৪৩ বিলিয়নের চাপে দেশ: একটি বিস্তৃত পর্যালোচনা

- Update Time : ১১:০৯:৪৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪
- / ৮৫ Time View
♦ আওয়ামী লীগ সরকারের প্রকল্পে বিদেশি ঋণ কিস্তি পরিশোধের ঝুঁকি
♦ অন্তর্বর্তী সরকারকে পরিশোধ করতে হবে ২.৬ বিলিয়ন, বাকি দায় যাবে নির্বাচিত সরকারের ঘাড়ে
বাংলাদেশে মেগা প্রকল্পগুলোর নামে বিদেশি ঋণ গ্রহণের প্রবণতা দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক চাপ তৈরি করেছে। এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের পর সেগুলোর আর্থিক সাফল্য এবং কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কর্ণফুলী টানেলের মতো প্রকল্প আজ দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০টি মেগা প্রকল্পে ৪৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ
এক গবেষণায় দেখা গেছে, মোট ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে দেশের ২০টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, যার মধ্যে ৪৩ বিলিয়ন ডলার এসেছে বিদেশি ঋণ থেকে। এই ঋণের সবচেয়ে বড় অংশ রাশিয়া (৩৬.৬%), জাপান (৩৫%), এবং চীনের (২১%) কাছে পরিশোধ করতে হবে।
ইআরডি–এর পরিসংখ্যান
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জানিয়েছে, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬২.৪ বিলিয়ন ডলার।
- ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধ: ২.৪৭ বিলিয়ন ডলার
- ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অন্তর্বর্তী সরকারকে পরিশোধ করতে হবে: ২.৬ বিলিয়ন ডলার
এদিকে নির্বাচিত সরকারের ঘাড়ে আরও বেশি ঋণের বোঝা চাপবে। বিশেষ করে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ২.৭৩ বিলিয়ন এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ৩.২ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধের চাপ আসবে।
বিদেশি ঋণ ব্যবহারে অনিয়ম
বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেনের মতে, প্রকল্প গ্রহণে যাচাই-বাছাই না করেই অনেক বিদেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, খুলনার রূপসা ৮০০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্যাস সংকটের কারণে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারেনি।
তিনি বলেন, ‘‘যারা ঋণ দিয়েছেন, তাদেরও সঠিক যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব ছিল। এখন এই ঋণের বোঝা জনগণের করের টাকায় মেটাতে হবে।’’
চীনের প্রকল্পগুলোর চাপ
চীনের অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোতে ঋণের কিস্তি পরিশোধের চ্যালেঞ্জ বেশি।
- পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প: ১৫ বছরের মধ্যে পরিশোধের জন্য ২.৬৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ।
- কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প: ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ, সুদের হার ২%।
- মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প: বাণিজ্যিকভাবে চালু হওয়ার আগেই কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে।
রাশিয়ার প্রকল্প ও রূপপুরের চাপ
রাশিয়ার অর্থায়নে নির্মিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বিদেশি ঋণের বোঝা আরও বাড়াচ্ছে।
মেগা প্রকল্পগুলোর আর্থিক ফলাফল
অনেক প্রকল্পই যথাযথ পরিকল্পনা এবং অর্থ ব্যবস্থাপনা ছাড়াই বাস্তবায়িত হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত সুফল দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে সরকারকে ঋণের কিস্তি মেটাতে গিয়ে রাজস্ব খাত এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবহারে বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মন্তব্য করেছেন, ‘‘রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্স উন্নত করার উদ্যোগ ছাড়া এই ঋণ পরিশোধ কার্যক্রম দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকি তৈরি করবে।’’
সমাধানের উপায়
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদেশি ঋণ গ্রহণের আগে সঠিক যাচাই-বাছাই এবং প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে বিশদ পরিকল্পনা প্রয়োজন।
- উন্নত রাজস্ব ব্যবস্থাপনা: কর কাঠামোকে শক্তিশালী করতে হবে এবং কর ফাঁকি রোধ করতে হবে।
- রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: রাজনীতি স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন নিশ্চিত করা জরুরি।
- বিদেশি ঋণ ব্যবহারে দক্ষতা: জনগণের অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় করে প্রকল্পগুলোর কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
মেগা প্রকল্পগুলো উন্নয়নের চিত্র বদলাতে পারতো, তবে দুর্বল পরিকল্পনা, ঋণ ব্যবহারে অনিয়ম এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এগুলো এখন দেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে। সময় এসেছে সঠিক পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসার।
Please Share This Post in Your Social Media

৪৩ বিলিয়নের চাপে দেশ: একটি বিস্তৃত পর্যালোচনা

♦ আওয়ামী লীগ সরকারের প্রকল্পে বিদেশি ঋণ কিস্তি পরিশোধের ঝুঁকি
♦ অন্তর্বর্তী সরকারকে পরিশোধ করতে হবে ২.৬ বিলিয়ন, বাকি দায় যাবে নির্বাচিত সরকারের ঘাড়ে
বাংলাদেশে মেগা প্রকল্পগুলোর নামে বিদেশি ঋণ গ্রহণের প্রবণতা দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক চাপ তৈরি করেছে। এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের পর সেগুলোর আর্থিক সাফল্য এবং কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কর্ণফুলী টানেলের মতো প্রকল্প আজ দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০টি মেগা প্রকল্পে ৪৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ
এক গবেষণায় দেখা গেছে, মোট ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে দেশের ২০টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, যার মধ্যে ৪৩ বিলিয়ন ডলার এসেছে বিদেশি ঋণ থেকে। এই ঋণের সবচেয়ে বড় অংশ রাশিয়া (৩৬.৬%), জাপান (৩৫%), এবং চীনের (২১%) কাছে পরিশোধ করতে হবে।
ইআরডি–এর পরিসংখ্যান
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জানিয়েছে, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬২.৪ বিলিয়ন ডলার।
- ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধ: ২.৪৭ বিলিয়ন ডলার
- ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অন্তর্বর্তী সরকারকে পরিশোধ করতে হবে: ২.৬ বিলিয়ন ডলার
এদিকে নির্বাচিত সরকারের ঘাড়ে আরও বেশি ঋণের বোঝা চাপবে। বিশেষ করে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ২.৭৩ বিলিয়ন এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ৩.২ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধের চাপ আসবে।
বিদেশি ঋণ ব্যবহারে অনিয়ম
বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেনের মতে, প্রকল্প গ্রহণে যাচাই-বাছাই না করেই অনেক বিদেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, খুলনার রূপসা ৮০০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্যাস সংকটের কারণে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারেনি।
তিনি বলেন, ‘‘যারা ঋণ দিয়েছেন, তাদেরও সঠিক যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব ছিল। এখন এই ঋণের বোঝা জনগণের করের টাকায় মেটাতে হবে।’’
চীনের প্রকল্পগুলোর চাপ
চীনের অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোতে ঋণের কিস্তি পরিশোধের চ্যালেঞ্জ বেশি।
- পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প: ১৫ বছরের মধ্যে পরিশোধের জন্য ২.৬৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ।
- কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প: ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ, সুদের হার ২%।
- মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প: বাণিজ্যিকভাবে চালু হওয়ার আগেই কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে।
রাশিয়ার প্রকল্প ও রূপপুরের চাপ
রাশিয়ার অর্থায়নে নির্মিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বিদেশি ঋণের বোঝা আরও বাড়াচ্ছে।
মেগা প্রকল্পগুলোর আর্থিক ফলাফল
অনেক প্রকল্পই যথাযথ পরিকল্পনা এবং অর্থ ব্যবস্থাপনা ছাড়াই বাস্তবায়িত হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত সুফল দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে সরকারকে ঋণের কিস্তি মেটাতে গিয়ে রাজস্ব খাত এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবহারে বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মন্তব্য করেছেন, ‘‘রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্স উন্নত করার উদ্যোগ ছাড়া এই ঋণ পরিশোধ কার্যক্রম দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকি তৈরি করবে।’’
সমাধানের উপায়
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদেশি ঋণ গ্রহণের আগে সঠিক যাচাই-বাছাই এবং প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে বিশদ পরিকল্পনা প্রয়োজন।
- উন্নত রাজস্ব ব্যবস্থাপনা: কর কাঠামোকে শক্তিশালী করতে হবে এবং কর ফাঁকি রোধ করতে হবে।
- রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: রাজনীতি স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন নিশ্চিত করা জরুরি।
- বিদেশি ঋণ ব্যবহারে দক্ষতা: জনগণের অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় করে প্রকল্পগুলোর কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
মেগা প্রকল্পগুলো উন্নয়নের চিত্র বদলাতে পারতো, তবে দুর্বল পরিকল্পনা, ঋণ ব্যবহারে অনিয়ম এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এগুলো এখন দেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে। সময় এসেছে সঠিক পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসার।