ইসরাইলকে হতাশ করলো সৌদি আরব!

- Update Time : ০৬:৩৮:৫১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪
- / ৯৫ Time View
গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার আগে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পরিকল্পনা করছিল সৌদি আরব। কিন্তু এক বছর পর গাজার যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সৌদি সরকার এখন তার পুরনো শত্রু ইরানের সাথে সম্পর্ক পুনর্গঠনের পথে এগোচ্ছে।
বছরখানেক আগে ইসরাইলের সাথে একটি সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিল সৌদি আরব, যা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে মৌলিকভাবে বদলে দিতে পারতো এবং ইরান ও তার মিত্রদের আরো বিচ্ছিন্ন করে রাখতো। এমনকি, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রশ্নটিও আলোচনার বাইরে চলে যেত।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে এএফপি বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানিয়েছে।
খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, এখন ইসরাইলের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সেই চুক্তি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি দূরে সরে গেছে। বিশেষ করে হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যার পর চুক্তিটি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে। গাজার যুদ্ধ যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে একটি শান্তি চুক্তির জন্য দ্রুত আলোচনার আহ্বান জোরালো হচ্ছে সব মহলে।
এদিকে, সৌদি আরব তার পুরনো শত্রু ইরানের সাথে সম্পর্ক পুনর্গঠনের দিকে এগোচ্ছে। একই সাথে সৌদি সরকার জোর দিয়ে বলছে, যেকোনো কূটনৈতিক চুক্তি বা সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের আগে ইসরাইলকে অবশ্যই স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবি মেনে নিতে হবে। এটি সৌদি সরকারের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন।
মধ্যপ্রাচ্যে এখন একটি জটিল কূটনৈতিক টানাপোড়েন চলছে। তবে নিশ্চিতভাবেই এটি ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পরিকল্পনার সাথে মিলছে না। নেতানিয়াহু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বারবার বলছিলেন যে, তার প্রশাসন রিয়াদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তির পথে এগোচ্ছে।
চলতি মাসে উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে প্রথমবারের মতো বৈঠকে বসেছেন, যা এর আগে কখনো ঘটেনি। যদিও এই উদ্যোগ এখনো প্রাথমিক স্তরে এবং কিছুটা নড়বড়ে, এটি শুধু এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান ধর্মীয় বৈরী ভাব দূর করার সুযোগ তৈরি করবে না, বরং রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যে কয়েক দশকের রক্তপাতের ইতি টানার একটি সুবর্ণ সুযোগ হতে পারে।
তেহরান এই বৈঠকের পর থেকেই তাদের কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি সৌদি আরব সফর করেছেন, এছাড়াও তিনি ইরাক ও ওমান সফর করেছেন, যার লক্ষ্য ছিল দেশগুলোর মধ্যে চলমান উত্তেজনা প্রশমিত করা। এর বাইরেও তিনি জর্ডান, মিসর, এবং তুরস্ক সফর করেছেন। ইরানি সংবাদমাধ্যম ‘ইরনা’ জানিয়েছে, গত ১২ বছরের মধ্যে এই প্রথম কোনো ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিসর সফর করলেন, যা উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
গত ১৮ অক্টোবর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি তুরস্ক সফর করেন। ইস্তাম্বুলে পৌঁছে তিনি বলেন, “এই অঞ্চলে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে এবং গাজা-লেবাননের যুদ্ধ ও বাস্তুচ্যুত মানুষের দুর্ভোগ সম্পর্কে এখন আমাদের মধ্যে অভিন্ন ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।”
একই সময়ে, যখন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বারবার ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি অস্বীকার করছেন, সৌদি কর্মকর্তারা গণমাধ্যম থেকে শুরু করে কূটনৈতিক ফোরাম—সব জায়গাতেই দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরছেন। আরব বিশ্বের নেতা হিসেবে পরিচিত সৌদি আরবের বক্তব্য সুস্পষ্ট। তাদের অবস্থান হলো, ইসরাইল যদি সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চায়, তবে একমাত্র পথ হলো স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও তার স্বীকৃতি প্রদান।
গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে জীবন্ত চাপা পড়া শিশুদের মর্মান্তিক দৃশ্য, মৃত সন্তানের সামনে মায়েদের আহাজারি, এবং ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য খাদ্য প্রবেশে ইসরাইলি বাধার ছবি—এসবই সৌদি নেতৃত্বকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ইস্যু উপেক্ষা করা একপ্রকার অসম্ভব করে তুলেছে।
সৌদি ব্যবসায়ী, রাজ পরিবারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি এবং নিওম প্রকল্পের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য আলি শিহাবি বলেন, “গাজা যুদ্ধের পর যা ঘটেছে তা হলো—এই অঞ্চলে ইসরাইলের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি অনেকটাই পিছিয়ে গেছে।”
তিনি আরও বলেন, “সৌদি আরব দেখছে যে গাজার ঘটনার পর থেকে ইসরাইলের সাথে সম্পর্কের তিক্ততা ক্রমশ বিষাক্ত হয়ে উঠছে। ইসরাইল যদি তাদের অবস্থান পরিবর্তন না করে এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি আন্তরিক প্রতিশ্রুতি না দেখায়, তাহলে এই পরিস্থিতি খুব একটা বদলাবে না।”
তেহরান ও রিয়াদের মধ্যে সম্পর্কের ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেলেও, সৌদি আরব এবং তার উপসাগরীয় মিত্ররা ইরানের কূটনৈতিক পদক্ষেপের আন্তরিকতা নিয়ে এখনও সন্দিহান। এর মূল কারণ হলো, ইরান এখনও হামাস, হিজবুল্লাহ, এবং ইয়েমেনের হুতিদের অস্ত্র ও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, যারা অতীতে সৌদি আরবে হামলা চালিয়েছিল।
তবে এটি তেহরান ও রিয়াদের সম্পর্কের জন্য বাধা হবে না বলেই মনে করেন আলি শিহাব। তিনি বলেন, “ইরান যদি রিয়াদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়, সৌদি নেতৃত্ব তা কখনো প্রত্যাখ্যান করবে না। আর যদি ইরান সত্যিই আন্তরিক হয়, তবে এটি মধ্যপ্রাচ্যের একটি প্রকৃত পুনর্গঠনের সূচনা হবে।”
সৌদি আরব ও ইরান দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক আধিপত্যের জন্য লড়াই করে আসছে, যা মূলত ইসলামের প্রধান দুই শাখার—সুন্নি ও শিয়া—দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত। হামাস, হিজবুল্লাহ এবং হুতিরা ইরানের সেই আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন।
গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইল হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজায় যে ভয়াবহ আগ্রাসন শুরু করে, তা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে। এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৪৩ হাজারেরও বেশি নিরীহ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন, যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।
সৌদি রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের মতো, আলি শিহাবও মনে করেন যে সৌদি আরবে গণতন্ত্র না থাকলেও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান জনমতের প্রতি খুবই সংবেদনশীল। গত এক বছরে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সৌদি জনমত অনেকটাই কঠোর হয়ে উঠেছে, যা যুবরাজ মোহাম্মদকেও উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছে।
উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তরুণ। এই তরুণরা প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গাজার ইসরাইলি আগ্রাসনের নির্মম চিত্র দেখে আসছে, যা তাদের ইসরাইল সম্পর্কে সামান্য ইতিবাচক মনোভাবকেও ঘৃণায় পরিণত করেছে।
গত বছরের অক্টোবরের আগের মাসগুলোতে সৌদি আরব ইসরাইলের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের পরিকল্পনা করছিল। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রিয়াদের একটি বিস্তৃত প্রতিরক্ষা চুক্তি ও বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের কথা ছিল।
রিয়াদ দীর্ঘদিন ধরেই দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে সোচ্চার ছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতিতে এই বিষয়টির গুরুত্ব কিছুটা কমে গিয়েছিল।
গত বছর সৌদি আরব যখন ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনা শুরু করে, তখন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি শর্ত হিসেবে তোলেনি। বরং সে সময় রিয়াদ ইসরাইলের কাছ থেকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ ও আরো ক্ষমতা দেয়ার দাবি জানায়।
তবে গত এক বছরে গাজার পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন সৌদি আরবের দৃষ্টিভঙ্গিও পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। সম্প্রতি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান প্রকাশ্যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে কথা বলেছেন এবং রিয়াদের নতুন দাবি দাওয়ার বিষয়েও তাকে সোচ্চার দেখা গেছে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর উপদেষ্টা পরিষদে দেয়া এক ভাষণে যুবরাজ বলেন, “সৌদি আরব পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা বন্ধ করবে না এবং আমরা নিশ্চিত করছি যে, ইসরাইলের সাথে এটি ছাড়া কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে না।” একই ধরনের বক্তব্য তিনি ইউএস স্টেট অব দ্য ইউনিয়নেও দিয়েছিলেন।
গত মাসে ইরানের সাথে উপসাগরীয় দেশগুলোর বৈঠক এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হয়, যার কয়েকদিন আগেই তেহরান ইসরাইলে দ্বিতীয় দফা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল। ইরান ওই হামলায় ২০০’র বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে, যা মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা আরও গাজায় চলমান যুদ্ধ এবং ইসরাইলের সাম্প্রতিক আক্রমণগুলো আব্রাহাম অ্যাকর্ডে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোকেও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের পক্ষে কথা বলার জন্য বাধ্য করছে। বিশেষত, সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE), যারা গত কয়েক বছর ধরে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখলেও সাম্প্রতিক সময়ে সেই সম্পর্ক ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে পড়েছে। এর কারণ হলো এই অঞ্চলের জনমত, যা গাজার ঘটনার প্রেক্ষিতে ক্রমশ ইসরাইলের বিরুদ্ধে কঠোর হয়ে উঠছে।
এই চাপের প্রেক্ষিতে, আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ বিন জায়েদ গত মাসে মন্তব্য করেছেন যে গাজা পুনর্নির্মাণের ভার ইসরাইলের ওপরও বর্তাবে এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া গাজার পুনর্গঠনকে সমর্থন করবে না।
যদিও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দাবি করে যাচ্ছেন যে রিয়াদের সাথে একটি স্মারক চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া চলছে, সৌদি কর্মকর্তারা দেশের জনমতের বিবেচনায় সেই চুক্তিকে আপাতত গুরুত্ব দিচ্ছেন না। সৌদি আরবের নাগরিকদের মধ্যে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন এবং ইসরাইলের বিরোধিতা যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ওপরও প্রভাব ফেলেছে, এবং তিনি পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শর্ত ছাড়া ইসরাইলের সাথে কোনো চুক্তিতে যেতে রাজি নন।
এই পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যে কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার জটিলতা বাড়িয়ে তুলেছে, যেখানে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা গাজা যুদ্ধের কারণে বড় ধরনের বাধার মুখে পড়েছে।
সূত্র : বাসস
Please Share This Post in Your Social Media

ইসরাইলকে হতাশ করলো সৌদি আরব!

গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার আগে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পরিকল্পনা করছিল সৌদি আরব। কিন্তু এক বছর পর গাজার যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সৌদি সরকার এখন তার পুরনো শত্রু ইরানের সাথে সম্পর্ক পুনর্গঠনের পথে এগোচ্ছে।
বছরখানেক আগে ইসরাইলের সাথে একটি সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিল সৌদি আরব, যা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে মৌলিকভাবে বদলে দিতে পারতো এবং ইরান ও তার মিত্রদের আরো বিচ্ছিন্ন করে রাখতো। এমনকি, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রশ্নটিও আলোচনার বাইরে চলে যেত।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে এএফপি বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানিয়েছে।
খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, এখন ইসরাইলের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সেই চুক্তি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি দূরে সরে গেছে। বিশেষ করে হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যার পর চুক্তিটি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে। গাজার যুদ্ধ যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে একটি শান্তি চুক্তির জন্য দ্রুত আলোচনার আহ্বান জোরালো হচ্ছে সব মহলে।
এদিকে, সৌদি আরব তার পুরনো শত্রু ইরানের সাথে সম্পর্ক পুনর্গঠনের দিকে এগোচ্ছে। একই সাথে সৌদি সরকার জোর দিয়ে বলছে, যেকোনো কূটনৈতিক চুক্তি বা সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের আগে ইসরাইলকে অবশ্যই স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবি মেনে নিতে হবে। এটি সৌদি সরকারের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন।
মধ্যপ্রাচ্যে এখন একটি জটিল কূটনৈতিক টানাপোড়েন চলছে। তবে নিশ্চিতভাবেই এটি ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পরিকল্পনার সাথে মিলছে না। নেতানিয়াহু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বারবার বলছিলেন যে, তার প্রশাসন রিয়াদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তির পথে এগোচ্ছে।
চলতি মাসে উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে প্রথমবারের মতো বৈঠকে বসেছেন, যা এর আগে কখনো ঘটেনি। যদিও এই উদ্যোগ এখনো প্রাথমিক স্তরে এবং কিছুটা নড়বড়ে, এটি শুধু এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান ধর্মীয় বৈরী ভাব দূর করার সুযোগ তৈরি করবে না, বরং রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যে কয়েক দশকের রক্তপাতের ইতি টানার একটি সুবর্ণ সুযোগ হতে পারে।
তেহরান এই বৈঠকের পর থেকেই তাদের কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি সৌদি আরব সফর করেছেন, এছাড়াও তিনি ইরাক ও ওমান সফর করেছেন, যার লক্ষ্য ছিল দেশগুলোর মধ্যে চলমান উত্তেজনা প্রশমিত করা। এর বাইরেও তিনি জর্ডান, মিসর, এবং তুরস্ক সফর করেছেন। ইরানি সংবাদমাধ্যম ‘ইরনা’ জানিয়েছে, গত ১২ বছরের মধ্যে এই প্রথম কোনো ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিসর সফর করলেন, যা উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
গত ১৮ অক্টোবর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি তুরস্ক সফর করেন। ইস্তাম্বুলে পৌঁছে তিনি বলেন, “এই অঞ্চলে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে এবং গাজা-লেবাননের যুদ্ধ ও বাস্তুচ্যুত মানুষের দুর্ভোগ সম্পর্কে এখন আমাদের মধ্যে অভিন্ন ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।”
একই সময়ে, যখন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বারবার ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি অস্বীকার করছেন, সৌদি কর্মকর্তারা গণমাধ্যম থেকে শুরু করে কূটনৈতিক ফোরাম—সব জায়গাতেই দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরছেন। আরব বিশ্বের নেতা হিসেবে পরিচিত সৌদি আরবের বক্তব্য সুস্পষ্ট। তাদের অবস্থান হলো, ইসরাইল যদি সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চায়, তবে একমাত্র পথ হলো স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও তার স্বীকৃতি প্রদান।
গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে জীবন্ত চাপা পড়া শিশুদের মর্মান্তিক দৃশ্য, মৃত সন্তানের সামনে মায়েদের আহাজারি, এবং ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য খাদ্য প্রবেশে ইসরাইলি বাধার ছবি—এসবই সৌদি নেতৃত্বকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ইস্যু উপেক্ষা করা একপ্রকার অসম্ভব করে তুলেছে।
সৌদি ব্যবসায়ী, রাজ পরিবারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি এবং নিওম প্রকল্পের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য আলি শিহাবি বলেন, “গাজা যুদ্ধের পর যা ঘটেছে তা হলো—এই অঞ্চলে ইসরাইলের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি অনেকটাই পিছিয়ে গেছে।”
তিনি আরও বলেন, “সৌদি আরব দেখছে যে গাজার ঘটনার পর থেকে ইসরাইলের সাথে সম্পর্কের তিক্ততা ক্রমশ বিষাক্ত হয়ে উঠছে। ইসরাইল যদি তাদের অবস্থান পরিবর্তন না করে এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি আন্তরিক প্রতিশ্রুতি না দেখায়, তাহলে এই পরিস্থিতি খুব একটা বদলাবে না।”
তেহরান ও রিয়াদের মধ্যে সম্পর্কের ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেলেও, সৌদি আরব এবং তার উপসাগরীয় মিত্ররা ইরানের কূটনৈতিক পদক্ষেপের আন্তরিকতা নিয়ে এখনও সন্দিহান। এর মূল কারণ হলো, ইরান এখনও হামাস, হিজবুল্লাহ, এবং ইয়েমেনের হুতিদের অস্ত্র ও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, যারা অতীতে সৌদি আরবে হামলা চালিয়েছিল।
তবে এটি তেহরান ও রিয়াদের সম্পর্কের জন্য বাধা হবে না বলেই মনে করেন আলি শিহাব। তিনি বলেন, “ইরান যদি রিয়াদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়, সৌদি নেতৃত্ব তা কখনো প্রত্যাখ্যান করবে না। আর যদি ইরান সত্যিই আন্তরিক হয়, তবে এটি মধ্যপ্রাচ্যের একটি প্রকৃত পুনর্গঠনের সূচনা হবে।”
সৌদি আরব ও ইরান দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক আধিপত্যের জন্য লড়াই করে আসছে, যা মূলত ইসলামের প্রধান দুই শাখার—সুন্নি ও শিয়া—দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত। হামাস, হিজবুল্লাহ এবং হুতিরা ইরানের সেই আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন।
গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইল হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজায় যে ভয়াবহ আগ্রাসন শুরু করে, তা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে। এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৪৩ হাজারেরও বেশি নিরীহ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন, যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।
সৌদি রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের মতো, আলি শিহাবও মনে করেন যে সৌদি আরবে গণতন্ত্র না থাকলেও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান জনমতের প্রতি খুবই সংবেদনশীল। গত এক বছরে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সৌদি জনমত অনেকটাই কঠোর হয়ে উঠেছে, যা যুবরাজ মোহাম্মদকেও উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছে।
উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তরুণ। এই তরুণরা প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গাজার ইসরাইলি আগ্রাসনের নির্মম চিত্র দেখে আসছে, যা তাদের ইসরাইল সম্পর্কে সামান্য ইতিবাচক মনোভাবকেও ঘৃণায় পরিণত করেছে।
গত বছরের অক্টোবরের আগের মাসগুলোতে সৌদি আরব ইসরাইলের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের পরিকল্পনা করছিল। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রিয়াদের একটি বিস্তৃত প্রতিরক্ষা চুক্তি ও বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের কথা ছিল।
রিয়াদ দীর্ঘদিন ধরেই দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে সোচ্চার ছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতিতে এই বিষয়টির গুরুত্ব কিছুটা কমে গিয়েছিল।
গত বছর সৌদি আরব যখন ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনা শুরু করে, তখন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি শর্ত হিসেবে তোলেনি। বরং সে সময় রিয়াদ ইসরাইলের কাছ থেকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ ও আরো ক্ষমতা দেয়ার দাবি জানায়।
তবে গত এক বছরে গাজার পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন সৌদি আরবের দৃষ্টিভঙ্গিও পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। সম্প্রতি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান প্রকাশ্যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে কথা বলেছেন এবং রিয়াদের নতুন দাবি দাওয়ার বিষয়েও তাকে সোচ্চার দেখা গেছে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর উপদেষ্টা পরিষদে দেয়া এক ভাষণে যুবরাজ বলেন, “সৌদি আরব পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা বন্ধ করবে না এবং আমরা নিশ্চিত করছি যে, ইসরাইলের সাথে এটি ছাড়া কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে না।” একই ধরনের বক্তব্য তিনি ইউএস স্টেট অব দ্য ইউনিয়নেও দিয়েছিলেন।
গত মাসে ইরানের সাথে উপসাগরীয় দেশগুলোর বৈঠক এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হয়, যার কয়েকদিন আগেই তেহরান ইসরাইলে দ্বিতীয় দফা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল। ইরান ওই হামলায় ২০০’র বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে, যা মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা আরও গাজায় চলমান যুদ্ধ এবং ইসরাইলের সাম্প্রতিক আক্রমণগুলো আব্রাহাম অ্যাকর্ডে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোকেও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের পক্ষে কথা বলার জন্য বাধ্য করছে। বিশেষত, সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE), যারা গত কয়েক বছর ধরে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখলেও সাম্প্রতিক সময়ে সেই সম্পর্ক ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে পড়েছে। এর কারণ হলো এই অঞ্চলের জনমত, যা গাজার ঘটনার প্রেক্ষিতে ক্রমশ ইসরাইলের বিরুদ্ধে কঠোর হয়ে উঠছে।
এই চাপের প্রেক্ষিতে, আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ বিন জায়েদ গত মাসে মন্তব্য করেছেন যে গাজা পুনর্নির্মাণের ভার ইসরাইলের ওপরও বর্তাবে এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া গাজার পুনর্গঠনকে সমর্থন করবে না।
যদিও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দাবি করে যাচ্ছেন যে রিয়াদের সাথে একটি স্মারক চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া চলছে, সৌদি কর্মকর্তারা দেশের জনমতের বিবেচনায় সেই চুক্তিকে আপাতত গুরুত্ব দিচ্ছেন না। সৌদি আরবের নাগরিকদের মধ্যে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন এবং ইসরাইলের বিরোধিতা যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ওপরও প্রভাব ফেলেছে, এবং তিনি পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শর্ত ছাড়া ইসরাইলের সাথে কোনো চুক্তিতে যেতে রাজি নন।
এই পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যে কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার জটিলতা বাড়িয়ে তুলেছে, যেখানে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা গাজা যুদ্ধের কারণে বড় ধরনের বাধার মুখে পড়েছে।
সূত্র : বাসস