বিজেপি নেতারা কেন বারবার বাংলাদেশিদের নিয়ে কটূক্তি করেন?

- Update Time : ০২:৩৯:৪১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
- / ৮৪ Time View
কখনও উইপোকা বলা, কখনও বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করার হুমকি, আবার কখনও উল্টো করে ঝুলিয়ে শায়েস্তা করার ভয় দেখানো—ভারতের বিজেপি নেতারা বাংলাদেশিদের নিয়ে প্রায়শই এ ধরনের মন্তব্য করে থাকেন। যদিও শেখ হাসিনা সরকার এসব কটূক্তির প্রতিবাদ সরাসরি জানায়নি, সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ বিষয়ে সরব হয়েছে।
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডে এক জনসভায় বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের উল্টো করে ঝুলিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন, যা নিয়ে কূটনৈতিক স্তরে প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা। এটি প্রথমবারের ঘটনা নয়; এর আগেও অমিত শাহ বাংলাদেশিদের নিয়ে কটূক্তি করেছেন। ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনি অন্তত দুবার বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের উইপোকা বলে উল্লেখ করেছেন এবং একবার বলেছিলেন, এদের বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়া উচিত।
এটা শুধু অমিত শাহর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বিজেপির অন্যান্য নেতারাও বাংলাদেশিদের নিয়ে একই ধরনের মন্তব্য করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আগে যেসব ‘কুকথা’ বলা হয়েছে, সেগুলো শুনেও শেখ হাসিনার সরকার জোরালোভাবে প্রতিবাদ করেনি। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তারা এধরনের মন্তব্য সহ্য করবে না। ঢাকায় ভারতীয় উপ-রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠিয়ে প্রতিবাদ জানানোর মাধ্যমে এটি স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এর মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের নেতাদের বাংলাদেশিদের প্রতি কটূক্তি নিয়ে তাদের কঠোর অবস্থান স্পষ্ট করেছে।
কী বলেছিলেন অমিত শাহ
ঝাড়খণ্ডের গিরিডিতে এক জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তার ভাষণে বেশ কয়েকবার রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন এবং ঝাড়খণ্ড থেকে তাদের উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা তুলে ধরেন।
প্রথমবার, অমিত শাহ বলেন, “ঝাড়খণ্ডে একবার সরকার বদল করুন। আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, ঝাড়খণ্ড থেকে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের খুঁজে খুঁজে বের করে ঝাড়খণ্ড থেকে তাড়ানোর কাজটি ভারতীয় জনতা পার্টি করবে। তারা আমাদের সভ্যতাকে ধ্বংস করছে এবং আমাদের সম্পত্তি দখল করছে।”
এরপর তিনি অভিযোগ তোলেন, “এরা আমাদের মেয়েদের ভুয়া বিবাহের মাধ্যমে প্রতারণা করছে এবং আমাদের চাকরি ও রোজগারপত্রও লুঠ করছে। ঝাড়খণ্ডে এই অনুপ্রবেশকারীদের কোনো জায়গা নেই। কেবলমাত্র বিজেপি সরকারই এদের সরাতে পারে।”
তৃতীয়বার, অমিত শাহ আরও বলেন, “যদি ঝাড়খণ্ডে এভাবে অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে, তাহলে আগামী ২৫-৩০ বছরের মধ্যে এখানকার অনুপ্রবেশকারীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠবে।”
ঝাড়খণ্ডের নারীদের ওপর ঘটে যাওয়া অত্যাচার ও হত্যার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এইসব ঘটনা যারা ঘটাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে রাজ্যের সরকার কিছু বলছে না, কারণ তারা এদের ভোটব্যাংক। এরা অনুপ্রবেশকারী।”
পরিশেষে, তিনি বিজেপির প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, “আমি আজ বলে যাচ্ছি, আপনারা এখানে পদ্মফুলের সরকার বানান, এইসব অনুপ্রবেশকারীদের উল্টো করে ঝুলিয়ে সোজা করার কাজটা আমরা করব।”
এই মন্তব্যগুলো ঝাড়খণ্ডের জনসভায় স্থানীয় ভোটারদের মনোভাবকে আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে করা হলেও, তার ভাষণ ভারতের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশ এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।
কেন বার বার বাংলাদেশিদের টার্গেট করা হয়?
হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিশেষজ্ঞ স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যের মতে, আগে হিন্দুত্ববাদী নেতা-নেত্রীরা যেভাবে পাকিস্তানকে লক্ষ্য করে কটূক্তি করতেন, এখন সেই একই ধরনের মন্তব্য বাংলাদেশিদের উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে। তার মতে, হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো সবসময়ই একটি ‘অপর পক্ষ’ দাঁড় করানোর চেষ্টা করে, এবং মুসলমানরাই তাদের কাছে সেই অপর পক্ষ। মুসলমানদের এরা বহিরাগত হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে। আগে তাদের কাছে প্রধান শত্রু ছিল পাকিস্তান, কিন্তু গত দশকে বাংলাদেশও তাদের টার্গেট হয়ে উঠেছে।
ভট্টাচার্য আরও বলেন, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ নিয়ে যে রাজনীতি চলছে, তা পূর্ব ভারতের অধিকাংশ জায়গায়ই করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরার মতো রাজ্যগুলোতে এদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা চলছিল, আর এখন একই ধরনের প্রচারণা ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশাতেও শুরু হয়েছে। তার মতে, এই প্রচারণার ফলে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দারা অন্যান্য রাজ্যে বিপদে পড়ছেন, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমানদেরও বাংলাদেশি ও অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, দিল্লির আশপাশের অঞ্চলগুলোতে এ ধরনের পরিস্থিতি বহুদিন ধরেই বিদ্যমান, এবং এখন ওড়িশাতেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী এ বিষয়টি আরও ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশিদের নিয়ে নেতারা যেসব কটূক্তি করেন, তা সাধারণত নির্বাচনী সময়ে ভোটারদের মেরুকরণের উদ্দেশ্যে করা হয়। এর মাধ্যমে নির্বাচনী সমর্থকদের মাঝে একটি বিভাজন তৈরি করার চেষ্টা করা হয়, বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ‘অপর পক্ষ’ হিসেবে চিহ্নিত করার মাধ্যমে।
এভাবে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মাধ্যমে মুসলিমবিরোধী মনোভাব ছড়িয়ে দিয়ে ভোটারদের একপাক্ষিক মনোভাব তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে।
নজিরবিহীন প্রতিবাদ ঢাকার
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বিতর্কিত মন্তব্যের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তীব্র আপত্তি, গভীর ক্ষোভ এবং চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। মন্ত্রণালয় স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে রাজনৈতিক নেতারা যেন এমন আপত্তিকর এবং অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। বিশেষ করে, প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে দায়িত্বশীল পদ থেকে এ ধরনের মন্তব্য দুই দেশের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়ার চেতনাকে নষ্ট করে।
এ ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে কূটনৈতিক স্তরে একটি নজিরবিহীন প্রতিবাদ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরীর মতে, এর আগে বিজেপি নেতা-নেত্রীরা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে কটূক্তি করলেও, বাংলাদেশ সরাসরি এভাবে প্রতিবাদ করেনি। তখনকার সরকার ভারতকে বন্ধু মনে করে এবং এ ধরনের মন্তব্য উপেক্ষা করার নীতি গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বর্তমানে দুই দেশের সম্পর্ক কিছুটা জটিল ও স্পর্শকাতর হওয়ায়, বাংলাদেশের এই পদক্ষেপ বিস্ময়কর নয়।
বসুরায়চৌধুরী মনে করেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়তো এ বার্তা দিতে চাইছে যে তারা ভারতের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে চায় এবং নিজস্ব অবস্থানকে মজবুত করতে প্রস্তুত। এর ফলে দুই দেশের সম্পর্কের ভিন্ন একটি মাত্রা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
অমিত শাহের বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা। তবে বিজেপির একাধিক মুখপাত্র এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এমন পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় অবস্থান শুধু ভারতের নেতাদের বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নয়, বরং বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করার ক্ষেত্রে এক নতুন রাজনৈতিক সংকল্পের প্রতিফলন বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
Please Share This Post in Your Social Media

বিজেপি নেতারা কেন বারবার বাংলাদেশিদের নিয়ে কটূক্তি করেন?

কখনও উইপোকা বলা, কখনও বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করার হুমকি, আবার কখনও উল্টো করে ঝুলিয়ে শায়েস্তা করার ভয় দেখানো—ভারতের বিজেপি নেতারা বাংলাদেশিদের নিয়ে প্রায়শই এ ধরনের মন্তব্য করে থাকেন। যদিও শেখ হাসিনা সরকার এসব কটূক্তির প্রতিবাদ সরাসরি জানায়নি, সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ বিষয়ে সরব হয়েছে।
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডে এক জনসভায় বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের উল্টো করে ঝুলিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন, যা নিয়ে কূটনৈতিক স্তরে প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা। এটি প্রথমবারের ঘটনা নয়; এর আগেও অমিত শাহ বাংলাদেশিদের নিয়ে কটূক্তি করেছেন। ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনি অন্তত দুবার বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের উইপোকা বলে উল্লেখ করেছেন এবং একবার বলেছিলেন, এদের বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়া উচিত।
এটা শুধু অমিত শাহর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বিজেপির অন্যান্য নেতারাও বাংলাদেশিদের নিয়ে একই ধরনের মন্তব্য করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আগে যেসব ‘কুকথা’ বলা হয়েছে, সেগুলো শুনেও শেখ হাসিনার সরকার জোরালোভাবে প্রতিবাদ করেনি। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তারা এধরনের মন্তব্য সহ্য করবে না। ঢাকায় ভারতীয় উপ-রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠিয়ে প্রতিবাদ জানানোর মাধ্যমে এটি স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এর মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের নেতাদের বাংলাদেশিদের প্রতি কটূক্তি নিয়ে তাদের কঠোর অবস্থান স্পষ্ট করেছে।
কী বলেছিলেন অমিত শাহ
ঝাড়খণ্ডের গিরিডিতে এক জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তার ভাষণে বেশ কয়েকবার রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন এবং ঝাড়খণ্ড থেকে তাদের উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা তুলে ধরেন।
প্রথমবার, অমিত শাহ বলেন, “ঝাড়খণ্ডে একবার সরকার বদল করুন। আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, ঝাড়খণ্ড থেকে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের খুঁজে খুঁজে বের করে ঝাড়খণ্ড থেকে তাড়ানোর কাজটি ভারতীয় জনতা পার্টি করবে। তারা আমাদের সভ্যতাকে ধ্বংস করছে এবং আমাদের সম্পত্তি দখল করছে।”
এরপর তিনি অভিযোগ তোলেন, “এরা আমাদের মেয়েদের ভুয়া বিবাহের মাধ্যমে প্রতারণা করছে এবং আমাদের চাকরি ও রোজগারপত্রও লুঠ করছে। ঝাড়খণ্ডে এই অনুপ্রবেশকারীদের কোনো জায়গা নেই। কেবলমাত্র বিজেপি সরকারই এদের সরাতে পারে।”
তৃতীয়বার, অমিত শাহ আরও বলেন, “যদি ঝাড়খণ্ডে এভাবে অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে, তাহলে আগামী ২৫-৩০ বছরের মধ্যে এখানকার অনুপ্রবেশকারীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠবে।”
ঝাড়খণ্ডের নারীদের ওপর ঘটে যাওয়া অত্যাচার ও হত্যার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এইসব ঘটনা যারা ঘটাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে রাজ্যের সরকার কিছু বলছে না, কারণ তারা এদের ভোটব্যাংক। এরা অনুপ্রবেশকারী।”
পরিশেষে, তিনি বিজেপির প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, “আমি আজ বলে যাচ্ছি, আপনারা এখানে পদ্মফুলের সরকার বানান, এইসব অনুপ্রবেশকারীদের উল্টো করে ঝুলিয়ে সোজা করার কাজটা আমরা করব।”
এই মন্তব্যগুলো ঝাড়খণ্ডের জনসভায় স্থানীয় ভোটারদের মনোভাবকে আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে করা হলেও, তার ভাষণ ভারতের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশ এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।
কেন বার বার বাংলাদেশিদের টার্গেট করা হয়?
হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিশেষজ্ঞ স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যের মতে, আগে হিন্দুত্ববাদী নেতা-নেত্রীরা যেভাবে পাকিস্তানকে লক্ষ্য করে কটূক্তি করতেন, এখন সেই একই ধরনের মন্তব্য বাংলাদেশিদের উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে। তার মতে, হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো সবসময়ই একটি ‘অপর পক্ষ’ দাঁড় করানোর চেষ্টা করে, এবং মুসলমানরাই তাদের কাছে সেই অপর পক্ষ। মুসলমানদের এরা বহিরাগত হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে। আগে তাদের কাছে প্রধান শত্রু ছিল পাকিস্তান, কিন্তু গত দশকে বাংলাদেশও তাদের টার্গেট হয়ে উঠেছে।
ভট্টাচার্য আরও বলেন, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ নিয়ে যে রাজনীতি চলছে, তা পূর্ব ভারতের অধিকাংশ জায়গায়ই করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরার মতো রাজ্যগুলোতে এদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা চলছিল, আর এখন একই ধরনের প্রচারণা ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশাতেও শুরু হয়েছে। তার মতে, এই প্রচারণার ফলে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দারা অন্যান্য রাজ্যে বিপদে পড়ছেন, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমানদেরও বাংলাদেশি ও অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, দিল্লির আশপাশের অঞ্চলগুলোতে এ ধরনের পরিস্থিতি বহুদিন ধরেই বিদ্যমান, এবং এখন ওড়িশাতেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী এ বিষয়টি আরও ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশিদের নিয়ে নেতারা যেসব কটূক্তি করেন, তা সাধারণত নির্বাচনী সময়ে ভোটারদের মেরুকরণের উদ্দেশ্যে করা হয়। এর মাধ্যমে নির্বাচনী সমর্থকদের মাঝে একটি বিভাজন তৈরি করার চেষ্টা করা হয়, বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ‘অপর পক্ষ’ হিসেবে চিহ্নিত করার মাধ্যমে।
এভাবে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মাধ্যমে মুসলিমবিরোধী মনোভাব ছড়িয়ে দিয়ে ভোটারদের একপাক্ষিক মনোভাব তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে।
নজিরবিহীন প্রতিবাদ ঢাকার
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বিতর্কিত মন্তব্যের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তীব্র আপত্তি, গভীর ক্ষোভ এবং চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। মন্ত্রণালয় স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে রাজনৈতিক নেতারা যেন এমন আপত্তিকর এবং অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। বিশেষ করে, প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে দায়িত্বশীল পদ থেকে এ ধরনের মন্তব্য দুই দেশের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়ার চেতনাকে নষ্ট করে।
এ ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে কূটনৈতিক স্তরে একটি নজিরবিহীন প্রতিবাদ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরীর মতে, এর আগে বিজেপি নেতা-নেত্রীরা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে কটূক্তি করলেও, বাংলাদেশ সরাসরি এভাবে প্রতিবাদ করেনি। তখনকার সরকার ভারতকে বন্ধু মনে করে এবং এ ধরনের মন্তব্য উপেক্ষা করার নীতি গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বর্তমানে দুই দেশের সম্পর্ক কিছুটা জটিল ও স্পর্শকাতর হওয়ায়, বাংলাদেশের এই পদক্ষেপ বিস্ময়কর নয়।
বসুরায়চৌধুরী মনে করেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়তো এ বার্তা দিতে চাইছে যে তারা ভারতের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে চায় এবং নিজস্ব অবস্থানকে মজবুত করতে প্রস্তুত। এর ফলে দুই দেশের সম্পর্কের ভিন্ন একটি মাত্রা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
অমিত শাহের বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা। তবে বিজেপির একাধিক মুখপাত্র এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এমন পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় অবস্থান শুধু ভারতের নেতাদের বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নয়, বরং বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করার ক্ষেত্রে এক নতুন রাজনৈতিক সংকল্পের প্রতিফলন বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
সূত্র: বিবিসি বাংলা