দ্বীন মুমিনের জীবনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত

- Update Time : ০৮:২১:৩৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪
- / ১০০ Time View
ইসলামিক দর্শনে মানবজীবনের আসল লক্ষ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা এবং তাঁর ইবাদতে নিজেকে উৎসর্গ করা। এই নিবন্ধে আমরা কুরআন ও হাদিসের আলোকে দেখব কেন একজন মুমিনের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য দ্বীন হওয়া উচিত
১. আল্লাহর ইবাদতই মানব জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য
আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন:
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
“আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি কেবল এজন্য যে, তারা আমার ইবাদত করবে।”
— (সুরা আয-যারিয়াত, ৫১:৫৬)
এই আয়াতে আল্লাহ্ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, মানবজাতি ও জিন জাতির সৃষ্টি করার মূল উদ্দেশ্য হলো তাঁর ইবাদত করা। এখানে বোঝানো হয়েছে, একজন মুমিনের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত আল্লাহর ইবাদতে আত্মনিবেদিত হওয়া এবং সকল কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।
হাদিসে ইবাদতের গুরুত্ব
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতকে বিভিন্ন হাদিসে আল্লাহর ইবাদতের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। একটি প্রসিদ্ধ হাদিসে তিনি বলেন:
“إِنَّ اللَّهَ قَالَ: يَا ابْنَ آدَمَ، تَفَرَّغْ لِعِبَادَتِي أَمْلَأْ قَلْبَكَ غِنًى، وَأَسُدَّ فَقْرَكَ، وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ مَلَأْتُ يَدَيْكَ شُغْلًا، وَلَمْ أَسُدَّ فَقْرَكَ”
“আল্লাহ বলেছেন: হে আদম সন্তান! তুমি আমার ইবাদতের জন্য নিজেকে মুক্ত রাখো; আমি তোমার অন্তরকে তৃপ্তি দিয়ে পূর্ণ করব এবং তোমার দারিদ্রতা দূর করব। আর যদি তুমি তা না করো, তবে আমি তোমার হাতে কাজের ভার দেব, কিন্তু তোমার অভাব পূরণ করব না।”
— (সুনান ইবনে মাজাহ: ৪১০৭)
এই হাদিসে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, ইবাদতের মাধ্যমে অন্তরে প্রশান্তি ও আত্মতৃপ্তি আসে এবং আল্লাহ তাদের দারিদ্রতা দূর করেন। অন্যদিকে, যারা ইবাদতে উদাসীন থাকে তাদের জীবনে বিভিন্ন রকমের ব্যস্ততা আসে, কিন্তু আল্লাহ তাদের অভাব পূরণ করেন না।
ইবাদতের মাধ্যমে আখিরাতের সফলতা
আরেকটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“مَنْ كَانَتِ الْآخِرَةُ هَمَّهُ، جَعَلَ اللَّهُ غِنَاهُ فِي قَلْبِهِ، وَجَمَعَ لَهُ شَمْلَهُ، وَأَتَتْهُ الدُّنْيَا وَهِيَ رَاغِمَةٌ، وَمَنْ كَانَتِ الدُّنْيَا هَمَّهُ، جَعَلَ اللَّهُ فَقْرَهُ بَيْنَ عَيْنَيْهِ، وَفَرَّقَ عَلَيْهِ شَمْلَهُ، وَلَمْ يَأْتِهِ مِنَ الدُّنْيَا إِلَّا مَا قُدِّرَ لَهُ”
“যে ব্যক্তির আখিরাতের চিন্তা প্রধান হয়, আল্লাহ তার অন্তরে তৃপ্তি দেন, তার দুশ্চিন্তা দূর করেন এবং দুনিয়া তার কাছে বিনীত হয়ে আসে। কিন্তু যে ব্যক্তির চিন্তা দুনিয়ার জন্য, আল্লাহ তার অভাবকে সামনে রেখে দেন এবং তার জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেন, আর দুনিয়া থেকে সে কেবল তা-ই পায় যা আল্লাহ তার জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন।”
— (তিরমিজি: ২৪৬৫)
এই হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের শেখাচ্ছেন যে, যারা আখিরাতকে তাদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করে তাদের জীবন শান্তিময় হয় এবং আল্লাহ দুনিয়া তাদের কাছে এনে দেন। কিন্তু যারা দুনিয়াকে মূল উদ্দেশ্য হিসেবে রাখে, তারা অন্তরে সবসময় অভাববোধ অনুভব করে এবং জীবন কষ্টময় হয়ে যায়।
২. আল্লাহর পথে জীবনযাপনই প্রকৃত সফলতা
আল্লাহ্ তাআলা বলেন:
وَمَن يُطِعِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَخْشَ ٱللَّهَ وَيَتَّقْهِۦ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْفَآئِزُونَ
“যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে এবং আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করে, তারাই হলো প্রকৃত সফলকাম।”
— (সুরা নূর, ২৪:৫২)
এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলা স্পষ্ট করেছেন যে, প্রকৃত সফলতা অর্জনের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য এবং আল্লাহর প্রতি ভয় ও তাকওয়ার মনোভাব থাকা প্রয়োজন। পার্থিব জীবনের সফলতা যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন, একজন মুমিনের কাছে আখিরাতের সফলতা সর্বোচ্চ গুরুত্ব রাখে। এই সফলতা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং রাসূলের অনুসরণের মাধ্যমে সম্ভব হয়, যা মুমিনের জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য হওয়া উচিত।
হাদিসে আল্লাহর পথে জীবনযাপনের গুরুত্ব
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“كُلُّ أُمَّتِي يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ إِلَّا مَنْ أَبَى، قِيلَ: وَمَنْ يَأْبَى؟ قَالَ: مَنْ أَطَاعَنِي دَخَلَ الْجَنَّةَ، وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ أَبَى”
“আমার উম্মতের সকলেই জান্নাতে প্রবেশ করবে, শুধু সে ব্যক্তি ব্যতীত যে অস্বীকার করে।” সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন, “কে অস্বীকার করে, হে আল্লাহর রাসূল?” তিনি বললেন, “যে আমার আনুগত্য করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার অবাধ্য হবে সে অস্বীকারকারী।”
— (বুখারি: ৭২৮০)
এই হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বুঝিয়েছেন যে, যারা রাসূলের আনুগত্য করে এবং তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করে, তারাই জান্নাত লাভ করবে। রাসূলের অনুসরণ করতে হলে আল্লাহর দেয়া বিধান মেনে চলা এবং আল্লাহর পথে সঠিক জীবনযাপন করা অপরিহার্য। এটি প্রকৃত সফলতা এবং পরকালীন জীবনের সাফল্যের পথ।
আল্লাহর পথে জীবনযাপন মুমিনের জন্য প্রশান্তির উৎস
আল্লাহ বলেন:
إِنَّ ٱلَّذِينَ قَالُوا۟ رَبُّنَا ٱللَّهُ ثُمَّ ٱسْتَقَـٰمُوا۟ تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ ٱلْمَلَـٰٓئِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا۟ وَلَا تَحْزَنُوا۟ وَأَبْشِرُوا۟ بِٱلْجَنَّةِ ٱلَّتِى كُنتُمْ تُوعَدُونَ
“নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, তারপর তাতে অটল থাকে, তাদের কাছে ফেরেশতারা অবতীর্ণ হয় এবং বলে, তোমরা ভয় করো না, দুঃখ করো না, তোমরা সেই জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর যা তোমাদের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।”
— (সুরা ফুস্সিলাত, ৪১:৩০
আয়াতে বলা হয়েছে যে, যারা আল্লাহকে তাদের রব হিসেবে মানে এবং এই বিশ্বাসে স্থির থাকে, তাদের জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা নেমে আসে। পরকালে জান্নাতের সুসংবাদও তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এটাই প্রকৃত সফলতা এবং মুমিনের জীবনের আসল উদ্দেশ্য।
সঠিক পথে জীবনযাপন এবং আল্লাহর কাছে পুরস্কার লাভ
মুমিনের জন্য আল্লাহর পথে সঠিক জীবনযাপনই প্রকৃত শান্তি ও সফলতার উৎস। জীবনকে আল্লাহর পথে পরিচালিত করে তাঁর কাছে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমেই প্রকৃত সফলতা অর্জন সম্ভব। আল্লাহর আনুগত্যে জীবন কাটানো এবং রাসূলের দেখানো পথে চলা একজন মুমিনের জীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
৩. রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশনা: দুনিয়ার চেয়ে আখিরাতের গুরুত্ব
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
الدُّنْيَا سِجْنُ الْمُؤْمِنِ وَجَنَّةُ الْكَافِرِ
“দুনিয়া হলো মুমিনের জন্য কারাগার এবং কাফিরের জন্য জান্নাত।”
— (সহিহ মুসলিম: ৭৪১৭)
এই হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) দুনিয়ার প্রকৃত অর্থকে বুঝিয়েছেন। একজন মুমিনের জন্য এই পৃথিবী পরীক্ষার স্থান; এটি তাদের জন্য চিরস্থায়ী বাসভূমি নয়। দুনিয়ার সকল আরাম-আয়েশ এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের থেকে মুমিনের জীবনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আখিরাতের সফলতা অর্জন করা। এই জীবন মুমিনের জন্য এক কারাগারের মতো, যেখানে তাকে শৃঙ্খলিতভাবে আল্লাহর বিধান অনুসারে জীবনযাপন করতে হবে, এবং আখিরাতের সফলতাই তার প্রকৃত মুক্তি।
দুনিয়ার জীবনের সীমাবদ্ধতা এবং আখিরাতের শাশ্বত জীবন
আল্লাহ বলেন:
وَمَا ٱلْحَيَوٰةُ ٱلدُّنْيَآ إِلَّا مَتَـٰعُ ٱلْغُرُورِ
“এই পার্থিব জীবন তো এক প্রতারণামূলক ভোগের উপকরণ ছাড়া আর কিছুই নয়।”
— (সুরা আল-ইমরান, ৩:১৮৫)
এই আয়াতটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দুনিয়ার জীবন আসলে এক মায়া, যেখানে মানুষকে ক্ষণিকের ভোগ-বিলাসে আকৃষ্ট করা হয়। একজন মুমিনের দায়িত্ব হলো এই সাময়িক জীবনের আনন্দকে পিছনে রেখে আখিরাতের জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া, যা চিরস্থায়ী এবং যার সাথে তুলনায় দুনিয়ার জীবন অত্যন্ত তুচ্ছ।
আখিরাতকে লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার গুরুত্ব
হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“كُنْ فِي الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ”
“তুমি এই দুনিয়াতে যেন অপরিচিত বা পথিকের মতো জীবনযাপন করো।”
— (সহিহ বুখারি: ৬৪১৬)
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এই হাদিসে বলা হয়েছে যে, এই পৃথিবীতে যেন মুমিন নিজেকে একজন পথিক বা সাময়িক অবস্থানকারী মনে করে। একজন পথিকের মতো এই পৃথিবীতে অল্প সময়ের জন্য অবস্থান করে আখিরাতের যাত্রা শুরু করাই মুমিনের আসল লক্ষ্য। দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে, আখিরাতকে মুমিনের জীবনের মূল লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা উচিত, কারণ এটাই স্থায়ী জীবন।আখিরাতের দিকে মনোযোগী থাকা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এই পৃথিবীতে জীবন যাপন করাই একজন মুমিনের প্রকৃত লক্ষ্য, যা তাকে চিরস্থায়ী শান্তি ও জান্নাতের দিকে নিয়ে যাবে।
৪. সমস্ত কাজই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হওয়া উচিত
আল্লাহ্ তাআলা বলেন:
وَٱصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ فَإِنَّكَ بِأَعْيُنِنَا
“তোমার প্রতিপালকের সন্তুষ্টির জন্য ধৈর্য ধারণ কর।”
— (সুরা মুদ্দাসসির, ৭৪:৭)
এই আয়াতে আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন যে, একজন মুমিনের উচিত জীবনের প্রতিটি কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ধৈর্য ধারণ করা। এটি শুধু ইবাদত বা উপাসনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ব্যক্তিগত, সামাজিক, এবং পেশাগত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কাজ করা উচিত। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি মুমিনের জীবনে সঠিক পথের নির্দেশনা দেয় এবং তার কাজকর্ম দ্বীনের আলোকে পরিচালিত হয়।
হাদিসে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাজ করার গুরুত্ব
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
“إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى”
“প্রত্যেক কাজই নিয়তের উপর নির্ভর করে, এবং প্রতিটি ব্যক্তির জন্য রয়েছে তার নিয়তের প্রতিদান।”
— (সহিহ বুখারি: ১)
এই হাদিসটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে, প্রতিটি কাজের মূলে নিয়ত থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি মুমিন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে কাজ করে, তবে তা ইবাদতের মর্যাদা লাভ করে। এমনকি দুনিয়াবী কাজও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করলে তা মুমিনের জন্য সওয়াবের কাজ হয়ে যায়। তাই মুমিনের উচিত নিয়তকে বিশুদ্ধ রাখা এবং জীবনের প্রতিটি কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টিকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা।
জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা
আল্লাহ বলেন:
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
“বলুন, নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ সবই আল্লাহর জন্য, যিনি সকল সৃষ্টির প্রতিপালক।”
— (সুরা আল-আনআম, ৬:১৬২)
এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, জীবনের প্রতিটি দিক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত হওয়া উচিত। নামাজ, কুরবানি, জীবন, এবং মৃত্যুর প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদন মুমিনের জীবনের প্রধান লক্ষ্য। এটি একজন মুমিনের জন্য এক ধরনের সম্পূর্ণ আত্মনিবেদনের শিক্ষা দেয়, যা আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে তাকে পরিচালিত করে।
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা একজন মুমিনের জীবনের পরিপূর্ণতা
একজন মুমিনের জন্য সব কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে কাজ করাই তার দ্বীনের পথে জীবনযাপনকে পূর্ণতা দেয়। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে একজন মুমিন তার দুনিয়াবী ও আখিরাতের জীবনে প্রকৃত সফলতা অর্জন করতে পারে।
৫. মুমিনদের জন্য দ্বীন পালন বাধ্যতামূলক
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ
“তোমরা সকলেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তার অধীনস্থদের বিষয়ে দায়িত্বশীল।”
— (সহিহ বুখারি: ৭১৩৮)
এই হাদিসের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সা.) বোঝাতে চেয়েছেন যে, প্রতিটি মুমিনের উপর দায়িত্ব অর্পিত আছে এবং সেই দায়িত্বের ব্যাপারে আল্লাহর সামনে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। একজন মুমিন শুধু নিজের জীবনের জন্যই নয়, বরং তার পরিবারের, সমাজের এবং উম্মতের প্রতিও দায়িত্বশীল। ইসলামের মূল শিক্ষা হলো দায়িত্ব পালন, যা একজন মুমিনকে তার দ্বীন অনুযায়ী জীবনযাপন করার জন্য বাধ্য করে।
দ্বীন পালন এবং সামাজিক দায়িত্ব
আল্লাহ্ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
“হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবারকে আগুন থেকে রক্ষা করো।”
— (সুরা তাহরিম, ৬৬:৬)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, একজন মুমিনের দায়িত্ব শুধু তার ব্যক্তিগত ইবাদত সীমাবদ্ধ নয়, বরং তার পরিবার ও নিকটজনের দ্বীনদারি এবং সঠিক পথে থাকার ব্যাপারেও সে দায়বদ্ধ। আল্লাহর আদেশ মেনে নিজের ও পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন একজন মুমিনের উপর বাধ্যতামূলক এবং এর মাধ্যমেই সে দ্বীনের প্রতি পূর্ণতা লাভ করতে পারে।
মুমিনের উপর দ্বীনকে জীবনের কেন্দ্রবিন্দু বানানোর গুরুত্ব
রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন:
مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيمَانِ
“তোমাদের মধ্যে যে কেউ মন্দ কাজ দেখবে, সে যেন তা হাত দিয়ে পরিবর্তন করে। যদি তাতে সক্ষম না হয় তবে মুখ দিয়ে, আর তাতেও সক্ষম না হলে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করবে, এবং এটাই সর্বনিম্ন ইমানের স্তর।”
— (সহিহ মুসলিম: ৪৯)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, মুমিনের জন্য অন্যায় ও পাপ থেকে নিজেকে বিরত রাখা এবং সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। দ্বীন পালন শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং সমাজের অন্যায় দূর করাও একজন মুমিনের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং মুমিনের জন্য দ্বীন পালন ও সমাজের কল্যাণে কাজ করা বাধ্যতামূলক, এবং এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই সে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হয়।
আল্লাহর সামনে দায়িত্বশীল হিসেবে হাজির হওয়ার প্রস্তুতি
মুমিনের জীবনের প্রতিটি কাজ, সিদ্ধান্ত, ও আচরণ আল্লাহর সামনে জবাবদিহিতার প্রস্তুতি হিসেবে হওয়া উচিত। দ্বীন পালনকে জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গ্রহণের মাধ্যমে একজন মুমিন জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই আল্লাহর প্রতি অনুগত হতে পারে।
শেষকথা, কুরআন ও হাদিসে বারংবার গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনই মুমিনের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। দুনিয়ার সাময়িক সফলতার দিকে না ছুটে মুমিনদের আখিরাতের সফলতার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পথ অনুসরণ করা প্রয়োজন। আল্লাহর ইবাদত, আখিরাতের সফলতা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য জীবনযাপনই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত, যা একজন মুমিনের জীবনকে পূর্ণতা দান করে।
Please Share This Post in Your Social Media

দ্বীন মুমিনের জীবনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত

ইসলামিক দর্শনে মানবজীবনের আসল লক্ষ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা এবং তাঁর ইবাদতে নিজেকে উৎসর্গ করা। এই নিবন্ধে আমরা কুরআন ও হাদিসের আলোকে দেখব কেন একজন মুমিনের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য দ্বীন হওয়া উচিত
১. আল্লাহর ইবাদতই মানব জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য
আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন:
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
“আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি কেবল এজন্য যে, তারা আমার ইবাদত করবে।”
— (সুরা আয-যারিয়াত, ৫১:৫৬)
এই আয়াতে আল্লাহ্ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, মানবজাতি ও জিন জাতির সৃষ্টি করার মূল উদ্দেশ্য হলো তাঁর ইবাদত করা। এখানে বোঝানো হয়েছে, একজন মুমিনের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত আল্লাহর ইবাদতে আত্মনিবেদিত হওয়া এবং সকল কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।
হাদিসে ইবাদতের গুরুত্ব
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতকে বিভিন্ন হাদিসে আল্লাহর ইবাদতের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। একটি প্রসিদ্ধ হাদিসে তিনি বলেন:
“إِنَّ اللَّهَ قَالَ: يَا ابْنَ آدَمَ، تَفَرَّغْ لِعِبَادَتِي أَمْلَأْ قَلْبَكَ غِنًى، وَأَسُدَّ فَقْرَكَ، وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ مَلَأْتُ يَدَيْكَ شُغْلًا، وَلَمْ أَسُدَّ فَقْرَكَ”
“আল্লাহ বলেছেন: হে আদম সন্তান! তুমি আমার ইবাদতের জন্য নিজেকে মুক্ত রাখো; আমি তোমার অন্তরকে তৃপ্তি দিয়ে পূর্ণ করব এবং তোমার দারিদ্রতা দূর করব। আর যদি তুমি তা না করো, তবে আমি তোমার হাতে কাজের ভার দেব, কিন্তু তোমার অভাব পূরণ করব না।”
— (সুনান ইবনে মাজাহ: ৪১০৭)
এই হাদিসে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, ইবাদতের মাধ্যমে অন্তরে প্রশান্তি ও আত্মতৃপ্তি আসে এবং আল্লাহ তাদের দারিদ্রতা দূর করেন। অন্যদিকে, যারা ইবাদতে উদাসীন থাকে তাদের জীবনে বিভিন্ন রকমের ব্যস্ততা আসে, কিন্তু আল্লাহ তাদের অভাব পূরণ করেন না।
ইবাদতের মাধ্যমে আখিরাতের সফলতা
আরেকটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“مَنْ كَانَتِ الْآخِرَةُ هَمَّهُ، جَعَلَ اللَّهُ غِنَاهُ فِي قَلْبِهِ، وَجَمَعَ لَهُ شَمْلَهُ، وَأَتَتْهُ الدُّنْيَا وَهِيَ رَاغِمَةٌ، وَمَنْ كَانَتِ الدُّنْيَا هَمَّهُ، جَعَلَ اللَّهُ فَقْرَهُ بَيْنَ عَيْنَيْهِ، وَفَرَّقَ عَلَيْهِ شَمْلَهُ، وَلَمْ يَأْتِهِ مِنَ الدُّنْيَا إِلَّا مَا قُدِّرَ لَهُ”
“যে ব্যক্তির আখিরাতের চিন্তা প্রধান হয়, আল্লাহ তার অন্তরে তৃপ্তি দেন, তার দুশ্চিন্তা দূর করেন এবং দুনিয়া তার কাছে বিনীত হয়ে আসে। কিন্তু যে ব্যক্তির চিন্তা দুনিয়ার জন্য, আল্লাহ তার অভাবকে সামনে রেখে দেন এবং তার জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেন, আর দুনিয়া থেকে সে কেবল তা-ই পায় যা আল্লাহ তার জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন।”
— (তিরমিজি: ২৪৬৫)
এই হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের শেখাচ্ছেন যে, যারা আখিরাতকে তাদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করে তাদের জীবন শান্তিময় হয় এবং আল্লাহ দুনিয়া তাদের কাছে এনে দেন। কিন্তু যারা দুনিয়াকে মূল উদ্দেশ্য হিসেবে রাখে, তারা অন্তরে সবসময় অভাববোধ অনুভব করে এবং জীবন কষ্টময় হয়ে যায়।
২. আল্লাহর পথে জীবনযাপনই প্রকৃত সফলতা
আল্লাহ্ তাআলা বলেন:
وَمَن يُطِعِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَخْشَ ٱللَّهَ وَيَتَّقْهِۦ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْفَآئِزُونَ
“যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে এবং আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করে, তারাই হলো প্রকৃত সফলকাম।”
— (সুরা নূর, ২৪:৫২)
এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলা স্পষ্ট করেছেন যে, প্রকৃত সফলতা অর্জনের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য এবং আল্লাহর প্রতি ভয় ও তাকওয়ার মনোভাব থাকা প্রয়োজন। পার্থিব জীবনের সফলতা যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন, একজন মুমিনের কাছে আখিরাতের সফলতা সর্বোচ্চ গুরুত্ব রাখে। এই সফলতা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং রাসূলের অনুসরণের মাধ্যমে সম্ভব হয়, যা মুমিনের জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য হওয়া উচিত।
হাদিসে আল্লাহর পথে জীবনযাপনের গুরুত্ব
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“كُلُّ أُمَّتِي يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ إِلَّا مَنْ أَبَى، قِيلَ: وَمَنْ يَأْبَى؟ قَالَ: مَنْ أَطَاعَنِي دَخَلَ الْجَنَّةَ، وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ أَبَى”
“আমার উম্মতের সকলেই জান্নাতে প্রবেশ করবে, শুধু সে ব্যক্তি ব্যতীত যে অস্বীকার করে।” সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন, “কে অস্বীকার করে, হে আল্লাহর রাসূল?” তিনি বললেন, “যে আমার আনুগত্য করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার অবাধ্য হবে সে অস্বীকারকারী।”
— (বুখারি: ৭২৮০)
এই হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বুঝিয়েছেন যে, যারা রাসূলের আনুগত্য করে এবং তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করে, তারাই জান্নাত লাভ করবে। রাসূলের অনুসরণ করতে হলে আল্লাহর দেয়া বিধান মেনে চলা এবং আল্লাহর পথে সঠিক জীবনযাপন করা অপরিহার্য। এটি প্রকৃত সফলতা এবং পরকালীন জীবনের সাফল্যের পথ।
আল্লাহর পথে জীবনযাপন মুমিনের জন্য প্রশান্তির উৎস
আল্লাহ বলেন:
إِنَّ ٱلَّذِينَ قَالُوا۟ رَبُّنَا ٱللَّهُ ثُمَّ ٱسْتَقَـٰمُوا۟ تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ ٱلْمَلَـٰٓئِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا۟ وَلَا تَحْزَنُوا۟ وَأَبْشِرُوا۟ بِٱلْجَنَّةِ ٱلَّتِى كُنتُمْ تُوعَدُونَ
“নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, তারপর তাতে অটল থাকে, তাদের কাছে ফেরেশতারা অবতীর্ণ হয় এবং বলে, তোমরা ভয় করো না, দুঃখ করো না, তোমরা সেই জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর যা তোমাদের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।”
— (সুরা ফুস্সিলাত, ৪১:৩০
আয়াতে বলা হয়েছে যে, যারা আল্লাহকে তাদের রব হিসেবে মানে এবং এই বিশ্বাসে স্থির থাকে, তাদের জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা নেমে আসে। পরকালে জান্নাতের সুসংবাদও তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এটাই প্রকৃত সফলতা এবং মুমিনের জীবনের আসল উদ্দেশ্য।
সঠিক পথে জীবনযাপন এবং আল্লাহর কাছে পুরস্কার লাভ
মুমিনের জন্য আল্লাহর পথে সঠিক জীবনযাপনই প্রকৃত শান্তি ও সফলতার উৎস। জীবনকে আল্লাহর পথে পরিচালিত করে তাঁর কাছে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমেই প্রকৃত সফলতা অর্জন সম্ভব। আল্লাহর আনুগত্যে জীবন কাটানো এবং রাসূলের দেখানো পথে চলা একজন মুমিনের জীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
৩. রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশনা: দুনিয়ার চেয়ে আখিরাতের গুরুত্ব
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
الدُّنْيَا سِجْنُ الْمُؤْمِنِ وَجَنَّةُ الْكَافِرِ
“দুনিয়া হলো মুমিনের জন্য কারাগার এবং কাফিরের জন্য জান্নাত।”
— (সহিহ মুসলিম: ৭৪১৭)
এই হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) দুনিয়ার প্রকৃত অর্থকে বুঝিয়েছেন। একজন মুমিনের জন্য এই পৃথিবী পরীক্ষার স্থান; এটি তাদের জন্য চিরস্থায়ী বাসভূমি নয়। দুনিয়ার সকল আরাম-আয়েশ এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের থেকে মুমিনের জীবনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আখিরাতের সফলতা অর্জন করা। এই জীবন মুমিনের জন্য এক কারাগারের মতো, যেখানে তাকে শৃঙ্খলিতভাবে আল্লাহর বিধান অনুসারে জীবনযাপন করতে হবে, এবং আখিরাতের সফলতাই তার প্রকৃত মুক্তি।
দুনিয়ার জীবনের সীমাবদ্ধতা এবং আখিরাতের শাশ্বত জীবন
আল্লাহ বলেন:
وَمَا ٱلْحَيَوٰةُ ٱلدُّنْيَآ إِلَّا مَتَـٰعُ ٱلْغُرُورِ
“এই পার্থিব জীবন তো এক প্রতারণামূলক ভোগের উপকরণ ছাড়া আর কিছুই নয়।”
— (সুরা আল-ইমরান, ৩:১৮৫)
এই আয়াতটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দুনিয়ার জীবন আসলে এক মায়া, যেখানে মানুষকে ক্ষণিকের ভোগ-বিলাসে আকৃষ্ট করা হয়। একজন মুমিনের দায়িত্ব হলো এই সাময়িক জীবনের আনন্দকে পিছনে রেখে আখিরাতের জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া, যা চিরস্থায়ী এবং যার সাথে তুলনায় দুনিয়ার জীবন অত্যন্ত তুচ্ছ।
আখিরাতকে লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার গুরুত্ব
হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“كُنْ فِي الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ”
“তুমি এই দুনিয়াতে যেন অপরিচিত বা পথিকের মতো জীবনযাপন করো।”
— (সহিহ বুখারি: ৬৪১৬)
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এই হাদিসে বলা হয়েছে যে, এই পৃথিবীতে যেন মুমিন নিজেকে একজন পথিক বা সাময়িক অবস্থানকারী মনে করে। একজন পথিকের মতো এই পৃথিবীতে অল্প সময়ের জন্য অবস্থান করে আখিরাতের যাত্রা শুরু করাই মুমিনের আসল লক্ষ্য। দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে, আখিরাতকে মুমিনের জীবনের মূল লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা উচিত, কারণ এটাই স্থায়ী জীবন।আখিরাতের দিকে মনোযোগী থাকা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এই পৃথিবীতে জীবন যাপন করাই একজন মুমিনের প্রকৃত লক্ষ্য, যা তাকে চিরস্থায়ী শান্তি ও জান্নাতের দিকে নিয়ে যাবে।
৪. সমস্ত কাজই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হওয়া উচিত
আল্লাহ্ তাআলা বলেন:
وَٱصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ فَإِنَّكَ بِأَعْيُنِنَا
“তোমার প্রতিপালকের সন্তুষ্টির জন্য ধৈর্য ধারণ কর।”
— (সুরা মুদ্দাসসির, ৭৪:৭)
এই আয়াতে আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন যে, একজন মুমিনের উচিত জীবনের প্রতিটি কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ধৈর্য ধারণ করা। এটি শুধু ইবাদত বা উপাসনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ব্যক্তিগত, সামাজিক, এবং পেশাগত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কাজ করা উচিত। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি মুমিনের জীবনে সঠিক পথের নির্দেশনা দেয় এবং তার কাজকর্ম দ্বীনের আলোকে পরিচালিত হয়।
হাদিসে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাজ করার গুরুত্ব
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
“إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى”
“প্রত্যেক কাজই নিয়তের উপর নির্ভর করে, এবং প্রতিটি ব্যক্তির জন্য রয়েছে তার নিয়তের প্রতিদান।”
— (সহিহ বুখারি: ১)
এই হাদিসটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে, প্রতিটি কাজের মূলে নিয়ত থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি মুমিন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে কাজ করে, তবে তা ইবাদতের মর্যাদা লাভ করে। এমনকি দুনিয়াবী কাজও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করলে তা মুমিনের জন্য সওয়াবের কাজ হয়ে যায়। তাই মুমিনের উচিত নিয়তকে বিশুদ্ধ রাখা এবং জীবনের প্রতিটি কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টিকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা।
জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা
আল্লাহ বলেন:
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
“বলুন, নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ সবই আল্লাহর জন্য, যিনি সকল সৃষ্টির প্রতিপালক।”
— (সুরা আল-আনআম, ৬:১৬২)
এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, জীবনের প্রতিটি দিক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত হওয়া উচিত। নামাজ, কুরবানি, জীবন, এবং মৃত্যুর প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদন মুমিনের জীবনের প্রধান লক্ষ্য। এটি একজন মুমিনের জন্য এক ধরনের সম্পূর্ণ আত্মনিবেদনের শিক্ষা দেয়, যা আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে তাকে পরিচালিত করে।
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা একজন মুমিনের জীবনের পরিপূর্ণতা
একজন মুমিনের জন্য সব কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে কাজ করাই তার দ্বীনের পথে জীবনযাপনকে পূর্ণতা দেয়। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে একজন মুমিন তার দুনিয়াবী ও আখিরাতের জীবনে প্রকৃত সফলতা অর্জন করতে পারে।
৫. মুমিনদের জন্য দ্বীন পালন বাধ্যতামূলক
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ
“তোমরা সকলেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তার অধীনস্থদের বিষয়ে দায়িত্বশীল।”
— (সহিহ বুখারি: ৭১৩৮)
এই হাদিসের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সা.) বোঝাতে চেয়েছেন যে, প্রতিটি মুমিনের উপর দায়িত্ব অর্পিত আছে এবং সেই দায়িত্বের ব্যাপারে আল্লাহর সামনে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। একজন মুমিন শুধু নিজের জীবনের জন্যই নয়, বরং তার পরিবারের, সমাজের এবং উম্মতের প্রতিও দায়িত্বশীল। ইসলামের মূল শিক্ষা হলো দায়িত্ব পালন, যা একজন মুমিনকে তার দ্বীন অনুযায়ী জীবনযাপন করার জন্য বাধ্য করে।
দ্বীন পালন এবং সামাজিক দায়িত্ব
আল্লাহ্ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
“হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবারকে আগুন থেকে রক্ষা করো।”
— (সুরা তাহরিম, ৬৬:৬)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, একজন মুমিনের দায়িত্ব শুধু তার ব্যক্তিগত ইবাদত সীমাবদ্ধ নয়, বরং তার পরিবার ও নিকটজনের দ্বীনদারি এবং সঠিক পথে থাকার ব্যাপারেও সে দায়বদ্ধ। আল্লাহর আদেশ মেনে নিজের ও পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন একজন মুমিনের উপর বাধ্যতামূলক এবং এর মাধ্যমেই সে দ্বীনের প্রতি পূর্ণতা লাভ করতে পারে।
মুমিনের উপর দ্বীনকে জীবনের কেন্দ্রবিন্দু বানানোর গুরুত্ব
রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন:
مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيمَانِ
“তোমাদের মধ্যে যে কেউ মন্দ কাজ দেখবে, সে যেন তা হাত দিয়ে পরিবর্তন করে। যদি তাতে সক্ষম না হয় তবে মুখ দিয়ে, আর তাতেও সক্ষম না হলে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করবে, এবং এটাই সর্বনিম্ন ইমানের স্তর।”
— (সহিহ মুসলিম: ৪৯)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, মুমিনের জন্য অন্যায় ও পাপ থেকে নিজেকে বিরত রাখা এবং সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। দ্বীন পালন শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং সমাজের অন্যায় দূর করাও একজন মুমিনের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং মুমিনের জন্য দ্বীন পালন ও সমাজের কল্যাণে কাজ করা বাধ্যতামূলক, এবং এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই সে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হয়।
আল্লাহর সামনে দায়িত্বশীল হিসেবে হাজির হওয়ার প্রস্তুতি
মুমিনের জীবনের প্রতিটি কাজ, সিদ্ধান্ত, ও আচরণ আল্লাহর সামনে জবাবদিহিতার প্রস্তুতি হিসেবে হওয়া উচিত। দ্বীন পালনকে জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গ্রহণের মাধ্যমে একজন মুমিন জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই আল্লাহর প্রতি অনুগত হতে পারে।
শেষকথা, কুরআন ও হাদিসে বারংবার গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনই মুমিনের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। দুনিয়ার সাময়িক সফলতার দিকে না ছুটে মুমিনদের আখিরাতের সফলতার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পথ অনুসরণ করা প্রয়োজন। আল্লাহর ইবাদত, আখিরাতের সফলতা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য জীবনযাপনই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত, যা একজন মুমিনের জীবনকে পূর্ণতা দান করে।