শেখ হাসিনাসহ কয়েকজনের মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত প্রায় শেষ: চিফ প্রসিকিউটর

- Update Time : ০৫:২১:৪৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
- / ৫৭ Time View

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বেশ কিছু আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত প্রায় শেষের পথে। মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এই মামলার তদন্ত আগামী ২০ এপ্রিলের মধ্যে সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন। তদন্তের এ পর্যায়ে আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর প্রাথমিক সত্যতা যাচাইয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
তদন্তের অগ্রগতি ও প্রসিকিউটরের বক্তব্য
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানান, শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত প্রায় শেষ। এই তদন্তের সঙ্গে জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন যুক্ত করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া হবে। নতুন প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ এবং ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তদন্তের সারসংক্ষেপ তৈরি করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর আদালত নির্দেশ দিয়েছিল যে, জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলার তদন্ত দুই মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে। একই মামলায় ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের নাম রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল দ্রুত বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রসিকিউশনকে নির্দেশনা দিয়েছে। এ মামলায় অভিযুক্তদের ভূমিকা সম্পর্কে বিশদ তথ্য এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে কী কী প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে সে বিষয়ে প্রসিকিউশন একটি বিশেষ প্রতিবেদনের মাধ্যমে আদালতকে অবহিত করবে।
গণহত্যা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে কঠোর দমননীতি গ্রহণ করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এই আন্দোলনের সময় সংঘটিত গণহত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনা সরকারকে অভিযুক্ত করা হয়। অভিযোগ রয়েছে যে, সরকার ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে নির্বিচারে হত্যা চালায়, যেখানে প্রায় দেড় হাজার মানুষ প্রাণ হারান। ভুক্তভোগীদের পরিবার ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে দমন-পীড়ন চালানো হয় এবং এ সংক্রান্ত বহু তথ্য-প্রমাণ বর্তমানে তদন্ত কমিটির হাতে রয়েছে।
৫ আগস্ট, ব্যাপক জনবিক্ষোভ ও ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। এরপর শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয় এবং জুলাই-আগস্টের গণহত্যার বিচারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে অভিযুক্তদের বিচার নিশ্চিত করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে, যার আওতায় ইতোমধ্যেই একাধিক শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম
স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর ২০১০ সালে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। একই বছরের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনালের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। তবে, ২০১৫ সালের পর থেকে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম ধীর হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিচার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে পূর্ববর্তী সময়ে অনেক বিচার কাজ বিলম্বিত হয়েছে।
২০২৪ সালে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আবারও সক্রিয় হয় এবং সাম্প্রতিক তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম জোরদার করে। এই প্রক্রিয়ায়, সাবেক সরকার প্রধানসহ অন্যান্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা যাচাই ও বিচার নিশ্চিত করতে নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই বিচার চলমান থাকলে বাংলাদেশে ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হবে।
পরবর্তী পদক্ষেপ
আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, আগামী ২০ এপ্রিলের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হবে। এরপর বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে এবং আদালত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দাখিল করা চার্জশিট এবং সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে শুনানি চলবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই বিচারের উপর নিবিড় নজর রাখছে এবং তারা স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচারের আহ্বান জানিয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই বিচার প্রক্রিয়া নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হলে তা দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষণ
বিশ্ব সম্প্রদায়ের নজর এখন বাংলাদেশে পরিচালিত এই বিচার কার্যক্রমের দিকে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো দাবি করেছে, ২০২৪ সালের গণহত্যার ঘটনায় দোষীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হলে তা ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, বিচার প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ এবং আইনের শাসনের ভিত্তিতে পরিচালিত হলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের মানদণ্ডে আরও শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করতে পারবে।
Please Share This Post in Your Social Media

শেখ হাসিনাসহ কয়েকজনের মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত প্রায় শেষ: চিফ প্রসিকিউটর


আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বেশ কিছু আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত প্রায় শেষের পথে। মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এই মামলার তদন্ত আগামী ২০ এপ্রিলের মধ্যে সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন। তদন্তের এ পর্যায়ে আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর প্রাথমিক সত্যতা যাচাইয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
তদন্তের অগ্রগতি ও প্রসিকিউটরের বক্তব্য
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানান, শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত প্রায় শেষ। এই তদন্তের সঙ্গে জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন যুক্ত করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া হবে। নতুন প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ এবং ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তদন্তের সারসংক্ষেপ তৈরি করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর আদালত নির্দেশ দিয়েছিল যে, জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলার তদন্ত দুই মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে। একই মামলায় ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের নাম রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল দ্রুত বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রসিকিউশনকে নির্দেশনা দিয়েছে। এ মামলায় অভিযুক্তদের ভূমিকা সম্পর্কে বিশদ তথ্য এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে কী কী প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে সে বিষয়ে প্রসিকিউশন একটি বিশেষ প্রতিবেদনের মাধ্যমে আদালতকে অবহিত করবে।
গণহত্যা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে কঠোর দমননীতি গ্রহণ করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এই আন্দোলনের সময় সংঘটিত গণহত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনা সরকারকে অভিযুক্ত করা হয়। অভিযোগ রয়েছে যে, সরকার ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে নির্বিচারে হত্যা চালায়, যেখানে প্রায় দেড় হাজার মানুষ প্রাণ হারান। ভুক্তভোগীদের পরিবার ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে দমন-পীড়ন চালানো হয় এবং এ সংক্রান্ত বহু তথ্য-প্রমাণ বর্তমানে তদন্ত কমিটির হাতে রয়েছে।
৫ আগস্ট, ব্যাপক জনবিক্ষোভ ও ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। এরপর শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয় এবং জুলাই-আগস্টের গণহত্যার বিচারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে অভিযুক্তদের বিচার নিশ্চিত করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে, যার আওতায় ইতোমধ্যেই একাধিক শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম
স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর ২০১০ সালে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। একই বছরের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনালের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। তবে, ২০১৫ সালের পর থেকে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম ধীর হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিচার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে পূর্ববর্তী সময়ে অনেক বিচার কাজ বিলম্বিত হয়েছে।
২০২৪ সালে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আবারও সক্রিয় হয় এবং সাম্প্রতিক তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম জোরদার করে। এই প্রক্রিয়ায়, সাবেক সরকার প্রধানসহ অন্যান্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা যাচাই ও বিচার নিশ্চিত করতে নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই বিচার চলমান থাকলে বাংলাদেশে ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হবে।
পরবর্তী পদক্ষেপ
আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, আগামী ২০ এপ্রিলের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হবে। এরপর বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে এবং আদালত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দাখিল করা চার্জশিট এবং সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে শুনানি চলবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই বিচারের উপর নিবিড় নজর রাখছে এবং তারা স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচারের আহ্বান জানিয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই বিচার প্রক্রিয়া নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হলে তা দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষণ
বিশ্ব সম্প্রদায়ের নজর এখন বাংলাদেশে পরিচালিত এই বিচার কার্যক্রমের দিকে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো দাবি করেছে, ২০২৪ সালের গণহত্যার ঘটনায় দোষীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হলে তা ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, বিচার প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ এবং আইনের শাসনের ভিত্তিতে পরিচালিত হলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের মানদণ্ডে আরও শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করতে পারবে।