সময়: বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

“পতিত সরকারের অনুগত আমলারা বর্তমান সরকারকে সফল হতে দিতে চায় না”: সাক্ষাৎকারে ড. নুরুল আমিন বেপারী

ডিজিটাল ডেস্ক
  • Update Time : ১০:৪৬:০৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর ২০২৪
  • / ৯৭ Time View

ড. নুরুল আমিন বেপারী

ড. নুরুল আমিন বেপারী

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নুরুল আমিন বেপারীর মতে, পূর্ববর্তী সরকারের আমলারা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সফল দেখতে চায় না। তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে আমলাদের যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, যার ফলস্বরূপ তারা সরকার পরিবর্তনের সময় জটিল পরিস্থিতিতে সংকট সৃষ্টি করেছে। কারণ, যত বেশি মৃত্যু ঘটবে, তত বেশি তারা পুরস্কৃত হবে। তিনি উল্লেখ করেন যে, পুলিশের মতো একটি সুশৃঙ্খল সংস্থাকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। যারা এখনো কাজ করছে, তারা পতিত সরকারের প্রতি অনুগত এবং সেই সরকারের লোকেরা চায় না যে বর্তমান সরকার সফল হোক।

তিনি আরও বলেন, ৫ই আগস্টের পরে পুলিশের যে অবস্থায় পৌঁছেছে, তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। এমনকি পাকিস্তান আমলেও এমনটি দেখা যায়নি। তাই বর্তমান পুলিশ ও আমলারা সরকারকে মন থেকে সমর্থন করতে পারছে না, যার কারণে এই বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। মানবজমিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রফেসর নুরুল আমিন বেপারী আরও বলেন, একটি প্রতিষ্ঠান একটি গাছের মতো। যত বেশি সময় ও যত্ন পাবে, ততই শক্তিশালী হবে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিকাশের সুযোগ দেওয়া হয়নি, যার ফলে গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হয়েছে। শেখ হাসিনা ওয়াজেদ দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষতি করেছেন, যার কারণে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সময় তিনি গণতান্ত্রিক উপায়ে সংকটের সমাধান করতে পারেননি।

তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভালোভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। যদিও কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপের জন্য জনগণ প্রশংসা করছে, তবে পরিস্থিতির মূল ডায়নামিকগুলো বুঝতে হবে। তিনি বলেন, কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিস্ট সরকারের হাত থেকে জনগণ মুক্তি পেয়েছে, যেখানে বাকস্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা ছিল না। সেই সময় গুম, খুন, হত্যা ও লুটপাট চলত। সেই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে। গণতন্ত্র মানে সমালোচনা এবং আত্মসমালোচনার সুযোগ প্রদান করা, যা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে এই পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি।

এক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, বর্তমান সরকারটি অভ্যুত্থানের ফসল, বিপ্লবের নয়। তিনি ব্যাখ্যা করেন, যদিও কিছু লোক এটিকে বিপ্লবের সরকার বলছেন, তবে পার্টি ছাড়া বিপ্লব সম্ভব নয়। এখানে ছাত্র ও জনগণের অভ্যুত্থান ঘটেছে, যার ফলস্বরূপ ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতায় এসেছেন। এই অভ্যুত্থানের ফল হিসেবে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন এবং মানুষ এতে খুশি হয়েছে। কিন্তু তাদের অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকলেও সব কিছু তিনি চাইলেই করতে পারেন না। ব্যক্তিগত জীবনে দেড়-দুই মাস হয়তো যথেষ্ট সময়, কিন্তু একটি জাতির জন্য এটি যথেষ্ট নয়। কিছু ইতিবাচক কাজ হলেও বিভিন্ন নিয়োগ নিয়ে ইতিমধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি বলেন, ড. ইউনূসের প্রশাসনিক যাত্রা ভালোভাবে হয়নি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে যে মৃত্যু ঘটেছে, তা সবাইকে নাড়া দিয়েছে এবং সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। তিনি মনে করেন, যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ নিয়োগ পেত, তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না।

ড. ইউনূস সেনাবাহিনী নামানোর বিষয়ে বলেন, তিনি ম্যাজেস্ট্রিসি পাওয়ার ব্যবহার করে সেনাবাহিনী নামিয়েছেন, কিন্তু এটি ৮ই আগস্টেই করতে পারতেন। এর ফলে অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। তিনি উল্লেখ করেন যে, ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের সময় ল’ অ্যান্ড অর্ডার ভালো ছিল, যদিও সেই সরকারকে সবাই পছন্দ করতেন না।

সংস্কার কমিশন নিয়ে তিনি বলেন, কিছু সদস্য শুরুতেই বিতর্ক তৈরি করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন যে, আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন বৈধ হবে না। কিন্তু এমন বক্তব্য বলার আগে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। সাখাওয়াত হোসেনও বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। তাদের বক্তব্য নিরপেক্ষ এবং বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে উপস্থাপন করা উচিত, কারণ তাদের কথার মূল্য অনেক।

তিনি সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে বলেন, এটি রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ, এবং যদি পুনর্লিখন করতে হয়, তাহলে জাতীয় বিপ্লবী সরকার গঠনের প্রয়োজন ছিল। কমিশনের তৈরি সংবিধান পাস করতে হলে সংসদে প্রয়োজন, কিন্তু বর্তমান সংসদে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ থাকবে না। তাই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

এছাড়া তিনি বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এই ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে একটি শিক্ষা হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বিএনপি’র পূর্বের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং দেশের ইন্সটিটিউশনগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। আওয়ামী লীগের দুর্নীতির কাজগুলো দখল করা বিএনপি’র জন্য বড় ভুল হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বড় সংস্কার আনতে হবে এবং দেশপ্রেমিক পুঁজিপতিদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে বিদেশে কাজ করা শ্রমিকরা রেমিট্যান্স পাঠায়, কিন্তু কিছু চোর সেই টাকা পাচার করে দেয়। দেশের পুঁজিকে পাচার না করে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করতে হবে। দক্ষ শ্রমিক তৈরি না করতে পারলে বিদেশি শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করতে হবে, যা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির কারণ হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ প্রফেসর বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোকে সমালোচনা ও আত্মসমালোচনার চর্চা করতে হবে, তবে তা দলীয় কাঠামোর ভেতরে করতে হবে, বাইরে নয়। তিনি আরও উল্লেখ করেন, দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ বন্ধ করা উচিত। তারেক রহমানের প্রস্তাবের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “পর পর” না হলেও বিরতি দিয়ে আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ থাকবে, যা জনগণ মেনে নেবে না।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি ও নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন যে, ভারত আওয়ামী লীগকে বিভিন্ন অপকর্মে সহায়তা করেছে, যার কারণে ভারতের প্রতি জনগণের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপিসহ সব দলকেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে জনগণের সম্মান এবং চাহিদার ভিত্তিতে—সহায়তার সম্পর্ক হতে হবে, দাসত্বের নয়।

এ প্রফেসর মনে করেন, আওয়ামী লীগের বর্তমান পরিস্থিতির মূল কারণ হলো গণতন্ত্রের অভাব। তিনি বলেন, “দলীয় কাঠামোতে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি থাকলে দলের পতন অনিবার্য হয়।” যদি আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মেনে চলত, তাহলে তারা নিজেদের ভুলগুলো বুঝতে পারত এবং সেগুলো সংশোধন করতে পারত। দলীয় নেতৃত্বের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের চর্চা না করার ফলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব একক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে, যা ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে ব্যর্থতার কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকার যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে পতন অনিবার্য। তিনি পরামর্শ দেন, এনজিওভিত্তিক কেবিনেট বাদ দিয়ে রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের দিয়ে সরকার গঠন করা উচিত। দেশের প্রশাসনে যোগ্য লোক নিয়োগের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, “যেসব ছাত্র কোটার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, তারাই এখন কোটার মাধ্যমে নিয়োগ পাচ্ছে, যা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতায় বাধা সৃষ্টি করছে।”

সরকারের মেয়াদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারের দুই থেকে তিন বছরের বেশি সময় নেয়া উচিত হবে না। নির্বাচনের পর নতুন সরকার যে-ই গঠন করুক, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কাজে লাগানো উচিত এবং তাকে পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হিসেবেও নিয়োগ দেয়া যেতে পারে, যেন কাজগুলো থেমে না যায়।

তৃতীয় শক্তির উত্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, এক-এগারোর সময় যে মাইনাস টু ফর্মুলা এসেছিল, সেটি কার্যকর হয়নি। এখন যদি তৃতীয় শক্তি প্রতিষ্ঠার কথা ওঠে, তাহলে শক্তিশালী দল গঠন করতে হবে। কিন্তু ড. ইউনূসের বর্তমানে সে ধরনের শক্তি আছে বলে তিনি মনে করেন না। অন্যদিকে, ছাত্র আন্দোলনও বিতর্কিত হয়ে যাচ্ছে, বিভিন্ন জায়গায় তাদের প্রতিহত করছে শিক্ষার্থীরা, যা ছাত্র আন্দোলনের গ্রহণযোগ্যতা কমিয়ে দিচ্ছে।

সূত্রঃ সাক্ষাৎকার   গ্রহনে  দৈনিক মানব জমিন

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

“পতিত সরকারের অনুগত আমলারা বর্তমান সরকারকে সফল হতে দিতে চায় না”: সাক্ষাৎকারে ড. নুরুল আমিন বেপারী

Update Time : ১০:৪৬:০৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর ২০২৪
ড. নুরুল আমিন বেপারী

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নুরুল আমিন বেপারীর মতে, পূর্ববর্তী সরকারের আমলারা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সফল দেখতে চায় না। তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে আমলাদের যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, যার ফলস্বরূপ তারা সরকার পরিবর্তনের সময় জটিল পরিস্থিতিতে সংকট সৃষ্টি করেছে। কারণ, যত বেশি মৃত্যু ঘটবে, তত বেশি তারা পুরস্কৃত হবে। তিনি উল্লেখ করেন যে, পুলিশের মতো একটি সুশৃঙ্খল সংস্থাকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। যারা এখনো কাজ করছে, তারা পতিত সরকারের প্রতি অনুগত এবং সেই সরকারের লোকেরা চায় না যে বর্তমান সরকার সফল হোক।

তিনি আরও বলেন, ৫ই আগস্টের পরে পুলিশের যে অবস্থায় পৌঁছেছে, তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। এমনকি পাকিস্তান আমলেও এমনটি দেখা যায়নি। তাই বর্তমান পুলিশ ও আমলারা সরকারকে মন থেকে সমর্থন করতে পারছে না, যার কারণে এই বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। মানবজমিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রফেসর নুরুল আমিন বেপারী আরও বলেন, একটি প্রতিষ্ঠান একটি গাছের মতো। যত বেশি সময় ও যত্ন পাবে, ততই শক্তিশালী হবে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিকাশের সুযোগ দেওয়া হয়নি, যার ফলে গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হয়েছে। শেখ হাসিনা ওয়াজেদ দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষতি করেছেন, যার কারণে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সময় তিনি গণতান্ত্রিক উপায়ে সংকটের সমাধান করতে পারেননি।

তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভালোভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। যদিও কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপের জন্য জনগণ প্রশংসা করছে, তবে পরিস্থিতির মূল ডায়নামিকগুলো বুঝতে হবে। তিনি বলেন, কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিস্ট সরকারের হাত থেকে জনগণ মুক্তি পেয়েছে, যেখানে বাকস্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা ছিল না। সেই সময় গুম, খুন, হত্যা ও লুটপাট চলত। সেই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে। গণতন্ত্র মানে সমালোচনা এবং আত্মসমালোচনার সুযোগ প্রদান করা, যা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে এই পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি।

এক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, বর্তমান সরকারটি অভ্যুত্থানের ফসল, বিপ্লবের নয়। তিনি ব্যাখ্যা করেন, যদিও কিছু লোক এটিকে বিপ্লবের সরকার বলছেন, তবে পার্টি ছাড়া বিপ্লব সম্ভব নয়। এখানে ছাত্র ও জনগণের অভ্যুত্থান ঘটেছে, যার ফলস্বরূপ ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতায় এসেছেন। এই অভ্যুত্থানের ফল হিসেবে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন এবং মানুষ এতে খুশি হয়েছে। কিন্তু তাদের অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকলেও সব কিছু তিনি চাইলেই করতে পারেন না। ব্যক্তিগত জীবনে দেড়-দুই মাস হয়তো যথেষ্ট সময়, কিন্তু একটি জাতির জন্য এটি যথেষ্ট নয়। কিছু ইতিবাচক কাজ হলেও বিভিন্ন নিয়োগ নিয়ে ইতিমধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি বলেন, ড. ইউনূসের প্রশাসনিক যাত্রা ভালোভাবে হয়নি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে যে মৃত্যু ঘটেছে, তা সবাইকে নাড়া দিয়েছে এবং সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। তিনি মনে করেন, যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ নিয়োগ পেত, তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না।

ড. ইউনূস সেনাবাহিনী নামানোর বিষয়ে বলেন, তিনি ম্যাজেস্ট্রিসি পাওয়ার ব্যবহার করে সেনাবাহিনী নামিয়েছেন, কিন্তু এটি ৮ই আগস্টেই করতে পারতেন। এর ফলে অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। তিনি উল্লেখ করেন যে, ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের সময় ল’ অ্যান্ড অর্ডার ভালো ছিল, যদিও সেই সরকারকে সবাই পছন্দ করতেন না।

সংস্কার কমিশন নিয়ে তিনি বলেন, কিছু সদস্য শুরুতেই বিতর্ক তৈরি করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন যে, আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন বৈধ হবে না। কিন্তু এমন বক্তব্য বলার আগে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। সাখাওয়াত হোসেনও বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। তাদের বক্তব্য নিরপেক্ষ এবং বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে উপস্থাপন করা উচিত, কারণ তাদের কথার মূল্য অনেক।

তিনি সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে বলেন, এটি রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ, এবং যদি পুনর্লিখন করতে হয়, তাহলে জাতীয় বিপ্লবী সরকার গঠনের প্রয়োজন ছিল। কমিশনের তৈরি সংবিধান পাস করতে হলে সংসদে প্রয়োজন, কিন্তু বর্তমান সংসদে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ থাকবে না। তাই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

এছাড়া তিনি বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এই ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে একটি শিক্ষা হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বিএনপি’র পূর্বের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং দেশের ইন্সটিটিউশনগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। আওয়ামী লীগের দুর্নীতির কাজগুলো দখল করা বিএনপি’র জন্য বড় ভুল হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বড় সংস্কার আনতে হবে এবং দেশপ্রেমিক পুঁজিপতিদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে বিদেশে কাজ করা শ্রমিকরা রেমিট্যান্স পাঠায়, কিন্তু কিছু চোর সেই টাকা পাচার করে দেয়। দেশের পুঁজিকে পাচার না করে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করতে হবে। দক্ষ শ্রমিক তৈরি না করতে পারলে বিদেশি শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করতে হবে, যা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির কারণ হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ প্রফেসর বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোকে সমালোচনা ও আত্মসমালোচনার চর্চা করতে হবে, তবে তা দলীয় কাঠামোর ভেতরে করতে হবে, বাইরে নয়। তিনি আরও উল্লেখ করেন, দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ বন্ধ করা উচিত। তারেক রহমানের প্রস্তাবের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “পর পর” না হলেও বিরতি দিয়ে আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ থাকবে, যা জনগণ মেনে নেবে না।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি ও নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন যে, ভারত আওয়ামী লীগকে বিভিন্ন অপকর্মে সহায়তা করেছে, যার কারণে ভারতের প্রতি জনগণের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপিসহ সব দলকেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে জনগণের সম্মান এবং চাহিদার ভিত্তিতে—সহায়তার সম্পর্ক হতে হবে, দাসত্বের নয়।

এ প্রফেসর মনে করেন, আওয়ামী লীগের বর্তমান পরিস্থিতির মূল কারণ হলো গণতন্ত্রের অভাব। তিনি বলেন, “দলীয় কাঠামোতে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি থাকলে দলের পতন অনিবার্য হয়।” যদি আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মেনে চলত, তাহলে তারা নিজেদের ভুলগুলো বুঝতে পারত এবং সেগুলো সংশোধন করতে পারত। দলীয় নেতৃত্বের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের চর্চা না করার ফলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব একক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে, যা ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে ব্যর্থতার কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকার যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে পতন অনিবার্য। তিনি পরামর্শ দেন, এনজিওভিত্তিক কেবিনেট বাদ দিয়ে রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের দিয়ে সরকার গঠন করা উচিত। দেশের প্রশাসনে যোগ্য লোক নিয়োগের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, “যেসব ছাত্র কোটার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, তারাই এখন কোটার মাধ্যমে নিয়োগ পাচ্ছে, যা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতায় বাধা সৃষ্টি করছে।”

সরকারের মেয়াদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারের দুই থেকে তিন বছরের বেশি সময় নেয়া উচিত হবে না। নির্বাচনের পর নতুন সরকার যে-ই গঠন করুক, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কাজে লাগানো উচিত এবং তাকে পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হিসেবেও নিয়োগ দেয়া যেতে পারে, যেন কাজগুলো থেমে না যায়।

তৃতীয় শক্তির উত্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, এক-এগারোর সময় যে মাইনাস টু ফর্মুলা এসেছিল, সেটি কার্যকর হয়নি। এখন যদি তৃতীয় শক্তি প্রতিষ্ঠার কথা ওঠে, তাহলে শক্তিশালী দল গঠন করতে হবে। কিন্তু ড. ইউনূসের বর্তমানে সে ধরনের শক্তি আছে বলে তিনি মনে করেন না। অন্যদিকে, ছাত্র আন্দোলনও বিতর্কিত হয়ে যাচ্ছে, বিভিন্ন জায়গায় তাদের প্রতিহত করছে শিক্ষার্থীরা, যা ছাত্র আন্দোলনের গ্রহণযোগ্যতা কমিয়ে দিচ্ছে।

সূত্রঃ সাক্ষাৎকার   গ্রহনে  দৈনিক মানব জমিন