সময়: বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বিএনপি-জামায়াতের ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্য সক্রিয় আওয়ামী লীগ

ডিজিটাল ডেস্ক
  • Update Time : ০২:২৪:১৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪
  • / ৭৫ Time View

19667729 176

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এখন তৎপর হয়ে উঠেছে বিএনপি-জামায়াতের ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্য। ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগ দলের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে তেমন পাত্তা না দিয়ে, বরং দলটির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ শীর্ষ নেতাদের নিয়ে হাস্যরসের এবং ঠাট্টা-মশকরায় মগ্ন ছিল। তবে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন স্বৈরসরকারের পতনের পর, দলটির রাজনৈতিক শক্তি প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে। ঠিক এমন এক পরিস্থিতিতে, বিএনপির সাথে তার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করার জন্য আওয়ামী লীগ নতুন পরিকল্পনা নিয়েছে।

এক্ষেত্রে, যারা বিদেশে পালিয়ে গেছেন বা আত্মগোপনে আছেন, তারা বিএনপির বিভিন্ন কার্যক্রমের প্রতি আড়ালেই সমর্থন জানাচ্ছেন এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে, বিএনপির সাথে কৌশলগত সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করছেন, এমন খবর এসেছে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে। এটি আওয়ামী লীগের একটি সুপরিকল্পিত চেষ্টা, যাতে তারা বিএনপি-জামায়াত জোটের মধ্যে ভাঙন ধরিয়ে রাজনৈতিক মঞ্চে নিজেদের পুনরুদ্ধার করতে পারে।

যদিও বিএনপি এবং জামায়াতের আদর্শিক অবস্থান প্রায় বিপরীত, ১৯৯৯ সালে চার দলীয় জোট গঠন করে ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় লাভের মাধ্যমে তারা সরকার গঠন করেছিল। তারপর থেকে ১/১১ পরিস্থিতি এবং পরবর্তী বছরগুলিতে, বিশেষত গত ৫ আগস্টের আগে পর্যন্ত, বিএনপি-জামায়াত সরকারবিরোধী আন্দোলনে একযোগে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। সে সময় থেকে আওয়ামী লীগ জামায়াত-বিএনপি ঐক্য ভাঙানোর জন্য চেষ্টা করে আসছিল। যদিও প্রথম দিকে তারা সফল হতে পারেনি, কিন্তু ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, সেই ভাঙনের ষড়যন্ত্র আবারো পুনরায় শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এখন আওয়ামী লীগ একটি নতুন কৌশল গ্রহণ করেছে, যাতে বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হয় এবং নিজেদের রাজনৈতিক পুঁজি পুনরুদ্ধার করা যায়।

গত ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যরা সবাই আত্মগোপনে চলে যান। এমনকি আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাও এই অবস্থায় ছিলেন, এবং দলের বেশির ভাগ নেতারা এখন প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। সেই সময়, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়।

সরকার গঠনের পর থেকেই বিএনপি তাদের নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা নিয়ে চাপ সৃষ্টি করছে, এবং জামায়াত ইসলামী সরকারকে সংস্কারের জন্য কিছু সময় দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। এর ফলস্বরূপ, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে মনমালিন্য এবং একে অপরকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ১০০ দিনের পর, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হচ্ছে, যদিও কখনো কখনো তাদের সম্পর্কের মধ্যে ওঠানামা হচ্ছে। অতীতে, বিএনপি ও জামায়াত একত্রিত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, তবে বর্তমানে তারা নিজেদের আদর্শ প্রচারের জন্য বেশি মনোযোগী হয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে, আওয়ামী লীগ একটি সুযোগ খুঁজছে, যাতে তারা বিএনপি-জামায়াতের আদর্শিক দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে আবারও রাজনীতির মাঠে ফিরতে পারে। আওয়ামী লীগ জানে যে, যদি বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা যায়, তাহলে তারা রাজনৈতিকভাবে নিজেদের শক্তি পুনরুদ্ধার করতে পারবে। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে কৌশলগতভাবে সুবিধা নিতে চায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ, যা তাদের পুনর্বাসনের পথ খুলে দিতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতিতে মধ্যস্থতা করার জন্য প্রতিবেশী দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা তৎপর রয়েছে, যাতে আওয়ামী লীগের এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হতে পারে।

আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্টের পর পর যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো, তবে বিএনপি নিরঙ্কুশ ভোট পেয়ে সহজেই নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করতে পারতো। তবে সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির এই আশা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে পড়ছে এবং জামায়াতের অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে। আওয়ামী লীগের ধারণা, যদি আগামী দুই-তিন বছর অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকে, তবে জামায়াতের অবস্থান আরও দৃঢ় হবে এবং বিএনপি ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়বে। এই আশঙ্কা বিএনপির মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, যাতে দলটি নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে।

এছাড়া, আওয়ামী লীগ আরও একটি বার্তা পাচ্ছে, তা হলো—যদি তারা রাজনীতিতে ফেরত না আসে, তবে জামায়াত বেষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের সাথে জোট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেবে, যা তাদের নিরঙ্কুশ জয়লাভের সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। এ বিষয়ে বিএনপির ভারতপন্থী অংশকে বিভিন্ন মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে যে, জামায়াতের দিকে তাদের ঝোঁক বাড়ছে। এই পরিস্থিতির মধ্যে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান ভবিষ্যতে আরও দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

এই পরিস্থিতিতে, আওয়ামী লীগ তাদের দীর্ঘমেয়াদী সহায়তা এবং সমর্থনের মাধ্যমে বিএনপিকে একটি অসাম্প্রদায়িক শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। আওয়ামী লীগের মতে, তারা একমাত্র দল যারা বিএনপির পাশে থেকে সমর্থন দিতে পারে এবং তারাই বিএনপির জন্য ভবিষ্যতে সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারে। ফলে, বিএনপির ভারতপন্থী অংশটি আড়ালে আড়ালে আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে, যা তাদের কৌশলগত বক্তব্যেও ফুটে উঠছে।

আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপির সহায়তা না পাওয়া এবং পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন না হলে আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ সহজে পাবে না। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলেছেন, এবং এমন পরিস্থিতিতে, আওয়ামী লীগ দলের শীর্ষ নেতারা বিশ্বাস করছেন যে, যদি জাতীয় সরকার গঠন হয়, সেখানে আওয়ামী লীগ থাকবে না। এই উদ্বেগের মধ্যেই আওয়ামী লীগ বুঝতে পেরেছে, রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে বিএনপির সাথে জামায়াতের ঐক্যে ফাটল ধরানো অপরিহার্য।

এক্ষেত্রে, আওয়ামী লীগ তাদের পুরনো মিত্র ভারতকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে, যাতে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা যায়। ভারতের অবস্থানও পরিষ্কার যে, তারা মনে করে, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগই তাদের একমাত্র সোল এজেন্ট। ভারত এই আশঙ্কা করছে যে, যদি আওয়ামী লীগ পুনর্বাসন না হয়, তবে বাংলাদেশে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান আগের জায়গায় ফিরে আসবে না। এই বিষয়টি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা ভারতে অবস্থান করা তাদের সহকর্মীদের মাধ্যমে যথেষ্ট বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, এবং ভারতের কাছে তারা এও স্পষ্ট করেছেন যে, আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন না হলে ভারতের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ড. আবদুল লতিফ মাসুম নয়া দিগন্তকে বলেন, “বিগত সময়ে বিএনপি এবং জামায়াত একযোগে নির্বাচন, সরকারবিরোধী আন্দোলন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে কাজ করেছে। তবে, এটি মনে রাখতে হবে যে, দুই দলের আদর্শ আলাদা, যা তাদের মধ্যে কিছু বিভেদ সৃষ্টি করছে—এটা সত্যি। পথচলায় মতবিরোধ থাকতে পারে, তা স্বাভাবিক। তবে, একটি স্বৈরাচারী দলের পুনর্বাসনের জন্য কাউকে কাজ করতে দেখলে তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। সবাইকে এই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন, এবং শ্রীলঙ্কা তাদের সংকট সমাধানে জাতীয় সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করছে। যদি জাতীয় সরকার গঠন হয়, তবে বিএনপি-জামায়াতের বৃহত্তর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে এবং দেশ পরিচালনায় স্থিতিশীলতা আসবে। এতে, বর্তমান সমস্যা অনেকটা মিটে যাবে। তবে, দেশের স্বার্থে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই পুনর্বাসিত না হয়। এজন্য বিএনপি এবং জামায়াতকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।”

বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ইকতেদার আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, “আদর্শিকভাবে দুটি দল ভিন্ন হলেও বিএনপি-জামায়াত একটি ঐতিহাসিক জোট হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে কিছু সমস্যা হচ্ছে, এবং কিছু সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি এই ঐক্যকে ভাঙানোর চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগও চাইবে, বিএনপি-জামায়াতের ঐক্যে ফাটল ধরুক, কারণ তারা এখন রাজনীতি থেকে কিছুটা ছিটকে পড়েছে এবং এই সুযোগে তারা পুনরায় রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চায়।”

তিনি আরও বলেন, “তবে, দেশের স্বার্থে, জাতির উন্নতির জন্য সব ভেদাভেদ ও মতদ্বৈধতা ভুলে বিএনপি-জামায়াতের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা উচিত। এভাবে তাদের নিজেদের কল্যাণ হবে, পাশাপাশি দেশের মঙ্গলও হবে। অন্যথায়, আবারো বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।”

সুত্রঃ নয়া দিগন্ত

 

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

বিএনপি-জামায়াতের ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্য সক্রিয় আওয়ামী লীগ

Update Time : ০২:২৪:১৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এখন তৎপর হয়ে উঠেছে বিএনপি-জামায়াতের ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্য। ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগ দলের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে তেমন পাত্তা না দিয়ে, বরং দলটির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ শীর্ষ নেতাদের নিয়ে হাস্যরসের এবং ঠাট্টা-মশকরায় মগ্ন ছিল। তবে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন স্বৈরসরকারের পতনের পর, দলটির রাজনৈতিক শক্তি প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে। ঠিক এমন এক পরিস্থিতিতে, বিএনপির সাথে তার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করার জন্য আওয়ামী লীগ নতুন পরিকল্পনা নিয়েছে।

এক্ষেত্রে, যারা বিদেশে পালিয়ে গেছেন বা আত্মগোপনে আছেন, তারা বিএনপির বিভিন্ন কার্যক্রমের প্রতি আড়ালেই সমর্থন জানাচ্ছেন এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে, বিএনপির সাথে কৌশলগত সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করছেন, এমন খবর এসেছে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে। এটি আওয়ামী লীগের একটি সুপরিকল্পিত চেষ্টা, যাতে তারা বিএনপি-জামায়াত জোটের মধ্যে ভাঙন ধরিয়ে রাজনৈতিক মঞ্চে নিজেদের পুনরুদ্ধার করতে পারে।

যদিও বিএনপি এবং জামায়াতের আদর্শিক অবস্থান প্রায় বিপরীত, ১৯৯৯ সালে চার দলীয় জোট গঠন করে ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় লাভের মাধ্যমে তারা সরকার গঠন করেছিল। তারপর থেকে ১/১১ পরিস্থিতি এবং পরবর্তী বছরগুলিতে, বিশেষত গত ৫ আগস্টের আগে পর্যন্ত, বিএনপি-জামায়াত সরকারবিরোধী আন্দোলনে একযোগে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। সে সময় থেকে আওয়ামী লীগ জামায়াত-বিএনপি ঐক্য ভাঙানোর জন্য চেষ্টা করে আসছিল। যদিও প্রথম দিকে তারা সফল হতে পারেনি, কিন্তু ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, সেই ভাঙনের ষড়যন্ত্র আবারো পুনরায় শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এখন আওয়ামী লীগ একটি নতুন কৌশল গ্রহণ করেছে, যাতে বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হয় এবং নিজেদের রাজনৈতিক পুঁজি পুনরুদ্ধার করা যায়।

গত ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যরা সবাই আত্মগোপনে চলে যান। এমনকি আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাও এই অবস্থায় ছিলেন, এবং দলের বেশির ভাগ নেতারা এখন প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। সেই সময়, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়।

সরকার গঠনের পর থেকেই বিএনপি তাদের নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা নিয়ে চাপ সৃষ্টি করছে, এবং জামায়াত ইসলামী সরকারকে সংস্কারের জন্য কিছু সময় দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। এর ফলস্বরূপ, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে মনমালিন্য এবং একে অপরকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ১০০ দিনের পর, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হচ্ছে, যদিও কখনো কখনো তাদের সম্পর্কের মধ্যে ওঠানামা হচ্ছে। অতীতে, বিএনপি ও জামায়াত একত্রিত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, তবে বর্তমানে তারা নিজেদের আদর্শ প্রচারের জন্য বেশি মনোযোগী হয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে, আওয়ামী লীগ একটি সুযোগ খুঁজছে, যাতে তারা বিএনপি-জামায়াতের আদর্শিক দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে আবারও রাজনীতির মাঠে ফিরতে পারে। আওয়ামী লীগ জানে যে, যদি বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা যায়, তাহলে তারা রাজনৈতিকভাবে নিজেদের শক্তি পুনরুদ্ধার করতে পারবে। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে কৌশলগতভাবে সুবিধা নিতে চায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ, যা তাদের পুনর্বাসনের পথ খুলে দিতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতিতে মধ্যস্থতা করার জন্য প্রতিবেশী দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা তৎপর রয়েছে, যাতে আওয়ামী লীগের এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হতে পারে।

আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্টের পর পর যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো, তবে বিএনপি নিরঙ্কুশ ভোট পেয়ে সহজেই নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করতে পারতো। তবে সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির এই আশা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে পড়ছে এবং জামায়াতের অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে। আওয়ামী লীগের ধারণা, যদি আগামী দুই-তিন বছর অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকে, তবে জামায়াতের অবস্থান আরও দৃঢ় হবে এবং বিএনপি ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়বে। এই আশঙ্কা বিএনপির মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, যাতে দলটি নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে।

এছাড়া, আওয়ামী লীগ আরও একটি বার্তা পাচ্ছে, তা হলো—যদি তারা রাজনীতিতে ফেরত না আসে, তবে জামায়াত বেষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের সাথে জোট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেবে, যা তাদের নিরঙ্কুশ জয়লাভের সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। এ বিষয়ে বিএনপির ভারতপন্থী অংশকে বিভিন্ন মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে যে, জামায়াতের দিকে তাদের ঝোঁক বাড়ছে। এই পরিস্থিতির মধ্যে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান ভবিষ্যতে আরও দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

এই পরিস্থিতিতে, আওয়ামী লীগ তাদের দীর্ঘমেয়াদী সহায়তা এবং সমর্থনের মাধ্যমে বিএনপিকে একটি অসাম্প্রদায়িক শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। আওয়ামী লীগের মতে, তারা একমাত্র দল যারা বিএনপির পাশে থেকে সমর্থন দিতে পারে এবং তারাই বিএনপির জন্য ভবিষ্যতে সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারে। ফলে, বিএনপির ভারতপন্থী অংশটি আড়ালে আড়ালে আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে, যা তাদের কৌশলগত বক্তব্যেও ফুটে উঠছে।

আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপির সহায়তা না পাওয়া এবং পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন না হলে আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ সহজে পাবে না। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলেছেন, এবং এমন পরিস্থিতিতে, আওয়ামী লীগ দলের শীর্ষ নেতারা বিশ্বাস করছেন যে, যদি জাতীয় সরকার গঠন হয়, সেখানে আওয়ামী লীগ থাকবে না। এই উদ্বেগের মধ্যেই আওয়ামী লীগ বুঝতে পেরেছে, রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে বিএনপির সাথে জামায়াতের ঐক্যে ফাটল ধরানো অপরিহার্য।

এক্ষেত্রে, আওয়ামী লীগ তাদের পুরনো মিত্র ভারতকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে, যাতে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা যায়। ভারতের অবস্থানও পরিষ্কার যে, তারা মনে করে, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগই তাদের একমাত্র সোল এজেন্ট। ভারত এই আশঙ্কা করছে যে, যদি আওয়ামী লীগ পুনর্বাসন না হয়, তবে বাংলাদেশে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান আগের জায়গায় ফিরে আসবে না। এই বিষয়টি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা ভারতে অবস্থান করা তাদের সহকর্মীদের মাধ্যমে যথেষ্ট বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, এবং ভারতের কাছে তারা এও স্পষ্ট করেছেন যে, আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন না হলে ভারতের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ড. আবদুল লতিফ মাসুম নয়া দিগন্তকে বলেন, “বিগত সময়ে বিএনপি এবং জামায়াত একযোগে নির্বাচন, সরকারবিরোধী আন্দোলন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে কাজ করেছে। তবে, এটি মনে রাখতে হবে যে, দুই দলের আদর্শ আলাদা, যা তাদের মধ্যে কিছু বিভেদ সৃষ্টি করছে—এটা সত্যি। পথচলায় মতবিরোধ থাকতে পারে, তা স্বাভাবিক। তবে, একটি স্বৈরাচারী দলের পুনর্বাসনের জন্য কাউকে কাজ করতে দেখলে তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। সবাইকে এই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন, এবং শ্রীলঙ্কা তাদের সংকট সমাধানে জাতীয় সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করছে। যদি জাতীয় সরকার গঠন হয়, তবে বিএনপি-জামায়াতের বৃহত্তর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে এবং দেশ পরিচালনায় স্থিতিশীলতা আসবে। এতে, বর্তমান সমস্যা অনেকটা মিটে যাবে। তবে, দেশের স্বার্থে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই পুনর্বাসিত না হয়। এজন্য বিএনপি এবং জামায়াতকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।”

বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ইকতেদার আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, “আদর্শিকভাবে দুটি দল ভিন্ন হলেও বিএনপি-জামায়াত একটি ঐতিহাসিক জোট হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে কিছু সমস্যা হচ্ছে, এবং কিছু সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি এই ঐক্যকে ভাঙানোর চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগও চাইবে, বিএনপি-জামায়াতের ঐক্যে ফাটল ধরুক, কারণ তারা এখন রাজনীতি থেকে কিছুটা ছিটকে পড়েছে এবং এই সুযোগে তারা পুনরায় রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চায়।”

তিনি আরও বলেন, “তবে, দেশের স্বার্থে, জাতির উন্নতির জন্য সব ভেদাভেদ ও মতদ্বৈধতা ভুলে বিএনপি-জামায়াতের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা উচিত। এভাবে তাদের নিজেদের কল্যাণ হবে, পাশাপাশি দেশের মঙ্গলও হবে। অন্যথায়, আবারো বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।”

সুত্রঃ নয়া দিগন্ত