সময়: বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে মোদির নাটকীয় কৌশল: জনগণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার এক কৌশলী খেলা

বিল্লাল হোসেন
  • Update Time : ০৬:০৭:৫৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ৭ মে ২০২৫
  • / ৯৬ Time View

MODI

MODI

ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। এ দেশের ভবিষ্যৎ শুধু ভারতের জনগণের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা, শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আজ ভারতের রাজনীতিতে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে সরকারের দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে একপ্রকার “মনস্তাত্ত্বিক রাজনীতি” চর্চা করা হচ্ছে—জনগণের দৃষ্টি মূল সমস্যা থেকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য পরিকল্পিত কৌশল নেওয়া হচ্ছে। এ কৌশলের প্রধান কারিগর হচ্ছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)।

নির্বাচনী সংকট জনসমর্থনের অবনমন

২০১৪ সালে মোদি যখন প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন, তখন জনগণের মধ্যে “আচ্ছে দিন”–এর আশায় এক বিরাট প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ১০ বছরের শাসনের পর আজ সেই মোদি সরকারের জনপ্রিয়তা দৃশ্যমানভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
পিউ রিসার্চ সেন্টার এর ২০২৩ সালের জরিপে উঠে এসেছে, শহুরে জনগণের ৪২% মনে করে, দেশে গণতন্ত্র আজ বিপন্ন।
লোকনীতি ফাউন্ডেশন এর এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে,

“২০১৯ সালে বিজেপির পক্ষে সমর্থন যেখানে ছিল প্রায় ৫৭%, ২০২৪-এর মাঝামাঝি সময়ে তা নেমে এসেছে ৪৫%-এ।”
এই জনপ্রিয়তা পতনের নেপথ্যে রয়েছে—

  • বেকারত্ব বৃদ্ধি
  • কৃষক আন্দোলনের প্রতি সরকারের উদাসীনতা
  • ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা
  • দমনমূলক নীতির মাধ্যমে প্রতিবাদ ঠেকানো
  • মিডিয়ার ওপর হস্তক্ষেপ
  • এবং বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ

অর্থনৈতিক দুরবস্থা: বাস্তব চিত্র

ভারতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানে উদ্বেগজনক।
CMIE (Centre for Monitoring Indian Economy) অনুযায়ী,

“২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে ভারতের বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে ৮.৩%, গ্রামীণ যুবসমাজে তা ১০%-এর ওপরে।”
মুদ্রাস্ফীতির হার বর্তমানে ৬.৫%–৭% এর মধ্যে, যা গড় আন্তর্জাতিক মানের চেয়েও বেশি।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেজা বাকের বলেন,
“সরকার যদি সঠিক অর্থনৈতিক নীতি না নেয়, তবে তা কর্মসংস্থান সৃষ্টির বদলে শুধু ধনী ও কর্পোরেট পুঁজির পক্ষে একতরফা সুবিধা তৈরি করবে।”

/> এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ দিন দিন বাড়ছে।

কাশ্মীর সীমান্ত নাটক: বিভ্রান্তির হাতিয়ার

কাশ্মীর ও সীমান্তকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ঘটনাবলি আবারো স্পষ্ট করেছে, কীভাবে মোদি সরকার সংকট ও নিরাপত্তার প্রশ্নকে ভোট ও জনমত প্রভাবিত করার একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে জম্মু-কাশ্মীরের পাহেলগাঁও এলাকায় একটি পর্যটকবাহী বাসে সশস্ত্র হামলায় ৯ জন নিহত হন এবং বহু আহত হন। এই নৃশংস হামলার মাত্র একদিনের ব্যবধানে ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তান সীমান্তে কথিত “প্রতিরোধমূলক অভিযান” চালানো হয়, যা নিয়ে পরবর্তীতে কোনো স্বাধীন আন্তর্জাতিক বা অভ্যন্তরীণ তদন্ত হয়নি। এই ঘটনার সময়কাল ও প্রকৃতি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মনে গভীর সন্দেহের উদ্রেক করেছে। বিশিষ্ট রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক অজয় গোস্বামী NDTV-তে বলেন, “কাশ্মীর নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টির মাধ্যমে মোদি সরকার জনগণের দৃষ্টি ঘরোয়া সংকট থেকে ঘুরিয়ে দেওয়ার কৌশল দীর্ঘদিন ধরেই প্রয়োগ করে আসছে।”

পূর্ববর্তী উদাহরণ: ২০১৯ সালের পুলওয়ামা বালাকোট স্ট্রাইক

২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলায় ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যু হয়, যার ঠিক এক মাস পর ভারতের বালাকোটে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ হয়।
BBC, The Wire, Scroll.in এর রিপোর্ট অনুযায়ী,

“বালাকোটে কতজন নিহত হয়েছিল তার সঠিক প্রমাণ আজও নেই। ভারতীয় বায়ুসেনার শীর্ষ কর্মকর্তারাও মৃতের সংখ্যা জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।”
অনেকেই একে ২০১৯ সালের নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে একটি জাতীয়তাবাদী আবেগ তৈরির প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেছেন।

বিশ্লেষক অরুন্ধতী রায় একবার বলেছিলেন,

“মোদি সরকার যখনই কোন ঘরোয়া সংকটে পড়ে, তখনই তারা ‘শত্রু দেশের’ বিপক্ষে যুদ্ধের মনোভাব সৃষ্টি করে। এটি একধরনের রাজনৈতিক থিয়েটার।”

ধর্মীয় মেরুকরণ: রাষ্ট্রীয় বিভাজনের রাজনীতি

ভারতের গণতান্ত্রিক ভিত্তি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু মোদি সরকারের আমলে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
USCIRF (United States Commission on International Religious Freedom) এর রিপোর্টে বলা হয়,

“ভারতে মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিয়মিত ধর্মীয় নিপীড়ন, উস্কানিমূলক সহিংসতা ও রাষ্ট্রীয় চুপচাপ সমর্থনের শিকার।”
উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট—এমন রাজ্যগুলোতে মুসলিমদের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্য আজ সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে।

দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এক বিশ্লেষণে লিখেছে:

“এখনকার ভারত যেন ১৯৪৭ সালের আগে ব্রিটিশদের ‘Divide and Rule’ নীতির পুনরাবৃত্তি দেখছে।”

মিডিয়া কনট্রোল: একচোখা প্রচারণা

নরেন্দ্র মোদি সরকারের অন্যতম বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রনির্ভর গণমাধ্যম
Reporters Without Borders (RSF) এর প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ভারত ২০২4 সালে ১৫৯তম স্থানে, যা একেবারেই লজ্জাজনক।
NDTV, Republic TV, Zee News–এর মতো বড় চ্যানেলগুলো সরকারের পক্ষে একতরফা প্রচারণা চালায়।
The WireAlt News সহ নিরপেক্ষ সাংবাদিকরা বিভিন্ন সময়ে সরকারের হুমকি, মামলায় জর্জরিত হয়েছেন।

জার্মান সাংবাদিক ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদন অনুযায়ী,

“ভারতের মিডিয়া স্বাধীন নয়, বরং সরকারপন্থী কর্পোরেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একধরনের প্রচারমাধ্যমে রূপান্তরিত হয়েছে।”

ভোট রাজনীতিতে কাশ্মীর পাকিস্তান: পুরনো কৌশল, নতুন রূপ

মোদি সরকার যখনই নির্বাচনের মুখোমুখি হয়, তখনই সীমান্তে উত্তেজনা, পাকিস্তান বিরোধী হুংকার বা কাশ্মীরে হামলা এক সাধারণ কৌশলে পরিণত হয়।
এগুলো জনগণের আবেগ ও দেশপ্রেমকে উত্তেজিত করে এবং আসল ইস্যুগুলো—যেমন দ্রব্যমূল্য, বেকারত্ব, কৃষক মৃত্যু—ছায়ায় পড়ে যায়।

Jawaharlal Nehru University–র অধ্যাপক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন,

“কাশ্মীর ও পাকিস্তানকে ভোট কৌশলে ব্যবহার করা মানেই হচ্ছে দেশের নিরাপত্তা ও কূটনীতি নিয়ে রাজনীতি করা। এটি একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন রাষ্ট্রীয় আচরণ।”

এই খেলা আর কতদূর?

ভারত আজ এমন এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে ‘প্রকৃত দেশপ্রেম’ ও ‘নাটকীয় জাতীয়তাবাদ’–এর পার্থক্য বুঝে ওঠার সময় এসেছে।
যদি একটি সরকার জনগণের দুঃখ-কষ্টের কথা শোনার পরিবর্তে শুধুই ক্ষমতা রক্ষায় ব্যস্ত থাকে, তাহলে সেই সরকার গণতন্ত্রের জন্য একটি ভয়ংকর সংকেত।
জনগণের উচিত—সংবেদনশীল হয়ে দেশের মূল সংকটগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা, মিডিয়ার বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকা, এবং এমন নেতৃত্ব বেছে নেওয়া যারা সত্যিকারের দায়িত্বশীল।

©billal Hossain

তথ্যসূত্র (Citations & References)

  1. Pew Research Center, India Public Opinion Poll, 2023 – www.pewresearch.org
  2. CMIE Unemployment Report, Q1 2024 – www.cmie.com
  3. The Wire – “Balakot and BJP’s Political Use of Military Strikes”, 2023
  4. USCIRF – “Religious Freedom Report on India 2023” – www.uscirf.gov
  5. Reporters Without Borders, Press Freedom Index 2024 – www.rsf.org
  6. Alt News & Factchecker.in – BJP propaganda and misinformation reports
  7. NDTV interview with Pratap Bhanu Mehta – “Nationalism and Electoral Gains”, March 2024
  8. Deutsche Welle (DW) – “India’s Shrinking Media Freedom”, Feb 2024
  9. Scroll.in – “How BJP Weaponizes Border Tensions for Votes”, April 2024
  10. The Hindu – “Economic Indicators & Public Sentiment”, Jan 2024

 

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

বিল্লাল হোসেন

বিল্লাল হোসেন, একজন প্রজ্ঞাবান পেশাজীবী, যিনি গণিতের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ হিসেবে একটি সমৃদ্ধ ও বহুমুখী ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছেন। তার আর্থিক খাতে যাত্রা তাকে নেতৃত্বের ভূমিকায় নিয়ে গেছে, বিশেষ করে সৌদি আরবের আল-রাজি ব্যাংকিং Inc. এবং ব্যাংক-আল-বিলাদে বিদেশী সম্পর্ক ও করেসপন্ডেন্ট মেইন্টেনেন্স অফিসার হিসেবে। প্রথাগত অর্থনীতির গণ্ডির বাইরে, বিল্লাল একজন প্রখ্যাত লেখক ও বিশ্লেষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, বিভিন্ন পত্রিকা ও অনলাইন পোর্টালে মননশীল কলাম ও গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করে। তার দক্ষতা বিস্তৃত বিষয় জুড়ে রয়েছে, যেমন অর্থনীতির জটিলতা, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, প্রবাসী শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্ট, রেমিটেন্স, রিজার্ভ এবং অন্যান্য সম্পর্কিত দিক। বিল্লাল তার লেখায় একটি অনন্য বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসেন, যা ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে অর্জিত বাস্তব জ্ঞানকে একত্রিত করে একাডেমিক কঠোরতার সাথে। তার প্রবন্ধগুলো শুধুমাত্র জটিল বিষয়গুলির উপর গভীর বোঝাপড়ার প্রতিফলন নয়, বরং পাঠকদের জন্য জ্ঞানপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে, যা তত্ত্ব ও বাস্তব প্রয়োগের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে। বিল্লাল হোসেনের অবদান তার প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করে যে, তিনি আমাদের আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বের জটিলতাগুলি উন্মোচন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের একটি বিস্তৃত এবং আরও সূক্ষ্ম বোঝাপড়ার দিকে মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।

ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে মোদির নাটকীয় কৌশল: জনগণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার এক কৌশলী খেলা

Update Time : ০৬:০৭:৫৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ৭ মে ২০২৫

MODI

ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। এ দেশের ভবিষ্যৎ শুধু ভারতের জনগণের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা, শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আজ ভারতের রাজনীতিতে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে সরকারের দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে একপ্রকার “মনস্তাত্ত্বিক রাজনীতি” চর্চা করা হচ্ছে—জনগণের দৃষ্টি মূল সমস্যা থেকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য পরিকল্পিত কৌশল নেওয়া হচ্ছে। এ কৌশলের প্রধান কারিগর হচ্ছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)।

নির্বাচনী সংকট জনসমর্থনের অবনমন

২০১৪ সালে মোদি যখন প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন, তখন জনগণের মধ্যে “আচ্ছে দিন”–এর আশায় এক বিরাট প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ১০ বছরের শাসনের পর আজ সেই মোদি সরকারের জনপ্রিয়তা দৃশ্যমানভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
পিউ রিসার্চ সেন্টার এর ২০২৩ সালের জরিপে উঠে এসেছে, শহুরে জনগণের ৪২% মনে করে, দেশে গণতন্ত্র আজ বিপন্ন।
লোকনীতি ফাউন্ডেশন এর এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে,

“২০১৯ সালে বিজেপির পক্ষে সমর্থন যেখানে ছিল প্রায় ৫৭%, ২০২৪-এর মাঝামাঝি সময়ে তা নেমে এসেছে ৪৫%-এ।”
এই জনপ্রিয়তা পতনের নেপথ্যে রয়েছে—

  • বেকারত্ব বৃদ্ধি
  • কৃষক আন্দোলনের প্রতি সরকারের উদাসীনতা
  • ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা
  • দমনমূলক নীতির মাধ্যমে প্রতিবাদ ঠেকানো
  • মিডিয়ার ওপর হস্তক্ষেপ
  • এবং বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ

অর্থনৈতিক দুরবস্থা: বাস্তব চিত্র

ভারতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানে উদ্বেগজনক।
CMIE (Centre for Monitoring Indian Economy) অনুযায়ী,

“২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে ভারতের বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে ৮.৩%, গ্রামীণ যুবসমাজে তা ১০%-এর ওপরে।”
মুদ্রাস্ফীতির হার বর্তমানে ৬.৫%–৭% এর মধ্যে, যা গড় আন্তর্জাতিক মানের চেয়েও বেশি।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেজা বাকের বলেন,
“সরকার যদি সঠিক অর্থনৈতিক নীতি না নেয়, তবে তা কর্মসংস্থান সৃষ্টির বদলে শুধু ধনী ও কর্পোরেট পুঁজির পক্ষে একতরফা সুবিধা তৈরি করবে।”

/> এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ দিন দিন বাড়ছে।

কাশ্মীর সীমান্ত নাটক: বিভ্রান্তির হাতিয়ার

কাশ্মীর ও সীমান্তকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ঘটনাবলি আবারো স্পষ্ট করেছে, কীভাবে মোদি সরকার সংকট ও নিরাপত্তার প্রশ্নকে ভোট ও জনমত প্রভাবিত করার একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে জম্মু-কাশ্মীরের পাহেলগাঁও এলাকায় একটি পর্যটকবাহী বাসে সশস্ত্র হামলায় ৯ জন নিহত হন এবং বহু আহত হন। এই নৃশংস হামলার মাত্র একদিনের ব্যবধানে ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তান সীমান্তে কথিত “প্রতিরোধমূলক অভিযান” চালানো হয়, যা নিয়ে পরবর্তীতে কোনো স্বাধীন আন্তর্জাতিক বা অভ্যন্তরীণ তদন্ত হয়নি। এই ঘটনার সময়কাল ও প্রকৃতি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মনে গভীর সন্দেহের উদ্রেক করেছে। বিশিষ্ট রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক অজয় গোস্বামী NDTV-তে বলেন, “কাশ্মীর নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টির মাধ্যমে মোদি সরকার জনগণের দৃষ্টি ঘরোয়া সংকট থেকে ঘুরিয়ে দেওয়ার কৌশল দীর্ঘদিন ধরেই প্রয়োগ করে আসছে।”

পূর্ববর্তী উদাহরণ: ২০১৯ সালের পুলওয়ামা বালাকোট স্ট্রাইক

২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলায় ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যু হয়, যার ঠিক এক মাস পর ভারতের বালাকোটে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ হয়।
BBC, The Wire, Scroll.in এর রিপোর্ট অনুযায়ী,

“বালাকোটে কতজন নিহত হয়েছিল তার সঠিক প্রমাণ আজও নেই। ভারতীয় বায়ুসেনার শীর্ষ কর্মকর্তারাও মৃতের সংখ্যা জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।”
অনেকেই একে ২০১৯ সালের নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে একটি জাতীয়তাবাদী আবেগ তৈরির প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেছেন।

বিশ্লেষক অরুন্ধতী রায় একবার বলেছিলেন,

“মোদি সরকার যখনই কোন ঘরোয়া সংকটে পড়ে, তখনই তারা ‘শত্রু দেশের’ বিপক্ষে যুদ্ধের মনোভাব সৃষ্টি করে। এটি একধরনের রাজনৈতিক থিয়েটার।”

ধর্মীয় মেরুকরণ: রাষ্ট্রীয় বিভাজনের রাজনীতি

ভারতের গণতান্ত্রিক ভিত্তি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু মোদি সরকারের আমলে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
USCIRF (United States Commission on International Religious Freedom) এর রিপোর্টে বলা হয়,

“ভারতে মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিয়মিত ধর্মীয় নিপীড়ন, উস্কানিমূলক সহিংসতা ও রাষ্ট্রীয় চুপচাপ সমর্থনের শিকার।”
উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট—এমন রাজ্যগুলোতে মুসলিমদের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্য আজ সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে।

দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এক বিশ্লেষণে লিখেছে:

“এখনকার ভারত যেন ১৯৪৭ সালের আগে ব্রিটিশদের ‘Divide and Rule’ নীতির পুনরাবৃত্তি দেখছে।”

মিডিয়া কনট্রোল: একচোখা প্রচারণা

নরেন্দ্র মোদি সরকারের অন্যতম বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রনির্ভর গণমাধ্যম
Reporters Without Borders (RSF) এর প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ভারত ২০২4 সালে ১৫৯তম স্থানে, যা একেবারেই লজ্জাজনক।
NDTV, Republic TV, Zee News–এর মতো বড় চ্যানেলগুলো সরকারের পক্ষে একতরফা প্রচারণা চালায়।
The WireAlt News সহ নিরপেক্ষ সাংবাদিকরা বিভিন্ন সময়ে সরকারের হুমকি, মামলায় জর্জরিত হয়েছেন।

জার্মান সাংবাদিক ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদন অনুযায়ী,

“ভারতের মিডিয়া স্বাধীন নয়, বরং সরকারপন্থী কর্পোরেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একধরনের প্রচারমাধ্যমে রূপান্তরিত হয়েছে।”

ভোট রাজনীতিতে কাশ্মীর পাকিস্তান: পুরনো কৌশল, নতুন রূপ

মোদি সরকার যখনই নির্বাচনের মুখোমুখি হয়, তখনই সীমান্তে উত্তেজনা, পাকিস্তান বিরোধী হুংকার বা কাশ্মীরে হামলা এক সাধারণ কৌশলে পরিণত হয়।
এগুলো জনগণের আবেগ ও দেশপ্রেমকে উত্তেজিত করে এবং আসল ইস্যুগুলো—যেমন দ্রব্যমূল্য, বেকারত্ব, কৃষক মৃত্যু—ছায়ায় পড়ে যায়।

Jawaharlal Nehru University–র অধ্যাপক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন,

“কাশ্মীর ও পাকিস্তানকে ভোট কৌশলে ব্যবহার করা মানেই হচ্ছে দেশের নিরাপত্তা ও কূটনীতি নিয়ে রাজনীতি করা। এটি একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন রাষ্ট্রীয় আচরণ।”

এই খেলা আর কতদূর?

ভারত আজ এমন এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে ‘প্রকৃত দেশপ্রেম’ ও ‘নাটকীয় জাতীয়তাবাদ’–এর পার্থক্য বুঝে ওঠার সময় এসেছে।
যদি একটি সরকার জনগণের দুঃখ-কষ্টের কথা শোনার পরিবর্তে শুধুই ক্ষমতা রক্ষায় ব্যস্ত থাকে, তাহলে সেই সরকার গণতন্ত্রের জন্য একটি ভয়ংকর সংকেত।
জনগণের উচিত—সংবেদনশীল হয়ে দেশের মূল সংকটগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা, মিডিয়ার বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকা, এবং এমন নেতৃত্ব বেছে নেওয়া যারা সত্যিকারের দায়িত্বশীল।

©billal Hossain

তথ্যসূত্র (Citations & References)

  1. Pew Research Center, India Public Opinion Poll, 2023 – www.pewresearch.org
  2. CMIE Unemployment Report, Q1 2024 – www.cmie.com
  3. The Wire – “Balakot and BJP’s Political Use of Military Strikes”, 2023
  4. USCIRF – “Religious Freedom Report on India 2023” – www.uscirf.gov
  5. Reporters Without Borders, Press Freedom Index 2024 – www.rsf.org
  6. Alt News & Factchecker.in – BJP propaganda and misinformation reports
  7. NDTV interview with Pratap Bhanu Mehta – “Nationalism and Electoral Gains”, March 2024
  8. Deutsche Welle (DW) – “India’s Shrinking Media Freedom”, Feb 2024
  9. Scroll.in – “How BJP Weaponizes Border Tensions for Votes”, April 2024
  10. The Hindu – “Economic Indicators & Public Sentiment”, Jan 2024