সময়: বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি প্রকাশ্যে এলেন: শিবিরের রাজনীতির নতুন দিগন্ত

ডিজিটাল ডেস্ক
  • Update Time : ১১:০০:৫৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • / ৯৫ Time View

শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি প্রকাশ্যে এলেন

শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি প্রকাশ্যে এলেন: শিবিরের রাজনীতির নতুন দিগন্ত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কমিটি রয়েছে এবং সেই কমিটির সভাপতি সাদিক কায়েম—এই তথ্য অবশেষে প্রকাশ্যে এসেছে। গতকাল শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণের পর গণমাধ্যমের সামনে নিজের পরিচয় প্রকাশ করেন সাদিক। এরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।

কিছু মানুষ সাদিকের সঙ্গে পরিচিত থাকলেও তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে অবগত না থাকার কারণে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। আবার কেউ কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের প্রকাশ্য রাজনীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ১৯৯০ সালে পরিবেশ পরিষদের মাধ্যমে শিবির ও জাতীয় পার্টির ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্রসমাজকে রাজনীতি করতে না দেওয়ার বিষয়ে একটি ঐক্যমত হয়েছিল, যা প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্রসংগঠনগুলোর মিথস্ক্রিয়ার একটি আনুষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্ম।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের পতন ঘটে। এই দীর্ঘ সময়কালে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করত এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরকে সেখানে কোনো কার্যক্রম চালাতে দিত না। শিবির সন্দেহে অনেক ছাত্রকে মারধর করা হয় এবং হল ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। তবে, গত জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে শনিবার অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভার প্রথম পর্বে অংশগ্রহণ করেন শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সাদিক কায়েম। এই পর্বে গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল ও বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন।

মতবিনিময় সভায় শিবিরের পক্ষ থেকে উপাচার্যের কাছে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ না করে এর সংস্কারের দাবি জানানো হয়। একইসঙ্গে অবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজনেরও আহ্বান জানানো হয়। সভা শেষে সাদিক গণমাধ্যমকে বলেন, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা কোনো প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্ত নয়। তাঁদের দাবি, সব ছাত্রসংগঠনকে নিয়ে সংলাপ আয়োজন করতে হবে, যেখানে ফ্যাসিবাদের দোসর ছাড়া সবাই অংশগ্রহণ করবে। শিবির মেধাভিত্তিক রাজনীতি চায় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘প্রত্যেকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে এবং কারও ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।’

সাদিক আরও বলেন, ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটভুক্ত ছাত্রসংগঠনগুলোকে তিনি ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে উল্লেখ করেন এবং তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই বলে মত দেন।

সাদিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। তিনি স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন এবং মাস্টারদা সূর্য সেন হলে ছিলেন। জানুয়ারিতে শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি হওয়ার আগে তিনি সূর্য সেন হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

শনিবারের মতবিনিময় সভায় সাদিক কায়েমের সঙ্গে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আরেক নেতা রেজাউল ইসলামও অংশগ্রহণ করেন। তবে, রেজাউলের সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সাদিক ও রেজাউল ছাড়া শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অন্য নেতাদের পরিচয় এখনো প্রকাশ হয়নি।

আজ রোববার দুপুরে সাদিক প্রথম আলোকে জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের কমিটি খুব শিগগিরই প্রকাশ করা হবে। তিনি আরও বলেন, “বিগত সাড়ে ১৫ বছর ফ্যাসিবাদী সরকার আমাদের আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিকস করতে বাধ্য করেছে,” যা গোপনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার ইঙ্গিত বহন করে।

সাদিক কায়েম গতকাল শনিবার একটি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালনের কথা জানান।

ছাত্রলীগ বিতাড়িত হওয়ার পর বর্তমানে শিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্ন ব্যানারে রাজনীতি করছে এবং হলগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে—এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সাদিক বলেন, “শিবিরের সমর্থকদের বেশিরভাগই হলের বাইরে থাকেন। কিছু নিয়মিত শিক্ষার্থী হলে থাকতে পারেন।” তিনি আরও যোগ করেন, “গোপনে শিবির সব নিয়ন্ত্রণ করছে, এটা ঠিক নয়।”ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শনিবারের সভাটি পরিবেশ পরিষদের ব্যানারে ডাকা হয়নি। শিবিরের দুজন নেতা সভাটিতে অংশ নেওয়ার পর এ নিয়ে উপাচার্যের সামনে প্রশ্ন তোলেন কয়েকটি বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের নেতারা।

ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ শনিবারের মতবিনিময় সভায় উপাচার্যকে উদ্দেশ করে প্রশ্ন করেন, “আপনি কীভাবে শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি তাকে খুঁজে পেলেন?” তবে, উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান এই প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি বলে মাঈন জানিয়েছেন।

এছাড়া, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টসহ (বাসদ) বেশ কয়েকটি বাম ছাত্রসংগঠনের নেতারাও সভায় শিবিরের অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

১৯৯০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদে জাতীয় ছাত্রসমাজ ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার সময় ঢাকার কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে বিএনপি নেতা খায়রুল কবির খোকন সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের অন্যতম নেতা ছিলেন। তিনি আজ সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, “স্বৈরাচারের সহযোগী হওয়ায় জাতীয় ছাত্রসমাজ এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে তখন সকল ছাত্রসংগঠনের মধ্যে ঐকমত্য ছিল।”

খায়রুল কবির আরও বলেন, “শিবির ও ছাত্রসমাজের বিষয়ে এখনকার ছাত্রসংগঠনগুলো কী আচরণ করবে, সে ব্যাপারে আমরা এখনকার ছাত্রসমাজের ওপরই আস্থা রাখতে চাই। আমরা দলীয় বা সাংগঠনিকভাবে এ বিষয়ে কিছু বলছি না।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও গুরুত্বপূর্ণ কলেজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সাড়ে তিন দশকে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল এবং বাম ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষ ঘটেছে। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, এবং এরপর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিচার শুরু হয়, যার মধ্যে কিছু নেতার মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর হয়

বিগত সাড়ে ১৫ বছরে বিএনপি ও জামায়াত বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলন করেছে। তবে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের পতনের পর বিএনপি জামায়াতের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে। গত ৩০ আগস্ট দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “জামায়াতের সঙ্গে আমাদের জোট অনেক আগেই অকার্যকর হয়ে গেছে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রভাব রয়েছে, এবং ছাত্রদলের সাংগঠনিক শক্তিও দৃঢ়। বাম ছাত্রসংগঠনগুলোও সক্রিয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অবস্থান হলো, তারা ক্যাম্পাসে কোনো রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের রাজনীতি চায় না।

শিবিরের প্রকাশ্য রাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের আপত্তি থাকলেও নেতারা এখনই এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি নন। ছাত্রদলের শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা, নাম প্রকাশ না করার শর্তে, প্রথম আলোকে বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে।” এরপর ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলো এবং অন্যান্য অংশীজন মিলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি প্রকাশ্যে এলেন: শিবিরের রাজনীতির নতুন দিগন্ত

Update Time : ১১:০০:৫৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি প্রকাশ্যে এলেন: শিবিরের রাজনীতির নতুন দিগন্ত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কমিটি রয়েছে এবং সেই কমিটির সভাপতি সাদিক কায়েম—এই তথ্য অবশেষে প্রকাশ্যে এসেছে। গতকাল শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণের পর গণমাধ্যমের সামনে নিজের পরিচয় প্রকাশ করেন সাদিক। এরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।

কিছু মানুষ সাদিকের সঙ্গে পরিচিত থাকলেও তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে অবগত না থাকার কারণে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। আবার কেউ কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের প্রকাশ্য রাজনীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ১৯৯০ সালে পরিবেশ পরিষদের মাধ্যমে শিবির ও জাতীয় পার্টির ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্রসমাজকে রাজনীতি করতে না দেওয়ার বিষয়ে একটি ঐক্যমত হয়েছিল, যা প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্রসংগঠনগুলোর মিথস্ক্রিয়ার একটি আনুষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্ম।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের পতন ঘটে। এই দীর্ঘ সময়কালে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করত এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরকে সেখানে কোনো কার্যক্রম চালাতে দিত না। শিবির সন্দেহে অনেক ছাত্রকে মারধর করা হয় এবং হল ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। তবে, গত জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে শনিবার অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভার প্রথম পর্বে অংশগ্রহণ করেন শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সাদিক কায়েম। এই পর্বে গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল ও বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন।

মতবিনিময় সভায় শিবিরের পক্ষ থেকে উপাচার্যের কাছে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ না করে এর সংস্কারের দাবি জানানো হয়। একইসঙ্গে অবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজনেরও আহ্বান জানানো হয়। সভা শেষে সাদিক গণমাধ্যমকে বলেন, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা কোনো প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্ত নয়। তাঁদের দাবি, সব ছাত্রসংগঠনকে নিয়ে সংলাপ আয়োজন করতে হবে, যেখানে ফ্যাসিবাদের দোসর ছাড়া সবাই অংশগ্রহণ করবে। শিবির মেধাভিত্তিক রাজনীতি চায় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘প্রত্যেকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে এবং কারও ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।’

সাদিক আরও বলেন, ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটভুক্ত ছাত্রসংগঠনগুলোকে তিনি ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে উল্লেখ করেন এবং তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই বলে মত দেন।

সাদিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। তিনি স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন এবং মাস্টারদা সূর্য সেন হলে ছিলেন। জানুয়ারিতে শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি হওয়ার আগে তিনি সূর্য সেন হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

শনিবারের মতবিনিময় সভায় সাদিক কায়েমের সঙ্গে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আরেক নেতা রেজাউল ইসলামও অংশগ্রহণ করেন। তবে, রেজাউলের সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সাদিক ও রেজাউল ছাড়া শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অন্য নেতাদের পরিচয় এখনো প্রকাশ হয়নি।

আজ রোববার দুপুরে সাদিক প্রথম আলোকে জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের কমিটি খুব শিগগিরই প্রকাশ করা হবে। তিনি আরও বলেন, “বিগত সাড়ে ১৫ বছর ফ্যাসিবাদী সরকার আমাদের আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিকস করতে বাধ্য করেছে,” যা গোপনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার ইঙ্গিত বহন করে।

সাদিক কায়েম গতকাল শনিবার একটি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালনের কথা জানান।

ছাত্রলীগ বিতাড়িত হওয়ার পর বর্তমানে শিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্ন ব্যানারে রাজনীতি করছে এবং হলগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে—এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সাদিক বলেন, “শিবিরের সমর্থকদের বেশিরভাগই হলের বাইরে থাকেন। কিছু নিয়মিত শিক্ষার্থী হলে থাকতে পারেন।” তিনি আরও যোগ করেন, “গোপনে শিবির সব নিয়ন্ত্রণ করছে, এটা ঠিক নয়।”ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শনিবারের সভাটি পরিবেশ পরিষদের ব্যানারে ডাকা হয়নি। শিবিরের দুজন নেতা সভাটিতে অংশ নেওয়ার পর এ নিয়ে উপাচার্যের সামনে প্রশ্ন তোলেন কয়েকটি বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের নেতারা।

ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ শনিবারের মতবিনিময় সভায় উপাচার্যকে উদ্দেশ করে প্রশ্ন করেন, “আপনি কীভাবে শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি তাকে খুঁজে পেলেন?” তবে, উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান এই প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি বলে মাঈন জানিয়েছেন।

এছাড়া, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টসহ (বাসদ) বেশ কয়েকটি বাম ছাত্রসংগঠনের নেতারাও সভায় শিবিরের অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

১৯৯০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদে জাতীয় ছাত্রসমাজ ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার সময় ঢাকার কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে বিএনপি নেতা খায়রুল কবির খোকন সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের অন্যতম নেতা ছিলেন। তিনি আজ সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, “স্বৈরাচারের সহযোগী হওয়ায় জাতীয় ছাত্রসমাজ এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে তখন সকল ছাত্রসংগঠনের মধ্যে ঐকমত্য ছিল।”

খায়রুল কবির আরও বলেন, “শিবির ও ছাত্রসমাজের বিষয়ে এখনকার ছাত্রসংগঠনগুলো কী আচরণ করবে, সে ব্যাপারে আমরা এখনকার ছাত্রসমাজের ওপরই আস্থা রাখতে চাই। আমরা দলীয় বা সাংগঠনিকভাবে এ বিষয়ে কিছু বলছি না।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও গুরুত্বপূর্ণ কলেজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সাড়ে তিন দশকে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল এবং বাম ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষ ঘটেছে। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, এবং এরপর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিচার শুরু হয়, যার মধ্যে কিছু নেতার মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর হয়

বিগত সাড়ে ১৫ বছরে বিএনপি ও জামায়াত বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলন করেছে। তবে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের পতনের পর বিএনপি জামায়াতের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে। গত ৩০ আগস্ট দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “জামায়াতের সঙ্গে আমাদের জোট অনেক আগেই অকার্যকর হয়ে গেছে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রভাব রয়েছে, এবং ছাত্রদলের সাংগঠনিক শক্তিও দৃঢ়। বাম ছাত্রসংগঠনগুলোও সক্রিয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অবস্থান হলো, তারা ক্যাম্পাসে কোনো রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের রাজনীতি চায় না।

শিবিরের প্রকাশ্য রাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের আপত্তি থাকলেও নেতারা এখনই এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি নন। ছাত্রদলের শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা, নাম প্রকাশ না করার শর্তে, প্রথম আলোকে বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে।” এরপর ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলো এবং অন্যান্য অংশীজন মিলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।