সময়: বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পর নেতানিয়াহুর ভাগ্যে এখন কী ঘটতে পারে?

ডিজিটাল ডেস্ক
  • Update Time : ১১:৪৬:১৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪
  • / ৮৬ Time View

prothomalo bangla 2024 10 10 esdnw0an netanyahuAFP

যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

 

যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। একই সঙ্গে হামাসের শীর্ষ নেতা মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধেও পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এ ঘটনাকে গাজার চলমান সংঘাত এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের প্রেক্ষাপটে একটি উল্লেখযোগ্য মোড় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ইতিহাসে প্রথমবার

গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে এই প্রথমবারের মতো আইসিসি কোনো ইসরায়েলি নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করল। ৭ অক্টোবর ২০২৩ সালে হামাসের আকস্মিক আক্রমণের পর ইসরায়েল গাজায় যে সামরিক অভিযান শুরু করে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই সংঘাতে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে এবং একে গণহত্যামূলক যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

অভিযোগ কী?

আইসিসি অভিযোগ করেছে যে, ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ২০ মে পর্যন্ত গাজায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ট প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। গাজায় সাধারণ মানুষকে “ক্ষুধার অস্ত্র” হিসেবে ব্যবহার এবং স্বাস্থ্যসেবা স্থাপনাগুলোকে টার্গেট করার বিষয়গুলো বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবাধিকার আইনের অধ্যাপক নেভ গর্ডন বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, “ইসরায়েল প্রায় দুই দশক ধরে গাজায় খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, এবং এটি প্রমাণ করা সহজ হবে। নেতানিয়াহুর বিভিন্ন বক্তব্য এবং ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ড এই দাবিকে শক্তিশালী করে।”

মোহাম্মদ দেইফের অবস্থান

ইসরায়েলের দাবি অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে মোহাম্মদ দেইফকে হত্যা করা হয়েছে। তবে তাঁর জীবিত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি। যদি তিনি বেঁচে থাকেন, তবে আইসিসির এই পরোয়ানা তাঁর ওপরও প্রভাব ফেলবে।

আইসিসির পরোয়ানার বাস্তবতা

আইসিসি রোম সনদে স্বাক্ষর করা ১২৪টি দেশে নেতানিয়াহু, গ্যালান্ট এবং দেইফের বিরুদ্ধে পরোয়ানা কার্যকর করার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশগুলোতে এই পরোয়ানার বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির সদস্য না হওয়ায় এ ধরনের পরোয়ানা মানতে বাধ্য নয়।

যদিও আইসিসি আইনগতভাবে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, তবে তাদের নিজস্ব পুলিশি ক্ষমতা না থাকায় পরোয়ানা কার্যকরের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল, কিন্তু এখনো তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।

পরবর্তী কী ঘটতে পারে?

নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের বিদেশ সফর এই পরোয়ানার পর অনেকটাই জটিল হয়ে উঠবে। যে কোনো দেশে সফর করলে তাঁদের গ্রেপ্তারের ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হবে। এর ফলে তাঁদের আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক কার্যক্রম উল্লেখযোগ্যভাবে সীমিত হতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, আইসিসির এই পদক্ষেপ পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য একটি কৌশলগত চাপ তৈরি করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সমর্থন বা সহযোগিতা করা পশ্চিমা দেশগুলোর নীতিগত অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

নেভ গর্ডন আরও উল্লেখ করেন, “আইসিসি এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ইসরায়েলি নেতাদের কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করা দেশগুলোর ওপর একটি শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে। এতে এসব দেশকে তাদের কৌশল ও নীতিমালা পুনর্মূল্যায়নে বাধ্য হতে হবে।”

পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকা

পশ্চিমা দেশগুলোতে আইসিসির এই পদক্ষেপ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো এ বিষয়ে কী অবস্থান নেয়, তা গুরুত্বপূর্ণ। যদি ইসরায়েলের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তবে এই দেশগুলোর জন্য ইসরায়েলের সামরিক কার্যক্রমে সহযোগিতা চালিয়ে যাওয়া আরও কঠিন হয়ে উঠবে।

রাজনৈতিক আন্তর্জাতিক চাপের ভূমিকা

আইসিসির এই পরোয়ানা কার্যকরের ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক চাপ এবং রাজনৈতিক সমর্থনের ওপর। যদিও এটি প্রতীকীভাবে একটি শক্তিশালী পদক্ষেপ হিসেবে ধরা হচ্ছে, তবে বাস্তবে এর প্রভাব কতটা কার্যকর হবে, তা সময়ই বলে দেবে।

আইসিসির এই পরোয়ানা শুধু নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্টের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং গতিবিধি সীমিত করবে না; বরং এটি পশ্চিমা দেশগুলোর নীতিগত অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। একইসঙ্গে, এটি আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকার সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রেও একটি নতুন দিক উন্মোচন করেছে।

 

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পর নেতানিয়াহুর ভাগ্যে এখন কী ঘটতে পারে?

Update Time : ১১:৪৬:১৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪
যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

 

যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। একই সঙ্গে হামাসের শীর্ষ নেতা মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধেও পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এ ঘটনাকে গাজার চলমান সংঘাত এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের প্রেক্ষাপটে একটি উল্লেখযোগ্য মোড় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ইতিহাসে প্রথমবার

গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে এই প্রথমবারের মতো আইসিসি কোনো ইসরায়েলি নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করল। ৭ অক্টোবর ২০২৩ সালে হামাসের আকস্মিক আক্রমণের পর ইসরায়েল গাজায় যে সামরিক অভিযান শুরু করে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই সংঘাতে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে এবং একে গণহত্যামূলক যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

অভিযোগ কী?

আইসিসি অভিযোগ করেছে যে, ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ২০ মে পর্যন্ত গাজায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ট প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। গাজায় সাধারণ মানুষকে “ক্ষুধার অস্ত্র” হিসেবে ব্যবহার এবং স্বাস্থ্যসেবা স্থাপনাগুলোকে টার্গেট করার বিষয়গুলো বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবাধিকার আইনের অধ্যাপক নেভ গর্ডন বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, “ইসরায়েল প্রায় দুই দশক ধরে গাজায় খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, এবং এটি প্রমাণ করা সহজ হবে। নেতানিয়াহুর বিভিন্ন বক্তব্য এবং ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ড এই দাবিকে শক্তিশালী করে।”

মোহাম্মদ দেইফের অবস্থান

ইসরায়েলের দাবি অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে মোহাম্মদ দেইফকে হত্যা করা হয়েছে। তবে তাঁর জীবিত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি। যদি তিনি বেঁচে থাকেন, তবে আইসিসির এই পরোয়ানা তাঁর ওপরও প্রভাব ফেলবে।

আইসিসির পরোয়ানার বাস্তবতা

আইসিসি রোম সনদে স্বাক্ষর করা ১২৪টি দেশে নেতানিয়াহু, গ্যালান্ট এবং দেইফের বিরুদ্ধে পরোয়ানা কার্যকর করার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশগুলোতে এই পরোয়ানার বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির সদস্য না হওয়ায় এ ধরনের পরোয়ানা মানতে বাধ্য নয়।

যদিও আইসিসি আইনগতভাবে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, তবে তাদের নিজস্ব পুলিশি ক্ষমতা না থাকায় পরোয়ানা কার্যকরের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল, কিন্তু এখনো তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।

পরবর্তী কী ঘটতে পারে?

নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের বিদেশ সফর এই পরোয়ানার পর অনেকটাই জটিল হয়ে উঠবে। যে কোনো দেশে সফর করলে তাঁদের গ্রেপ্তারের ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হবে। এর ফলে তাঁদের আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক কার্যক্রম উল্লেখযোগ্যভাবে সীমিত হতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, আইসিসির এই পদক্ষেপ পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য একটি কৌশলগত চাপ তৈরি করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সমর্থন বা সহযোগিতা করা পশ্চিমা দেশগুলোর নীতিগত অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

নেভ গর্ডন আরও উল্লেখ করেন, “আইসিসি এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ইসরায়েলি নেতাদের কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করা দেশগুলোর ওপর একটি শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে। এতে এসব দেশকে তাদের কৌশল ও নীতিমালা পুনর্মূল্যায়নে বাধ্য হতে হবে।”

পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকা

পশ্চিমা দেশগুলোতে আইসিসির এই পদক্ষেপ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো এ বিষয়ে কী অবস্থান নেয়, তা গুরুত্বপূর্ণ। যদি ইসরায়েলের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তবে এই দেশগুলোর জন্য ইসরায়েলের সামরিক কার্যক্রমে সহযোগিতা চালিয়ে যাওয়া আরও কঠিন হয়ে উঠবে।

রাজনৈতিক আন্তর্জাতিক চাপের ভূমিকা

আইসিসির এই পরোয়ানা কার্যকরের ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক চাপ এবং রাজনৈতিক সমর্থনের ওপর। যদিও এটি প্রতীকীভাবে একটি শক্তিশালী পদক্ষেপ হিসেবে ধরা হচ্ছে, তবে বাস্তবে এর প্রভাব কতটা কার্যকর হবে, তা সময়ই বলে দেবে।

আইসিসির এই পরোয়ানা শুধু নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্টের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং গতিবিধি সীমিত করবে না; বরং এটি পশ্চিমা দেশগুলোর নীতিগত অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। একইসঙ্গে, এটি আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকার সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রেও একটি নতুন দিক উন্মোচন করেছে।