ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন

- Update Time : ০৭:৩৫:৩১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪
- / ১১১ Time View
সরকার আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে। বুধবার (২৩ অক্টোবর) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করার কথা জানানো হয়।
ছাত্র-জনতার বিশাল আন্দোলনের ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এ দাবিকে সমর্থন জানায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানায়। সর্বশেষ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বৃহস্পতিবারের মধ্যে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার আল্টিমেটাম দেয়।
সরকার গতকাল রাতে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক শাখা-২ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে বিশেষ করে গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, গণরুমে নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। এই সম্পর্কিত প্রমাণ দেশের প্রধান গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় তাদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, ১৫ জুলাই ২০২৪ তারিখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সশস্ত্র হামলা চালিয়ে শত শত নিরীহ শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে এবং অনেকের জীবন বিপন্ন করেছে।’
সরকারের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ রয়েছে যে, ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক এবং উস্কানিমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত ছিল, যা বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত।
তাই সরকার ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯’-এর ধারা ১৮ এর উপ-ধারা (১) অনুযায়ী প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং এই সংগঠনকে উক্ত আইনের তফসিল-২ এ নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর হবে।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংগঠনটি বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে সময়ের সঙ্গে সংগঠনটি বিভক্ত হয়ে একাধিক ধারায় বিভাজিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দলাদলি, হামলা-মারামারি, খুন, শিক্ষার্থী নির্যাতন, টেন্ডারবাজি এবং চাঁদাবাজির মতো নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য ছাত্রলীগকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে।
২০১৯ সালে চাঁদাবাজির অভিযোগে তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে তাদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, যা সেসময় দেশজুড়ে আলোড়ন তোলে। ছাত্রলীগের এই দুই শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তারা সংগঠনের অবস্থান ব্যবহার করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে বেআইনিভাবে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করেছেন। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন, যার ফলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এই দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতা তাদের পদ হারান। এই পদক্ষেপ সরকারের পক্ষ থেকে ছাত্রলীগের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রয়াস হিসেবে দেখা হলেও এটি ছাত্র সংগঠনের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ও ক্ষমতার লড়াইয়ের প্রতিফলন ছিল।
তবে ২০১৯ সালের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে হত্যা। ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী আবরারকে তার কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করেন। আবরারের অপরাধ ছিল, তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে করা একটি চুক্তি নিয়ে সরকারবিরোধী একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। এই ঘটনাটি দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং শিক্ষার্থী, নাগরিক সমাজসহ বিভিন্ন মহল আবরার হত্যার বিচারের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলনে নামেন।
আবরার ফাহাদ ছিলেন বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র। তার হত্যাকাণ্ডের পর দায়ের করা মামলায় আদালত দ্রুত বিচারকার্য শুরু করেন। দীর্ঘ শুনানির পর আদালত ২০২১ সালে ২০ জন অভিযুক্তের মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন। এ রায়কে আবরারের পরিবার এবং সাধারণ মানুষ স্বস্তির সাথে গ্রহণ করলেও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে উঠা নানা ধরনের অভিযোগ এবং আবরার হত্যার মতো ঘটনা ছাত্র সংগঠনটির ভাবমূর্তিতে গভীর আঘাত হানে।
আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ড এবং এর সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছাত্র সংগঠনটির ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। এ ঘটনা ছাত্ররাজনীতির উপর মানুষের আস্থা কমিয়ে দেয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকার পুরান এলাকার বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে নির্মমভাবে দরজি দোকানের কর্মচারী বিশ্বজিৎ দাসকে হত্যা করা হয়, যা দেশের রাজনৈতিক সহিংসতার অন্যতম কলঙ্কজনক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশ্বজিৎ দাস ওইদিন তার দৈনন্দিন কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে বিরোধীদলীয় হরতাল চলাকালে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মীর আক্রমণের শিকার হন। তারা বিশ্বজিতের সাথে কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা না থাকলেও তাকে হরতালের অংশগ্রহণকারী ভেবে সন্দেহ করে, এবং প্রকাশ্যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। পুরো ঘটনাটি সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হলে দেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং সারা দেশের মানুষ বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেন।
এ ঘটনার পর দায়ের করা মামলায় আদালত দ্রুত বিচার কার্যক্রমের মাধ্যমে ২০১৩ সালে ৮ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। বিশ্বজিতের হত্যা দেশের রাজনৈতিক সহিংসতার নিষ্ঠুর প্রতিচ্ছবি হিসেবে উঠে আসে এবং ছাত্রলীগের সহিংস কর্মকাণ্ড নিয়ে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দেয়।
একই বছর, ২০১২ সালে, আরেকটি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদকে নির্মমভাবে হত্যা করেন ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী। তাদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং ক্ষমতার লড়াইয়ের ফলে জুবায়ের এই আক্রমণের শিকার হন। তাকে বেধড়ক পিটিয়ে হত্যা করা হয়, যা শিক্ষাঙ্গনে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার প্রশ্নে উদ্বেগের সৃষ্টি করে।
জুবায়ের হত্যার পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, এবং হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু হয়। এ হত্যাকাণ্ডের বিচারেও আদালত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি প্রদান করেন। এই দুই ঘটনা ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে দেশব্যাপী বিতর্ক উসকে দেয়।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালে শুরু হওয়া আন্দোলন বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি উপেক্ষা করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাদের ওপর হামলা চালায়। এ ঘটনার পর ছাত্রলীগের ভূমিকা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তবে আন্দোলন তৎকালীন সরকারের চাপে থেমে গেলেও ২০২৪ সালে পুনরায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে, আবারও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সহিংস আক্রমণ চালায়। ১৫ জুলাই, ছাত্রদের ওপর এই হামলার পরপরই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দেন যে, ক্যাম্পাসে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ হয়েছে, তার জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত রয়েছে।
তবে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়, এবং ১৬ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তারা হল থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বের করে দেন, এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও একই ধরনের প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। শিক্ষার্থীদের এই প্রবল প্রতিরোধের ফলে দেশের শিক্ষাঙ্গনে নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, যা ছাত্রলীগের অবস্থানকে ক্রমশ দুর্বল করে তোলে।
২০২২ সাল থেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন সাদ্দাম হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে, ছাত্রলীগের নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। তাদের রাজনৈতিক শক্তি ও প্রভাব ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে।
যদিও সরকার ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, রাতে ছাত্রলীগের প্যাডে তাদের স্বাক্ষরসহ একটি বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। ওই বিবৃতিতে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে অন্তর্বর্তী সরকারের অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে উল্লেখ করা হয়। ছাত্রলীগ নেতারা দাবি করেন যে, এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং তাদের সংগঠনের ইতিহাস ও ভূমিকার প্রতি অবমাননাকর।
যে দাবির মুখে নিষিদ্ধ হলো
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির মুখে অবশেষে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলো সরকার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছিল। গত মঙ্গলবার, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীরা তাদের পাঁচ দফা দাবির দ্বিতীয়টি হিসেবে উল্লেখ করেন যে, ছাত্রলীগকে আজীবন নিষিদ্ধ করতে হবে। তাঁরা দাবি করেন, ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড দেশের শিক্ষাঙ্গনে সহিংসতা, নিপীড়ন ও সন্ত্রাসকে উৎসাহিত করেছে, যা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও শিক্ষা পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।
বুধবার সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যৌথভাবে সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। সেখান থেকেই তাঁরা ছাত্রলীগকে বৃহস্পতিবারের মধ্যে নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি সময়সীমা নির্ধারণ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, “ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন বাংলাদেশে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। গত ১৬ বছর ধরে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগ যে ধরনের নৃশংসতা চালিয়েছে এবং হলগুলোকে যেভাবে নির্যাতন কেন্দ্র বানিয়েছে, তার ফলে এই সংগঠনের জন্য পুনর্বাসনের কোনো সুযোগ নেই। একটি জঙ্গি সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন, সব কটিই ছাত্রলীগের মধ্যে বিদ্যমান।”
এ বক্তব্যের মাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবিগুলো আরও শক্তিশালী হয়, এবং জনগণের মধ্যে ছাত্রলীগের নিষিদ্ধের পক্ষে জোরালো সমর্থন তৈরি হয়।

আনন্দমিছিল
ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আনন্দমিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বুধবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে থেকে শুরু করে রাজু ভাস্কর্যের দিকে মিছিল নিয়ে তারা সমাবেশ করে।
এর আগে, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালনের পরিকল্পনা ছিল তাঁদের। রাত ৯টা ২০ মিনিটের দিকে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনের চত্বরে জড়ো হতে থাকে। পরে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে তাঁরা আনন্দমিছিল বের করেন।
এদিকে, সরকার ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। সরকারি ঘোষণার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনন্দমিছিল অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
প্রসঙ্গত, ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের অ্যাসেম্বলি হলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠার সময় এটি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এটি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নামে পরিচিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় ভূমিকা পালন করেছে ছাত্রলীগ। তবে স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময় বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য সংগঠনটি সমালোচিত হয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণ এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগকেও বেকায়দায় ফেলেছে।
আজকের আনন্দমিছিল এবং সমাবেশ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি নতুন মোড়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে।
Please Share This Post in Your Social Media

ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন

সরকার আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে। বুধবার (২৩ অক্টোবর) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করার কথা জানানো হয়।
ছাত্র-জনতার বিশাল আন্দোলনের ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এ দাবিকে সমর্থন জানায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানায়। সর্বশেষ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বৃহস্পতিবারের মধ্যে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার আল্টিমেটাম দেয়।
সরকার গতকাল রাতে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক শাখা-২ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে বিশেষ করে গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, গণরুমে নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। এই সম্পর্কিত প্রমাণ দেশের প্রধান গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় তাদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, ১৫ জুলাই ২০২৪ তারিখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সশস্ত্র হামলা চালিয়ে শত শত নিরীহ শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে এবং অনেকের জীবন বিপন্ন করেছে।’
সরকারের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ রয়েছে যে, ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক এবং উস্কানিমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত ছিল, যা বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত।
তাই সরকার ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯’-এর ধারা ১৮ এর উপ-ধারা (১) অনুযায়ী প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং এই সংগঠনকে উক্ত আইনের তফসিল-২ এ নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর হবে।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংগঠনটি বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে সময়ের সঙ্গে সংগঠনটি বিভক্ত হয়ে একাধিক ধারায় বিভাজিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দলাদলি, হামলা-মারামারি, খুন, শিক্ষার্থী নির্যাতন, টেন্ডারবাজি এবং চাঁদাবাজির মতো নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য ছাত্রলীগকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে।
২০১৯ সালে চাঁদাবাজির অভিযোগে তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে তাদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, যা সেসময় দেশজুড়ে আলোড়ন তোলে। ছাত্রলীগের এই দুই শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তারা সংগঠনের অবস্থান ব্যবহার করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে বেআইনিভাবে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করেছেন। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন, যার ফলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এই দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতা তাদের পদ হারান। এই পদক্ষেপ সরকারের পক্ষ থেকে ছাত্রলীগের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রয়াস হিসেবে দেখা হলেও এটি ছাত্র সংগঠনের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ও ক্ষমতার লড়াইয়ের প্রতিফলন ছিল।
তবে ২০১৯ সালের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে হত্যা। ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী আবরারকে তার কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করেন। আবরারের অপরাধ ছিল, তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে করা একটি চুক্তি নিয়ে সরকারবিরোধী একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। এই ঘটনাটি দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং শিক্ষার্থী, নাগরিক সমাজসহ বিভিন্ন মহল আবরার হত্যার বিচারের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলনে নামেন।
আবরার ফাহাদ ছিলেন বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র। তার হত্যাকাণ্ডের পর দায়ের করা মামলায় আদালত দ্রুত বিচারকার্য শুরু করেন। দীর্ঘ শুনানির পর আদালত ২০২১ সালে ২০ জন অভিযুক্তের মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন। এ রায়কে আবরারের পরিবার এবং সাধারণ মানুষ স্বস্তির সাথে গ্রহণ করলেও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে উঠা নানা ধরনের অভিযোগ এবং আবরার হত্যার মতো ঘটনা ছাত্র সংগঠনটির ভাবমূর্তিতে গভীর আঘাত হানে।
আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ড এবং এর সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছাত্র সংগঠনটির ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। এ ঘটনা ছাত্ররাজনীতির উপর মানুষের আস্থা কমিয়ে দেয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকার পুরান এলাকার বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে নির্মমভাবে দরজি দোকানের কর্মচারী বিশ্বজিৎ দাসকে হত্যা করা হয়, যা দেশের রাজনৈতিক সহিংসতার অন্যতম কলঙ্কজনক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশ্বজিৎ দাস ওইদিন তার দৈনন্দিন কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে বিরোধীদলীয় হরতাল চলাকালে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মীর আক্রমণের শিকার হন। তারা বিশ্বজিতের সাথে কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা না থাকলেও তাকে হরতালের অংশগ্রহণকারী ভেবে সন্দেহ করে, এবং প্রকাশ্যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। পুরো ঘটনাটি সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হলে দেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং সারা দেশের মানুষ বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেন।
এ ঘটনার পর দায়ের করা মামলায় আদালত দ্রুত বিচার কার্যক্রমের মাধ্যমে ২০১৩ সালে ৮ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। বিশ্বজিতের হত্যা দেশের রাজনৈতিক সহিংসতার নিষ্ঠুর প্রতিচ্ছবি হিসেবে উঠে আসে এবং ছাত্রলীগের সহিংস কর্মকাণ্ড নিয়ে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দেয়।
একই বছর, ২০১২ সালে, আরেকটি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদকে নির্মমভাবে হত্যা করেন ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী। তাদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং ক্ষমতার লড়াইয়ের ফলে জুবায়ের এই আক্রমণের শিকার হন। তাকে বেধড়ক পিটিয়ে হত্যা করা হয়, যা শিক্ষাঙ্গনে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার প্রশ্নে উদ্বেগের সৃষ্টি করে।
জুবায়ের হত্যার পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, এবং হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু হয়। এ হত্যাকাণ্ডের বিচারেও আদালত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি প্রদান করেন। এই দুই ঘটনা ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে দেশব্যাপী বিতর্ক উসকে দেয়।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালে শুরু হওয়া আন্দোলন বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি উপেক্ষা করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাদের ওপর হামলা চালায়। এ ঘটনার পর ছাত্রলীগের ভূমিকা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তবে আন্দোলন তৎকালীন সরকারের চাপে থেমে গেলেও ২০২৪ সালে পুনরায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে, আবারও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সহিংস আক্রমণ চালায়। ১৫ জুলাই, ছাত্রদের ওপর এই হামলার পরপরই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দেন যে, ক্যাম্পাসে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ হয়েছে, তার জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত রয়েছে।
তবে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়, এবং ১৬ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তারা হল থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বের করে দেন, এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও একই ধরনের প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। শিক্ষার্থীদের এই প্রবল প্রতিরোধের ফলে দেশের শিক্ষাঙ্গনে নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, যা ছাত্রলীগের অবস্থানকে ক্রমশ দুর্বল করে তোলে।
২০২২ সাল থেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন সাদ্দাম হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে, ছাত্রলীগের নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। তাদের রাজনৈতিক শক্তি ও প্রভাব ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে।
যদিও সরকার ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, রাতে ছাত্রলীগের প্যাডে তাদের স্বাক্ষরসহ একটি বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। ওই বিবৃতিতে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে অন্তর্বর্তী সরকারের অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে উল্লেখ করা হয়। ছাত্রলীগ নেতারা দাবি করেন যে, এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং তাদের সংগঠনের ইতিহাস ও ভূমিকার প্রতি অবমাননাকর।
যে দাবির মুখে নিষিদ্ধ হলো
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির মুখে অবশেষে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলো সরকার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছিল। গত মঙ্গলবার, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীরা তাদের পাঁচ দফা দাবির দ্বিতীয়টি হিসেবে উল্লেখ করেন যে, ছাত্রলীগকে আজীবন নিষিদ্ধ করতে হবে। তাঁরা দাবি করেন, ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড দেশের শিক্ষাঙ্গনে সহিংসতা, নিপীড়ন ও সন্ত্রাসকে উৎসাহিত করেছে, যা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও শিক্ষা পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।
বুধবার সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যৌথভাবে সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। সেখান থেকেই তাঁরা ছাত্রলীগকে বৃহস্পতিবারের মধ্যে নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি সময়সীমা নির্ধারণ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, “ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন বাংলাদেশে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। গত ১৬ বছর ধরে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগ যে ধরনের নৃশংসতা চালিয়েছে এবং হলগুলোকে যেভাবে নির্যাতন কেন্দ্র বানিয়েছে, তার ফলে এই সংগঠনের জন্য পুনর্বাসনের কোনো সুযোগ নেই। একটি জঙ্গি সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন, সব কটিই ছাত্রলীগের মধ্যে বিদ্যমান।”
এ বক্তব্যের মাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবিগুলো আরও শক্তিশালী হয়, এবং জনগণের মধ্যে ছাত্রলীগের নিষিদ্ধের পক্ষে জোরালো সমর্থন তৈরি হয়।

আনন্দমিছিল
ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আনন্দমিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বুধবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে থেকে শুরু করে রাজু ভাস্কর্যের দিকে মিছিল নিয়ে তারা সমাবেশ করে।
এর আগে, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালনের পরিকল্পনা ছিল তাঁদের। রাত ৯টা ২০ মিনিটের দিকে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনের চত্বরে জড়ো হতে থাকে। পরে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে তাঁরা আনন্দমিছিল বের করেন।
এদিকে, সরকার ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। সরকারি ঘোষণার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনন্দমিছিল অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
প্রসঙ্গত, ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের অ্যাসেম্বলি হলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠার সময় এটি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এটি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নামে পরিচিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় ভূমিকা পালন করেছে ছাত্রলীগ। তবে স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময় বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য সংগঠনটি সমালোচিত হয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণ এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগকেও বেকায়দায় ফেলেছে।
আজকের আনন্দমিছিল এবং সমাবেশ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি নতুন মোড়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে।