সময়: বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সবাই মিলে লুট বেসিক ব্যাংক: বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি

ডিজিটাল ডেস্ক
  • Update Time : ১১:৫৪:৪০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৫ জানুয়ারী ২০২৫
  • / ৬৮ Time View

1736008824 f7b52e95798897860f6095eeecbb41ad

 

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বড় একটি কেলেঙ্কারির নাম বেসিক ব্যাংক লুটপাট। এই কেলেঙ্কারির পরিমাণ ও ব্যাপকতা এমন যে, এটি দেশের আর্থিক ব্যবস্থায় গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ যৌথভাবে এই লুটপাটের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই লুটপাট শুধু একটি ব্যাংকের সীমাবদ্ধ ঘটনা নয় বরং এটি দেশের আর্থিক খাতের দুর্বলতা ও নজরদারির অভাবকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর নেতৃত্বে ব্যাংকটি থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকটি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি দেশের ব্যাংকিং খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

লুটপাটের শুরু এবং নেতৃত্ব

২০০৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। তার যোগদানের পর থেকেই ব্যাংকটিতে অনিয়ম শুরু হয়। তার মেয়াদকালে (২০০৯-২০১৪) ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়। বাচ্চু ও তার সহযোগীদের বিভিন্ন প্রকল্পের নামে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয়। এই ঋণ আদায়ের কোনো কার্যকর প্রক্রিয়া ছিল না।

বাচ্চু প্রভাব খাটিয়ে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেন যা ব্যাংকের নীতিমালার সরাসরি লঙ্ঘন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাচ্চুর নেতৃত্বে পরিচালনা পর্ষদ নিয়ম ভেঙে ঋণ অনুমোদন করত এবং এমডি ও কর্মকর্তাদের চাপ দিত। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ঋণের প্রস্তাব যাচাই না করেই অনুমোদন দেওয়া হতো।

পরিচালনা পর্ষদের ভূমিকা

বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে থাকা সরকারি কর্মকর্তারা অনেকেই পরবর্তী সময়ে পদোন্নতি পেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব রাজিয়া বেগম, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) চেয়ারম্যান মো. সিদ্দিকুর রহমান, ফখরুল ইসলাম, শ্যামসুন্দর শিকদার, এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব বিজয় ভট্টাচার্য।

পর্ষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তারা বাচ্চুর অনৈতিক কার্যকলাপে বাধা দেননি। বরং তাদের কেউ কেউ লুটপাট থেকে লাভবান হয়েছেন। অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অর্থাৎ, পুরো ব্যবস্থাপনাতেই একটি বড় ধরনের ব্যর্থতা ছিল।

সরকারের নজরদারির অভাব

বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয় বেসিক ব্যাংকের লুটপাট ঠেকাতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে এই লুটপাট আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৎকালীন সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারাও এই লুটপাটের জন্য দায়ী। অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, “যারা বাচ্চুকে চুরি করার জন্য দরজা খুলে দিয়েছে, তারাও অপরাধী।” বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিন ধরে নজরদারির অভাব এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এ ধরনের কেলেঙ্কারি সম্ভব হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সময়মতো কার্যকর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে ব্যর্থ হয়েছে। যদি ব্যাংকের কার্যক্রমের ওপর শক্ত নজরদারি থাকত, তবে এত বড় পরিমাণ লুটপাট সম্ভব হতো না।

দুর্নীতির বিচার এবং তদন্ত প্রতিবেদন

বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে দায়ের করা ১৬টি দুর্নীতির মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তিন তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করেছেন আদালত। অভিযোগ উঠেছে, এই কর্মকর্তারা তদন্ত প্রতিবেদনে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের নাম বাদ দিয়েছেন। ঢাকার ১ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবুল কাশেম তাদের তলব করেন এবং ব্যাংকের দুর্নীতির সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদ জড়িত কি না, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছেন।

দুদকের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তারা এই দুর্নীতির ঘটনায় নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করেনি। পরিচালনা পর্ষদের প্রভাবশালী সদস্যদের নাম তদন্ত থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, দুর্নীতি দমন সংস্থাগুলোও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নয়।

আর্থিক ক্ষতি এবং ভবিষ্যৎ করণীয়

বেসিক ব্যাংকের লুটপাটের ফলে গত ১০ বছরে ব্যাংকটির মোট লোকসান হয়েছে ৪,২৩০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির ঋণের বড় একটি অংশ খেলাপি হয়ে গেছে। ব্যাংকের সঞ্চিত অর্থও প্রায় শেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে এই খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও এমডিদের বিরুদ্ধে সম্পদের হিসাব নেওয়া উচিত এবং তাদের বিচার করা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকেও এই লুটপাটের দায়ভার নিতে হবে।

পর্যালোচনা সুপারিশ

বিশ্লেষকরা মনে করেন, শুধু আবদুল হাই বাচ্চুকে দোষারোপ করলে চলবে না। বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। লুটপাটের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের হিসাব নিয়ে দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারির অভাব এবং দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণেও এই ধরনের কেলেঙ্কারি ঘটেছে।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হলে বেসিক ব্যাংকের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর জন্য প্রয়োজন কঠোর আইন প্রয়োগ এবং আর্থিক খাতের সংস্কার। এর পাশাপাশি ব্যাংক ব্যবস্থাপনার আধুনিকীকরণ, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা দরকার।

এছাড়া খেলাপি ঋণের সমস্যা সমাধানে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। যারা ব্যাংক থেকে অবৈধভাবে ঋণ নিয়েছেন এবং ফেরত দেননি, তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা উচিত। আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে যেন বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় দোষীদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত হয়।

বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি: প্রাসঙ্গিক তথ্য রেফারেন্সসমূহ

  1. বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ তদন্ত প্রতিবেদন
    • সূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক (২০১৫)
    • সারসংক্ষেপ: বাংলাদেশ ব্যাংক বেসিক ব্যাংকের লুটপাটের বিষয়ে একটি বিশেষ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ২০০৯-২০১৪ সময়কালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর নেতৃত্বে পরিচালনা পর্ষদ অসংখ্য ঋণ অনিয়ম করে।
  2. দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রিপোর্ট
    • সূত্র: দুর্নীতি দমন কমিশন (২০১৯)
    • সারসংক্ষেপ: দুদকের তদন্তে অভিযোগ ওঠে যে বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা জড়িত থাকলেও তাদের অনেকের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।
  3. বিশ্বব্যাংকের আর্থিক খাত মূল্যায়ন রিপোর্ট
    • World Bank Financial Sector Assessment Report (2020)
    • সারসংক্ষেপ: বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অভাব এই কেলেঙ্কারির জন্য দায়ী বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
  4. প্রথম আলো, “বেসিক ব্যাংক লুটপাট: কারা দায়ী?”
    • প্রকাশিত তারিখ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯
    • সারসংক্ষেপ: প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসিক ব্যাংকের লুটপাটে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ভূমিকা রয়েছে এবং তাদের শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন।
  5. দ্য ডেইলি স্টার, “The BASIC Bank Scandal: A Timeline of Corruption”
    • প্রকাশিত তারিখ: ১৫ জুন ২০১৮
    • সারসংক্ষেপ: বেসিক ব্যাংকের কেলেঙ্কারির সময়কাল, বিভিন্ন অনিয়ম এবং সরকারের পদক্ষেপের বিস্তারিত বিবরণ এই প্রতিবেদনে দেওয়া হয়েছে।
  6. অর্থনীতিবিদ . মুহাম্মদ ফারুকের গবেষণা প্রবন্ধ
    • শিরোনাম: “Banking Corruption in Bangladesh: The BASIC Bank Case”
    • প্রকাশক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগ
    • সারসংক্ষেপ: প্রবন্ধে ব্যাংকিং খাতে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুর্নীতি এবং নজরদারির অভাবের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
  7. ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (TIB) রিপোর্ট
    • শিরোনাম: “Corruption in Bangladesh’s Financial Sector: Challenges and Solutions”
    • প্রকাশিত তারিখ: নভেম্বর ২০১৯
    • সারসংক্ষেপ: রিপোর্টে বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য এবং বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
  8. আল জাজিরা, “Bangladesh’s Banking Crisis: The Story of BASIC Bank”
    • প্রকাশিত তারিখ: ২৭ জানুয়ারি ২০২০
    • সারসংক্ষেপ: আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রতিবেদনে বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতির পেছনের কারণ এবং এর প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
  9. বিডিনিউজ২৪.কম, “বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি: মামলার বর্তমান অবস্থা
    • প্রকাশিত তারিখ: ৫ এপ্রিল ২০২৩
    • সারসংক্ষেপ: বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে দায়েরকৃত মামলাগুলোর বর্তমান অবস্থা এবং বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত তথ্য এই প্রতিবেদনে রয়েছে।

 

 

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

সবাই মিলে লুট বেসিক ব্যাংক: বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি

Update Time : ১১:৫৪:৪০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৫ জানুয়ারী ২০২৫

 

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বড় একটি কেলেঙ্কারির নাম বেসিক ব্যাংক লুটপাট। এই কেলেঙ্কারির পরিমাণ ও ব্যাপকতা এমন যে, এটি দেশের আর্থিক ব্যবস্থায় গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ যৌথভাবে এই লুটপাটের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই লুটপাট শুধু একটি ব্যাংকের সীমাবদ্ধ ঘটনা নয় বরং এটি দেশের আর্থিক খাতের দুর্বলতা ও নজরদারির অভাবকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর নেতৃত্বে ব্যাংকটি থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকটি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি দেশের ব্যাংকিং খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

লুটপাটের শুরু এবং নেতৃত্ব

২০০৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। তার যোগদানের পর থেকেই ব্যাংকটিতে অনিয়ম শুরু হয়। তার মেয়াদকালে (২০০৯-২০১৪) ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়। বাচ্চু ও তার সহযোগীদের বিভিন্ন প্রকল্পের নামে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয়। এই ঋণ আদায়ের কোনো কার্যকর প্রক্রিয়া ছিল না।

বাচ্চু প্রভাব খাটিয়ে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেন যা ব্যাংকের নীতিমালার সরাসরি লঙ্ঘন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাচ্চুর নেতৃত্বে পরিচালনা পর্ষদ নিয়ম ভেঙে ঋণ অনুমোদন করত এবং এমডি ও কর্মকর্তাদের চাপ দিত। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ঋণের প্রস্তাব যাচাই না করেই অনুমোদন দেওয়া হতো।

পরিচালনা পর্ষদের ভূমিকা

বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে থাকা সরকারি কর্মকর্তারা অনেকেই পরবর্তী সময়ে পদোন্নতি পেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব রাজিয়া বেগম, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) চেয়ারম্যান মো. সিদ্দিকুর রহমান, ফখরুল ইসলাম, শ্যামসুন্দর শিকদার, এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব বিজয় ভট্টাচার্য।

পর্ষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তারা বাচ্চুর অনৈতিক কার্যকলাপে বাধা দেননি। বরং তাদের কেউ কেউ লুটপাট থেকে লাভবান হয়েছেন। অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অর্থাৎ, পুরো ব্যবস্থাপনাতেই একটি বড় ধরনের ব্যর্থতা ছিল।

সরকারের নজরদারির অভাব

বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয় বেসিক ব্যাংকের লুটপাট ঠেকাতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে এই লুটপাট আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৎকালীন সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারাও এই লুটপাটের জন্য দায়ী। অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, “যারা বাচ্চুকে চুরি করার জন্য দরজা খুলে দিয়েছে, তারাও অপরাধী।” বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিন ধরে নজরদারির অভাব এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এ ধরনের কেলেঙ্কারি সম্ভব হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সময়মতো কার্যকর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে ব্যর্থ হয়েছে। যদি ব্যাংকের কার্যক্রমের ওপর শক্ত নজরদারি থাকত, তবে এত বড় পরিমাণ লুটপাট সম্ভব হতো না।

দুর্নীতির বিচার এবং তদন্ত প্রতিবেদন

বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে দায়ের করা ১৬টি দুর্নীতির মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তিন তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করেছেন আদালত। অভিযোগ উঠেছে, এই কর্মকর্তারা তদন্ত প্রতিবেদনে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের নাম বাদ দিয়েছেন। ঢাকার ১ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবুল কাশেম তাদের তলব করেন এবং ব্যাংকের দুর্নীতির সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদ জড়িত কি না, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছেন।

দুদকের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তারা এই দুর্নীতির ঘটনায় নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করেনি। পরিচালনা পর্ষদের প্রভাবশালী সদস্যদের নাম তদন্ত থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, দুর্নীতি দমন সংস্থাগুলোও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নয়।

আর্থিক ক্ষতি এবং ভবিষ্যৎ করণীয়

বেসিক ব্যাংকের লুটপাটের ফলে গত ১০ বছরে ব্যাংকটির মোট লোকসান হয়েছে ৪,২৩০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির ঋণের বড় একটি অংশ খেলাপি হয়ে গেছে। ব্যাংকের সঞ্চিত অর্থও প্রায় শেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে এই খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও এমডিদের বিরুদ্ধে সম্পদের হিসাব নেওয়া উচিত এবং তাদের বিচার করা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকেও এই লুটপাটের দায়ভার নিতে হবে।

পর্যালোচনা সুপারিশ

বিশ্লেষকরা মনে করেন, শুধু আবদুল হাই বাচ্চুকে দোষারোপ করলে চলবে না। বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। লুটপাটের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের হিসাব নিয়ে দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারির অভাব এবং দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণেও এই ধরনের কেলেঙ্কারি ঘটেছে।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হলে বেসিক ব্যাংকের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর জন্য প্রয়োজন কঠোর আইন প্রয়োগ এবং আর্থিক খাতের সংস্কার। এর পাশাপাশি ব্যাংক ব্যবস্থাপনার আধুনিকীকরণ, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা দরকার।

এছাড়া খেলাপি ঋণের সমস্যা সমাধানে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। যারা ব্যাংক থেকে অবৈধভাবে ঋণ নিয়েছেন এবং ফেরত দেননি, তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা উচিত। আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে যেন বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় দোষীদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত হয়।

বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি: প্রাসঙ্গিক তথ্য রেফারেন্সসমূহ

  1. বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ তদন্ত প্রতিবেদন
    • সূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক (২০১৫)
    • সারসংক্ষেপ: বাংলাদেশ ব্যাংক বেসিক ব্যাংকের লুটপাটের বিষয়ে একটি বিশেষ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ২০০৯-২০১৪ সময়কালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর নেতৃত্বে পরিচালনা পর্ষদ অসংখ্য ঋণ অনিয়ম করে।
  2. দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রিপোর্ট
    • সূত্র: দুর্নীতি দমন কমিশন (২০১৯)
    • সারসংক্ষেপ: দুদকের তদন্তে অভিযোগ ওঠে যে বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা জড়িত থাকলেও তাদের অনেকের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।
  3. বিশ্বব্যাংকের আর্থিক খাত মূল্যায়ন রিপোর্ট
    • World Bank Financial Sector Assessment Report (2020)
    • সারসংক্ষেপ: বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অভাব এই কেলেঙ্কারির জন্য দায়ী বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
  4. প্রথম আলো, “বেসিক ব্যাংক লুটপাট: কারা দায়ী?”
    • প্রকাশিত তারিখ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯
    • সারসংক্ষেপ: প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসিক ব্যাংকের লুটপাটে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ভূমিকা রয়েছে এবং তাদের শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন।
  5. দ্য ডেইলি স্টার, “The BASIC Bank Scandal: A Timeline of Corruption”
    • প্রকাশিত তারিখ: ১৫ জুন ২০১৮
    • সারসংক্ষেপ: বেসিক ব্যাংকের কেলেঙ্কারির সময়কাল, বিভিন্ন অনিয়ম এবং সরকারের পদক্ষেপের বিস্তারিত বিবরণ এই প্রতিবেদনে দেওয়া হয়েছে।
  6. অর্থনীতিবিদ . মুহাম্মদ ফারুকের গবেষণা প্রবন্ধ
    • শিরোনাম: “Banking Corruption in Bangladesh: The BASIC Bank Case”
    • প্রকাশক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগ
    • সারসংক্ষেপ: প্রবন্ধে ব্যাংকিং খাতে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুর্নীতি এবং নজরদারির অভাবের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
  7. ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (TIB) রিপোর্ট
    • শিরোনাম: “Corruption in Bangladesh’s Financial Sector: Challenges and Solutions”
    • প্রকাশিত তারিখ: নভেম্বর ২০১৯
    • সারসংক্ষেপ: রিপোর্টে বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য এবং বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
  8. আল জাজিরা, “Bangladesh’s Banking Crisis: The Story of BASIC Bank”
    • প্রকাশিত তারিখ: ২৭ জানুয়ারি ২০২০
    • সারসংক্ষেপ: আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রতিবেদনে বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতির পেছনের কারণ এবং এর প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
  9. বিডিনিউজ২৪.কম, “বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি: মামলার বর্তমান অবস্থা
    • প্রকাশিত তারিখ: ৫ এপ্রিল ২০২৩
    • সারসংক্ষেপ: বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে দায়েরকৃত মামলাগুলোর বর্তমান অবস্থা এবং বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত তথ্য এই প্রতিবেদনে রয়েছে।