সময়: বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইরানে ইসরায়েলের হামলা: মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা

ডিজিটাল ডেস্ক
  • Update Time : ০৭:৪৮:৫৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৪
  • / ১০৫ Time View

ইরানে ইসরায়েলের হামলা

শনিবার ভোররাতে ইরানে হামলা চালানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর এক পাইলট। ছবিটি প্রকাশ করেছে ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)ছবি : দ্য টাইমস অব ইসরায়েলের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

 

– ইরানে ইসরায়েলের হামলায় নিহত দু’জন সেনা, ক্ষয়ক্ষতি সীমিত।

– যুক্তরাষ্ট্রকে হামলার বিষয়ে আগেই জানানো হয়েছিল।

– সৌদি আরব, ইরাক, আরব আমিরাত ও সিরিয়া হামলার নিন্দা জানিয়েছে।

শনিবার ভোরবেলায় ইসরায়েলি বিমানবাহিনী ইরানে বিমান হামলা চালিয়েছে। ইরানের তিনটি প্রদেশের বেশ কয়েকটি সামরিক স্থাপনায় এ আক্রমণ চালানো হয়। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী দাবি করেছে, এই হামলা ইরানের ১ অক্টোবরের ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের প্রতিশোধ হিসেবে করা হয়েছে। একই সঙ্গে ইসরায়েল ইরানকে ভবিষ্যতে এ ধরনের হামলা থেকে বিরত থাকার সতর্ক বার্তা দিয়েছে।

ইরান জানিয়েছে, ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলায় তাদের অন্তত দুই সেনাসদস্য নিহত হয়েছে এবং সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই ঘটনায় ইরান তাদের আত্মরক্ষার অধিকার তুলে ধরে পাল্টা জবাব দেওয়ার সতর্কতা উচ্চারণ করেছে, যা মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়াচ্ছে। ইরানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে।

শনিবার ভোররাতে ঠিক কখন ইসরায়েল এই হামলা শুরু করেছিল, তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, স্থানীয় সময় রাত আড়াইটার দিকে তেহরান, কারাজ ও মাশহাদ শহরে অন্তত সাতটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। হামলা চলতে থাকে প্রায় চার ঘণ্টা ধরে, এবং এর সঙ্গে সঙ্গেই ইরানজুড়ে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে। ইসরায়েল, যদিও কোনো তেলক্ষেত্র বা পারমাণবিক স্থাপনায় আক্রমণ চালায়নি, তবু এই হামলার পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।

ইসরায়েল কী বলছে?

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, শনিবার ভোরে ইরানে তাদের বিমান হামলা সম্পন্ন হয়েছে। এই অভিযানে ইরানের অভ্যন্তরে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নির্মাণকারী বেশ কয়েকটি কারখানা এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর তিনটি পর্যায়ে হামলা চালানো হয়।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে এই হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এই অভিযানের সাংকেতিক নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ডেস অব রিপেনট্যান্স’ বা ‘অনুতাপের দিন’। অভিযানে কয়েক ডজন যুদ্ধবিমান অংশ নেয় এবং তারা সফলভাবে ইরানকে আঘাত করার পর নিরাপদে নিজ নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে।

ইসরায়েলি বাহিনী এর আগে কখনোই ইরানে সরাসরি আক্রমণের বিষয়টি স্বীকার করেনি। তবে এবার আল-জাজিরা জানিয়েছে, তেল আবিবে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভূগর্ভস্থ এক বাংকার থেকে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এই হামলার প্রতিটি ধাপ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন।

ইরান যা বলছে

ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বিভাগ জানিয়েছে, ইসরায়েল সম্প্রতি তেহরান, খুজেস্তান এবং ইলাম প্রদেশের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় আক্রমণ চালিয়েছে। এই হামলার ফলে কিছু এলাকায় সীমিত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ইরানি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। হামলার সময়ে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ইরানের স্থানীয় কিছু সম্প্রচারমাধ্যমে প্রকাশিত ফুটেজে দেখা যায়, তেহরানের আকাশে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রের প্রতিক্রিয়ায় ইরানের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।

অন্যদিকে, ইরানের আধা-সরকারি সংবাদ সংস্থা তাসনিম জানিয়েছে যে, ইসরায়েল ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) ঘাঁটিতেও আঘাত হানে। তবে, এই হামলায় সেখানে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়নি বলে দাবি করা হয়েছে। ইরানের সরকারি ও সামরিক নেতৃত্ব বলছে, এ ধরনের হামলা ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা সমতুল্য, এবং নিজেদের রক্ষা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা বজায় রাখার অধিকার তাদের রয়েছে।

ইরানের সাম্প্রতিক বিবৃতি এবং প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কার্যকর করার প্রক্রিয়া মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইরানের এই প্রতিরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া এবং আক্রমণ প্রতিহতের প্রচেষ্টা মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। উল্লেখ্য, ইসরায়েল একই সময়ে সিরিয়াতেও বিমান হামলা চালিয়েছে, তবে সিরিয়ার আক্রমণের ক্ষয়ক্ষতি বা হতাহতের নির্ভরযোগ্য তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি।

যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হয়েছিল

ইসরায়েল ইরানে হামলা চালানোর বিষয়টি আগেই যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছিল। এক মার্কিন কর্মকর্তা রয়টার্সকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন এবং বলেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র এ হামলায় সরাসরি অংশ নেয়নি। বাইডেন প্রশাসনের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এ হামলাকে “সুনির্দিষ্ট ও আনুপাতিক” উল্লেখ করে বলেন, এর ফলে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘর্ষ নিরসনের প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়েছে। তবে, ইরান পাল্টা আঘাত হানলে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত আছে বলেও জানান তিনি।

এর পেছনের প্রেক্ষাপটে, ১ অক্টোবর ইরান প্রায় ২০০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের দিকে নিক্ষেপ করেছিল, যেটি ছিল ইরান-সমর্থিত হামাসপ্রধান ইসমাইল হানিয়া ও লেবাননের হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহর হত্যার প্রতিক্রিয়ায়। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য মিত্রদের সহযোগিতায় এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর অধিকাংশ ভূপাতিত করা হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া জানানোর অঙ্গীকার করেছিলেন। প্রথমে ধারণা করা হচ্ছিল, ইসরায়েল ইরানের জ্বালানি তেল ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালাবে। কিন্তু এ ধরনের আক্রমণের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ফলে ইসরায়েল তেল ও পারমাণবিক স্থাপনা এড়িয়ে কেবল সামরিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালায়।

পাল্টা হামলার শঙ্কা

ইসরায়েলের হামলার আগে ইরানের শীর্ষ কর্মকর্তারা একাধিকবার সতর্কবার্তা দেন যে, ইরান যেকোনো আগ্রাসনের জবাব দেওয়ার অধিকার রাখে। ইরানের আধা সরকারি সংবাদ সংস্থা তাসনিম জানায়, ইসরায়েলকে সমানুপাতিক প্রতিক্রিয়া দেওয়া হবে। তবে, গত বৃহস্পতিবার ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি) ইঙ্গিত দেয় যে, যদি হামলাকে সীমিত আকারের মনে হয় এবং তাতে ইরানের কোনো বড় ক্ষতি বা হতাহতের ঘটনা না ঘটে, তাহলে ইরানের পক্ষ থেকে পাল্টা হামলার সম্ভাবনা কম থাকবে।

সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওস জানায়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন যে ইরান কোনো পাল্টা হামলা চালাতে পারে, তবে সেটি হবে সীমিত আকারে। তবে, ইসরায়েল ইরানকে সতর্কবার্তা দিয়েছে যেন তারা প্রতিক্রিয়া থেকে বিরত থাকে। এদিকে, ইসরায়েল তার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য কোনো নতুন সতর্কতা জারি করেনি, যা ইঙ্গিত করে যে দেশটি তাত্ক্ষণিক কোনো পাল্টা হামলার আশঙ্কা করছে না।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

ইরানে ইসরায়েলের হামলার ঘটনায় বিভিন্ন দেশ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আসছে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার এ বিষয়ে এক বিবৃতিতে বলেছেন, “ইরানের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে।” তবে তিনি আঞ্চলিক উত্তেজনা যেন আর না বাড়ে, সেদিকে নজর দেওয়ার ওপরও জোর দেন।

ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া বিবৃতিতে এই অঞ্চলে উত্তপ্ত পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। ফ্রান্স সব পক্ষকে উত্তেজনা বাড়াতে পারে এমন যেকোনো উসকানি ও পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানায়।

সৌদি আরব কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ইরানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের জন্য ইসরায়েলের এ হামলার নিন্দা করেছে। সৌদি আরবের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের এ ধরনের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইন ও নীতির প্রতি অসম্মান প্রদর্শন।

মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরাক, হামাস, হিজবুল্লাহ এবং পাকিস্তানসহ বেশ কয়েকটি দেশও ইরানে ইসরায়েলের এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে। এই দেশগুলো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার আহ্বান জানায়।

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

ইরানে ইসরায়েলের হামলা: মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা

Update Time : ০৭:৪৮:৫৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৪
শনিবার ভোররাতে ইরানে হামলা চালানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর এক পাইলট। ছবিটি প্রকাশ করেছে ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)ছবি : দ্য টাইমস অব ইসরায়েলের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

 

– ইরানে ইসরায়েলের হামলায় নিহত দু’জন সেনা, ক্ষয়ক্ষতি সীমিত।

– যুক্তরাষ্ট্রকে হামলার বিষয়ে আগেই জানানো হয়েছিল।

– সৌদি আরব, ইরাক, আরব আমিরাত ও সিরিয়া হামলার নিন্দা জানিয়েছে।

শনিবার ভোরবেলায় ইসরায়েলি বিমানবাহিনী ইরানে বিমান হামলা চালিয়েছে। ইরানের তিনটি প্রদেশের বেশ কয়েকটি সামরিক স্থাপনায় এ আক্রমণ চালানো হয়। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী দাবি করেছে, এই হামলা ইরানের ১ অক্টোবরের ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের প্রতিশোধ হিসেবে করা হয়েছে। একই সঙ্গে ইসরায়েল ইরানকে ভবিষ্যতে এ ধরনের হামলা থেকে বিরত থাকার সতর্ক বার্তা দিয়েছে।

ইরান জানিয়েছে, ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলায় তাদের অন্তত দুই সেনাসদস্য নিহত হয়েছে এবং সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই ঘটনায় ইরান তাদের আত্মরক্ষার অধিকার তুলে ধরে পাল্টা জবাব দেওয়ার সতর্কতা উচ্চারণ করেছে, যা মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়াচ্ছে। ইরানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে।

শনিবার ভোররাতে ঠিক কখন ইসরায়েল এই হামলা শুরু করেছিল, তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, স্থানীয় সময় রাত আড়াইটার দিকে তেহরান, কারাজ ও মাশহাদ শহরে অন্তত সাতটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। হামলা চলতে থাকে প্রায় চার ঘণ্টা ধরে, এবং এর সঙ্গে সঙ্গেই ইরানজুড়ে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে। ইসরায়েল, যদিও কোনো তেলক্ষেত্র বা পারমাণবিক স্থাপনায় আক্রমণ চালায়নি, তবু এই হামলার পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।

ইসরায়েল কী বলছে?

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, শনিবার ভোরে ইরানে তাদের বিমান হামলা সম্পন্ন হয়েছে। এই অভিযানে ইরানের অভ্যন্তরে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নির্মাণকারী বেশ কয়েকটি কারখানা এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর তিনটি পর্যায়ে হামলা চালানো হয়।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে এই হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এই অভিযানের সাংকেতিক নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ডেস অব রিপেনট্যান্স’ বা ‘অনুতাপের দিন’। অভিযানে কয়েক ডজন যুদ্ধবিমান অংশ নেয় এবং তারা সফলভাবে ইরানকে আঘাত করার পর নিরাপদে নিজ নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে।

ইসরায়েলি বাহিনী এর আগে কখনোই ইরানে সরাসরি আক্রমণের বিষয়টি স্বীকার করেনি। তবে এবার আল-জাজিরা জানিয়েছে, তেল আবিবে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভূগর্ভস্থ এক বাংকার থেকে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এই হামলার প্রতিটি ধাপ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন।

ইরান যা বলছে

ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বিভাগ জানিয়েছে, ইসরায়েল সম্প্রতি তেহরান, খুজেস্তান এবং ইলাম প্রদেশের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় আক্রমণ চালিয়েছে। এই হামলার ফলে কিছু এলাকায় সীমিত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ইরানি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। হামলার সময়ে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ইরানের স্থানীয় কিছু সম্প্রচারমাধ্যমে প্রকাশিত ফুটেজে দেখা যায়, তেহরানের আকাশে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রের প্রতিক্রিয়ায় ইরানের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।

অন্যদিকে, ইরানের আধা-সরকারি সংবাদ সংস্থা তাসনিম জানিয়েছে যে, ইসরায়েল ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) ঘাঁটিতেও আঘাত হানে। তবে, এই হামলায় সেখানে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়নি বলে দাবি করা হয়েছে। ইরানের সরকারি ও সামরিক নেতৃত্ব বলছে, এ ধরনের হামলা ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা সমতুল্য, এবং নিজেদের রক্ষা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা বজায় রাখার অধিকার তাদের রয়েছে।

ইরানের সাম্প্রতিক বিবৃতি এবং প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কার্যকর করার প্রক্রিয়া মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইরানের এই প্রতিরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া এবং আক্রমণ প্রতিহতের প্রচেষ্টা মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। উল্লেখ্য, ইসরায়েল একই সময়ে সিরিয়াতেও বিমান হামলা চালিয়েছে, তবে সিরিয়ার আক্রমণের ক্ষয়ক্ষতি বা হতাহতের নির্ভরযোগ্য তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি।

যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হয়েছিল

ইসরায়েল ইরানে হামলা চালানোর বিষয়টি আগেই যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছিল। এক মার্কিন কর্মকর্তা রয়টার্সকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন এবং বলেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র এ হামলায় সরাসরি অংশ নেয়নি। বাইডেন প্রশাসনের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এ হামলাকে “সুনির্দিষ্ট ও আনুপাতিক” উল্লেখ করে বলেন, এর ফলে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘর্ষ নিরসনের প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়েছে। তবে, ইরান পাল্টা আঘাত হানলে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত আছে বলেও জানান তিনি।

এর পেছনের প্রেক্ষাপটে, ১ অক্টোবর ইরান প্রায় ২০০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের দিকে নিক্ষেপ করেছিল, যেটি ছিল ইরান-সমর্থিত হামাসপ্রধান ইসমাইল হানিয়া ও লেবাননের হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহর হত্যার প্রতিক্রিয়ায়। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য মিত্রদের সহযোগিতায় এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর অধিকাংশ ভূপাতিত করা হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া জানানোর অঙ্গীকার করেছিলেন। প্রথমে ধারণা করা হচ্ছিল, ইসরায়েল ইরানের জ্বালানি তেল ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালাবে। কিন্তু এ ধরনের আক্রমণের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ফলে ইসরায়েল তেল ও পারমাণবিক স্থাপনা এড়িয়ে কেবল সামরিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালায়।

পাল্টা হামলার শঙ্কা

ইসরায়েলের হামলার আগে ইরানের শীর্ষ কর্মকর্তারা একাধিকবার সতর্কবার্তা দেন যে, ইরান যেকোনো আগ্রাসনের জবাব দেওয়ার অধিকার রাখে। ইরানের আধা সরকারি সংবাদ সংস্থা তাসনিম জানায়, ইসরায়েলকে সমানুপাতিক প্রতিক্রিয়া দেওয়া হবে। তবে, গত বৃহস্পতিবার ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি) ইঙ্গিত দেয় যে, যদি হামলাকে সীমিত আকারের মনে হয় এবং তাতে ইরানের কোনো বড় ক্ষতি বা হতাহতের ঘটনা না ঘটে, তাহলে ইরানের পক্ষ থেকে পাল্টা হামলার সম্ভাবনা কম থাকবে।

সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওস জানায়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন যে ইরান কোনো পাল্টা হামলা চালাতে পারে, তবে সেটি হবে সীমিত আকারে। তবে, ইসরায়েল ইরানকে সতর্কবার্তা দিয়েছে যেন তারা প্রতিক্রিয়া থেকে বিরত থাকে। এদিকে, ইসরায়েল তার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য কোনো নতুন সতর্কতা জারি করেনি, যা ইঙ্গিত করে যে দেশটি তাত্ক্ষণিক কোনো পাল্টা হামলার আশঙ্কা করছে না।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

ইরানে ইসরায়েলের হামলার ঘটনায় বিভিন্ন দেশ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আসছে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার এ বিষয়ে এক বিবৃতিতে বলেছেন, “ইরানের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে।” তবে তিনি আঞ্চলিক উত্তেজনা যেন আর না বাড়ে, সেদিকে নজর দেওয়ার ওপরও জোর দেন।

ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া বিবৃতিতে এই অঞ্চলে উত্তপ্ত পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। ফ্রান্স সব পক্ষকে উত্তেজনা বাড়াতে পারে এমন যেকোনো উসকানি ও পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানায়।

সৌদি আরব কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ইরানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের জন্য ইসরায়েলের এ হামলার নিন্দা করেছে। সৌদি আরবের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের এ ধরনের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইন ও নীতির প্রতি অসম্মান প্রদর্শন।

মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরাক, হামাস, হিজবুল্লাহ এবং পাকিস্তানসহ বেশ কয়েকটি দেশও ইরানে ইসরায়েলের এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে। এই দেশগুলো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার আহ্বান জানায়।