সময়: বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

খেলাপি ঋণ পৌনে ৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়াল

ডিজিটাল ডেস্ক
  • Update Time : ০৪:৪৯:২২ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪
  • / ৮৬ Time View

Bangladesh bank

সুশাসনের অভাব, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ক্রমশ খেলাপি ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এই খাতের খেলাপি ঋণের হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, দেশের খেলাপি ঋণ প্রথমবারের মতো ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকার সীমা অতিক্রম করেছে।

এই পরিসংখ্যান গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে ঘটে যাওয়া অসংখ্য কেলেঙ্কারি ও অনিয়মের প্রমাণ হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায়, যা মোট বিতরণ করা ঋণের (১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২১ কোটি টাকা) ১৬.৯৩ শতাংশ। এটি গত ১৬ বছরের মধ্যে বিতরণকৃত ঋণ এবং খেলাপি ঋণের সর্বোচ্চ অনুপাত।

তথ্য আরও বলছে, ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপের ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ পেতে শুরু করেছে, যা এতদিন স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজিতে গোপন রাখা হয়েছিল। তাঁদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে, কারণ বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে প্রণীত নীতিমালাগুলো এখনো বহাল রয়েছে। এই নীতিমালার সুযোগ নিয়ে একটি শ্রেণি দীর্ঘদিন ধরে লাভবান হয়েছে।

এছাড়া অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে যেসব ঋণ নিয়মিত দেখানো হয়েছে, সেগুলোর বিশেষ সুবিধা বাতিল করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনের সমাপ্তি ঘটে। গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। তাঁর পদত্যাগের পর থেকেই ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত অবস্থা সামনে আসতে শুরু করেছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার সময় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ব্যাংকিং খাতে একের পর এক অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটতে থাকে। এর ফলে খেলাপি ঋণ ক্রমাগত বাড়তে থাকে, যা এখন এক ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে।

সেপ্টেম্বর মাস শেষে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ১১১ কোটি টাকায়, যা তাদের মোট বিতরণকৃত ঋণের ৪০.৩৫ শতাংশ। অন্যদিকে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ পৌঁছেছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮০৬ কোটি টাকায়, যা তাদের বিতরণকৃত ঋণের ১১.৮৮ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা বিতরণকৃত ঋণের ৪.৯৯ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ হয়েছে ৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অক্টোবর-ডিসেম্বর ত্রৈমাসিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে। তাঁদের ধারণা, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো ভুয়া দলিলপত্র ও নানা অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়েছিল। সরকার পরিবর্তনের পর সেই ঋণগুলোর একটি বড় অংশ খেলাপিতে পরিণত হবে।

বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, এস আলম গ্রুপ এবং তাদের সহযোগীরা ছয়টি ব্যাংক থেকে ৯৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে। এই ঋণগুলোর একটি বড় অংশ ইতিমধ্যেই মন্দ ঋণে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এটি ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের সংকটকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে অনেক ঋণগ্রহীতা তাদের ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন। তাদের এই প্রবণতা দেশের ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণের বোঝা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।

বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের একটি বড় অংশ অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে, যা এসব ঋণ আদায়কে অত্যন্ত কঠিন করে তুলছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল আগের সরকার। সে অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল। তবে বাস্তবতা বলছে, এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা বর্তমান পরিস্থিতিতে চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

খেলাপি ঋণ পৌনে ৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়াল

Update Time : ০৪:৪৯:২২ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪

সুশাসনের অভাব, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ক্রমশ খেলাপি ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এই খাতের খেলাপি ঋণের হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, দেশের খেলাপি ঋণ প্রথমবারের মতো ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকার সীমা অতিক্রম করেছে।

এই পরিসংখ্যান গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে ঘটে যাওয়া অসংখ্য কেলেঙ্কারি ও অনিয়মের প্রমাণ হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায়, যা মোট বিতরণ করা ঋণের (১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২১ কোটি টাকা) ১৬.৯৩ শতাংশ। এটি গত ১৬ বছরের মধ্যে বিতরণকৃত ঋণ এবং খেলাপি ঋণের সর্বোচ্চ অনুপাত।

তথ্য আরও বলছে, ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপের ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ পেতে শুরু করেছে, যা এতদিন স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজিতে গোপন রাখা হয়েছিল। তাঁদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে, কারণ বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে প্রণীত নীতিমালাগুলো এখনো বহাল রয়েছে। এই নীতিমালার সুযোগ নিয়ে একটি শ্রেণি দীর্ঘদিন ধরে লাভবান হয়েছে।

এছাড়া অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে যেসব ঋণ নিয়মিত দেখানো হয়েছে, সেগুলোর বিশেষ সুবিধা বাতিল করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনের সমাপ্তি ঘটে। গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। তাঁর পদত্যাগের পর থেকেই ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত অবস্থা সামনে আসতে শুরু করেছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার সময় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ব্যাংকিং খাতে একের পর এক অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটতে থাকে। এর ফলে খেলাপি ঋণ ক্রমাগত বাড়তে থাকে, যা এখন এক ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে।

সেপ্টেম্বর মাস শেষে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ১১১ কোটি টাকায়, যা তাদের মোট বিতরণকৃত ঋণের ৪০.৩৫ শতাংশ। অন্যদিকে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ পৌঁছেছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮০৬ কোটি টাকায়, যা তাদের বিতরণকৃত ঋণের ১১.৮৮ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা বিতরণকৃত ঋণের ৪.৯৯ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ হয়েছে ৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অক্টোবর-ডিসেম্বর ত্রৈমাসিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে। তাঁদের ধারণা, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো ভুয়া দলিলপত্র ও নানা অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়েছিল। সরকার পরিবর্তনের পর সেই ঋণগুলোর একটি বড় অংশ খেলাপিতে পরিণত হবে।

বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, এস আলম গ্রুপ এবং তাদের সহযোগীরা ছয়টি ব্যাংক থেকে ৯৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে। এই ঋণগুলোর একটি বড় অংশ ইতিমধ্যেই মন্দ ঋণে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এটি ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের সংকটকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে অনেক ঋণগ্রহীতা তাদের ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন। তাদের এই প্রবণতা দেশের ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণের বোঝা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।

বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের একটি বড় অংশ অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে, যা এসব ঋণ আদায়কে অত্যন্ত কঠিন করে তুলছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল আগের সরকার। সে অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল। তবে বাস্তবতা বলছে, এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা বর্তমান পরিস্থিতিতে চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে।