পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান: শেখ পরিবারের প্রশ্রয় ও অনুসন্ধানের অগ্রগতি

- Update Time : ১০:৫০:৪৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪
- / ৮৪ Time View
দেশের অর্থপাচার সমস্যায় এখন কঠোর অবস্থানে রয়েছে সরকার। যারা সাধারণ মানুষের রক্ত-ঘামে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীন গোয়েন্দা সেলসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে পাচারকারীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে।
সরকার অর্থপাচার রোধ এবং পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার লক্ষ্যে ১৫টি দেশ ছাড়াও বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)-এর সহযোগিতা চেয়েছে। আন্তর্জাতিক এসব সংস্থার কাছে কারিগরি সহায়তা, প্রশিক্ষণ, এবং তথ্য সরবরাহের আহ্বান জানানো হয়েছে। বিশেষ করে ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন এবং পাচার হওয়া অর্থের উৎস ও গন্তব্য চিহ্নিত করার জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগত সহায়তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সংস্থাগুলো তাদের অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সহায়তা করার আশ্বাস দিয়েছে, যা পাচার রোধে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে আরও কার্যকর করবে।
শেখ পরিবারের প্রশ্রয়: দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দু
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র উন্মোচিত হয়েছে। তথ্যসূত্র অনুযায়ী, ১৬ বছরের শাসনকালে দলটি অনিয়ম ও দুর্নীতির চরম সীমা অতিক্রম করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শেখ রেহানা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বিরুদ্ধে বেপরোয়া দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
বিশেষ অভিযোগ
- শেখ পরিবারের সদস্যদের নাম ভাঙিয়ে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করা হয়েছে।
- শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সাবেক স্বামী খন্দকার মাশরুর হোসেনের দুবাইয়ে অর্থপাচারের অভিযোগে আটক হওয়ার ঘটনাটি ব্যাপক আলোচিত।
- বিভিন্ন আমলা, রাজনীতিবিদ, এবং ব্যবসায়ী শেখ পরিবারের প্রশ্রয়ে এই অর্থপাচারে যুক্ত ছিলেন।
এনবিআরের তৎপরতা: ২০০ সন্দেহভাজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) ইতোমধ্যে অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত প্রায় ২০০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে।
- লক্ষ্যবস্তু: রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা।
- উদ্যোগ: বিভিন্ন দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য চেয়ে পাঠানো হয়েছে, যাতে বিদেশে থাকা সম্পদ এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিস্তারিত জানা যায়।
সিআইসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, “যদি করদাতা বিদেশে সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জরিমানার অর্থ আদায়ে তাদের দেশীয় সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।”
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, কানাডা, মালয়েশিয়া, এবং দুবাইসহ ১৫টি দেশের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) কাছ থেকেও কারিগরি ও তথ্যগত সহায়তার আশ্বাস পাওয়া গেছে। বিশেষ করে ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন এবং পাচার রোধে প্রশিক্ষণ প্রদানের বিষয়ে তারা সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক।
সম্পদ বাজেয়াপ্ত: নজির গড়ার পথে এনবিআর
বিদেশে থাকা সম্পদ চিহ্নিত করার পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে থাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার কাজ চলছে।
- উদাহরণস্বরূপ, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আয়কর রিটার্নে এসব তথ্য না দেওয়ায় তার দেশীয় সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে জরিমানার অর্থ আদায়ের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে সাবেক এনবিআর সদস্য ড. সৈয়দ আমিনুল করিম বলেন, “এর আগে সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার নজির নেই। তবে এখনই এমন উদ্যোগ নেওয়া উচিত। কারণ, এ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।”
কঠোর অবস্থানের প্রয়োজনীয়তা
সরকার পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পাশাপাশি পাচারকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে চায়।
- একদিকে দেশের অভ্যন্তরে থাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে।
- অন্যদিকে বিদেশি সম্পদের অবস্থান চিহ্নিত করে তা দেশে ফেরানোর চেষ্টা চলছে।
সিআইসির কর্মকর্তারা মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদি হলেও এই প্রক্রিয়া সফল করা সম্ভব। তবে এজন্য সঠিক নীতিমালা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থপাচার রোধের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত সরকার অর্থপাচারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। তবে পাচারের মূলে শেখ পরিবারের সংশ্লিষ্টতা যে অভিযোগ উঠেছে, তা পুরো প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে।
সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। এর মাধ্যমে শুধু পাচার হওয়া অর্থই ফিরিয়ে আনা যাবে না, দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা আসবে।
Please Share This Post in Your Social Media

পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান: শেখ পরিবারের প্রশ্রয় ও অনুসন্ধানের অগ্রগতি

দেশের অর্থপাচার সমস্যায় এখন কঠোর অবস্থানে রয়েছে সরকার। যারা সাধারণ মানুষের রক্ত-ঘামে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীন গোয়েন্দা সেলসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে পাচারকারীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে।
সরকার অর্থপাচার রোধ এবং পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার লক্ষ্যে ১৫টি দেশ ছাড়াও বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)-এর সহযোগিতা চেয়েছে। আন্তর্জাতিক এসব সংস্থার কাছে কারিগরি সহায়তা, প্রশিক্ষণ, এবং তথ্য সরবরাহের আহ্বান জানানো হয়েছে। বিশেষ করে ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন এবং পাচার হওয়া অর্থের উৎস ও গন্তব্য চিহ্নিত করার জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগত সহায়তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সংস্থাগুলো তাদের অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সহায়তা করার আশ্বাস দিয়েছে, যা পাচার রোধে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে আরও কার্যকর করবে।
শেখ পরিবারের প্রশ্রয়: দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দু
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র উন্মোচিত হয়েছে। তথ্যসূত্র অনুযায়ী, ১৬ বছরের শাসনকালে দলটি অনিয়ম ও দুর্নীতির চরম সীমা অতিক্রম করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শেখ রেহানা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বিরুদ্ধে বেপরোয়া দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
বিশেষ অভিযোগ
- শেখ পরিবারের সদস্যদের নাম ভাঙিয়ে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করা হয়েছে।
- শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সাবেক স্বামী খন্দকার মাশরুর হোসেনের দুবাইয়ে অর্থপাচারের অভিযোগে আটক হওয়ার ঘটনাটি ব্যাপক আলোচিত।
- বিভিন্ন আমলা, রাজনীতিবিদ, এবং ব্যবসায়ী শেখ পরিবারের প্রশ্রয়ে এই অর্থপাচারে যুক্ত ছিলেন।
এনবিআরের তৎপরতা: ২০০ সন্দেহভাজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) ইতোমধ্যে অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত প্রায় ২০০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে।
- লক্ষ্যবস্তু: রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা।
- উদ্যোগ: বিভিন্ন দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য চেয়ে পাঠানো হয়েছে, যাতে বিদেশে থাকা সম্পদ এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিস্তারিত জানা যায়।
সিআইসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, “যদি করদাতা বিদেশে সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জরিমানার অর্থ আদায়ে তাদের দেশীয় সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।”
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, কানাডা, মালয়েশিয়া, এবং দুবাইসহ ১৫টি দেশের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) কাছ থেকেও কারিগরি ও তথ্যগত সহায়তার আশ্বাস পাওয়া গেছে। বিশেষ করে ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন এবং পাচার রোধে প্রশিক্ষণ প্রদানের বিষয়ে তারা সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক।
সম্পদ বাজেয়াপ্ত: নজির গড়ার পথে এনবিআর
বিদেশে থাকা সম্পদ চিহ্নিত করার পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে থাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার কাজ চলছে।
- উদাহরণস্বরূপ, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আয়কর রিটার্নে এসব তথ্য না দেওয়ায় তার দেশীয় সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে জরিমানার অর্থ আদায়ের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে সাবেক এনবিআর সদস্য ড. সৈয়দ আমিনুল করিম বলেন, “এর আগে সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার নজির নেই। তবে এখনই এমন উদ্যোগ নেওয়া উচিত। কারণ, এ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।”
কঠোর অবস্থানের প্রয়োজনীয়তা
সরকার পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পাশাপাশি পাচারকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে চায়।
- একদিকে দেশের অভ্যন্তরে থাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে।
- অন্যদিকে বিদেশি সম্পদের অবস্থান চিহ্নিত করে তা দেশে ফেরানোর চেষ্টা চলছে।
সিআইসির কর্মকর্তারা মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদি হলেও এই প্রক্রিয়া সফল করা সম্ভব। তবে এজন্য সঠিক নীতিমালা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থপাচার রোধের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত সরকার অর্থপাচারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। তবে পাচারের মূলে শেখ পরিবারের সংশ্লিষ্টতা যে অভিযোগ উঠেছে, তা পুরো প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে।
সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। এর মাধ্যমে শুধু পাচার হওয়া অর্থই ফিরিয়ে আনা যাবে না, দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা আসবে।