয়ন্ত্রণই পারে ভবিষ্যতের ভয়াবহতাকে প্রতিরোধ করতে।

এইচকেইউ৫ ভাইরাস কেবল চীনের সমস্যা নয়, এটি এখন বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য এক সময়োপযোগী সতর্কবার্তা।