ব্যাংক থেকে লুটকৃত অর্থ এখন খেলাপির খাতায়

- Update Time : ০৯:৫৪:০৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪
- / ৮৬ Time View
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে দুর্নীতির ঘটনা নতুন মাত্রা পেয়েছিল। একাধিক ব্যাংক দখল করে, সেগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে নিয়ম লঙ্ঘন করে বিভিন্ন নামে-বেনামে ঋণের আড়ালে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছিল। এসব অনিয়ম রোধ করার দায়িত্ব থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যত এই কাজে সহযোগিতা করেছে। অনেক ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ আড়াল করার ক্ষেত্রেও তারা ভূমিকা রেখেছে। ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানতের অভাব ছিল, যা ঋণপত্রের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়
সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংক খাতের প্রকৃত অবস্থা ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। এর ফলে, এখন প্রকৃত খেলাপি ঋণের চিত্র জনগণের সামনে উঠে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংকের মতো মালিকানা বদল হওয়া বিভিন্ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ শিল্পগোষ্ঠী যেমন বেক্সিমকো, এস আলম, বসুন্ধরা গ্রুপসহ অন্যান্য প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণও খেলাপি হয়ে পড়েছে। এর ফলে, গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়কালে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়ে, সেপ্টেম্বর শেষে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায়। এটি মোট ব্যাংক ঋণের ১৬.৯৩ শতাংশ।
বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, আলোচ্য সময়ে সরকারি ব্যাংকের তুলনায় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির হার বেশি। সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ২৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা, যেখানে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪৯ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা।
এমন পরিস্থিতি শুধু ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেনি, বরং দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকেও গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছে। এখন জরুরি ভিত্তিতে নীতি সংস্কার ও কঠোর তদারকির মাধ্যমে ব্যাংক খাতকে স্থিতিশীল করা প্রয়োজন। খেলাপি ঋণ আদায়ের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের অনিয়ম রোধে আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার জোরদার করাও অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব ছিল ব্যাংক খাতের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং অনিয়ম প্রতিরোধ করা। কিন্তু বাস্তবে, তারা এর বিপরীত ভূমিকা পালন করেছে। অনেক ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ আড়াল করা হয়েছে এবং এসব ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানতের ঘাটতি ছিল। এর ফলে ব্যাংক খাতের আর্থিক সুরক্ষা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “এত দিন খেলাপি ঋণ লুকানো ছিল। যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০১৯ সালে এমন একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়েছিল, যার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কৃত্রিমভাবে কমিয়ে দেখানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং স্থানীয় অডিট প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে, আন্তর্জাতিক মানের নীতিমালা মেনে চললে এই চিত্র উন্মোচিত হবে।”
তিনি আরও বলেন, “বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকগুলোর নিরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ব্যাংক নিজেদের উদ্যোগে এমন নিরীক্ষা চালালে প্রকৃত পরিস্থিতি উঠে আসবে। এরপরে সেই তথ্যের ভিত্তিতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।”
এটি স্পষ্ট যে, খেলাপি ঋণ লুকানোর এই প্রবণতা ব্যাংক খাতকে আরও সংকটে ফেলেছে। বিশেষত ২০১৯ সালের তথাকথিত নীতিমালা এবং এর আওতায় আনা পরিবর্তনগুলো ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা নষ্ট করেছে। খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র গোপন রাখার ফলে আর্থিক ঝুঁকি বেড়েছে এবং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক মানের নিরীক্ষা প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, এবং দোষী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি। এর মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে পুনরায় আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
খেলাপি ঋণের ক্রমবর্ধমান চিত্র:
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালের শেষে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুন মাসে তা বেড়ে হয় ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। এরই মধ্যে সেপ্টেম্বরে এই ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
তুলনা করলে দেখা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শুরুতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। অর্থাৎ, গত ১৫ বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৩ গুণ বেড়েছে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ঋণ বৃদ্ধির কারণ:
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি। উদাহরণস্বরূপ:
– মার্চ ২০২৩: ৮৮,৯০০ কোটি টাকা
– জুন ২০২৩: ৯৯,৯২১ কোটি টাকা
– সেপ্টেম্বর ২০২৩: ১,৪৯,৮০৬ কোটি টাকা
এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলো এ ঋণ বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।
প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ:
ব্যাংকারদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত পরিসংখ্যান প্রকৃত চিত্রের চেয়ে অনেক কম। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন, আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা ১ হাজার ৬৭০ কোটি ডলার (প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা) লুট করেছেন, যা খেলাপি ঋণ হিসাবেই বিবেচিত হতে পারে।
তথ্য গোপন ও আইএমএফের শর্ত:
বিগত সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ গোপন রাখার চেষ্টা করেছিল এবং পরিসংখ্যানে কমিয়ে দেখিয়েছে। কিন্তু নতুন সরকার এসে প্রকৃত চিত্র উন্মোচনের নির্দেশ দেওয়ার পরই এই ভয়াবহ বাস্তবতা প্রকাশ পাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর শর্তানুযায়ী, ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি এর বিপরীত দিকে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
করণীয়:
খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ জরুরি:
- আইনশৃঙ্খলা জোরদার: প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ।
- স্বচ্ছতা বৃদ্ধি: ব্যাংকিং খাতের তদারকি আরও কার্যকর করা।
- আন্তর্জাতিক মানের নিরীক্ষা: প্রকৃত চিত্র বের করে কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ।
- আইএমএফের শর্ত পূরণ: ঋণ পুনর্গঠন ও আদায়ের কার্যকর প্রক্রিয়া চালু করা।
দেশের ব্যাংক খাতকে এ সংকট থেকে বের করতে দ্রুত ও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
কার বেশি খেলাপি ঋণ
সরকারি বনাম বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের চিত্র:
সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ:
সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
– মার্চ ২০২৩: ৮৪,২২১ কোটি টাকা
– জুন ২০২৩: ১,০২,৪৮৩ কোটি টাকা
– সেপ্টেম্বর ২০২৩: ১,২৬,১১১ কোটি টাকা
সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বড় অংশ (প্রায় ৫০%) জনতা ব্যাংকের। এই ব্যাংকে বেক্সিমকো গ্রুপ, অ্যাননটেক্স গ্রুপ এবং এস আলম গ্রুপের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের এই উচ্চমাত্রা মূলত প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর অর্থ আদায়ের ব্যর্থতার প্রতিফলন। উল্লেখযোগ্যভাবে, বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এবং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
সরকারি ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের হার এখন ৪০.৩৫ শতাংশ, যা এই খাতে গভীর সঙ্কটের ইঙ্গিত দেয়।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ:
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি আরও দ্রুতগতির।
– মার্চ ২০২৩: ৮৮,৯০০ কোটি টাকা
– জুন ২০২৩: ৯৯,৯২১ কোটি টাকা
– সেপ্টেম্বর ২০২৩: ১,৪৯,৮০৬ কোটি টাকা
বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের উচ্চমাত্রায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলো।
– ইসলামী ব্যাংক: জুন ২০২৩-এ খেলাপি ঋণ ছিল ৭,৭২৪ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বরে বেড়ে হয়েছে ১৭,৭৫১ কোটি টাকা।
– ফার্স্ট সিকিউরিটি, ন্যাশনাল, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক: এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণও একই সময় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
– বসুন্ধরা গ্রুপ: এই গ্রুপেরও ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার বর্তমানে ১১.৮৮ শতাংশ।
খেলাপি ঋণের বৃদ্ধির কারণ:
- নামে-বেনামে ঋণ উত্তোলন:
এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ আমানত নামে-বেনামে তুলে নেওয়া হয়েছে।
- ব্যবসায়ীদের পলায়ন:
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এবং অন্যান্য খাতের ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ না করে পালিয়ে যাচ্ছেন, যা খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়িয়েছে।
- ইচ্ছাকৃত ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা:
অনেক প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতা ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ পরিশোধ করছেন না।
বিশেষজ্ঞদের মতামত:
এবিবি-এর সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেছেন:
– “এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রিত ৭ ব্যাংকে যে বিপুল পরিমাণ আমানত ছিল, তা গ্রুপটি তুলে নিয়ে খেলাপি ঋণ তৈরি করেছে।”
– “ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যা অন্য গ্রাহকদের জন্য সতর্কবার্তা হতে পারে।”
ভবিষ্যৎ করণীয়:
- দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি: ঋণখেলাপিদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া।
- ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা: ব্যাংকগুলোতে স্বচ্ছ আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।
- নিরীক্ষার মানোন্নয়ন: আন্তর্জাতিক মানের নিরীক্ষা বাস্তবায়ন।
- আইএমএফ-এর শর্ত পূরণ: খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে আনার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ।
খেলাপি ঋণের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতাকে দীর্ঘমেয়াদে হুমকির মুখে ফেলছে। এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন কঠিন হবে।
খেলাপি ঋণ লুকানোর কৌশল
গত ১৫ বছরে ঋণখেলাপি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের জন্য একের পর এক সুবিধা দিয়ে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আড়াল করার নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে।
প্রধান কৌশলসমূহ:
- খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিলকরণ:
– ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর সরকার খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিল করে।
– প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সুবিধা দিতে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়।
- ঋণ পুনর্গঠন ও অবলোপন সুবিধা:
– ২০১৫ সালে সালমান এফ রহমানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়।
– ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়, যা ঋণখেলাপিদের ঋণ পরিশোধের চাপ কমিয়ে দেয়।
- ২ শতাংশ অর্থ দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ (২০১৯):
– খেলাপি ঋণগ্রহীতারা ২ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার বিশেষ সুবিধা পায়।
– এর ফলে ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়া আরও শিথিল হয়।
- কোভিড-১৯ মহামারির সময় ঋণ পরিশোধে ছাড়:
– মহামারির সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ছাড় দেয়।
– এতে অনেক ভালো ঋণগ্রহীতাও ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে।
- নিম্ন হারে অর্থ জমা দিয়ে ঋণ নিয়মিতকরণ:
– সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়ে মাত্র ২.৫%-৬.৫% অর্থ জমা দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার নিয়ম চালু হয়।
– আগে এ হার ছিল ১০%-৩০%।
- ঋণ শোধে দীর্ঘ সময়সীমা:
– ঋণ শোধের সময় ৫-৮ বছর করা হয়, যা আগে ছিল সর্বোচ্চ ২ বছর।
– এতে ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়া আরও শ্লথ হয়।
- নামে-বেনামে ঋণ উত্তোলন:
– এস আলম গ্রুপসহ প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো তাদের নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে বিপুল ঋণ তুলে নেয়।
– এসব ঋণ খেলাপি হলেও তা দীর্ঘদিন নিয়মিত দেখানো হতো।
- প্রভাবশালীদের অনুকূলে নীতি প্রণয়ন:
– ব্যাংকের মালিকানায় থাকা প্রভাবশালীদের ঋণ খেলাপি হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা আড়াল করত।
– নতুন সরকার আসার পর এই তথ্য প্রকাশ পেতে শুরু করে।
পরিণতি:
- খেলাপি ঋণ আড়ালের মাধ্যমে ব্যাংক খাতের প্রকৃত ঝুঁকির চিত্র গোপন রাখা হয়েছে।
- প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের জন্য আইনি সুবিধা তৈরি করে ব্যাংক খাতে অনিয়মের সংস্কৃতি চালু হয়েছে।
- বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত:
এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান:
– “এস আলম গ্রুপসহ প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর নামে-বেনামে ঋণ উত্তোলন খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি ঘটিয়েছে।”
– “খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।”
সামনে করণীয়:
- ঋণখেলাপিদের জন্য দেওয়া সব ধরনের ছাড় বাতিল করা।
- ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কঠোর আইন প্রণয়ন।
- প্রভাবশালীদের অনৈতিক প্রভাবমুক্ত আর্থিক নীতি চালু করা।
- খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশের জন্য শক্তিশালী নিরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করা।
খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশ ব্যাংকিং খাত আরও বড় সঙ্কটে পড়বে।
তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো
Please Share This Post in Your Social Media

ব্যাংক থেকে লুটকৃত অর্থ এখন খেলাপির খাতায়

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে দুর্নীতির ঘটনা নতুন মাত্রা পেয়েছিল। একাধিক ব্যাংক দখল করে, সেগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে নিয়ম লঙ্ঘন করে বিভিন্ন নামে-বেনামে ঋণের আড়ালে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছিল। এসব অনিয়ম রোধ করার দায়িত্ব থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যত এই কাজে সহযোগিতা করেছে। অনেক ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ আড়াল করার ক্ষেত্রেও তারা ভূমিকা রেখেছে। ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানতের অভাব ছিল, যা ঋণপত্রের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়
সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংক খাতের প্রকৃত অবস্থা ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। এর ফলে, এখন প্রকৃত খেলাপি ঋণের চিত্র জনগণের সামনে উঠে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংকের মতো মালিকানা বদল হওয়া বিভিন্ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ শিল্পগোষ্ঠী যেমন বেক্সিমকো, এস আলম, বসুন্ধরা গ্রুপসহ অন্যান্য প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণও খেলাপি হয়ে পড়েছে। এর ফলে, গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়কালে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়ে, সেপ্টেম্বর শেষে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায়। এটি মোট ব্যাংক ঋণের ১৬.৯৩ শতাংশ।
বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, আলোচ্য সময়ে সরকারি ব্যাংকের তুলনায় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির হার বেশি। সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ২৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা, যেখানে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪৯ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা।
এমন পরিস্থিতি শুধু ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেনি, বরং দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকেও গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছে। এখন জরুরি ভিত্তিতে নীতি সংস্কার ও কঠোর তদারকির মাধ্যমে ব্যাংক খাতকে স্থিতিশীল করা প্রয়োজন। খেলাপি ঋণ আদায়ের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের অনিয়ম রোধে আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার জোরদার করাও অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব ছিল ব্যাংক খাতের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং অনিয়ম প্রতিরোধ করা। কিন্তু বাস্তবে, তারা এর বিপরীত ভূমিকা পালন করেছে। অনেক ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ আড়াল করা হয়েছে এবং এসব ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানতের ঘাটতি ছিল। এর ফলে ব্যাংক খাতের আর্থিক সুরক্ষা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “এত দিন খেলাপি ঋণ লুকানো ছিল। যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০১৯ সালে এমন একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়েছিল, যার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কৃত্রিমভাবে কমিয়ে দেখানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং স্থানীয় অডিট প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে, আন্তর্জাতিক মানের নীতিমালা মেনে চললে এই চিত্র উন্মোচিত হবে।”
তিনি আরও বলেন, “বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকগুলোর নিরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ব্যাংক নিজেদের উদ্যোগে এমন নিরীক্ষা চালালে প্রকৃত পরিস্থিতি উঠে আসবে। এরপরে সেই তথ্যের ভিত্তিতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।”
এটি স্পষ্ট যে, খেলাপি ঋণ লুকানোর এই প্রবণতা ব্যাংক খাতকে আরও সংকটে ফেলেছে। বিশেষত ২০১৯ সালের তথাকথিত নীতিমালা এবং এর আওতায় আনা পরিবর্তনগুলো ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা নষ্ট করেছে। খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র গোপন রাখার ফলে আর্থিক ঝুঁকি বেড়েছে এবং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক মানের নিরীক্ষা প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, এবং দোষী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি। এর মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে পুনরায় আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
খেলাপি ঋণের ক্রমবর্ধমান চিত্র:
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালের শেষে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুন মাসে তা বেড়ে হয় ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। এরই মধ্যে সেপ্টেম্বরে এই ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
তুলনা করলে দেখা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শুরুতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। অর্থাৎ, গত ১৫ বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৩ গুণ বেড়েছে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ঋণ বৃদ্ধির কারণ:
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি। উদাহরণস্বরূপ:
– মার্চ ২০২৩: ৮৮,৯০০ কোটি টাকা
– জুন ২০২৩: ৯৯,৯২১ কোটি টাকা
– সেপ্টেম্বর ২০২৩: ১,৪৯,৮০৬ কোটি টাকা
এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলো এ ঋণ বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।
প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ:
ব্যাংকারদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত পরিসংখ্যান প্রকৃত চিত্রের চেয়ে অনেক কম। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন, আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা ১ হাজার ৬৭০ কোটি ডলার (প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা) লুট করেছেন, যা খেলাপি ঋণ হিসাবেই বিবেচিত হতে পারে।
তথ্য গোপন ও আইএমএফের শর্ত:
বিগত সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ গোপন রাখার চেষ্টা করেছিল এবং পরিসংখ্যানে কমিয়ে দেখিয়েছে। কিন্তু নতুন সরকার এসে প্রকৃত চিত্র উন্মোচনের নির্দেশ দেওয়ার পরই এই ভয়াবহ বাস্তবতা প্রকাশ পাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর শর্তানুযায়ী, ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি এর বিপরীত দিকে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
করণীয়:
খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ জরুরি:
- আইনশৃঙ্খলা জোরদার: প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ।
- স্বচ্ছতা বৃদ্ধি: ব্যাংকিং খাতের তদারকি আরও কার্যকর করা।
- আন্তর্জাতিক মানের নিরীক্ষা: প্রকৃত চিত্র বের করে কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ।
- আইএমএফের শর্ত পূরণ: ঋণ পুনর্গঠন ও আদায়ের কার্যকর প্রক্রিয়া চালু করা।
দেশের ব্যাংক খাতকে এ সংকট থেকে বের করতে দ্রুত ও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
কার বেশি খেলাপি ঋণ
সরকারি বনাম বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের চিত্র:
সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ:
সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
– মার্চ ২০২৩: ৮৪,২২১ কোটি টাকা
– জুন ২০২৩: ১,০২,৪৮৩ কোটি টাকা
– সেপ্টেম্বর ২০২৩: ১,২৬,১১১ কোটি টাকা
সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বড় অংশ (প্রায় ৫০%) জনতা ব্যাংকের। এই ব্যাংকে বেক্সিমকো গ্রুপ, অ্যাননটেক্স গ্রুপ এবং এস আলম গ্রুপের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের এই উচ্চমাত্রা মূলত প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর অর্থ আদায়ের ব্যর্থতার প্রতিফলন। উল্লেখযোগ্যভাবে, বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এবং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
সরকারি ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের হার এখন ৪০.৩৫ শতাংশ, যা এই খাতে গভীর সঙ্কটের ইঙ্গিত দেয়।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ:
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি আরও দ্রুতগতির।
– মার্চ ২০২৩: ৮৮,৯০০ কোটি টাকা
– জুন ২০২৩: ৯৯,৯২১ কোটি টাকা
– সেপ্টেম্বর ২০২৩: ১,৪৯,৮০৬ কোটি টাকা
বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের উচ্চমাত্রায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলো।
– ইসলামী ব্যাংক: জুন ২০২৩-এ খেলাপি ঋণ ছিল ৭,৭২৪ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বরে বেড়ে হয়েছে ১৭,৭৫১ কোটি টাকা।
– ফার্স্ট সিকিউরিটি, ন্যাশনাল, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক: এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণও একই সময় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
– বসুন্ধরা গ্রুপ: এই গ্রুপেরও ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার বর্তমানে ১১.৮৮ শতাংশ।
খেলাপি ঋণের বৃদ্ধির কারণ:
- নামে-বেনামে ঋণ উত্তোলন:
এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ আমানত নামে-বেনামে তুলে নেওয়া হয়েছে।
- ব্যবসায়ীদের পলায়ন:
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এবং অন্যান্য খাতের ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ না করে পালিয়ে যাচ্ছেন, যা খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়িয়েছে।
- ইচ্ছাকৃত ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা:
অনেক প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতা ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ পরিশোধ করছেন না।
বিশেষজ্ঞদের মতামত:
এবিবি-এর সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেছেন:
– “এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রিত ৭ ব্যাংকে যে বিপুল পরিমাণ আমানত ছিল, তা গ্রুপটি তুলে নিয়ে খেলাপি ঋণ তৈরি করেছে।”
– “ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যা অন্য গ্রাহকদের জন্য সতর্কবার্তা হতে পারে।”
ভবিষ্যৎ করণীয়:
- দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি: ঋণখেলাপিদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া।
- ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা: ব্যাংকগুলোতে স্বচ্ছ আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।
- নিরীক্ষার মানোন্নয়ন: আন্তর্জাতিক মানের নিরীক্ষা বাস্তবায়ন।
- আইএমএফ-এর শর্ত পূরণ: খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে আনার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ।
খেলাপি ঋণের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতাকে দীর্ঘমেয়াদে হুমকির মুখে ফেলছে। এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন কঠিন হবে।
খেলাপি ঋণ লুকানোর কৌশল
গত ১৫ বছরে ঋণখেলাপি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের জন্য একের পর এক সুবিধা দিয়ে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আড়াল করার নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে।
প্রধান কৌশলসমূহ:
- খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিলকরণ:
– ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর সরকার খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিল করে।
– প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সুবিধা দিতে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়।
- ঋণ পুনর্গঠন ও অবলোপন সুবিধা:
– ২০১৫ সালে সালমান এফ রহমানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়।
– ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়, যা ঋণখেলাপিদের ঋণ পরিশোধের চাপ কমিয়ে দেয়।
- ২ শতাংশ অর্থ দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ (২০১৯):
– খেলাপি ঋণগ্রহীতারা ২ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার বিশেষ সুবিধা পায়।
– এর ফলে ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়া আরও শিথিল হয়।
- কোভিড-১৯ মহামারির সময় ঋণ পরিশোধে ছাড়:
– মহামারির সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ছাড় দেয়।
– এতে অনেক ভালো ঋণগ্রহীতাও ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে।
- নিম্ন হারে অর্থ জমা দিয়ে ঋণ নিয়মিতকরণ:
– সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়ে মাত্র ২.৫%-৬.৫% অর্থ জমা দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার নিয়ম চালু হয়।
– আগে এ হার ছিল ১০%-৩০%।
- ঋণ শোধে দীর্ঘ সময়সীমা:
– ঋণ শোধের সময় ৫-৮ বছর করা হয়, যা আগে ছিল সর্বোচ্চ ২ বছর।
– এতে ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়া আরও শ্লথ হয়।
- নামে-বেনামে ঋণ উত্তোলন:
– এস আলম গ্রুপসহ প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো তাদের নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে বিপুল ঋণ তুলে নেয়।
– এসব ঋণ খেলাপি হলেও তা দীর্ঘদিন নিয়মিত দেখানো হতো।
- প্রভাবশালীদের অনুকূলে নীতি প্রণয়ন:
– ব্যাংকের মালিকানায় থাকা প্রভাবশালীদের ঋণ খেলাপি হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা আড়াল করত।
– নতুন সরকার আসার পর এই তথ্য প্রকাশ পেতে শুরু করে।
পরিণতি:
- খেলাপি ঋণ আড়ালের মাধ্যমে ব্যাংক খাতের প্রকৃত ঝুঁকির চিত্র গোপন রাখা হয়েছে।
- প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের জন্য আইনি সুবিধা তৈরি করে ব্যাংক খাতে অনিয়মের সংস্কৃতি চালু হয়েছে।
- বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত:
এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান:
– “এস আলম গ্রুপসহ প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর নামে-বেনামে ঋণ উত্তোলন খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি ঘটিয়েছে।”
– “খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।”
সামনে করণীয়:
- ঋণখেলাপিদের জন্য দেওয়া সব ধরনের ছাড় বাতিল করা।
- ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কঠোর আইন প্রণয়ন।
- প্রভাবশালীদের অনৈতিক প্রভাবমুক্ত আর্থিক নীতি চালু করা।
- খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশের জন্য শক্তিশালী নিরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করা।
খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশ ব্যাংকিং খাত আরও বড় সঙ্কটে পড়বে।
তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো