সময়: বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইরানের মাটিতে ইসরায়েলের যত ‘গোপন অপারেশন’

ডিজিটাল ডেস্ক
  • Update Time : ১১:১৭:৫৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • / ৭৮ Time View

IRAN ISRAIL 1

 

ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়ের হত্যার পরপরই অভিযোগের তীর ইসরায়েলের দিকে উঠেছিল। সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ইরানও ইসরায়েলকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। যদিও ইসরায়েলের পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি, দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ইসরায়েল সাম্প্রতিক সময়ে তার শত্রুদের ধ্বংস করে দেওয়ার মতো হামলা চালিয়েছে।

বিবিসির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক জেরেমি বোয়েনও হানিয়ের হত্যার পর বলেছিলেন, ইসরায়েলই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে ধরা যেতে পারে। তবে এই ঘটনা ইসরায়েলের গোপন কার্যক্রমের প্রথম উদাহরণ নয়। এর আগেও বহুবার প্রমাণ হয়েছে যে, ইরানের অভ্যন্তরে মোসাদ কীভাবে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। বিগত কয়েক বছরের ঘটনা বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, ইরানে উচ্চ পর্যায়ে কর্মরত ব্যক্তিদেরও তারা নির্দিষ্ট অপারেশনের জন্য ব্যবহার করে আসছে।

ইসরায়েলের এসব গোপন অপারেশনের মধ্যে যেমন খুনের ঘটনা রয়েছে, তেমনি রয়েছে সাইবার আক্রমণ ও ড্রোন হামলাও। এসব হামলার অনেকগুলোতেই একটা মিল পাওয়া যায়, তা হলো—ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সাথে সংযোগ। ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে যে, তেহরান গোপনে পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে, যা তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। যদিও ইরান সামরিক পরমাণু কর্মসূচির কথা অস্বীকার করে, তারা বলে যে বেসামরিক পরমাণু শক্তির উন্নয়নের অধিকার তাদের রয়েছে।

ইসমাইল হানিয়ে – ফাইল ছবি

 

ইরানে গত প্রায় দেড় দশকে মোসাদের কার্যকলাপের বেশ কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইরানের দাবি, তাদের বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী ও সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যার পেছনে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হাত ছিল। এ ধরনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো:

 ১. অধ্যাপক মাসুদ আলি-মোহাম্মদীর হত্যা (জানুয়ারি ২০১০)

তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক মাসুদ আলি-মোহাম্মদী ২০১০ সালের জানুয়ারিতে একটি রিমোট-নিয়ন্ত্রিত বোমার আঘাতে নিহত হন। তেহরানের বাড়ির কাছে তার মোটরসাইকেলে বোমাটি রাখা ছিল। প্রাথমিকভাবে ইরানের সংবাদমাধ্যমে বলা হয় তিনি একজন পারমাণবিক বিজ্ঞানী এবং সরকারের সমর্থক ছিলেন, তবে পরবর্তী প্রতিবেদনে বলা হয় তিনি ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। ইরান অভিযোগ করেছিল, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল।

 ২. মাজিদ শাহরিয়ারির হত্যা (নভেম্বর ২০১০)

২০১০ সালের নভেম্বরে তেহরানের শহীদ বেহেস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পারমাণবিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মাজিদ শাহরিয়ারি গাড়ি বিস্ফোরণে নিহত হন। তার স্ত্রীও এ ঘটনায় আহত হন। ইরান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলকে এ হামলার জন্য দায়ী করে।

 ৩. মোহসেন ফাখরিজাদেহর হত্যা (নভেম্বর ২০২০)

২০২০ সালের নভেম্বরে ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহ তেহরানের বাইরে একটি গাড়িতে চেপে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। পশ্চিমা দেশগুলো এবং ইসরায়েলের গোয়েন্দারা দীর্ঘদিন ধরে মনে করতেন যে ফাখরিজাদেহ ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। ইরানের অভিযোগ অনুযায়ী, এই হত্যাকাণ্ডে রিমোট কন্ট্রোল অস্ত্র ব্যবহার করে মোসাদ ফাখরিজাদেহকে হত্যা করে।

ইরান এ ধরনের একাধিক হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে আসছে, যদিও নিরপেক্ষভাবে এসব দাবি যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

মোসাদ ইরানে বিভিন্ন ধরণের হামলা ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বারবার ইরানের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে এই কর্মকাণ্ডগুলোতে ইসরায়েলের সাইবার হামলা এবং গুপ্ত হত্যা উভয়ই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তুলে ধরা হলো:

 ১. কর্নেল হাসান সায়াদ খোদাইর হত্যা (মে ২০২২)

ইরানের ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) কর্নেল হাসান সায়াদ খোদাইকে তেহরানে তার বাড়ির বাইরে পাঁচবার গুলি করে হত্যা করা হয়। ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্য মাজিদ মিরাহমাদি এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেন। খোদাই আইআরজিসি-র কুদস ফোর্সের সদস্য ছিলেন এবং প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি এ ঘটনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের দায়ী করেন, এটিকে ‘বৈশ্বিক ঔদ্ধত্য’ বলে আখ্যায়িত করেন

 ২. স্টাক্সনেট ভাইরাস আক্রমণ (জুন ২০১০)

২০১০ সালে ইরানের বুশেহর পারমাণবিক কেন্দ্রের কম্পিউটারে স্টাক্সনেট নামক একটি ভাইরাস পাওয়া যায়, যা পারমাণবিক প্রকল্পের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। স্টাক্সনেট একটি জটিল ভাইরাস যা শিল্প কারখানার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের ভাইরাস শুধু কোনো ‘জাতিরাষ্ট্র’ বানাতে পারে, এবং অনেকেই মনে করেন এটি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ কার্যক্রমের ফলাফল ছিল

 ৩. ফ্লেম ভাইরাস আক্রমণ (মে ২০১২)

২০১২ সালে ইরান দাবি করে যে ফ্লেম নামক একটি জটিল ভাইরাস ব্যবহার করে তাদের সরকারি কম্পিউটার থেকে তথ্য চুরি করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। সাইবার-নিরাপত্তা সংস্থা ক্যাস্পারেস্কি এটিকে তখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সব থেকে জটিল ভাইরাস হিসেবে অভিহিত করে। যদিও ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি, ইরান এই সাইবার হামলার জন্য ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকেই দায়ী করে।

 ৪. পেট্রোল স্টেশন সাইবার হামলা (অক্টোবর ২০২১)

ইরানের ৪,৩০০টি পেট্রোল স্টেশন সাইবার হামলার শিকার হয়, যেখানে ভর্তুকিযুক্ত কার্ডের মাধ্যমে নাগরিকরা পেট্রোল কিনতে পারতেন। এই হামলার ফলে দীর্ঘ সময় ধরে স্টেশনগুলো বন্ধ ছিল, এবং গ্রাহকদের স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দামে পেট্রোল কিনতে হয়। ইরান এই ঘটনার জন্য ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে।

 ৫. শহীদ রাজাই বন্দরে সাইবার হামলা (মে ২০২০)

২০২০ সালের মে মাসে ইরানের দক্ষিণ উপকূলে শহীদ রাজাই বন্দরে সাইবার হামলা হয়, যার ফলে সামুদ্রিক জাহাজ চলাচল ব্যাহত হয়। ইরান অভিযোগ করে, এই সাইবার হামলার পেছনে ইসরায়েলের হাত ছিল। ওয়াশিংটন পোস্টও এই খবরটি নিশ্চিত করে, যদিও ইসরায়েল এই হামলার দায় অস্বীকার করেছে।

ইরানের বিরুদ্ধে মোসাদের এসব সাইবার ও গুপ্ত হত্যার কার্যক্রম ইরান-ইসরায়েল সম্পর্ককে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে, এবং এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতেও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি করতে পারে।

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ছায়াযুদ্ধের অংশ হিসেবে ড্রোন হামলা ও গুপ্ত অভিযানগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এবং অন্যান্য সামরিক বাহিনী ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ও সামরিক স্থাপনায় নিয়মিতভাবে ড্রোন হামলা, গুপ্ত অভিযান ও সাইবার আক্রমণ চালিয়েছে। এখানে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা তুলে ধরা হলো:

 ১. গোপন পারমাণবিক তথ্য চুরি (জানুয়ারি ২০১৮)

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মোসাদ এজেন্টরা তেহরানের একটি সুরক্ষিত স্থাপনায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ গোপন পারমাণবিক তথ্য চুরি করে। এরপর ২০১৮ সালের এপ্রিলে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দেন যে তারা এক লক্ষ গোপন ফাইল উদ্ধার করেছেন, যা প্রমাণ করে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই অভিযান ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের গোয়েন্দা কার্যক্রমের একটি বৃহৎ সাফল্য হিসেবে দেখা হয়।

 ২. সিনিয়র কমান্ডারের ড্রোন হামলায় হত্যা (ফেব্রুয়ারি ২০২২)

ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট ২০২৩ সালে স্বীকার করেন যে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইসরায়েল একটি ড্রোন হামলা চালিয়ে ইরানের ইসলামিক রেভলিউশানারি গার্ড কোরের একজন সিনিয়র কমান্ডারকে হত্যা করেছে। এই হামলার বিস্তারিত আলোকপাত না করা হলেও, এটি ইরানের সামরিক কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে পরিচালিত হামলার ধারাবাহিকতার অংশ ছিল।

 ৩. পারচিন সামরিক কমপ্লেক্সে ড্রোন হামলা (মে ২০২২)

২০২২ সালের মে মাসে তেহরানের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত পারচিন সামরিক কমপ্লেক্সে একটি বিস্ফোরক বোঝাই ড্রোন হামলা চালানো হয়। এতে এক প্রকৌশলী নিহত হন এবং ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি ড্রোন তৈরির স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই হামলাটি ইরানের সামরিক সক্ষমতাকে লক্ষ্য করে পরিচালিত একটি বড় আঘাত ছিল বলে মনে করা হয়।

 ৪. সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে হামলা (এপ্রিল ২০২৪)

ইরানে দেড় দশকে অনেকবার সাইবার হামলা হয়েছে, যার অনেকগুলির জন্যই অভিযোগ ওঠে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে – প্রতীকী ছবি

 

২০২৪ সালের এপ্রিলে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে ইসরায়েলি হামলায় সাতজন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন ইরানের কুদস ফোর্সের সিনিয়র কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদী এবং তার ডেপুটি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ হাদি হাজি-রাহিমি। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরান শয়ে শয়ে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইসরায়েলের ওপর হামলা চালায়, যা ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান ছায়াযুদ্ধের সরাসরি সংঘর্ষে রূপ নেয়।

এই ঘটনাগুলোর মাধ্যমে দেখা যায়, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান ছায়াযুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ড্রোন হামলা, গুপ্ত অভিযান এবং পারমাণবিক কর্মসূচি। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে এই ধরণের সংঘর্ষ ভবিষ্যতেও এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক ভারসাম্যকে প্রভাবিত করবে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

 

 

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

ইরানের মাটিতে ইসরায়েলের যত ‘গোপন অপারেশন’

Update Time : ১১:১৭:৫৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

 

ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়ের হত্যার পরপরই অভিযোগের তীর ইসরায়েলের দিকে উঠেছিল। সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ইরানও ইসরায়েলকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। যদিও ইসরায়েলের পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি, দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ইসরায়েল সাম্প্রতিক সময়ে তার শত্রুদের ধ্বংস করে দেওয়ার মতো হামলা চালিয়েছে।

বিবিসির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক জেরেমি বোয়েনও হানিয়ের হত্যার পর বলেছিলেন, ইসরায়েলই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে ধরা যেতে পারে। তবে এই ঘটনা ইসরায়েলের গোপন কার্যক্রমের প্রথম উদাহরণ নয়। এর আগেও বহুবার প্রমাণ হয়েছে যে, ইরানের অভ্যন্তরে মোসাদ কীভাবে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। বিগত কয়েক বছরের ঘটনা বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, ইরানে উচ্চ পর্যায়ে কর্মরত ব্যক্তিদেরও তারা নির্দিষ্ট অপারেশনের জন্য ব্যবহার করে আসছে।

ইসরায়েলের এসব গোপন অপারেশনের মধ্যে যেমন খুনের ঘটনা রয়েছে, তেমনি রয়েছে সাইবার আক্রমণ ও ড্রোন হামলাও। এসব হামলার অনেকগুলোতেই একটা মিল পাওয়া যায়, তা হলো—ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সাথে সংযোগ। ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে যে, তেহরান গোপনে পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে, যা তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। যদিও ইরান সামরিক পরমাণু কর্মসূচির কথা অস্বীকার করে, তারা বলে যে বেসামরিক পরমাণু শক্তির উন্নয়নের অধিকার তাদের রয়েছে।

ইসমাইল হানিয়ে – ফাইল ছবি

 

ইরানে গত প্রায় দেড় দশকে মোসাদের কার্যকলাপের বেশ কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইরানের দাবি, তাদের বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী ও সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যার পেছনে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হাত ছিল। এ ধরনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো:

 ১. অধ্যাপক মাসুদ আলি-মোহাম্মদীর হত্যা (জানুয়ারি ২০১০)

তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক মাসুদ আলি-মোহাম্মদী ২০১০ সালের জানুয়ারিতে একটি রিমোট-নিয়ন্ত্রিত বোমার আঘাতে নিহত হন। তেহরানের বাড়ির কাছে তার মোটরসাইকেলে বোমাটি রাখা ছিল। প্রাথমিকভাবে ইরানের সংবাদমাধ্যমে বলা হয় তিনি একজন পারমাণবিক বিজ্ঞানী এবং সরকারের সমর্থক ছিলেন, তবে পরবর্তী প্রতিবেদনে বলা হয় তিনি ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। ইরান অভিযোগ করেছিল, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল।

 ২. মাজিদ শাহরিয়ারির হত্যা (নভেম্বর ২০১০)

২০১০ সালের নভেম্বরে তেহরানের শহীদ বেহেস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পারমাণবিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মাজিদ শাহরিয়ারি গাড়ি বিস্ফোরণে নিহত হন। তার স্ত্রীও এ ঘটনায় আহত হন। ইরান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলকে এ হামলার জন্য দায়ী করে।

 ৩. মোহসেন ফাখরিজাদেহর হত্যা (নভেম্বর ২০২০)

২০২০ সালের নভেম্বরে ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহ তেহরানের বাইরে একটি গাড়িতে চেপে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। পশ্চিমা দেশগুলো এবং ইসরায়েলের গোয়েন্দারা দীর্ঘদিন ধরে মনে করতেন যে ফাখরিজাদেহ ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। ইরানের অভিযোগ অনুযায়ী, এই হত্যাকাণ্ডে রিমোট কন্ট্রোল অস্ত্র ব্যবহার করে মোসাদ ফাখরিজাদেহকে হত্যা করে।

ইরান এ ধরনের একাধিক হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে আসছে, যদিও নিরপেক্ষভাবে এসব দাবি যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

মোসাদ ইরানে বিভিন্ন ধরণের হামলা ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বারবার ইরানের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে এই কর্মকাণ্ডগুলোতে ইসরায়েলের সাইবার হামলা এবং গুপ্ত হত্যা উভয়ই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তুলে ধরা হলো:

 ১. কর্নেল হাসান সায়াদ খোদাইর হত্যা (মে ২০২২)

ইরানের ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) কর্নেল হাসান সায়াদ খোদাইকে তেহরানে তার বাড়ির বাইরে পাঁচবার গুলি করে হত্যা করা হয়। ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্য মাজিদ মিরাহমাদি এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেন। খোদাই আইআরজিসি-র কুদস ফোর্সের সদস্য ছিলেন এবং প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি এ ঘটনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের দায়ী করেন, এটিকে ‘বৈশ্বিক ঔদ্ধত্য’ বলে আখ্যায়িত করেন

 ২. স্টাক্সনেট ভাইরাস আক্রমণ (জুন ২০১০)

২০১০ সালে ইরানের বুশেহর পারমাণবিক কেন্দ্রের কম্পিউটারে স্টাক্সনেট নামক একটি ভাইরাস পাওয়া যায়, যা পারমাণবিক প্রকল্পের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। স্টাক্সনেট একটি জটিল ভাইরাস যা শিল্প কারখানার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের ভাইরাস শুধু কোনো ‘জাতিরাষ্ট্র’ বানাতে পারে, এবং অনেকেই মনে করেন এটি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ কার্যক্রমের ফলাফল ছিল

 ৩. ফ্লেম ভাইরাস আক্রমণ (মে ২০১২)

২০১২ সালে ইরান দাবি করে যে ফ্লেম নামক একটি জটিল ভাইরাস ব্যবহার করে তাদের সরকারি কম্পিউটার থেকে তথ্য চুরি করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। সাইবার-নিরাপত্তা সংস্থা ক্যাস্পারেস্কি এটিকে তখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সব থেকে জটিল ভাইরাস হিসেবে অভিহিত করে। যদিও ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি, ইরান এই সাইবার হামলার জন্য ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকেই দায়ী করে।

 ৪. পেট্রোল স্টেশন সাইবার হামলা (অক্টোবর ২০২১)

ইরানের ৪,৩০০টি পেট্রোল স্টেশন সাইবার হামলার শিকার হয়, যেখানে ভর্তুকিযুক্ত কার্ডের মাধ্যমে নাগরিকরা পেট্রোল কিনতে পারতেন। এই হামলার ফলে দীর্ঘ সময় ধরে স্টেশনগুলো বন্ধ ছিল, এবং গ্রাহকদের স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দামে পেট্রোল কিনতে হয়। ইরান এই ঘটনার জন্য ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে।

 ৫. শহীদ রাজাই বন্দরে সাইবার হামলা (মে ২০২০)

২০২০ সালের মে মাসে ইরানের দক্ষিণ উপকূলে শহীদ রাজাই বন্দরে সাইবার হামলা হয়, যার ফলে সামুদ্রিক জাহাজ চলাচল ব্যাহত হয়। ইরান অভিযোগ করে, এই সাইবার হামলার পেছনে ইসরায়েলের হাত ছিল। ওয়াশিংটন পোস্টও এই খবরটি নিশ্চিত করে, যদিও ইসরায়েল এই হামলার দায় অস্বীকার করেছে।

ইরানের বিরুদ্ধে মোসাদের এসব সাইবার ও গুপ্ত হত্যার কার্যক্রম ইরান-ইসরায়েল সম্পর্ককে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে, এবং এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতেও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি করতে পারে।

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ছায়াযুদ্ধের অংশ হিসেবে ড্রোন হামলা ও গুপ্ত অভিযানগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এবং অন্যান্য সামরিক বাহিনী ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ও সামরিক স্থাপনায় নিয়মিতভাবে ড্রোন হামলা, গুপ্ত অভিযান ও সাইবার আক্রমণ চালিয়েছে। এখানে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা তুলে ধরা হলো:

 ১. গোপন পারমাণবিক তথ্য চুরি (জানুয়ারি ২০১৮)

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মোসাদ এজেন্টরা তেহরানের একটি সুরক্ষিত স্থাপনায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ গোপন পারমাণবিক তথ্য চুরি করে। এরপর ২০১৮ সালের এপ্রিলে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দেন যে তারা এক লক্ষ গোপন ফাইল উদ্ধার করেছেন, যা প্রমাণ করে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই অভিযান ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের গোয়েন্দা কার্যক্রমের একটি বৃহৎ সাফল্য হিসেবে দেখা হয়।

 ২. সিনিয়র কমান্ডারের ড্রোন হামলায় হত্যা (ফেব্রুয়ারি ২০২২)

ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট ২০২৩ সালে স্বীকার করেন যে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইসরায়েল একটি ড্রোন হামলা চালিয়ে ইরানের ইসলামিক রেভলিউশানারি গার্ড কোরের একজন সিনিয়র কমান্ডারকে হত্যা করেছে। এই হামলার বিস্তারিত আলোকপাত না করা হলেও, এটি ইরানের সামরিক কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে পরিচালিত হামলার ধারাবাহিকতার অংশ ছিল।

 ৩. পারচিন সামরিক কমপ্লেক্সে ড্রোন হামলা (মে ২০২২)

২০২২ সালের মে মাসে তেহরানের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত পারচিন সামরিক কমপ্লেক্সে একটি বিস্ফোরক বোঝাই ড্রোন হামলা চালানো হয়। এতে এক প্রকৌশলী নিহত হন এবং ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি ড্রোন তৈরির স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই হামলাটি ইরানের সামরিক সক্ষমতাকে লক্ষ্য করে পরিচালিত একটি বড় আঘাত ছিল বলে মনে করা হয়।

 ৪. সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে হামলা (এপ্রিল ২০২৪)

ইরানে দেড় দশকে অনেকবার সাইবার হামলা হয়েছে, যার অনেকগুলির জন্যই অভিযোগ ওঠে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে – প্রতীকী ছবি

 

২০২৪ সালের এপ্রিলে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে ইসরায়েলি হামলায় সাতজন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন ইরানের কুদস ফোর্সের সিনিয়র কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদী এবং তার ডেপুটি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ হাদি হাজি-রাহিমি। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরান শয়ে শয়ে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইসরায়েলের ওপর হামলা চালায়, যা ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান ছায়াযুদ্ধের সরাসরি সংঘর্ষে রূপ নেয়।

এই ঘটনাগুলোর মাধ্যমে দেখা যায়, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান ছায়াযুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ড্রোন হামলা, গুপ্ত অভিযান এবং পারমাণবিক কর্মসূচি। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে এই ধরণের সংঘর্ষ ভবিষ্যতেও এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক ভারসাম্যকে প্রভাবিত করবে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা