সময়: বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সাকিব আল হাসান খেলার মাঠের বাইরে অপরাধ জগতের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছিলেন,পুঁজিবাজারে শেয়ার কারসাজির দায়ে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা

ডিজিটাল ডেস্ক
  • Update Time : ০৭:২৮:১২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • / ১৭১ Time View

Sakib al Hasan

ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান

সাকিব আল হাসান খেলার মাঠে দক্ষতা দিয়ে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছেন। তবে মাঠের বাইরেও তিনি ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন, যা তাকে বিভিন্ন সময় বিতর্কের মধ্যে ফেলেছে। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব গোপন করা, পুলিশের হত্যা মামলার আসামির দোকান উদ্বোধন করা, এবং অনলাইন বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপনে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার মতো কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি এর আগেও সমালোচিত হয়েছেন। সর্বশেষ, শেয়ার বাজারে কারসাজির অভিযোগে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সাকিব আল হাসানকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে।

সাকিব আল হাসানের দেশের পুঁজিবাজারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক শুরু হয় ২০১৭ সালে, যখন তিনি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির শুভেচ্ছাদূত হন। ক্রিকেটারদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো আইনগত বা নৈতিক বাধা না থাকলেও সাকিবের বিনিয়োগ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে সমবায় অধিদপ্তরের উপনিবন্ধক মো. আবুল খায়ের হিরুর মাধ্যমে এবং শেয়ার কারসাজির কারণে আলোচিত কোম্পানিতে বিনিয়োগের বিষয়টি তাকে বিতর্কিত করেছে। স্টক এক্সচেঞ্জের তদন্তেও তার সন্দেহজনক লেনদেনের কথা উঠে আসে। তবে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সমর্থনে সাকিব শেয়ার কারসাজির শাস্তি থেকে রেহাই পান। সংস্থাটি জানায়, অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, যদিও তদন্তে কারসাজির স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল।

এ বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসে, যার প্রভাব বিএসইসির শীর্ষ পর্যায়েও পড়ে। নতুন নেতৃত্ব দায়িত্ব নেওয়ার পর সংস্থাটি অতীতের অনিয়ম ও শেয়ার কারসাজির ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এর ধারাবাহিকতায়, ২৮ আগস্ট সাকিব আল হাসানকে বিএসইসির শুভেচ্ছাদূতের পদ থেকে অপসারণ করা হয়। এরপর, গতকাল বিএসইসির কমিশন সভায় ২০২৩ সালের ৮ আগস্ট থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগে সাকিব আল হাসানকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। একই ঘটনায় বিনিয়োগকারী মো. আবুল খায়ের হিরুকে ২৫ লাখ, তার পিতা আবুল কালাম মাতবরকে ১০ লাখ, সাকিব ও হিরুর প্রতিষ্ঠান মোনার্ক মার্টকে ১ লাখ, হিরুর প্রতিষ্ঠান লাভা ইলেকট্রোডস ইন্ডাস্ট্রিজকে ১ লাখ, ইশাল কমিউনিকেশন লিমিটেডকে ৭৫ লাখ এবং মো. জাহিদ কামালকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। সব মিলিয়ে চার ব্যক্তি ও তিন প্রতিষ্ঠানকে মোট ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স ছাড়াও আরও পাঁচটি কোম্পানির শেয়ার কারসাজির ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে সাকিব আল হাসানের নাম উঠে এসেছিল। এর মধ্যে ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে এশিয়া ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের শেয়ার লেনদেন নিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) একটি তদন্ত পরিচালনা করেছিল। ওই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারদর ৩০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বেড়ে ৬৮ টাকা ৬০ পয়সায় পৌঁছায়। এই সময়ে কোম্পানিটির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শেয়ার কেনাবেচার মধ্যে সাকিব আল হাসানও ছিলেন। তিনি ওই সময়ে ৮ লাখ ২০ হাজার শেয়ার কেনার বিপরীতে ২ লাখ শেয়ার বিক্রি করেন। এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির কারণে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) দেশ আইডিয়াল ট্রাস্ট কো-অপারেটিভ লিমিটেডকে ৭২ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল, যার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন মো. আবুল খায়ের হিরু।

পরের বছর ২০২১ সালের ৫ মে থেকে ২৪ মে পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের শেয়ারদর ১২ টাকা ৪০ পয়সা থেকে বেড়ে ৩৩ টাকা ৮০ পয়সায় দাঁড়িয়েছিল। এ সময়ে ব্যাংকটির শেয়ার লেনদেন নিয়ে তদন্ত করে ডিএসই। তদন্তে ব্যাংকটির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শেয়ার লেনদেনকারীর তালিকায় সাকিব আল হাসানের নাম উঠে আসে। তিনি ব্যাংকটির ২৭ লাখ শেয়ার কেনার বিপরীতে এক লাখ শেয়ার বিক্রি করেছিলেন। ব্যাংকটির শেয়ার কারসাজির কারণে বিএসইসি কনিকা আফরোজ ও তার সহযোগীদের ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা জরিমানা করে। কনিকা আফরোজ মো. আবুল খায়ের হিরুর বোন।

একই বছরের ২০ মে থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত ফরচুন সুজ লিমিটেডের শেয়ার লেনদেন নিয়ে আরেকটি তদন্ত করে ডিএসই। এ তদন্ত প্রতিবেদন বিএসইসির কাছেও পাঠিয়েছিল এক্সচেঞ্জটি। এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিএসইসি হিরুর পিতা আবুল কালাম মাতবর ও তার সহযোগীদের দেড় কোটি টাকা জরিমানা করে। এ তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, যারা কোম্পানিটির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শেয়ার লেনদেন করেছিলেন, তাদের মধ্যে সাকিব আল হাসানের নামও ছিল। তিনি কোম্পানিটির ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩১৩টি শেয়ার কেনার বিপরীতে বিক্রি করেন ১ লাখ ৮৩ হাজার ২৪৩টি।

২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর ওয়ান ব্যাংক লিমিটেডের শেয়ারদর ছিল ১২ টাকা ৬০ পয়সা। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে তা দাঁড়ায় ২০ টাকা ১০ পয়সায়। ব্যাংকটির ওই সময়কার শেয়ার লেনদেন নিয়ে তদন্ত চালিয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ লেনদেনকারীদের তালিকায় আবারো সাকিব আল হাসানের নাম উঠে আসে। তিনি এ সময়ে ব্যাংকটির ৭৫ লাখ ১ হাজার ৬৭৬টি শেয়ার কেনার বিপরীতে ১০ লাখ ২০ হাজার শেয়ার বিক্রি করেছিলেন। ব্যাংকটির শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকার কারণে বিএসইসি আবুল কালাম মাতবর ও তার সহযোগীদের ৩ কোটি টাকা জরিমানা করে।

২০২২ সালে আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের শেয়ার নিয়ে কারসাজির ঘটনা ঘটে। ২৯ মার্চ শেয়ারটির মূল্য ছিল ৩৪ টাকা, যা ২৪ এপ্রিল বেড়ে ৫৪ টাকা ৭০ পয়সায় পৌঁছায়। এই সময়ের শেয়ার লেনদেন নিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) তদন্ত চালায়। আলোচ্য সময়ে সাকিব আল হাসান আইপিডিসির ১১ লাখ শেয়ার কেনার বিপরীতে ১০ লাখ ৬৯ হাজার ৪৩৩টি শেয়ার বিক্রি করেন। শেয়ার কারসাজির দায়ে বিএসইসি মো. আবুল খায়ের হিরু ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করে।

২০২১ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত সাকিব আল হাসান ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শেয়ার লেনদেন করেছেন। এর পাশাপাশি আরও কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারে তার বিনিয়োগ রয়েছে। সাকিবের বিরুদ্ধে শেয়ার কারসাজির বহু প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, অভিযোগ রয়েছে যে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের কারণে এসব ঘটনা সম্পূর্ণরূপে তদন্ত করা হয়নি। বরং তার বিরুদ্ধে সাকিব ও মো. আবুল খায়ের হিরুদের পুঁজিবাজারে কারসাজিতে উৎসাহ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ বিষয়ে জানতে সাকিব আল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও, বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত থাকায় তাকে পাওয়া যায়নি।

শেয়ার কারসাজির দায়ে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা আরোপের কারণে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা জানতে চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি ফারুক আহমেদের কাছে। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জরিমানার বিষয়টি আমি আপনার কাছ থেকেই শুনলাম। আসলে এ ব্যাপারে কিছু জানিই না। কাল (আজ) বোর্ডে গিয়ে দেখি, তারপর বলা যায়। জানতে হবে জিনিসটা, কিসের জন্য করছে ওরা। এ মুহূর্তে আমার কোনো মন্তব্য নেই।’

শেয়ার কারসাজির অভিযোগে জরিমানার মুখে পড়ায় সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করছেন দেশের ক্রিকেট সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) ইমেজ রক্ষার স্বার্থে এই ধরনের ঘটনায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক শফিকুল হক হীরা বণিক বার্তাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “যদি এটা সত্যি হয়ে থাকে, তবে এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এতে বিসিবির কিছুটা বদনাম হবে। বিসিবি প্রেসিডেন্ট হয়তো বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করবেন এবং সিদ্ধান্ত নেবেন। কারণ এটি একটি অফিশিয়াল সিদ্ধান্ত (বিএসইসির)। যদি বোর্ড নিশ্চিত হয়, তাহলে হয়তো সাকিবকে পরবর্তী টেস্ট বা টি-টোয়েন্টি ম্যাচগুলো থেকে বাদ দেওয়া হতে পারে এবং তাকে ট্যুর থেকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে। তবে বিসিবিকে শতভাগ নিশ্চিত হতে হবে যে অভিযোগটি সঠিক। যদি এটি একটি অথেনটিক রিপোর্ট হয়, তাহলে বোর্ড অবশ্যই একটি ব্যবস্থা নেবে। এমনও হতে পারে যে বিসিবি প্রেসিডেন্ট ক্রীড়া উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করবেন, এবং যদি উপদেষ্টা বলেন যে অভিযোগটি সঠিক, তবে তাকে বাদ দেওয়ার পরামর্শ দেবেন। সবার জন্য নিয়ম সমান হতে হবে, তাই বিসিবি প্রেসিডেন্ট হয়তো এমন একটি সিদ্ধান্ত নেবেন যাতে বোর্ডের সুনাম অক্ষুণ্ন থাকে।”

শফিকুল হক হীরা আরও বলেন, “বিসিবির উচিত সবকিছু বিস্তারিতভাবে জেনে তারপর ব্যবস্থা নেওয়া। সাকিবের সঙ্গে কথা বলে, তাকে জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হতে হবে যে তিনি এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন কি না। এখনই তাড়াহুড়া করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। সাকিব বর্তমানে ট্যুরে আছেন, সামনে টেস্ট ম্যাচও রয়েছে। তাই বোর্ডকে বিষয়টি ভালোভাবে তদন্ত করে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে পদক্ষেপ নিতে হবে।”

এর আগেও সাকিব আল হাসান বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন। ২০২৩ সালে তিনি বেটউইনার নিউজ নামক একটি অনলাইন বেটিং সাইটের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনী পণ্যদূত হওয়ার চুক্তি করেছিলেন, যা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। বিসিবির নিয়ম অনুযায়ী ক্রিকেটারদের কোনো বাণিজ্যিক চুক্তি করতে হলে বোর্ডের অনুমোদন প্রয়োজন, তবে সাকিব সেই অনুমোদন নেননি। এমনকি সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি চুক্তি বাতিল করতে চাননি। পরে বিসিবির চাপের মুখে তিনি বাধ্য হন চুক্তিটি বাতিল করতে।

এই ঘটনায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অনুসন্ধানে উঠে আসে যে বেটিং সাইটটির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাকিব আল হাসানকে তাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয়।

গত বছর সাকিব আল হাসান পুলিশ হত্যার পলাতক আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খানের মালিকানাধীন একটি জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দুবাই গিয়েছিলেন। সাকিব নিজেই ফেসবুকে এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের বিষয়টি জানান, যা ব্যাপক আলোড়ন ও সমালোচনার জন্ম দেয়।

এর আগে ২০১৯ সালে সাকিব আল হাসান ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব গোপন করায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) কর্তৃক দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন। যদিও এই শাস্তি তার অর্থনৈতিক অপরাধের প্রলোভন থেকে দূরে সরাতে পারেনি।

টুর্নামেন্টের মাঝে শোরুম উদ্বোধন ও টুর্নামেন্টের বিরতিতে দেশে এসে বাণিজ্যিক চুক্তি করার মতো বিষয়গুলোও সাকিবকে সমালোচনার মুখে ফেলেছে। এসব ঘটনা তার ক্যারিয়ারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং বোর্ডের দৃষ্টিতে তার অবস্থানকে দুর্বল করতে পারে।

সাবেক ও বর্তমান ক্রিকেটারদের মতে, সাকিব আল হাসানের দলে প্রভাব ও আবেদন অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশি। উঠতি তারকা এবং জুনিয়র ক্রিকেটাররা তাকে অনুসরণ করে এবং তার সাফল্যকে আদর্শ মনে করে। এ কারণে, সাকিবের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডগুলো সহজেই তার পার পেয়ে যায়, যা অন্যান্য ক্রিকেটারদেরও প্রভাবিত করেছে।

সাকিবের মাঠের সাফল্য এবং জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে, অনেকেই তার মতো বিতর্কিত আর্থিক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়তে উৎসাহিত হচ্ছেন। তারা শেয়ারবাজারের বিতর্কিত চরিত্রগুলোর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এবং সাকিবের প্রভাব তাদের কর্মকাণ্ডে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। সাকিব নিজেও কিছু জুনিয়র ক্রিকেটারকে মো. আবুল খায়ের হিরুর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করেছেন, যা পুরো পরিস্থিতির আরও জটিলতা সৃষ্টি করেছে।

এভাবে, সাকিবের কর্মকাণ্ড কেবল তার ক্যারিয়ারকে প্রভাবিত করছে না, বরং নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটারদের মূল্যবোধ এবং সিদ্ধান্তগ্রহণেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

বাংলাদেশ দলের তারকা সাকিব আল হাসান যশ, খ্যাতি এবং অর্থবিত্ত সবকিছুই অর্জন করেছেন। ২০১০ সাল থেকে তিনি ব্যবসায় প্রবেশ করেন এবং বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে তার ব্যবসায়িক যাত্রা শুরু হলেও দ্রুতই তিনি নানা খাতে নিজের ব্যবসায়িক পরিমণ্ডল বিস্তৃত করেছেন।

সাকিবের বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, যেমন:

– পুঁজিবাজার: সাকিবের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ এবং শেয়ার লেনদেনের ঘটনা বেশ আলোচিত।

– বিদ্যুৎ কেন্দ্র: বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ করে তিনি বিদ্যুৎ খাতেও অংশগ্রহণ করেছেন।

– প্রসাধনী এবং ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট: প্রসাধনী শিল্প এবং ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে তার বিনিয়োগের অভিজ্ঞতা রয়েছে।

– হোটেল এবং ট্রাভেল এজেন্সি: ভ্রমণ ও আতিথেয়তার খাতেও তার প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি দেখা যায়।

– কাঁকড়া ও কুঁচের খামার: এ খাতে সাকিবের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে।

– শপিং মল এবং স্বর্ণ আমদানির প্রতিষ্ঠান: দেশের অর্থনীতিতে তার বিনিয়োগের বিভিন্ন দিক রয়েছে।

এছাড়া, সাকিব বিদেশেও যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ নানা দেশে বড় অংকের বিনিয়োগ করেছেন। তবে, ব্যাট-বল হাতে সাফল্য অর্জন করার পরেও ব্যবসায় তেমন সফলতা আসেনি। দেশে তার বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান বর্তমানে রুগ্ণ অবস্থায় রয়েছে এবং কিছু প্রতিষ্ঠান তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। সাকিবের ব্যবসায়িক প্রচেষ্টা এবং সাফল্য নিয়ে আলোচনা চলতেই থাকবে, তবে ভবিষ্যতে তিনি কিভাবে তার প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিস্থিতি উন্নত করতে পারবেন, সেটাই দেখা যাবে।

সূত্রঃ বণিক বার্তা

 

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

সাকিব আল হাসান খেলার মাঠের বাইরে অপরাধ জগতের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছিলেন,পুঁজিবাজারে শেয়ার কারসাজির দায়ে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা

Update Time : ০৭:২৮:১২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান

সাকিব আল হাসান খেলার মাঠে দক্ষতা দিয়ে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছেন। তবে মাঠের বাইরেও তিনি ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন, যা তাকে বিভিন্ন সময় বিতর্কের মধ্যে ফেলেছে। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব গোপন করা, পুলিশের হত্যা মামলার আসামির দোকান উদ্বোধন করা, এবং অনলাইন বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপনে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার মতো কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি এর আগেও সমালোচিত হয়েছেন। সর্বশেষ, শেয়ার বাজারে কারসাজির অভিযোগে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সাকিব আল হাসানকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে।

সাকিব আল হাসানের দেশের পুঁজিবাজারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক শুরু হয় ২০১৭ সালে, যখন তিনি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির শুভেচ্ছাদূত হন। ক্রিকেটারদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো আইনগত বা নৈতিক বাধা না থাকলেও সাকিবের বিনিয়োগ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে সমবায় অধিদপ্তরের উপনিবন্ধক মো. আবুল খায়ের হিরুর মাধ্যমে এবং শেয়ার কারসাজির কারণে আলোচিত কোম্পানিতে বিনিয়োগের বিষয়টি তাকে বিতর্কিত করেছে। স্টক এক্সচেঞ্জের তদন্তেও তার সন্দেহজনক লেনদেনের কথা উঠে আসে। তবে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সমর্থনে সাকিব শেয়ার কারসাজির শাস্তি থেকে রেহাই পান। সংস্থাটি জানায়, অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, যদিও তদন্তে কারসাজির স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল।

এ বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসে, যার প্রভাব বিএসইসির শীর্ষ পর্যায়েও পড়ে। নতুন নেতৃত্ব দায়িত্ব নেওয়ার পর সংস্থাটি অতীতের অনিয়ম ও শেয়ার কারসাজির ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এর ধারাবাহিকতায়, ২৮ আগস্ট সাকিব আল হাসানকে বিএসইসির শুভেচ্ছাদূতের পদ থেকে অপসারণ করা হয়। এরপর, গতকাল বিএসইসির কমিশন সভায় ২০২৩ সালের ৮ আগস্ট থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগে সাকিব আল হাসানকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। একই ঘটনায় বিনিয়োগকারী মো. আবুল খায়ের হিরুকে ২৫ লাখ, তার পিতা আবুল কালাম মাতবরকে ১০ লাখ, সাকিব ও হিরুর প্রতিষ্ঠান মোনার্ক মার্টকে ১ লাখ, হিরুর প্রতিষ্ঠান লাভা ইলেকট্রোডস ইন্ডাস্ট্রিজকে ১ লাখ, ইশাল কমিউনিকেশন লিমিটেডকে ৭৫ লাখ এবং মো. জাহিদ কামালকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। সব মিলিয়ে চার ব্যক্তি ও তিন প্রতিষ্ঠানকে মোট ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স ছাড়াও আরও পাঁচটি কোম্পানির শেয়ার কারসাজির ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে সাকিব আল হাসানের নাম উঠে এসেছিল। এর মধ্যে ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে এশিয়া ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের শেয়ার লেনদেন নিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) একটি তদন্ত পরিচালনা করেছিল। ওই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারদর ৩০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বেড়ে ৬৮ টাকা ৬০ পয়সায় পৌঁছায়। এই সময়ে কোম্পানিটির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শেয়ার কেনাবেচার মধ্যে সাকিব আল হাসানও ছিলেন। তিনি ওই সময়ে ৮ লাখ ২০ হাজার শেয়ার কেনার বিপরীতে ২ লাখ শেয়ার বিক্রি করেন। এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির কারণে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) দেশ আইডিয়াল ট্রাস্ট কো-অপারেটিভ লিমিটেডকে ৭২ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল, যার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন মো. আবুল খায়ের হিরু।

পরের বছর ২০২১ সালের ৫ মে থেকে ২৪ মে পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের শেয়ারদর ১২ টাকা ৪০ পয়সা থেকে বেড়ে ৩৩ টাকা ৮০ পয়সায় দাঁড়িয়েছিল। এ সময়ে ব্যাংকটির শেয়ার লেনদেন নিয়ে তদন্ত করে ডিএসই। তদন্তে ব্যাংকটির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শেয়ার লেনদেনকারীর তালিকায় সাকিব আল হাসানের নাম উঠে আসে। তিনি ব্যাংকটির ২৭ লাখ শেয়ার কেনার বিপরীতে এক লাখ শেয়ার বিক্রি করেছিলেন। ব্যাংকটির শেয়ার কারসাজির কারণে বিএসইসি কনিকা আফরোজ ও তার সহযোগীদের ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা জরিমানা করে। কনিকা আফরোজ মো. আবুল খায়ের হিরুর বোন।

একই বছরের ২০ মে থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত ফরচুন সুজ লিমিটেডের শেয়ার লেনদেন নিয়ে আরেকটি তদন্ত করে ডিএসই। এ তদন্ত প্রতিবেদন বিএসইসির কাছেও পাঠিয়েছিল এক্সচেঞ্জটি। এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিএসইসি হিরুর পিতা আবুল কালাম মাতবর ও তার সহযোগীদের দেড় কোটি টাকা জরিমানা করে। এ তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, যারা কোম্পানিটির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শেয়ার লেনদেন করেছিলেন, তাদের মধ্যে সাকিব আল হাসানের নামও ছিল। তিনি কোম্পানিটির ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩১৩টি শেয়ার কেনার বিপরীতে বিক্রি করেন ১ লাখ ৮৩ হাজার ২৪৩টি।

২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর ওয়ান ব্যাংক লিমিটেডের শেয়ারদর ছিল ১২ টাকা ৬০ পয়সা। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে তা দাঁড়ায় ২০ টাকা ১০ পয়সায়। ব্যাংকটির ওই সময়কার শেয়ার লেনদেন নিয়ে তদন্ত চালিয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ লেনদেনকারীদের তালিকায় আবারো সাকিব আল হাসানের নাম উঠে আসে। তিনি এ সময়ে ব্যাংকটির ৭৫ লাখ ১ হাজার ৬৭৬টি শেয়ার কেনার বিপরীতে ১০ লাখ ২০ হাজার শেয়ার বিক্রি করেছিলেন। ব্যাংকটির শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকার কারণে বিএসইসি আবুল কালাম মাতবর ও তার সহযোগীদের ৩ কোটি টাকা জরিমানা করে।

২০২২ সালে আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের শেয়ার নিয়ে কারসাজির ঘটনা ঘটে। ২৯ মার্চ শেয়ারটির মূল্য ছিল ৩৪ টাকা, যা ২৪ এপ্রিল বেড়ে ৫৪ টাকা ৭০ পয়সায় পৌঁছায়। এই সময়ের শেয়ার লেনদেন নিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) তদন্ত চালায়। আলোচ্য সময়ে সাকিব আল হাসান আইপিডিসির ১১ লাখ শেয়ার কেনার বিপরীতে ১০ লাখ ৬৯ হাজার ৪৩৩টি শেয়ার বিক্রি করেন। শেয়ার কারসাজির দায়ে বিএসইসি মো. আবুল খায়ের হিরু ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করে।

২০২১ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত সাকিব আল হাসান ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শেয়ার লেনদেন করেছেন। এর পাশাপাশি আরও কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারে তার বিনিয়োগ রয়েছে। সাকিবের বিরুদ্ধে শেয়ার কারসাজির বহু প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, অভিযোগ রয়েছে যে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের কারণে এসব ঘটনা সম্পূর্ণরূপে তদন্ত করা হয়নি। বরং তার বিরুদ্ধে সাকিব ও মো. আবুল খায়ের হিরুদের পুঁজিবাজারে কারসাজিতে উৎসাহ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ বিষয়ে জানতে সাকিব আল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও, বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত থাকায় তাকে পাওয়া যায়নি।

শেয়ার কারসাজির দায়ে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা আরোপের কারণে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা জানতে চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি ফারুক আহমেদের কাছে। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জরিমানার বিষয়টি আমি আপনার কাছ থেকেই শুনলাম। আসলে এ ব্যাপারে কিছু জানিই না। কাল (আজ) বোর্ডে গিয়ে দেখি, তারপর বলা যায়। জানতে হবে জিনিসটা, কিসের জন্য করছে ওরা। এ মুহূর্তে আমার কোনো মন্তব্য নেই।’

শেয়ার কারসাজির অভিযোগে জরিমানার মুখে পড়ায় সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করছেন দেশের ক্রিকেট সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) ইমেজ রক্ষার স্বার্থে এই ধরনের ঘটনায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক শফিকুল হক হীরা বণিক বার্তাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “যদি এটা সত্যি হয়ে থাকে, তবে এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এতে বিসিবির কিছুটা বদনাম হবে। বিসিবি প্রেসিডেন্ট হয়তো বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করবেন এবং সিদ্ধান্ত নেবেন। কারণ এটি একটি অফিশিয়াল সিদ্ধান্ত (বিএসইসির)। যদি বোর্ড নিশ্চিত হয়, তাহলে হয়তো সাকিবকে পরবর্তী টেস্ট বা টি-টোয়েন্টি ম্যাচগুলো থেকে বাদ দেওয়া হতে পারে এবং তাকে ট্যুর থেকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে। তবে বিসিবিকে শতভাগ নিশ্চিত হতে হবে যে অভিযোগটি সঠিক। যদি এটি একটি অথেনটিক রিপোর্ট হয়, তাহলে বোর্ড অবশ্যই একটি ব্যবস্থা নেবে। এমনও হতে পারে যে বিসিবি প্রেসিডেন্ট ক্রীড়া উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করবেন, এবং যদি উপদেষ্টা বলেন যে অভিযোগটি সঠিক, তবে তাকে বাদ দেওয়ার পরামর্শ দেবেন। সবার জন্য নিয়ম সমান হতে হবে, তাই বিসিবি প্রেসিডেন্ট হয়তো এমন একটি সিদ্ধান্ত নেবেন যাতে বোর্ডের সুনাম অক্ষুণ্ন থাকে।”

শফিকুল হক হীরা আরও বলেন, “বিসিবির উচিত সবকিছু বিস্তারিতভাবে জেনে তারপর ব্যবস্থা নেওয়া। সাকিবের সঙ্গে কথা বলে, তাকে জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হতে হবে যে তিনি এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন কি না। এখনই তাড়াহুড়া করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। সাকিব বর্তমানে ট্যুরে আছেন, সামনে টেস্ট ম্যাচও রয়েছে। তাই বোর্ডকে বিষয়টি ভালোভাবে তদন্ত করে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে পদক্ষেপ নিতে হবে।”

এর আগেও সাকিব আল হাসান বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন। ২০২৩ সালে তিনি বেটউইনার নিউজ নামক একটি অনলাইন বেটিং সাইটের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনী পণ্যদূত হওয়ার চুক্তি করেছিলেন, যা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। বিসিবির নিয়ম অনুযায়ী ক্রিকেটারদের কোনো বাণিজ্যিক চুক্তি করতে হলে বোর্ডের অনুমোদন প্রয়োজন, তবে সাকিব সেই অনুমোদন নেননি। এমনকি সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি চুক্তি বাতিল করতে চাননি। পরে বিসিবির চাপের মুখে তিনি বাধ্য হন চুক্তিটি বাতিল করতে।

এই ঘটনায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অনুসন্ধানে উঠে আসে যে বেটিং সাইটটির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাকিব আল হাসানকে তাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয়।

গত বছর সাকিব আল হাসান পুলিশ হত্যার পলাতক আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খানের মালিকানাধীন একটি জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দুবাই গিয়েছিলেন। সাকিব নিজেই ফেসবুকে এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের বিষয়টি জানান, যা ব্যাপক আলোড়ন ও সমালোচনার জন্ম দেয়।

এর আগে ২০১৯ সালে সাকিব আল হাসান ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব গোপন করায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) কর্তৃক দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন। যদিও এই শাস্তি তার অর্থনৈতিক অপরাধের প্রলোভন থেকে দূরে সরাতে পারেনি।

টুর্নামেন্টের মাঝে শোরুম উদ্বোধন ও টুর্নামেন্টের বিরতিতে দেশে এসে বাণিজ্যিক চুক্তি করার মতো বিষয়গুলোও সাকিবকে সমালোচনার মুখে ফেলেছে। এসব ঘটনা তার ক্যারিয়ারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং বোর্ডের দৃষ্টিতে তার অবস্থানকে দুর্বল করতে পারে।

সাবেক ও বর্তমান ক্রিকেটারদের মতে, সাকিব আল হাসানের দলে প্রভাব ও আবেদন অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশি। উঠতি তারকা এবং জুনিয়র ক্রিকেটাররা তাকে অনুসরণ করে এবং তার সাফল্যকে আদর্শ মনে করে। এ কারণে, সাকিবের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডগুলো সহজেই তার পার পেয়ে যায়, যা অন্যান্য ক্রিকেটারদেরও প্রভাবিত করেছে।

সাকিবের মাঠের সাফল্য এবং জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে, অনেকেই তার মতো বিতর্কিত আর্থিক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়তে উৎসাহিত হচ্ছেন। তারা শেয়ারবাজারের বিতর্কিত চরিত্রগুলোর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এবং সাকিবের প্রভাব তাদের কর্মকাণ্ডে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। সাকিব নিজেও কিছু জুনিয়র ক্রিকেটারকে মো. আবুল খায়ের হিরুর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করেছেন, যা পুরো পরিস্থিতির আরও জটিলতা সৃষ্টি করেছে।

এভাবে, সাকিবের কর্মকাণ্ড কেবল তার ক্যারিয়ারকে প্রভাবিত করছে না, বরং নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটারদের মূল্যবোধ এবং সিদ্ধান্তগ্রহণেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

বাংলাদেশ দলের তারকা সাকিব আল হাসান যশ, খ্যাতি এবং অর্থবিত্ত সবকিছুই অর্জন করেছেন। ২০১০ সাল থেকে তিনি ব্যবসায় প্রবেশ করেন এবং বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে তার ব্যবসায়িক যাত্রা শুরু হলেও দ্রুতই তিনি নানা খাতে নিজের ব্যবসায়িক পরিমণ্ডল বিস্তৃত করেছেন।

সাকিবের বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, যেমন:

– পুঁজিবাজার: সাকিবের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ এবং শেয়ার লেনদেনের ঘটনা বেশ আলোচিত।

– বিদ্যুৎ কেন্দ্র: বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ করে তিনি বিদ্যুৎ খাতেও অংশগ্রহণ করেছেন।

– প্রসাধনী এবং ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট: প্রসাধনী শিল্প এবং ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে তার বিনিয়োগের অভিজ্ঞতা রয়েছে।

– হোটেল এবং ট্রাভেল এজেন্সি: ভ্রমণ ও আতিথেয়তার খাতেও তার প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি দেখা যায়।

– কাঁকড়া ও কুঁচের খামার: এ খাতে সাকিবের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে।

– শপিং মল এবং স্বর্ণ আমদানির প্রতিষ্ঠান: দেশের অর্থনীতিতে তার বিনিয়োগের বিভিন্ন দিক রয়েছে।

এছাড়া, সাকিব বিদেশেও যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ নানা দেশে বড় অংকের বিনিয়োগ করেছেন। তবে, ব্যাট-বল হাতে সাফল্য অর্জন করার পরেও ব্যবসায় তেমন সফলতা আসেনি। দেশে তার বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান বর্তমানে রুগ্ণ অবস্থায় রয়েছে এবং কিছু প্রতিষ্ঠান তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। সাকিবের ব্যবসায়িক প্রচেষ্টা এবং সাফল্য নিয়ে আলোচনা চলতেই থাকবে, তবে ভবিষ্যতে তিনি কিভাবে তার প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিস্থিতি উন্নত করতে পারবেন, সেটাই দেখা যাবে।

সূত্রঃ বণিক বার্তা