মার্কিন আদালতের রায়ে অবৈধভাবে বসবাস করায় বাংলাদেশিকে ২২ কোটি টাকার বেশি জরিমানা!

- Update Time : ০৫:৪৭:১০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২১ মে ২০২৫
- / ১০৩ Time View
২০০৫ সালে ইমিগ্রেশন কেস প্রত্যাখ্যান হওয়ার পরও অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করায় এক প্রবাসী বাংলাদেশিকে ১৮ লাখ ২০ হাজার ৩৫২ ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, ১ ডলারে ১২৫ টাকা ধরে) সিভিল পেনাল্টি হিসেবে জরিমানা করেছে মার্কিন আদালত। নিউ ইয়র্কের কুইন্সের এস্টোরিয়ায় বসবাসরত এই প্রবাসীর নাম ও পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে মানবিক ও আইনি কারণে, তবে ছদ্মনাম হিসেবে ‘আরিফুল’ ব্যবহার করা হয়েছে।
১৭ বছর আগের মামলার রায় অমান্য ছিল জরিমানার কারণ
২০০৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মার্কিন ইমিগ্রেশন আদালত “কেস রিমুভাল” আদেশ জারি করে আরিফুলের বিরুদ্ধে। সেই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করলেও, ২০০৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আদালত তাঁর আবেদন খারিজ করে কেস “ডিসমিসড” ঘোষণা করে। এরপরও তিনি যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ না করে সেখানে বসবাস করে আসছিলেন। মূলত সন্তানদের ছোটবেলা ও পরিবারের প্রয়োজনে তিনি দেশত্যাগের আদেশ পালন করেননি।
বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও মার্কিন সরকার তখন কোনো সক্রিয় পদক্ষেপ না নিলেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনে এসে অভিবাসন নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান শুরু হয়। বিভিন্ন ফেডারেল বিভাগ একযোগে অবৈধ অভিবাসীদের শনাক্ত ও বহিষ্কারে কাজ শুরু করে।
ফেডারেল আদালতের হঠাৎ জরিমানার আদেশ
নিউ ইয়র্কের ২৬ ফেডারেল প্লাজায় অবস্থিত আদালত প্রায় দুই দশক পর হঠাৎ করে আরিফুলের বিরুদ্ধে ১৮ লাখ ডলারের বেশি অর্থদণ্ড জারি করে। এতে প্রবাসী আরিফুল একপ্রকার দিশেহারা হয়ে পড়েন। তিনি এ রায় হাতে পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে জরিমানা পরিশোধ না করলে তা চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। এসময় তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন বলেও জানানো হয়েছে।
তবে উল্লেখযোগ্যভাবে তার স্ত্রী ও সন্তানরা মার্কিন নাগরিক হওয়ায়, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের সম্ভাবনা নেই।
আইনি বিশ্লেষণ: যুক্তরাষ্ট্রে আইন
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরী এ বিষয়ে জানান, “আইনটি নতুন নয়, এটি ১৯৫২ সালের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্ট (INA)-এর সংশোধনী যা ১৯৯৬ সালে কার্যকর হয়। আগে এই আইন থাকলেও বাস্তবে জরিমানার প্রয়োগ ছিল না। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় সেই পুরনো আইনকে জোরালোভাবে কার্যকর করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “আরিফুল তার কেস রিওপেন করার চেষ্টা করলেও আদালত তা গ্রহণ করেনি। সরকারও জানে তিনি কোথায় থাকেন, কী করেন – তাই এই জরিমানার নোটিশ এসেছে। জরিমানা না দিলে সরকারের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তেরও অধিকার রয়েছে।”
মানবিক বিবেচনায় আবেদন ও সম্ভাব্য প্রতিকার
অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরীর মতে, আরিফুল এখন ৩০ দিনের মধ্যে জরিমানা পরিশোধ না করলে এবং কোনো আবেদন না করলে সেটি চূড়ান্ত হয়ে যাবে। তবে তিনি চাইলে মানবিক বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে জরিমানার পরিমাণ কমানোর বা মওকুফ করার আবেদন করতে পারেন। এমনকি যদি আবেদন গ্রহণ না হয়, তাহলে তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
এছাড়া, যেহেতু এটি কোনো অপরাধমূলক মামলা নয়, তাই তাকে জেলে পাঠানোর সম্ভাবনা খুবই কম।
প্রশ্ন উঠছে: যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নীতির ভবিষ্যৎ কী?
এই ঘটনা শুধু আরিফুলের জন্য নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত লক্ষাধিক অনিয়মিত অভিবাসীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। সরকারের তরফে এ ধরণের পদক্ষেপ স্পষ্টতই একটি বার্তা দিতে চায় – অবৈধভাবে বসবাস করলেই ছাড় নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈধতা ছাড়া দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করা অতীতে যত সহজ ছিল, এখন সেই সুযোগ নেই। অভিবাসন সংক্রান্ত যেকোনো মামলার আদেশ বা সিদ্ধান্তকে অমান্য করা দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
আরিফুলের কাহিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসীদের জন্য এক রূঢ় বাস্তবতা তুলে ধরেছে। যদিও তিনি মানবিক কারণে যুক্তরাষ্ট্রে থাকার চেষ্টা করেছেন, আদালতের চোখে আইনের লঙ্ঘনই মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঘটনার মাধ্যমে অন্যান্য অভিবাসীদের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা রয়ে গেল – যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতে হলে আইনি প্রক্রিয়াকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে, না হলে ভবিষ্যতে তা দুঃস্বপ্নের রূপ নিতে পারে।
Please Share This Post in Your Social Media

মার্কিন আদালতের রায়ে অবৈধভাবে বসবাস করায় বাংলাদেশিকে ২২ কোটি টাকার বেশি জরিমানা!

২০০৫ সালে ইমিগ্রেশন কেস প্রত্যাখ্যান হওয়ার পরও অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করায় এক প্রবাসী বাংলাদেশিকে ১৮ লাখ ২০ হাজার ৩৫২ ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, ১ ডলারে ১২৫ টাকা ধরে) সিভিল পেনাল্টি হিসেবে জরিমানা করেছে মার্কিন আদালত। নিউ ইয়র্কের কুইন্সের এস্টোরিয়ায় বসবাসরত এই প্রবাসীর নাম ও পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে মানবিক ও আইনি কারণে, তবে ছদ্মনাম হিসেবে ‘আরিফুল’ ব্যবহার করা হয়েছে।
১৭ বছর আগের মামলার রায় অমান্য ছিল জরিমানার কারণ
২০০৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মার্কিন ইমিগ্রেশন আদালত “কেস রিমুভাল” আদেশ জারি করে আরিফুলের বিরুদ্ধে। সেই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করলেও, ২০০৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আদালত তাঁর আবেদন খারিজ করে কেস “ডিসমিসড” ঘোষণা করে। এরপরও তিনি যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ না করে সেখানে বসবাস করে আসছিলেন। মূলত সন্তানদের ছোটবেলা ও পরিবারের প্রয়োজনে তিনি দেশত্যাগের আদেশ পালন করেননি।
বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও মার্কিন সরকার তখন কোনো সক্রিয় পদক্ষেপ না নিলেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনে এসে অভিবাসন নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান শুরু হয়। বিভিন্ন ফেডারেল বিভাগ একযোগে অবৈধ অভিবাসীদের শনাক্ত ও বহিষ্কারে কাজ শুরু করে।
ফেডারেল আদালতের হঠাৎ জরিমানার আদেশ
নিউ ইয়র্কের ২৬ ফেডারেল প্লাজায় অবস্থিত আদালত প্রায় দুই দশক পর হঠাৎ করে আরিফুলের বিরুদ্ধে ১৮ লাখ ডলারের বেশি অর্থদণ্ড জারি করে। এতে প্রবাসী আরিফুল একপ্রকার দিশেহারা হয়ে পড়েন। তিনি এ রায় হাতে পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে জরিমানা পরিশোধ না করলে তা চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। এসময় তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন বলেও জানানো হয়েছে।
তবে উল্লেখযোগ্যভাবে তার স্ত্রী ও সন্তানরা মার্কিন নাগরিক হওয়ায়, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের সম্ভাবনা নেই।
আইনি বিশ্লেষণ: যুক্তরাষ্ট্রে
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরী এ বিষয়ে জানান, “আইনটি নতুন নয়, এটি ১৯৫২ সালের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্ট (INA)-এর সংশোধনী যা ১৯৯৬ সালে কার্যকর হয়। আগে এই আইন থাকলেও বাস্তবে জরিমানার প্রয়োগ ছিল না। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় সেই পুরনো আইনকে জোরালোভাবে কার্যকর করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “আরিফুল তার কেস রিওপেন করার চেষ্টা করলেও আদালত তা গ্রহণ করেনি। সরকারও জানে তিনি কোথায় থাকেন, কী করেন – তাই এই জরিমানার নোটিশ এসেছে। জরিমানা না দিলে সরকারের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তেরও অধিকার রয়েছে।”
মানবিক বিবেচনায় আবেদন ও সম্ভাব্য প্রতিকার
অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরীর মতে, আরিফুল এখন ৩০ দিনের মধ্যে জরিমানা পরিশোধ না করলে এবং কোনো আবেদন না করলে সেটি চূড়ান্ত হয়ে যাবে। তবে তিনি চাইলে মানবিক বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে জরিমানার পরিমাণ কমানোর বা মওকুফ করার আবেদন করতে পারেন। এমনকি যদি আবেদন গ্রহণ না হয়, তাহলে তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
এছাড়া, যেহেতু এটি কোনো অপরাধমূলক মামলা নয়, তাই তাকে জেলে পাঠানোর সম্ভাবনা খুবই কম।
প্রশ্ন উঠছে: যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নীতির ভবিষ্যৎ কী?
এই ঘটনা শুধু আরিফুলের জন্য নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত লক্ষাধিক অনিয়মিত অভিবাসীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। সরকারের তরফে এ ধরণের পদক্ষেপ স্পষ্টতই একটি বার্তা দিতে চায় – অবৈধভাবে বসবাস করলেই ছাড় নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈধতা ছাড়া দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করা অতীতে যত সহজ ছিল, এখন সেই সুযোগ নেই। অভিবাসন সংক্রান্ত যেকোনো মামলার আদেশ বা সিদ্ধান্তকে অমান্য করা দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
আরিফুলের কাহিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসীদের জন্য এক রূঢ় বাস্তবতা তুলে ধরেছে। যদিও তিনি মানবিক কারণে যুক্তরাষ্ট্রে থাকার চেষ্টা করেছেন, আদালতের চোখে আইনের লঙ্ঘনই মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঘটনার মাধ্যমে অন্যান্য অভিবাসীদের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা রয়ে গেল – যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতে হলে আইনি প্রক্রিয়াকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে, না হলে ভবিষ্যতে তা দুঃস্বপ্নের রূপ নিতে পারে।