গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন: গর্ভবতী নারীরা,মা-মেয়ে,সন্তানসহ গুম ও নির্যাতনের ভয়াবহতার চিত্র

- Update Time : ০৯:৪৩:৪৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৫
- / ৬৭ Time View
গুম একটি অত্যন্ত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, যা শুধু ব্যক্তির শারীরিক অস্তিত্বকে অব্যক্ত করে না, বরং তার পরিবার এবং সমাজেও গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে গুমের ঘটনা সত্ত্বেও, দীর্ঘ সময় ধরে এসব অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া ছিল প্রায় অব্যবস্থাপনা ও গোপনীয়তার মধ্যে। তবে, গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন কিছু অত্যন্ত ভয়ংকর এবং হৃদয়বিদারক তথ্য প্রকাশ করেছে, যা দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং সরকারের প্রতি জনগণের আস্থার প্রশ্ন তুলেছে। বিশেষত, গর্ভবতী নারীরা এবং তাদের শিশুদের গুমের শিকার হওয়ার ভয়াবহতার চিত্র উঠে এসেছে এই প্রতিবেদনে, যা সমাজে তীব্র আলোচনার সৃষ্টি করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে নারীদের উপর নিপীড়ন
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে, বিশেষ করে ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে, গুমের ঘটনা ব্যাপকভাবে ঘটেছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনী, বিশেষত র্যাব ও সিআইডি, নির্যাতন ও গুমের প্রক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। প্রতিবেদনটি প্রকাশের মাধ্যমে, এটি পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে যে, গুমের শিকার হওয়া নারীদের মধ্যে এমন অনেকেই ছিলেন, যারা তাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যদের সাথে সম্পর্কের কারণে হেনস্তা হয়েছেন।
গর্ভবতী নারী ও সন্তানসহ গুমের ঘটনা
গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন তাদের প্রতিবেদনেও উল্লেখ করেছে, যে গর্ভবতী নারীও গুমের শিকার হয়েছেন। এই ধরনের একটি ঘটনা তুলে ধরে, কমিশন এক নারীর সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ করেছে। ওই নারী জানান যে, তাকে এবং তার দুই শিশুকে এক মাস ধরে আটক করে রাখা হয়েছিল। নারীটি গর্ভবতী ছিলেন, অথচ তার সঙ্গে তার দুই শিশু ছিল—একজন মাত্র তিন বছর এবং অন্যজন ১৮ মাসের। গর্ভবতী থাকা সত্ত্বেও, নারীটিকে এক পুরুষ অফিসার মারধর করতেন। গর্ভাবস্থায় এমন অমানবিক অত্যাচার একেবারে অগ্রহণযোগ্য।
ছয় বছরের শিশুর গুম এবং নির্যাতন
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, এক ছয় বছরের শিশুকেও গুমের শিকার হতে হয়েছিল। ওই শিশুটিকে তার মায়ের সঙ্গে সিটিটিসির একটি কেন্দ্রে আটক রাখা হয়েছিল। তদন্ত কমিশন জানিয়েছে, তারা শিশুটির সাক্ষাৎকার নিয়েছিল এবং শিশু নিজে জানিয়েছিল যে, তার মা ছিল না এবং তাকে নির্যাতন করা হয়েছিল। এমনকি, ওই শিশুর মা কোনদিন ফিরে আসেননি। এর পরে, এক ইমাম শিশুটিকে খুঁজে পেয়ে তার পরিবারে ফিরিয়ে দেন। তবে, তার মা আর কোনোদিন ফিরে আসেননি। এই ঘটনা, দেশের ইতিহাসে একটি গভীর দুঃখজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হবে।
র্যাবের নিষ্ঠুরতা ও রাতের কক্ষে আটক রাখা
কমিশন আরও এক ভয়াবহ ঘটনা উল্লেখ করেছে, যেখানে এক মা ও তার মেয়ে রাতে র্যাব-২ ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে আটক ছিলেন। পরের দিন মেয়ে মায়ের কোনো খোঁজ না পেয়েই গাড়ি থেকে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়। মায়ের ভাগ্যে কি ঘটেছিল, সে সম্পর্কে কোনো নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি। এমনকি, কমিশনও নিশ্চিত হয়নি যে, তার মা জীবিত ছিলেন কিনা। তার মা আর ফিরে আসেনি এবং এই ঘটনা পুরো পরিবারের জন্য এক দুর্বিষহ স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে।
নারীদের চুপ থাকার কারণ: সামাজিক কলঙ্কের ভয়
গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায় যে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা পুরুষদের তুলনায় কম হলেও, নারী গুমের ঘটনা আরও গভীর দুঃখজনক। কমিশন জানায়, অধিকাংশ নারীরা নির্যাতন ও সামাজিক কলঙ্কের ভয় নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করেননি। তাদের অনেকেই সামনে এসে নিজের গুম হওয়ার কথা বলতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, কারণ সমাজে এমন ঘটনায় নারীদের কিভাবে দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়া হয় তা তাদের কাছে স্পষ্ট ছিল। এর ফলে, অনেক নারী তাঁদের পুরুষ আত্মীয়দের প্রতি বিশেষ সম্পর্ক থাকার কারণে, নিজের গুম হওয়ার ঘটনা কখনো প্রকাশ করেননি।
প্রতিবেদনের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনটি এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক আলোচনার সূচনা করেছে। এটি জনসাধারণের সামনে তুলে ধরেছে যে, একটি গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিকদের মানবাধিকার কতটা গুরুত্বের সঙ্গে সংরক্ষণ করা উচিত। সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধির জন্য, গুমের ঘটনা এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত নির্যাতনগুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিচার প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করা জরুরি।
এছাড়াও, কমিশন নির্দেশনা দিয়েছে যে, এসব গুমের ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত এবং যথাযথ বিচার হতে হবে, যেন ভবিষ্যতে কোনো মা, সন্তান বা গর্ভবতী নারীকে এমন নিষ্ঠুর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে না হয়। এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক এবং জাতীয়ভাবে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে এমন জঘন্য ঘটনা আর কখনো না ঘটে।
এতে করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় শুদ্ধি প্রক্রিয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ হবে, যা মানুষের মানবাধিকারের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
Please Share This Post in Your Social Media

গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন: গর্ভবতী নারীরা,মা-মেয়ে,সন্তানসহ গুম ও নির্যাতনের ভয়াবহতার চিত্র

গুম একটি অত্যন্ত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, যা শুধু ব্যক্তির শারীরিক অস্তিত্বকে অব্যক্ত করে না, বরং তার পরিবার এবং সমাজেও গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে গুমের ঘটনা সত্ত্বেও, দীর্ঘ সময় ধরে এসব অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া ছিল প্রায় অব্যবস্থাপনা ও গোপনীয়তার মধ্যে। তবে, গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন কিছু অত্যন্ত ভয়ংকর এবং হৃদয়বিদারক তথ্য প্রকাশ করেছে, যা দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং সরকারের প্রতি জনগণের আস্থার প্রশ্ন তুলেছে। বিশেষত, গর্ভবতী নারীরা এবং তাদের শিশুদের গুমের শিকার হওয়ার ভয়াবহতার চিত্র উঠে এসেছে এই প্রতিবেদনে, যা সমাজে তীব্র আলোচনার সৃষ্টি করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে নারীদের উপর নিপীড়ন
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে, বিশেষ করে ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে, গুমের ঘটনা ব্যাপকভাবে ঘটেছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনী, বিশেষত র্যাব ও সিআইডি, নির্যাতন ও গুমের প্রক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। প্রতিবেদনটি প্রকাশের মাধ্যমে, এটি পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে যে, গুমের শিকার হওয়া নারীদের মধ্যে এমন অনেকেই ছিলেন, যারা তাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যদের সাথে সম্পর্কের কারণে হেনস্তা হয়েছেন।
গর্ভবতী নারী ও সন্তানসহ গুমের ঘটনা
গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন তাদের প্রতিবেদনেও উল্লেখ করেছে, যে গর্ভবতী নারীও গুমের শিকার হয়েছেন। এই ধরনের একটি ঘটনা তুলে ধরে, কমিশন এক নারীর সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ করেছে। ওই নারী জানান যে, তাকে এবং তার দুই শিশুকে এক মাস ধরে আটক করে রাখা হয়েছিল। নারীটি গর্ভবতী ছিলেন, অথচ তার সঙ্গে তার দুই শিশু ছিল—একজন মাত্র তিন বছর এবং অন্যজন ১৮ মাসের। গর্ভবতী থাকা সত্ত্বেও, নারীটিকে এক পুরুষ অফিসার মারধর করতেন। গর্ভাবস্থায় এমন অমানবিক অত্যাচার একেবারে অগ্রহণযোগ্য।
ছয় বছরের শিশুর গুম এবং নির্যাতন
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, এক ছয় বছরের শিশুকেও গুমের শিকার হতে হয়েছিল। ওই শিশুটিকে তার মায়ের সঙ্গে সিটিটিসির একটি কেন্দ্রে আটক রাখা হয়েছিল। তদন্ত কমিশন জানিয়েছে, তারা শিশুটির সাক্ষাৎকার নিয়েছিল এবং শিশু নিজে জানিয়েছিল যে, তার মা ছিল না এবং তাকে নির্যাতন করা হয়েছিল। এমনকি, ওই শিশুর মা কোনদিন ফিরে আসেননি। এর পরে, এক ইমাম শিশুটিকে খুঁজে পেয়ে তার পরিবারে ফিরিয়ে দেন। তবে, তার মা আর কোনোদিন ফিরে আসেননি। এই ঘটনা, দেশের ইতিহাসে একটি গভীর দুঃখজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হবে।
র্যাবের নিষ্ঠুরতা ও রাতের কক্ষে আটক রাখা
কমিশন আরও এক ভয়াবহ ঘটনা উল্লেখ করেছে, যেখানে এক মা ও তার মেয়ে রাতে র্যাব-২ ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে আটক ছিলেন। পরের দিন মেয়ে মায়ের কোনো খোঁজ না পেয়েই গাড়ি থেকে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়। মায়ের ভাগ্যে কি ঘটেছিল, সে সম্পর্কে কোনো নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি। এমনকি, কমিশনও নিশ্চিত হয়নি যে, তার মা জীবিত ছিলেন কিনা। তার মা আর ফিরে আসেনি এবং এই ঘটনা পুরো পরিবারের জন্য এক দুর্বিষহ স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে।
নারীদের চুপ থাকার কারণ: সামাজিক কলঙ্কের ভয়
গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায় যে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা পুরুষদের তুলনায় কম হলেও, নারী গুমের ঘটনা আরও গভীর দুঃখজনক। কমিশন জানায়, অধিকাংশ নারীরা নির্যাতন ও সামাজিক কলঙ্কের ভয় নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করেননি। তাদের অনেকেই সামনে এসে নিজের গুম হওয়ার কথা বলতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, কারণ সমাজে এমন ঘটনায় নারীদের কিভাবে দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়া হয় তা তাদের কাছে স্পষ্ট ছিল। এর ফলে, অনেক নারী তাঁদের পুরুষ আত্মীয়দের প্রতি বিশেষ সম্পর্ক থাকার কারণে, নিজের গুম হওয়ার ঘটনা কখনো প্রকাশ করেননি।
প্রতিবেদনের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনটি এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক আলোচনার সূচনা করেছে। এটি জনসাধারণের সামনে তুলে ধরেছে যে, একটি গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিকদের মানবাধিকার কতটা গুরুত্বের সঙ্গে সংরক্ষণ করা উচিত। সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধির জন্য, গুমের ঘটনা এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত নির্যাতনগুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিচার প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করা জরুরি।
এছাড়াও, কমিশন নির্দেশনা দিয়েছে যে, এসব গুমের ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত এবং যথাযথ বিচার হতে হবে, যেন ভবিষ্যতে কোনো মা, সন্তান বা গর্ভবতী নারীকে এমন নিষ্ঠুর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে না হয়। এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক এবং জাতীয়ভাবে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে এমন জঘন্য ঘটনা আর কখনো না ঘটে।
এতে করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় শুদ্ধি প্রক্রিয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ হবে, যা মানুষের মানবাধিকারের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।