সময়: বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ক্ষুধা লাগলে মেজাজ খিটখিটে থাকে কেন?

সাজেদা আক্তার
  • Update Time : ০২:৪০:৫৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২ অক্টোবর ২০২৪
  • / ১২৮ Time View

ক্ষুধা লাগলে মেজাজ খিটখিটে থাকে কেন

ক্ষুধা লাগলে মেজাজ খিটখিটে হওয়া একটি সাধারণ শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া, যা মূলত শরীরে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু পরিবর্তনের কারণে ঘটে। প্রথমত, ক্ষুধার্ত অবস্থায় রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যায়, যা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং ফলে মেজাজের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এছাড়াও, ক্ষুধা লাগলে শরীরে স্ট্রেস হরমোন যেমন কোর্টিসল এবং অ্যাড্রেনালিনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা আমাদের আরও উত্তেজিত এবং উদ্বিগ্ন করে তোলে। সেরোটোনিনের মাত্রা কমে যাওয়াও মেজাজকে খারাপ করার একটি কারণ, কারণ এই রাসায়নিকটি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষুধার কারণে মনোযোগের অভাব দেখা দেয়, যার ফলে আমরা ছোটখাটো বিষয়েও বিরক্ত হয়ে পড়ি। দীর্ঘ সময় না খাওয়া শরীরে পুষ্টির ঘাটতি সৃষ্টি করে, যা মেজাজকে আরো খারাপ করে দেয়। সব মিলিয়ে, ক্ষুধা শরীর ও মনের উপর একসাথে প্রভাব ফেলতে শুরু করে এবং এর ফলে আমাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়।

 ১. রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যাওয়া

আমাদের শরীরের শক্তির প্রধান উৎস হলো গ্লুকোজ, যা প্রতিদিনের শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য অপরিহার্য। আমরা খাবার গ্রহণ করলে শরীর সেই খাবারকে গ্লুকোজে রূপান্তর করে, যা রক্তের মাধ্যমে শরীরের প্রতিটি কোষে পৌঁছে। গ্লুকোজ মস্তিষ্কের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান, কারণ মস্তিষ্ক তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে প্রচুর পরিমাণে গ্লুকোজ ব্যবহার করে। তবে, দীর্ঘ সময় না খেলে বা খাবারের অভাবে শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ দ্রুত কমতে থাকে, যা রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস করে। যখন রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যায়, মস্তিষ্ক প্রয়োজনীয় গ্লুকোজ পায় না, ফলে এর কর্মক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। মস্তিষ্কে গ্লুকোজের অভাব হলে মনোযোগ কমে যায়, তথ্য প্রক্রিয়াকরণে ধীরগতি আসে, এবং স্নায়ুবিক উত্তেজনা বেড়ে যায়। এ কারণে আমরা সহজেই ছোটখাটো বিষয় নিয়ে রেগে যাই, সংবেদনশীলতা হারাই, এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করতে না পারলে শরীরে স্ট্রেস হরমোনের উৎপাদন বেড়ে যায়, যা আমাদের মেজাজকে আরও খারাপ করে তোলে। ক্ষুধার কারণে এই প্রক্রিয়াটি আরও দ্রুত হয়, এবং ক্ষুধার্ত অবস্থায় মানুষ সাধারণত বেশি উত্তেজিত, উদ্বিগ্ন এবং অস্থির অনুভব করে।

 ২. হরমোনের পরিবর্তন

ক্ষুধা লাগলে শরীরে বেশ কিছু হরমোনের পরিবর্তন ঘটে, যা আমাদের মানসিক ও শারীরিক অবস্থার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে, ক্ষুধার্ত অবস্থায় কোর্টিসল এবং অ্যাড্রেনালিন নামক দুইটি গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। কোর্টিসল মূলত শরীরের স্ট্রেস প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। যখন শরীরে পর্যাপ্ত গ্লুকোজের অভাব হয়, তখন কোর্টিসল উৎপাদন বেড়ে যায়, যা শরীরকে অতিরিক্ত স্ট্রেসের মধ্যে ফেলে। একই সময়ে, অ্যাড্রেনালিনের মাত্রা বেড়ে গিয়ে শরীরকে “ফাইট-অর-ফ্লাইট” (Fight or Flight) অবস্থায় নিয়ে যায়, যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ও অস্থির করে তোলে। এই হরমোনের অতিরিক্ত স্রাব আমাদের মেজাজের স্থিতিশীলতাকে বিঘ্নিত করে এবং সামান্য বিরক্তি বা চাপের মুখে আমরা দ্রুত রেগে যাই। ক্ষুধা যখন দীর্ঘ সময় ধরে অব্যাহত থাকে, তখন এই হরমোনগুলোর প্রভাব আরও তীব্র হয়ে ওঠে, যা রাগ, হতাশা এবং মনস্তাত্ত্বিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। ফলে, ক্ষুধা লাগলে আমরা নিজের অজান্তেই মেজাজ খারাপ এবং খিটখিটে অনুভব করি।

 ৩. হাঙ্গার অ্যান্ড অ্যাংগার: ‘হ্যাঙ্গরি’ অনুভূতি

‘হ্যাঙ্গরি’ একটি জনপ্রিয় শব্দ যা ক্ষুধার্ত (hungry) এবং রাগান্বিত (angry) হওয়ার মিশ্র প্রতিক্রিয়াকে বোঝায়। ক্ষুধার কারণে শরীরে শারীরবৃত্তীয় এবং মানসিক পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে আমাদের আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। যখন আমরা দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকি, শরীরে গ্লুকোজের অভাব সৃষ্টি হয়, এবং এর প্রভাব সরাসরি মস্তিষ্কে পড়ে। এই সময়ে, মস্তিষ্ক পর্যাপ্ত শক্তি না পেয়ে আমাদের মধ্যে হতাশা ও রাগের অনুভূতি সৃষ্টি করে। এর পাশাপাশি, ক্ষুধার সময় শরীরের হরমোন যেমন কোর্টিসল এবং অ্যাড্রেনালিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা আমাদের আরও উত্তেজিত এবং চঞ্চল করে তোলে। এই অবস্থায় আমরা অল্পতেই রেগে যাই, এবং কোনো কিছুতে সন্তুষ্ট না হয়ে মেজাজ খিটখিটে হয়ে পড়ে। ‘হ্যাঙ্গরি’ অনুভূতিটি আসলে মস্তিষ্কের এক ধরণের প্রতিরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া, যা আমাদের ক্ষুধা মেটানোর জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে প্ররোচিত করে। এটি একটি প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া হলেও, বারবার এমন পরিস্থিতিতে পড়লে মানসিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সম্পর্কগুলোতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

 ৪. সেরোটোনিনের মাত্রা কমে যাওয়া

সেরোটোনিন হলো মস্তিষ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক, যা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং ভালো মেজাজ বজায় রাখতে সাহায্য করে। এটি প্রায়শই “হ্যাপি হরমোন” নামে পরিচিত, কারণ এটি আমাদের সুখ এবং প্রশান্তির অনুভূতির সঙ্গে জড়িত। যখন আমরা দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকি, তখন শরীরে গ্লুকোজের অভাবের পাশাপাশি সেরোটোনিনের মাত্রাও কমে যায়। সেরোটোনিনের এই হ্রাস আমাদের মানসিক অবস্থার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে, যার ফলে আমরা বিষণ্ণ, অস্বস্তিকর, এবং সহজেই বিরক্ত বোধ করতে শুরু করি। সেরোটোনিনের অভাবে আমরা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খিটখিটে হয়ে যাই এবং ক্ষুধা লাগলে এই অনুভূতিগুলো আরও তীব্র হয়ে ওঠে। এটি শুধু মেজাজ খারাপ করে না, বরং মানসিক স্থিতিশীলতাও বিঘ্নিত করে। ফলে, ক্ষুধা থেকে সৃষ্ট সেরোটোনিনের ঘাটতি আমাদের মেজাজকে দ্রুত খারাপের দিকে নিয়ে যায়, যা দৈনন্দিন কাজকর্মে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

 ৫. মনোযোগের অভাব

ক্ষুধা অনুভব করলে আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়, ফলে মনোযোগ ধরে রাখা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। মস্তিষ্কের সঠিক কার্যক্রমের জন্য গ্লুকোজ একটি অপরিহার্য উপাদান, যা শরীরের খাদ্য থেকে আসে। যখন আমরা খাবার গ্রহণ করতে বিলম্ব করি বা দীর্ঘ সময় ক্ষুধার্ত থাকি, তখন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যায়, এবং মস্তিষ্ক পর্যাপ্ত শক্তি পায় না। এর ফলে, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যায়, এবং মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা কঠিন হয়ে যায়। এই সময়ে, আমাদের মন এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে না, এবং আমরা সহজেই নানা ধরনের চিন্তা ও উদ্বেগে আক্রান্ত হয়ে পড়ি।

মনোযোগের অভাব মানসিক চাপ সৃষ্টি করে এবং আমাদের আবেগপ্রবণ করে তোলে। যেকোনো ছোটখাটো ঘটনা বা পরিস্থিতি আমাদের প্রতিক্রিয়ায় অতিরিক্ত তীব্রতা নিয়ে আসতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যখন কেউ আমাদের সাথে অস্বাভাবিকভাবে কথা বলে বা আমাদেরকে কিছু জিজ্ঞেস করে, তখন আমরা সেটা অতি সাধারণভাবে নাও নিতে পারি এবং চট করে রেগে যেতে পারি। এই মনোযোগের অভাব আমাদের সামাজিক সম্পর্কগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে, কারণ আমরা বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের প্রতি ধৈর্যহীন হয়ে পড়ি। এছাড়াও, ক্ষুধার কারণে আমাদের কাজে ফোকাস হারিয়ে যেতে পারে, যা আমাদের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং চাপের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। ফলে, ক্ষুধার সময় এই মনোযোগের অভাব শুধু আমাদের মানসিক অবস্থার ওপরই নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিকেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

 ৬. পুষ্টির ঘাটতি

শরীরে নিয়মিত পুষ্টির ঘাটতি হলে, বিশেষ করে যদি প্রোটিন এবং শর্করা যথেষ্ট পরিমাণে না পাওয়া যায়, তখন ক্ষুধার অনুভূতি আমাদের মানসিক অবস্থায় গুরুতর প্রভাব ফেলে। পুষ্টির অভাবের কারণে শরীরের শক্তির স্তর কমে যায় এবং এটি শরীরকে অস্থির করে তোলে। যখন আমরা প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানগুলো যেমন ভিটামিন, মিনারেল, প্রোটিন, এবং শর্করা যথেষ্ট পরিমাণে গ্রহণ করি না, তখন আমাদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে কমে যেতে পারে। এই গ্লুকোজের ঘাটতি আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতাকে প্রভাবিত করে, ফলে মনোযোগ, স্মৃতি, এবং চিন্তার প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে।

যখন শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে পড়ে, তখন এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংকেত পাঠাতে শুরু করে। এই সংকেতগুলো আমাদের ক্ষুধা লাগার অনুভূতি দেয়, কিন্তু সেইসাথে মেজাজ খারাপ করতেও সাহায্য করে। এর ফলে, আমরা অনেক দ্রুত অস্থির এবং বিরক্ত হয়ে পড়ি। এছাড়াও, পুষ্টির ঘাটতি আমাদের শরীরের স্বাভাবিক হরমোনের ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করে, যার ফলে আমাদের আবেগ ও মনোভাবেও পরিবর্তন আসে। যে কারণে, ক্ষুধার সময় এই পুষ্টির অভাব আমাদের মেজাজ খিটখিটে করে তোলে এবং সামগ্রিক মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পুষ্টির ঘাটতির কারণে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হতে পারে, যা আমাদের শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতার জন্য ক্ষতিকর।

 ৭. স্ট্রেসের সাথে ক্ষুধার সংযোগ

মানসিক চাপ বা স্ট্রেস আমাদের শরীরে বেশ কিছু শারীরবৃত্তীয় এবং হরমোনাল পরিবর্তন ঘটায়, যা ক্ষুধার অনুভূতিকে বাড়িয়ে তোলে। যখন আমরা স্ট্রেসে থাকি, তখন শরীরের কোর্টিসল হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উচ্চ কোর্টিসল স্তরের ফলে আমাদের শরীরের শক্তির জন্য খাবারের প্রয়োজন বাড়তে থাকে, এবং এটি আমাদের ক্ষুধা অনুভূতিকে আরও তীব্র করে তোলে। এ সময়, আমাদের মস্তিষ্ককে শক্তি সরবরাহ করার জন্য প্রয়োজনীয় গ্লুকোজের চাহিদা বেড়ে যায়, ফলে আমরা খাবারের জন্য তীব্রভাবে আকৃষ্ট হই।

অন্যদিকে, এই হরমোনাল পরিবর্তন শুধু ক্ষুধাকে প্রভাবিত করে না, বরং আমাদের মানসিক অবস্থাকেও খারাপ করে তোলে। স্ট্রেসের সময় মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় এবং ছোটখাটো বিষয়েও আমরা অসন্তুষ্ট বোধ করি। এটি একটি চক্র সৃষ্টি করে, যেখানে ক্ষুধা এবং স্ট্রেস একে অপরকে বাড়িয়ে তোলে। ফলস্বরূপ, আমরা দ্রুত রেগে যাই, যা আমাদের কাজকর্ম এবং সম্পর্কগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অতএব, স্ট্রেসের সাথে ক্ষুধার এই সংযোগ আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এবং এটি মোকাবেলা করার জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

 ৮. স্বল্প বিশ্রামের প্রভাব

যদি আমরা পর্যাপ্ত বিশ্রাম বা ঘুম না পাই, তবে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে, যা আমাদের মেজাজকে ক্ষুণ্ণ করে। ক্লান্তির এই অবস্থায়, যখন ক্ষুধা অনুভব করি, তখন আমাদের মেজাজ আরও খিটখিটে হয়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ঘুমের অভাব আমাদের শরীরের হরমোনাল ভারসাম্যকে প্রভাবিত করে, বিশেষ করে গ্রেলিন এবং লেপ্টিন হরমোন, যা ক্ষুধা এবং সন্তুষ্টির অনুভূতির সাথে সম্পর্কিত। ঘুমের অভাবে গ্রেলিনের মাত্রা বাড়ে, ফলে আমাদের ক্ষুধা বেড়ে যায়, এবং লেপ্টিনের মাত্রা কমে যায়, যা আমাদের তৃপ্তির অনুভূতিকে হ্রাস করে।

ক্লান্তির কারণে আমাদের মানসিক অবস্থার ওপরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যখন শরীর ইতিমধ্যেই ক্লান্ত থাকে, তখন ক্ষুধা অনুভব করলে এটি আরও চাপ তৈরি করে এবং মেজাজ খারাপ করে তোলে। এ সময়, আমরা অল্পতেই বিরক্তি প্রকাশ করতে শুরু করি এবং দৈনন্দিন কাজে মনোযোগ হারিয়ে ফেলি। ঘুমের অভাবে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়, ফলে চিন্তা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও কমে যায়। সুতরাং, স্বল্প বিশ্রামের প্রভাবের ফলে ক্ষুধার সময় আমাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠে, যা আমাদের সামাজিক জীবন এবং কাজের দক্ষতা উভয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিশ্চিত করা আমাদের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে অপরিহার্য।

 সমাধান

ক্ষুধা লাগলে মেজাজ খারাপ হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিয়মিত এবং পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। পুষ্টিকর খাবার আমাদের শরীরের শক্তি বজায় রাখতে এবং গ্লুকোজের স্বাভাবিক মাত্রা রক্ষা করতে সহায়ক। এজন্য আমাদের খাদ্য তালিকায় বিভিন্ন ধরনের ফল, শাকসবজি, প্রোটিন, এবং স্বাস্থ্যকর শর্করা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, ফলমূল যেমন আপেল, কলা, এবং বেরি শরীরকে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেল সরবরাহ করে, যা আমাদের মেজাজ ভালো রাখতে সাহায্য করে। শাকসবজির মধ্যে পালং শাক, ব্রোকোলি, এবং গাজর ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যা শরীরের জন্য পুষ্টি এবং ফাইবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

এছাড়াও, প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন মুরগি, মাছ, ডিম, এবং দুধ আমাদের শরীরে শক্তি যোগায় এবং ক্ষুধার অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। স্বাস্থ্যকর শর্করা যেমন ওটস, বাদাম, এবং গোটা শস্য আমাদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে, ফলে আমরা ক্ষুধার অনুভূতি কম অনুভব করি এবং মেজাজ খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।

পর্যাপ্ত বিশ্রামও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন প্রাপ্তবয়স্কের জন্য প্রতি রাতে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো স্বাস্থ্যকর এবং এটি মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায়। ঘুমের অভাব আমাদের শরীরকে ক্লান্ত করে তোলে, যা মেজাজ খারাপ করতে সহায়ক। পর্যাপ্ত ঘুম আমাদের মনোযোগ বাড়ায় এবং স্ট্রেসের স্তর কমাতে সাহায্য করে, ফলে ক্ষুধার সময় অস্থিরতার অনুভূতি কমে যায়।

এছাড়াও, পর্যাপ্ত পানি পান করা শরীরের হাইড্রেশন বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং ক্ষুধা অনুভূতির প্রভাব কমাতে সহায়ক। দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা উচিত, যা শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রমে সাহায্য করে এবং মনোযোগ বজায় রাখতে সহায়তা করে। যথেষ্ট পানি পান করলে শরীরে টক্সিন পরিষ্কার হয় এবং মেটাবলিজম উন্নত হয়, ফলে শরীর তাজা ও প্রাণবন্ত থাকে।

এভাবে, নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাবার, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, এবং সঠিক পরিমাণে পানি পান করলে ক্ষুধা লাগার সময় মেজাজ খারাপ হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এটি আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলো অনুসরণ করলে আমরা শুধু ক্ষুধার সময়ই নয়, সার্বিকভাবে সুস্থ ও প্রফুল্ল থাকতে পারি, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

সাজেদা আক্তার

সাজেদা আক্তার একজন বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী এবং দক্ষ কলামিস্ট, যিনি সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বিডিবো নিউজে, তিনি সমাজ, পরিবার এবং জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লেখেন। একজন অভিজ্ঞ কলামিস্ট হিসেবে, তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় সমাজিক বিষয়, পারিবারিক গতিশীলতা এবং বিভিন্ন জীবনধারা সম্পর্কিত ভাবনাপ্রসূত বিষয়গুলি নিয়ে লেখেন। সামাজিক প্রবণতাগুলি বিশ্লেষণ ও প্রকাশ করার ক্ষেত্রে তার দক্ষতা তাকে এই ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্থান দিয়েছে। সাজেদা আক্তারের কাজ শুধু পাঠকদের তথ্য প্রদান করে না, বরং তাদের অনুপ্রাণিতও করে, যা তাকে সাংবাদিকতা এবং সমাজবিজ্ঞানের জগতে সম্মানিত একটি কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

ক্ষুধা লাগলে মেজাজ খিটখিটে থাকে কেন?

Update Time : ০২:৪০:৫৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২ অক্টোবর ২০২৪

ক্ষুধা লাগলে মেজাজ খিটখিটে হওয়া একটি সাধারণ শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া, যা মূলত শরীরে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু পরিবর্তনের কারণে ঘটে। প্রথমত, ক্ষুধার্ত অবস্থায় রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যায়, যা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং ফলে মেজাজের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এছাড়াও, ক্ষুধা লাগলে শরীরে স্ট্রেস হরমোন যেমন কোর্টিসল এবং অ্যাড্রেনালিনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা আমাদের আরও উত্তেজিত এবং উদ্বিগ্ন করে তোলে। সেরোটোনিনের মাত্রা কমে যাওয়াও মেজাজকে খারাপ করার একটি কারণ, কারণ এই রাসায়নিকটি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষুধার কারণে মনোযোগের অভাব দেখা দেয়, যার ফলে আমরা ছোটখাটো বিষয়েও বিরক্ত হয়ে পড়ি। দীর্ঘ সময় না খাওয়া শরীরে পুষ্টির ঘাটতি সৃষ্টি করে, যা মেজাজকে আরো খারাপ করে দেয়। সব মিলিয়ে, ক্ষুধা শরীর ও মনের উপর একসাথে প্রভাব ফেলতে শুরু করে এবং এর ফলে আমাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়।

 ১. রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যাওয়া

আমাদের শরীরের শক্তির প্রধান উৎস হলো গ্লুকোজ, যা প্রতিদিনের শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য অপরিহার্য। আমরা খাবার গ্রহণ করলে শরীর সেই খাবারকে গ্লুকোজে রূপান্তর করে, যা রক্তের মাধ্যমে শরীরের প্রতিটি কোষে পৌঁছে। গ্লুকোজ মস্তিষ্কের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান, কারণ মস্তিষ্ক তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে প্রচুর পরিমাণে গ্লুকোজ ব্যবহার করে। তবে, দীর্ঘ সময় না খেলে বা খাবারের অভাবে শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ দ্রুত কমতে থাকে, যা রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস করে। যখন রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যায়, মস্তিষ্ক প্রয়োজনীয় গ্লুকোজ পায় না, ফলে এর কর্মক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। মস্তিষ্কে গ্লুকোজের অভাব হলে মনোযোগ কমে যায়, তথ্য প্রক্রিয়াকরণে ধীরগতি আসে, এবং স্নায়ুবিক উত্তেজনা বেড়ে যায়। এ কারণে আমরা সহজেই ছোটখাটো বিষয় নিয়ে রেগে যাই, সংবেদনশীলতা হারাই, এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করতে না পারলে শরীরে স্ট্রেস হরমোনের উৎপাদন বেড়ে যায়, যা আমাদের মেজাজকে আরও খারাপ করে তোলে। ক্ষুধার কারণে এই প্রক্রিয়াটি আরও দ্রুত হয়, এবং ক্ষুধার্ত অবস্থায় মানুষ সাধারণত বেশি উত্তেজিত, উদ্বিগ্ন এবং অস্থির অনুভব করে।

 ২. হরমোনের পরিবর্তন

ক্ষুধা লাগলে শরীরে বেশ কিছু হরমোনের পরিবর্তন ঘটে, যা আমাদের মানসিক ও শারীরিক অবস্থার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে, ক্ষুধার্ত অবস্থায় কোর্টিসল এবং অ্যাড্রেনালিন নামক দুইটি গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। কোর্টিসল মূলত শরীরের স্ট্রেস প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। যখন শরীরে পর্যাপ্ত গ্লুকোজের অভাব হয়, তখন কোর্টিসল উৎপাদন বেড়ে যায়, যা শরীরকে অতিরিক্ত স্ট্রেসের মধ্যে ফেলে। একই সময়ে, অ্যাড্রেনালিনের মাত্রা বেড়ে গিয়ে শরীরকে “ফাইট-অর-ফ্লাইট” (Fight or Flight) অবস্থায় নিয়ে যায়, যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ও অস্থির করে তোলে। এই হরমোনের অতিরিক্ত স্রাব আমাদের মেজাজের স্থিতিশীলতাকে বিঘ্নিত করে এবং সামান্য বিরক্তি বা চাপের মুখে আমরা দ্রুত রেগে যাই। ক্ষুধা যখন দীর্ঘ সময় ধরে অব্যাহত থাকে, তখন এই হরমোনগুলোর প্রভাব আরও তীব্র হয়ে ওঠে, যা রাগ, হতাশা এবং মনস্তাত্ত্বিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। ফলে, ক্ষুধা লাগলে আমরা নিজের অজান্তেই মেজাজ খারাপ এবং খিটখিটে অনুভব করি।

 ৩. হাঙ্গার অ্যান্ড অ্যাংগার: ‘হ্যাঙ্গরি’ অনুভূতি

‘হ্যাঙ্গরি’ একটি জনপ্রিয় শব্দ যা ক্ষুধার্ত (hungry) এবং রাগান্বিত (angry) হওয়ার মিশ্র প্রতিক্রিয়াকে বোঝায়। ক্ষুধার কারণে শরীরে শারীরবৃত্তীয় এবং মানসিক পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে আমাদের আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। যখন আমরা দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকি, শরীরে গ্লুকোজের অভাব সৃষ্টি হয়, এবং এর প্রভাব সরাসরি মস্তিষ্কে পড়ে। এই সময়ে, মস্তিষ্ক পর্যাপ্ত শক্তি না পেয়ে আমাদের মধ্যে হতাশা ও রাগের অনুভূতি সৃষ্টি করে। এর পাশাপাশি, ক্ষুধার সময় শরীরের হরমোন যেমন কোর্টিসল এবং অ্যাড্রেনালিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা আমাদের আরও উত্তেজিত এবং চঞ্চল করে তোলে। এই অবস্থায় আমরা অল্পতেই রেগে যাই, এবং কোনো কিছুতে সন্তুষ্ট না হয়ে মেজাজ খিটখিটে হয়ে পড়ে। ‘হ্যাঙ্গরি’ অনুভূতিটি আসলে মস্তিষ্কের এক ধরণের প্রতিরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া, যা আমাদের ক্ষুধা মেটানোর জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে প্ররোচিত করে। এটি একটি প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া হলেও, বারবার এমন পরিস্থিতিতে পড়লে মানসিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সম্পর্কগুলোতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

 ৪. সেরোটোনিনের মাত্রা কমে যাওয়া

সেরোটোনিন হলো মস্তিষ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক, যা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং ভালো মেজাজ বজায় রাখতে সাহায্য করে। এটি প্রায়শই “হ্যাপি হরমোন” নামে পরিচিত, কারণ এটি আমাদের সুখ এবং প্রশান্তির অনুভূতির সঙ্গে জড়িত। যখন আমরা দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকি, তখন শরীরে গ্লুকোজের অভাবের পাশাপাশি সেরোটোনিনের মাত্রাও কমে যায়। সেরোটোনিনের এই হ্রাস আমাদের মানসিক অবস্থার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে, যার ফলে আমরা বিষণ্ণ, অস্বস্তিকর, এবং সহজেই বিরক্ত বোধ করতে শুরু করি। সেরোটোনিনের অভাবে আমরা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খিটখিটে হয়ে যাই এবং ক্ষুধা লাগলে এই অনুভূতিগুলো আরও তীব্র হয়ে ওঠে। এটি শুধু মেজাজ খারাপ করে না, বরং মানসিক স্থিতিশীলতাও বিঘ্নিত করে। ফলে, ক্ষুধা থেকে সৃষ্ট সেরোটোনিনের ঘাটতি আমাদের মেজাজকে দ্রুত খারাপের দিকে নিয়ে যায়, যা দৈনন্দিন কাজকর্মে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

 ৫. মনোযোগের অভাব

ক্ষুধা অনুভব করলে আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়, ফলে মনোযোগ ধরে রাখা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। মস্তিষ্কের সঠিক কার্যক্রমের জন্য গ্লুকোজ একটি অপরিহার্য উপাদান, যা শরীরের খাদ্য থেকে আসে। যখন আমরা খাবার গ্রহণ করতে বিলম্ব করি বা দীর্ঘ সময় ক্ষুধার্ত থাকি, তখন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যায়, এবং মস্তিষ্ক পর্যাপ্ত শক্তি পায় না। এর ফলে, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যায়, এবং মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা কঠিন হয়ে যায়। এই সময়ে, আমাদের মন এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে না, এবং আমরা সহজেই নানা ধরনের চিন্তা ও উদ্বেগে আক্রান্ত হয়ে পড়ি।

মনোযোগের অভাব মানসিক চাপ সৃষ্টি করে এবং আমাদের আবেগপ্রবণ করে তোলে। যেকোনো ছোটখাটো ঘটনা বা পরিস্থিতি আমাদের প্রতিক্রিয়ায় অতিরিক্ত তীব্রতা নিয়ে আসতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যখন কেউ আমাদের সাথে অস্বাভাবিকভাবে কথা বলে বা আমাদেরকে কিছু জিজ্ঞেস করে, তখন আমরা সেটা অতি সাধারণভাবে নাও নিতে পারি এবং চট করে রেগে যেতে পারি। এই মনোযোগের অভাব আমাদের সামাজিক সম্পর্কগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে, কারণ আমরা বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের প্রতি ধৈর্যহীন হয়ে পড়ি। এছাড়াও, ক্ষুধার কারণে আমাদের কাজে ফোকাস হারিয়ে যেতে পারে, যা আমাদের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং চাপের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। ফলে, ক্ষুধার সময় এই মনোযোগের অভাব শুধু আমাদের মানসিক অবস্থার ওপরই নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিকেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

 ৬. পুষ্টির ঘাটতি

শরীরে নিয়মিত পুষ্টির ঘাটতি হলে, বিশেষ করে যদি প্রোটিন এবং শর্করা যথেষ্ট পরিমাণে না পাওয়া যায়, তখন ক্ষুধার অনুভূতি আমাদের মানসিক অবস্থায় গুরুতর প্রভাব ফেলে। পুষ্টির অভাবের কারণে শরীরের শক্তির স্তর কমে যায় এবং এটি শরীরকে অস্থির করে তোলে। যখন আমরা প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানগুলো যেমন ভিটামিন, মিনারেল, প্রোটিন, এবং শর্করা যথেষ্ট পরিমাণে গ্রহণ করি না, তখন আমাদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে কমে যেতে পারে। এই গ্লুকোজের ঘাটতি আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতাকে প্রভাবিত করে, ফলে মনোযোগ, স্মৃতি, এবং চিন্তার প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে।

যখন শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে পড়ে, তখন এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংকেত পাঠাতে শুরু করে। এই সংকেতগুলো আমাদের ক্ষুধা লাগার অনুভূতি দেয়, কিন্তু সেইসাথে মেজাজ খারাপ করতেও সাহায্য করে। এর ফলে, আমরা অনেক দ্রুত অস্থির এবং বিরক্ত হয়ে পড়ি। এছাড়াও, পুষ্টির ঘাটতি আমাদের শরীরের স্বাভাবিক হরমোনের ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করে, যার ফলে আমাদের আবেগ ও মনোভাবেও পরিবর্তন আসে। যে কারণে, ক্ষুধার সময় এই পুষ্টির অভাব আমাদের মেজাজ খিটখিটে করে তোলে এবং সামগ্রিক মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পুষ্টির ঘাটতির কারণে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হতে পারে, যা আমাদের শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতার জন্য ক্ষতিকর।

 ৭. স্ট্রেসের সাথে ক্ষুধার সংযোগ

মানসিক চাপ বা স্ট্রেস আমাদের শরীরে বেশ কিছু শারীরবৃত্তীয় এবং হরমোনাল পরিবর্তন ঘটায়, যা ক্ষুধার অনুভূতিকে বাড়িয়ে তোলে। যখন আমরা স্ট্রেসে থাকি, তখন শরীরের কোর্টিসল হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উচ্চ কোর্টিসল স্তরের ফলে আমাদের শরীরের শক্তির জন্য খাবারের প্রয়োজন বাড়তে থাকে, এবং এটি আমাদের ক্ষুধা অনুভূতিকে আরও তীব্র করে তোলে। এ সময়, আমাদের মস্তিষ্ককে শক্তি সরবরাহ করার জন্য প্রয়োজনীয় গ্লুকোজের চাহিদা বেড়ে যায়, ফলে আমরা খাবারের জন্য তীব্রভাবে আকৃষ্ট হই।

অন্যদিকে, এই হরমোনাল পরিবর্তন শুধু ক্ষুধাকে প্রভাবিত করে না, বরং আমাদের মানসিক অবস্থাকেও খারাপ করে তোলে। স্ট্রেসের সময় মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় এবং ছোটখাটো বিষয়েও আমরা অসন্তুষ্ট বোধ করি। এটি একটি চক্র সৃষ্টি করে, যেখানে ক্ষুধা এবং স্ট্রেস একে অপরকে বাড়িয়ে তোলে। ফলস্বরূপ, আমরা দ্রুত রেগে যাই, যা আমাদের কাজকর্ম এবং সম্পর্কগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অতএব, স্ট্রেসের সাথে ক্ষুধার এই সংযোগ আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এবং এটি মোকাবেলা করার জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

 ৮. স্বল্প বিশ্রামের প্রভাব

যদি আমরা পর্যাপ্ত বিশ্রাম বা ঘুম না পাই, তবে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে, যা আমাদের মেজাজকে ক্ষুণ্ণ করে। ক্লান্তির এই অবস্থায়, যখন ক্ষুধা অনুভব করি, তখন আমাদের মেজাজ আরও খিটখিটে হয়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ঘুমের অভাব আমাদের শরীরের হরমোনাল ভারসাম্যকে প্রভাবিত করে, বিশেষ করে গ্রেলিন এবং লেপ্টিন হরমোন, যা ক্ষুধা এবং সন্তুষ্টির অনুভূতির সাথে সম্পর্কিত। ঘুমের অভাবে গ্রেলিনের মাত্রা বাড়ে, ফলে আমাদের ক্ষুধা বেড়ে যায়, এবং লেপ্টিনের মাত্রা কমে যায়, যা আমাদের তৃপ্তির অনুভূতিকে হ্রাস করে।

ক্লান্তির কারণে আমাদের মানসিক অবস্থার ওপরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যখন শরীর ইতিমধ্যেই ক্লান্ত থাকে, তখন ক্ষুধা অনুভব করলে এটি আরও চাপ তৈরি করে এবং মেজাজ খারাপ করে তোলে। এ সময়, আমরা অল্পতেই বিরক্তি প্রকাশ করতে শুরু করি এবং দৈনন্দিন কাজে মনোযোগ হারিয়ে ফেলি। ঘুমের অভাবে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়, ফলে চিন্তা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও কমে যায়। সুতরাং, স্বল্প বিশ্রামের প্রভাবের ফলে ক্ষুধার সময় আমাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠে, যা আমাদের সামাজিক জীবন এবং কাজের দক্ষতা উভয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিশ্চিত করা আমাদের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে অপরিহার্য।

 সমাধান

ক্ষুধা লাগলে মেজাজ খারাপ হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিয়মিত এবং পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। পুষ্টিকর খাবার আমাদের শরীরের শক্তি বজায় রাখতে এবং গ্লুকোজের স্বাভাবিক মাত্রা রক্ষা করতে সহায়ক। এজন্য আমাদের খাদ্য তালিকায় বিভিন্ন ধরনের ফল, শাকসবজি, প্রোটিন, এবং স্বাস্থ্যকর শর্করা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, ফলমূল যেমন আপেল, কলা, এবং বেরি শরীরকে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেল সরবরাহ করে, যা আমাদের মেজাজ ভালো রাখতে সাহায্য করে। শাকসবজির মধ্যে পালং শাক, ব্রোকোলি, এবং গাজর ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যা শরীরের জন্য পুষ্টি এবং ফাইবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

এছাড়াও, প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন মুরগি, মাছ, ডিম, এবং দুধ আমাদের শরীরে শক্তি যোগায় এবং ক্ষুধার অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। স্বাস্থ্যকর শর্করা যেমন ওটস, বাদাম, এবং গোটা শস্য আমাদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে, ফলে আমরা ক্ষুধার অনুভূতি কম অনুভব করি এবং মেজাজ খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।

পর্যাপ্ত বিশ্রামও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন প্রাপ্তবয়স্কের জন্য প্রতি রাতে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো স্বাস্থ্যকর এবং এটি মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায়। ঘুমের অভাব আমাদের শরীরকে ক্লান্ত করে তোলে, যা মেজাজ খারাপ করতে সহায়ক। পর্যাপ্ত ঘুম আমাদের মনোযোগ বাড়ায় এবং স্ট্রেসের স্তর কমাতে সাহায্য করে, ফলে ক্ষুধার সময় অস্থিরতার অনুভূতি কমে যায়।

এছাড়াও, পর্যাপ্ত পানি পান করা শরীরের হাইড্রেশন বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং ক্ষুধা অনুভূতির প্রভাব কমাতে সহায়ক। দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা উচিত, যা শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রমে সাহায্য করে এবং মনোযোগ বজায় রাখতে সহায়তা করে। যথেষ্ট পানি পান করলে শরীরে টক্সিন পরিষ্কার হয় এবং মেটাবলিজম উন্নত হয়, ফলে শরীর তাজা ও প্রাণবন্ত থাকে।

এভাবে, নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাবার, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, এবং সঠিক পরিমাণে পানি পান করলে ক্ষুধা লাগার সময় মেজাজ খারাপ হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এটি আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলো অনুসরণ করলে আমরা শুধু ক্ষুধার সময়ই নয়, সার্বিকভাবে সুস্থ ও প্রফুল্ল থাকতে পারি, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।